Wednesday, December 20, 2017

বছর শেষের হিসেব নিকেশ

ওরে বাবা, ভাবতেই পারছিনা, এই সেই টুংটাং করে ফোনে মেসেজ ঢুকছিল এত হ্যাপি ন্যু ইয়ার বলে, তারপরে ৩৫৪ দিন শেষ? কী কাণ্ড, এত তাড়াতাড়ি শেষ হল কি করে এই একটা আস্ত বছর, কে জানে বাবা। কত কিছু করব বলে গত বছর এমন সময়ে লম্বা লিস্ট করলাম, তার তো বোধহয় সিকিভাগও পুরণ হয়নি। এখনো রোগা হওয়াটা বাকি। ওজন কমা তো দূর অস্ত, উল্টে কিলো পাঁচেক অন্তত বেড়েছে। (এবার সেটা বুদ্ধি না ফ্যাট, টু বি ভেরি স্পেসিফিক, বার বার কিলো কিলো চকোলেট, সেটা নিয়ে আমার এখনো সন্দেহ আছে যথেষ্ট পরিমাণে।) এখনো একটা পাব্লিকেশন হলো না ফার্স্ট অথরে। (শুনুন, পি এইচ ডি স্টুডেন্ট, তায় ফিফথ ইয়ার চলছে, এই সময়ে এইসব ভাবনা আপনা আপনি না চাইতেই মাথায় আসে।) ম্যানুয়াল মোডে ডি এস এল আর চালানো শিখলাম না (এদিকে যতক্ষণ না কিনছিলাম, ততক্ষণ নিজেকে রঘু রাইয়ের মাস্টার ভাবছিলাম। কিছু কিছু লোককে কচুপোড়া দেখিয়ে একটা পৈশাচিক হাসি হাসতে পারলাম না (ওটা আমার হেব্বি সখ, কী করব)। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স যেমন ছিল, বাড়ে তো নি, বরং আরো কমেছে (গরীব রিসার্চ স্কলার। আমাদের ওইসব পে কমিশন হ্যান কমিশন কিচ্ছু হয় না)। বছর শেষ হচ্ছে ভাবতে বসেই যদি এতগুলো হা পিত্যেশ মাথায়া সে প্রথমে, না জানি ব্যালেন্স শিট বানাতে বসলে কি দাঁড়াবে। না মানে জানি, না পাওয়াগুলো অনেক অনেক বেশী হবে সংখ্যায়। চেষ্টা করি মাস ধরে ধরে একটু হিসেব নিকেশ করার (আমি আদপে একটুও হিসেবী না হলেও...)।

