আমাদের আশে পাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা অন্যের ব্যাপারে মতামত, উপদেশ দিতে খুব ভালোবাসেন। তারা হয়ত সব সময় যে নাক গলাতে আসেন, তা না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভালো করতে চেয়ে এগিয়ে আসেন তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলির ওপর নির্ভর করে কিছু মন্তব্য করতে। সকলে একইভাবে ব্যাপারটা নেন না। সেরকমই একজনের কথা লিখছি।
********************************************************************************
নিবারণ কাকা
আমাদের পাড়ার নিবারণ কাকা। সবার সব ব্যাপারে তার মন্তব্য করা চাইই চাই। নতুন ফ্ল্যাট কিনে কে সত্যনারায়ণ পুজোয় শ্যামল জেঠুদের ডাকল আর তার ভাই বিমল জেঠুদের ডাকল না, অনিমেষ কর্নেলে যাবে না কারনিগি (কি? কি বললেন? কোন নিধি?) মেলন (সেটার যে আদৌ তরমুজের সাথে কোনভাবেই মিল নেই, অবশ্য করেই সেই বিষয়ে না জেনে), রাখী কেন করন অর্জুনের মায়ের পার্ট করবে, মিনতির মা কেন পাঁচতলার ঘোষেদের বাড়ি জামাকাপড় কাচতে পাঁচশ আর বি ব্লকের সান্যালদের থেকে সাড়ে পাঁচশ নেবে, পুজোর চাঁদা কেন প্রতি বছর বাড়বে সমস্ত বিষয়ে ওনার মহামূল্যবান মতামতের ছড়াছড়ি, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে বেশীরভাগ সময়েই নিবারণ কাকার বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত ওনার কথার কোন পাত্তা দেন না। রমা কাকীমা তো উঠতে বসতে কাকাকে খোঁটা দিয়েই চলেন।
নিজের বাড়ির লোকের তো মাথা খাচ্ছই, আবার পাড়া প্রতিবেশীর জীবন অতিষ্ঠ না করলেই নয়?
কেন কেন? আমি কার কোন পাকা ধানে মই দিলাম শুনি?
পাকা ধানে মই দাওনি তো কি করেছ? ছবিদির নাতনির স্কুলের ভর্তি নিয়ে তোমাকে কে মন্তব্য করতে বলেছিল হ্যাঁ?
ওমা ওইটুকু মেয়েকে এখন থেকেই কিসের জন্য বইয়ের বস্তা পিঠে করে স্কুলে পাঠাবে, সেটা গুরুজন হিসেবে আমার বলার কি কোন দায়িত্ব নেই?
তা ওরা তোমার কথা শুনল তো?
সে ওরা আমার উপদেশ কানে দেয়নি, এতে ওদের মেয়েরই দুদিন বাদে ঘাড়ে পিঠে ব্যাথা হবে যখন, বুঝবে।
কেন কেন করতে যাও? নতুন বৌ এসে মিষ্টি করে দুপুরবেলা চারটি কথা শুনিয়ে গেল।
কি বলেছে সে?
কি না বলেছে? আমায় ঠারেঠোরে জিজ্ঞেস করল তুমি কোন ক্লাস পাস, আমাদের ছেলে মেয়েরা কে কতদূর পড়বে।
কি? এত বড় স্পর্ধা? ওর শ্বশুর আমায় ছোট ভাইয়ের চোখে দেখে বলে না আমি নাতনির ভালো মন্দ নিয়ে কথা বলতে গেছিলাম! আমার বিদ্যে নিয়ে প্রশ্ন তোলে? জানিয়ে দেবে ওকে সামনের বারে যে আমি কালীকৃষ্ণ স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলাম মাধ্যমিকে, হুহ। ও মেয়ে কিনা শহরের ইংরেজি স্কুলের ভারী আমার কি না কি লেখাপড়ায়, সে আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনিয়ে যাচ্ছে! দাঁড়াও, আমি আজই দাদাকে বলব। সনৎ কত ভদ্র ছেলে। এই নতুন বৌ এসে মাথা খেয়েছে ছেলেটার। দাদাকে বলব, সুনীতি মায়ের জন্য যেন দেখে শুনে বিয়ে দায়ে; এরকম শহুরে ধিঙ্গি ছেলেপিলে জোটালে মুশকিল।
তুমি আর কোনদিনও শুধরোবে না, নাকি! এত কিছু হল, তাও তুমি ওদের বাড়ি গিয়ে আবার বিয়ের কথা তুলবে?