গত বছর শেষ করেছিলাম হাতে ভালো মতো চোট পেয়ে। তাই নতুন বছরকে স্বাগত করি হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে! বেশ বিরক্ত লাগত, হুটহাট লেগে যেত হাতে, ব্যথা পেতাম। তারই মধ্যে পুণা গেলাম কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করতে। আই আই টি তে আসার পর আমার স্বভাবের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। যে আমি কি না এক সপ্তাহ বাকি থাকতে সব পেন্ডিং কাজ সেরে ফেলতাম এক কালে, সেই আমিই কি না আজকাল সব ইলেভেন্থ আওয়ার অবধি মিনিমাম ফেলে রাখি। তা হয়েছে কি, পোস্টার প্রিন্ট করতে গিয়ে যারপরনাই বিচ্ছিরি অবস্থায় পড়েছিলাম। একদম হিসেবের বাইরে ছিল যে তামিল নাড়ুতে পোঙ্গাল রীতিমতো বিরাট উৎসব যখন দোকান পাট সব বন্ধ থাকে।  লাস্ট মোমেন্টে কোনমতে সুপারভাইসারের সাথে কম কারেকশনের রফা করে যা হোক করে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে, আর ছাপানোর সময় পাবো না, ইত্যাদি ইত্যাদি করে কোনমতে তো পোস্টার সহ গেলাম পুণাতে। তা কনফারেন্সে আগেই বলে রেখেছিল যে ওরাল টকের জন্যও প্রস্তুত হয়ে আসতে, বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তেও পারে। আমি কে আমি, এত কনফিডেন্স নিজের ওপর, ধরেই নিলাম। এই তো ভারী কাজ করেছি, নেহাত সরকারি টাকায় দেশভ্রমণ হবে, তাই যাচ্ছি। আমি তো জেতার ধারেকাছেও থাকবনা। তার উপর আবার এরকম জঘন্য ভাবে শেষ মুহূর্তে বানানো পোস্টার। তাই কোনরকম  প্রস্তুতি না নিয়েই এমনিই গিয়েছিলাম। কেলোটা করল কনফারেন্সের তৃতীয় দিন। দুইদিন পোস্টারের পর তারা রেজাল্টে হঠাৎ করেই আমার নাম ঘোষণা করে দিলেন, নাকি টক দিতে হবে। খুব নার্ভাস হয়ে গিয়ে সেই টক তো দিলামও। আবার ভগবান জানেন কি করে, সেখানে আবার প্রথম পুরস্কারও পেয়ে গেলাম। আমার সুপারভাইজার তো শুনে হতবাক, ফোনে জানাতে উনি প্রথম যে কথাটি বলেন, " সে কী? কেউ আদৌ এসছিল তোমার কাজ নিয়ে শুনতে? কি করে জিতলে? যাই হোক, কংগ্র্যাটস।" বছরের শুরুতেই একটা মোক্ষম শিক্ষা পেলাম। বা বলা চলে, নিজের সম্বন্ধে জানলাম। টেনশন না করে কাজ করলে, বেশী এক্সপেক্টেশন না রাখলে অনেক কিছু প্রাপ্তি হয়। এখন পদে পদে তা মানার চেষ্টা করলেও ম্যাক্সিমাম সময়েই মানতে পারিনা। সামান্য কিছুতেই হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায়। তাও যাই হোক, বছর শুরু হল বেশ কাজের স্বীকৃতি পেয়ে। দিব্যি মন খুশি। এক্সট্রা খুশি হলাম তারপর যখন একটা মোটামুটি ভালো জারনালে সেকেন্ড অথরে পেপার বেরোলো মার্চ মাসে। যারা রিসারচের সাথে যুক্ত নন, তাদের বলি। এই পেপার পাব্লিশ করাটা অনেকটা সাধারণের সরকারি চাকরি পাওয়ার মতো বলা চলে। ফার্স্ট অথর মানে ওই আই এ এস, আই এফ এস। আর সেকেন্ড অথর মানে হয়তো স্টেট ব্যাঙ্কের পি ও। নিজে রিসারচার বলে লেখায় মাঝে মাঝে এই প্রসঙ্গ আসতে পারে। আগাম ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
এপ্রিল মাস, আমার জন্ম মাস। আমার ক্যাম্পাসের ভাই বোনদের কথা তো আগে ম্যাড্রাস প্রসঙ্গে লেখায় বলেছি। তা এবার হলো কি, ভাইরা মিলে সব আমার জন্মদিন পালন করল। মাঝরাতে, ক্যাম্পাসের বেশ একদম মধ্যমা জায়গায় আমায় মধ্যমণি করে চলল সেলিব্রেশন। বয়স হচ্ছে, জীবনে কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা। এইসব ভাবতে ভাবতে আমার কেন জানিনা নিজের জন্মদিনটা বড্ড মন খারাপ মন কেমন করা লাগে। জন্মদিনের আগেরদিন থেকেই কেমন অকারণে ডিপ্রেশন হয়। গতবারে বাবা মায়ের সাথে মুন্নারে পালিয়েছিলাম। এইবারে মন খারাপ নিয়ে ছিলাম যে জন্মদিনে মা বাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। তবে ভাইগুলো এক্কেবারে ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করে দারুন সুন্দর করে আমার জন্মদিন পালন করল। সারাদিন বেশ খাওয়াদাওয়া, ছবি তোলা, কেক কাটা, উপহার পাওয়া, সব মিলিয়ে খুব ভালো কেটেছিল। মানে অভাবনীয় ভালোই বলা চলে। প্রবাসে আত্মীয়তা পেলে যা হয় আর কী।
মে মাসটা আমার খুব খারাপ কেটেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু মানুষের সাথে চরম মতানৈক্য হওয়ার ফলে নিজের অত্যন্ত একটা প্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে চিরতরে সরিয়ে নিই। খুব খুব কষ্ট হয়েছিল, বেশ অনেক রাত কেঁদেকেটে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু ওই যে বলে না, অন্ধকারের পরে আলোর উৎস আছেই। সব কিছু ভালোর জন্য হয়। তা আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এই অভিশপ্ত দিনগুলির মন খারাপ করা কাটাতে আমি লেখালিখিতে অনেক অনেক বেশী মনোযোগ দিতে লাগলাম। আগে যেটা সপ্তাহে একটা কি আরো কম লিখতাম, সেই আমি হঠাৎ শুরু করলাম প্রায় রোজ নতুন নতুন লেখার। রসেবশে বলে একটা গ্রুপে লিখতাম। অনেকের ভালোবাসা পেয়েছি। প্রচুর গুণীজনের সান্নিধ্যও পেয়েছিলাম। কিন্তু বাঙ্গালী একসাথে দুইজন থাকলেই অন্তত তিনটে দুর্গাপুজো হয়, বেশিদিন রসেবশেতে থাকতে পারিনি। অর্ণবের হাত ধরে এসছিলাম বছরের মাঝামাঝি আত্মপ্রকাশে। খুচখাচ লিখতে লিখতে তারপরে কখন যে এত আত্মীয় পেয়ে গেলাম, এই বছরের একটা বিরাট প্রাপ্তি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। সেই একই সাথে সাথে এলো আমার নিজস্ব একটি পেজ, সাম্পান। সাম্পান নামে আমার বাবা তাঁর কলেজ জীবনে লিটল ম্যাগাজিন চালাতেন। কয়েকটা সংখ্যাই বেরিয়েছিল। যখন নিজের পেজ বানাই, তাই নাম নিয়ে ভাবতে দুইবারের বেশী চিন্তা করতে হয়নি। বাবার ম্যাগাজিনের লিগ্যাসি চালানোর চেষ্টা করে চলেছি প্রতিনিয়ত। সাম্পান সন্তানসম প্রিয়।