কাকিমা, ও কাকিমা।
কে রে? ও নিতু? আয় আয়। এক্ষুনি তোর কাকা আর আমি তোকে নিয়ে কথা বলছিলাম।
অ। তা কি কথা কইছিলে শুনি?
ওই তোর বিয়ে নিয়ে।
ওমা, মা তোমাদের বলে দিয়েছে? আমি যে বললুম আমিই এসে নিজের মুখে তোমাদের জানাব। মায়ের পেটে না কোন কথাই থাকেনা দেখছি। ধুর।
কি? ছবি দি তো কিছু বলেনি? কি বলবে?
তাও ভালো। দাঁড়াও আগে এক খান পেন্নাম ঠুকে নিই।
দেখো দেখো রমা, নিতুর মত মেয়ে হয় না।
আসলে নতুন জীবনে পা দিতে চলেছি, তাই তোমাদের আশীর্বাদ নিতে এলাম।
কোথায় চললি? ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেলি? যেটার ফর্মের খবর তোকে এনে দিয়েছিলাম...
না না নিবারণ কাকা। আমার মাথায় অত বুদ্ধি নেই। তোমায় তো তখনি বলেছিলাম, ওসব আমার দ্বারা হবেনা। আমি বিয়ে করেছি। আজ রেজিস্ট্রি করে এলাম। আসলে সুবলকে বাবা মা মেনে নিচ্ছিল না, তাই বাধ্য হলাম। বারবার বলা সত্ত্বেও বাবা একের পর এক সম্বন্ধ আনছিল। আমি আর নিতে না পেরে আজ রেজিস্ট্রিটা সেরেই ফেললাম। বাবার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। মা মিনমিন করছে। কাকা তুমিই পারবে বাবাকে বোঝাতে, প্লীজ বল।
হে ভগবান, আর আমি কিনা দাদার কাছে তোর জন্য ভালো পাত্রের সন্ধান দিতে যাচ্ছিলাম, আর তুই কিনা বিয়ে করে ফেললি। উফ। দুনিয়ায় কেউ যদি আমার কথার ওপর ভরসা রাখত। রাধা মাধব রাধা মাধব।
ও রমা। মিঠু বাড়ি আসবে কখন? ওকে আজ একটু বোঝাতে হবে। ও যেন আমার মান সম্মান না ডোবায়।
হম, দিনকাল ভালো না। কত নানানলোকের সাথে মেলামেশা করে, কার থেকে কি শিখছে জানছে কে জানে। আমার বড় ভয় করে।
হ্যাঁ। ওকে বলব। রাইসে ভর্তি করে দেবো, মন দিয়ে সরকারী চাকরির পরীক্ষা দিক। ওসব ফ্যাশন ডিজাইনিং না কি ছাই পাঁশ পড়তে চায়, সেসব চলবে না।
উফ। তুমি কি ঠেকেও শেখোনা? মেয়ে বড় হয়েছে। নিজের ভালো মন্দ নিজেই বুঝবে। ওর কেরিয়ার নিয়ে মতামত দিতে যেও না। বাবা হিসেবে যেটুকু কর্তব্য, সেই টুকু করো। আর হ্যাঁ, পাড়াপড়শি কেউ আজকাল অন্যের কথা শোনেনা; মেয়ে নিজের বাপ মার কথা শুনছে না, নাকি দুনিয়ার লোক তোমার কথা শুনবে। একটু বোঝার চেষ্টা করো।
সেই রাত্রে নিবারণ কাকাকে বাস স্ট্যান্ডের কাছে অনেক রাত অবধি চুপচাপ দুখী মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, এই প্রথম কারুর সাথে একটি কথাও না বলে বাড়ী ফিরেছিলেন।
******************************************************************************
No comments:
Post a Comment