এই করতে করতে এসে গেলো পুজোর কটাদিন। আগের লেখাতেই বলেছি। চেন্নাইতে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার পুজো কাটালাম। একটাবারের জন্যও মনে হয়নি পরিবারের থেকে দূরে আছি। আসলে রক্তের সম্পর্ক দিয়েই তো সব সময় আত্মীয়তা হয় না। মনের টান, প্রাণের টান লাগেই। এটা আমি খুব বিশ্বাস করি। এবং আমার জীবনে এর বহু বহু উদাহরণ। পুজো দারুণ কাটিয়েছি। বিশাল প্রাপ্তিস্বরুপ নতুন করে বানানো এখানে অনেকের সাথে আত্মীয়তা।

"কান্না হাসির দোল দোলানো
পৌষ ফাগুনের পালা।"
এত আনন্দের মধ্যে তারপর হঠাৎ একদিন আমার অতি নিকটাত্মীয়ার অকাল মৃত্যু সংবাদ সাঙ্ঘাতিকভাবে নাড়িয়ে দিলো আমায়। শোকের থেকে নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশী সময় নিতে পারিনি। কারণ সাথে যোগ হয়েছিল বাড়তি কিছু দায়িত্ব, দায়বদ্ধ্বতা, পরিবারের প্রতি।

এই করতে করতে এসে গেলো শীত। মানে মোটামুটি আপনাদের সকলের শীতকাল। আমাদের এখানে অল্প গরম। আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি বেশ কিছু মাস পরে। তারপরে শনিবারে বেড়াতে যাবো রাজস্থান, বাবা মায়ের সাথে। বছর দুই পরে আবার সপরিবারে আমাদের বেরানো। একটা সময়ে বছরে অন্তত দুইবার বেরানো হতোই হত। চেন্নাই আসার পর থেকে সেটা বন্ধ হতেই বসেছিল। তাই এই বেরানো নিয়ে খুব উদ্গ্রীব হয়ে আছি।

এই যে, লিখতে লিখতে বেশ একটা আত্মসমীক্ষণও হয়ে গেল। বছরের শুরুতে যেমন করে কাটাব ভেবেছিলাম, অবশ্যই তা মেলেনি। তাই মিললে বোধহয় জীবন থেকে সারপ্রাইজ এলিমেন্ট চলে যেত। একটা গতে বাঁধা জীবন কাটাতে হত। নিজেকে রোবট মনে হত। বরং এই বেশ ভালো। জীবন প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। যতটা পেরেছি মোকাবিলা করেছি। অনেক অনেক কিছু শেখা বাকি। অনেক কিছু একমপ্লিশ করা বাকি। সামনের বছরের রেজোল্যুশনে সেসব থাকবে। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, সামনের বছর যেন এরকম সময়ে বসে এই বছরের মতই বলতে পারি, ভালো মন্দ মিশিয়ে কাটলেও, মূলত ভালোর ওপর দিয়েই সব গিয়েছে। এইটুকুই আশা। আপনাদের সকলের জন্যও এইটুকুই প্রার্থনা রইলো। আগামী বছর খুব ভালো কাটুক।

Tuesday, December 12, 2017

তিতিরের ফেরা।

১।

অক্টোবরের শেষ। কিন্তু তবুও আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। অকালের বৃষ্টি। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তিতির আনমনে তাকিয়ে রয়েছে পাশের বাড়ির নিমগাছের দিকে। ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়ছে পাতাগুলির থেকে। জানলার গ্রিলে জলের ফোঁটারা আলপনা দিচ্ছে যেন। পাশের ফ্ল্যাট থেকে দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একে এক করে ভেসে আসছে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, আহা আজি এ বসন্তে, হৃদয় বসন্তবনে। মাঝে মাঝে তাতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে মেঘেদের গুরুগম্ভীর ডাক। সামনের কাঞ্চনগাছটাতে একটা কাক সেই কখন থেকে বসে ভিজেই চলেছে। রাস্তার ওপারের নেড়িটা বন্ধ দোকানের শাটারের তলায় কোনমতে ঘুপচি করে বসেছে। আজ সোমবার। পাড়ার সব দোকান বন্ধ। আর দুপুর বলে রাস্তায় এমনিও অনেক লোক কম। ক্রমশ বৃষ্টিটা বাড়ছে। লোক চলাচলও কমে আসছে।
" ও বৌদি, ভাতটা নামিয়ে নেবে? আমি বাকি সব রেঁধে টেবিলে গুছিয়ে এসছি। ভাতটা নামানো অবধি থাকতে গেলে একটার ট্রেনটা মিস করবো।"
রান্নার লোক মলয়ার কন্ঠস্বরে চমকে উঠলো তিতির।
" অ্যাঁ? ও হ্যাঁ। ঠিক আছে। আমি ভাতটা নামিয়ে নেবো। তুমি এসো। কাল কামাই করোনা কিন্তু। আমার কাল একটু বেরোনোর আছে। "
" হ্যাঁ হ্যাঁ, কামাই করবোনি। এবার যাই। "
" যাই না। বলো আসি। "
" হ্যাঁ, আসছিইইইইই।"
 একটা সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি পড়ে এসছিল আজ মলয়া। বৃষ্টির মরসুম বলেই বোধহয়। ছোটবেলা থেকে তিতির মা কে দেখত, বর্ষাকালে অফিস করতে যেত গার্ডেনের দোকান থেকে কেনা সুন্দর সুন্দর প্রিন্টের সিন্থেটিক শাড়িগুলো পড়ে। কী নরম হত, মায়ের আঁচলে মুখ ঢেকে কত খেলাই খেলত ও। মায়ের শাড়ির কালেকশান অতুলনীয়। আলমারি ভর্তি ভর্তি ঢাকাই, জামদানি, বিভিন্ন প্রদেশের নানান সিল্কের নানান ডিসাইনের নানান রঙের শাড়ি। মা চলে যাওয়ার পর বাবা একবার ডেকে আলমারির চাবি হাতে তুলে দিয়ে ওকে পছন্দসই শাড়ি বেছে নিতে বলেছিলও তিতিরকে। কিন্তু তিতির শাড়ি পড়েনা। শাড়িতে স্বচ্ছন্দবোধ করেনা। কাজের জায়গায় তো বটেই, এমনকি অনুষ্ঠানবাড়িতেও জিন্স কুর্তি নইলে চুড়িদার কুর্তা। এই এখন ঘরে রয়েছে, একটা সাদা খয়েরি ছাপা লঙ স্কারট আর সাদা এমব্রয়ডারি করা টপ। তাই মায়ের বিয়ের বেনারসি আর দু তিনটে সিল্ক ছাড়া একটাও কিছু নেয়নি সে। বাবাকে বলেছিল মাসতুতো বৌদিদের ডেকে দিয়ে দিতে। কিন্তু তিতির জানে। বাবা সেগুলো দেয়নি। এখনো আগলে বসে আছে। বসার ঘরে জানলার ধারের ওর প্রিয় জায়গা থেকে উঠে রান্নাঘরে গেল তিতির। চামচ দিয়ে একটু ভাত তুলে দেখে নিলো হয়েছে কি না, তারপর গ্যাসটা অফ করে দিলো। রান্নাঘরের ঘড়িতে চোখ যেতে তিতির খেয়াল করল প্রায় একটা বাজতে যায়, এখনো স্নান হয়নি ওর। চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বাড়িতে থাকতে থাকতে সব রুটিন ভেস্তে গিয়েছে। 



২।

" কি রে মিলু তুই আবার নামতা ভুল করেছিস? তেরোর নামতা এখনো মুখস্থ হয়নি? কাল বাদে পরশু পরীক্ষা না তোর?" কোন ভোরবেলা বেরিয়ে সারাদিন শহরের দাদা বৌদিদের হেঁসেল ঠেলে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মলয়ার প্রথম কাজই হল সাত বছরের ছেলে মিলন আর পাঁচ বছরের মেয়ে সোনালীর স্কুলের খাতাগুলোতে চোখ বোলানো। মলয়া নিজে গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেন অবধি লেখাপড়া করেছিল, খুব যে ভালো মাথা ছিল, তা না। কিন্তু পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল। তবে অবশ্য বাপ মা মরা মেয়ে, তায় মামাবাড়িতে মামীর দয়ায় মানুষ। মামা নিজে ওর স্কুল ছাড়িয়ে পাশের গ্রামের এক জুটমিল  করমচারীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় মলয়ার। রঞ্জিত, ওর স্বামী, ওর থেকে অন্তত দশ বছরের বড়। বিয়ের পর ওর লেখাপড়ায় ইচ্ছে আছে জেনে খুশি হয়ে আবার নাইট স্কুলে ভর্তি করার কথা বলেছিল বটে রঞ্জিত। কিন্তু স্বামীর সংসার আর ছেলে মেয়ে মানুষ করতে করতে মলয়ার আর লেখাপড়ার সময় হল না। দিব্যি চলছিল সংসার। তারপর হঠাৎ শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি একদিন এক অজানা জ্বরের কবলে পড়ল রঞ্জিত।  এক সপ্তাহ যমে মানুষে টানাটানি করেও আর ওকে বাঁচানো গেলোনা। জমানো টাকা যেটুকু ছিল, তা শেষ হওয়ার মুখে। অগত্যা মলয়াকে শহরে বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ নিতে হল। সেই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে উঠে ছেলেমেয়ে আর নিজের জন্য অল্প পান্তা ভাতের ব্যবস্থা করে ওদের স্কুলের জন্য রেডি করে নিজে ছোটে ছটার ট্রেন ধরতে। আর তারপর সারা সকাল চার বাড়ি রেঁধে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি এসে আবার শুরু জীবনযাপন। মলয়ার খুব সখ ছেলে মেয়ে দুটোকে অনেক দূর পড়াবে, ওরা মস্ত বড় মানুষ হবে। নিজের যেটুকু সাধ্য, সেই দিয়ে একটু আধটু ওদের দেখিয়ে দেয় ও। আজও তাই করতে বসে অঙ্কর খাতাতে একগাদা ভুল দেখে ছেলেকে মৃদু বকা দিল ও।
" মা দাদা না নামতা খালি ভুল করছিল। আমার অঙ্কও দেখাতে গিয়ে ভুল করে। আমি ঠিক করে দিলাম।" সোনালীর কথায় অবাক হয়ে মলয়া জিজ্ঞেস করে মিলনকে। "হ্যাঁ রে? সত্যি?"
মিলু খানিক চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মায়ের ক্রমশ রাগ হচ্ছে টের পেয়ে এক ছুটে সদর দরজা দিয়ে দৌড় লাগায়।
" মিলুউউউউ। ফেরত আয়।" মলয়ার ডাকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই মিলু ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যায় পুকুরের ধারে। ওইদিকটা নির্জন একটু। খানিক গাছের ছায়ায় বসে কাটিয়ে তারপর মায়ের রাগ কমলে ঘরে ফেরার কথা ভাবে মিলু। মা কিছুতেই যে কেন বুঝতে চায় না কে জানে। এইসব একগাদা নম্বর, হিসেব নিকেশ একদম ঢোকেনা ওর পুচকে মাথাটায়। অনেক চেষ্টা করেছে। তাও হয়না। মা খালি রেগে যায় আর পিটুনি দেয়। ভালো লাগেনা। কই বাবা থাকতে তো এমন হতনা। বাবা কী সুন্দর গুছিয়ে বসে গল্পের ছলে বুঝিয়ে দিতো সব।
কিছুক্ষণ পরে সোনালী গুটিগুটি পায়ে এসে বসলো মিলুর পাশে, গাছের ছায়ায়। নরম হাতদুটো  ওর হাতে রেখে বলল, "দাদা চল। মা ডাকছে। খাবার বেড়ে দিয়েছে। "
" আমি যাবো না। তুই যা। "
" ওরকম বললে হয় নাকি দাদা? চল চল। তুই না খেলে আমরা কেউ খেতে বসতে পারছিনা। "
" মা কেন খালি বকে আমায়? আমি যাবো না। তুইই বা কেন মা কে বলতে গেলি? "
" আচ্ছা আর বলব না। নে কান ধরছি। এবার আয়। "
খানিক বোনের দিকে তাকিয়ে মায়াভরা চোখদুটির আকুতিতে সারা দিয়ে মিলু ফেরত চলল মায়ের কাছে।


৩।

বারান্দায় দড়িতে গামছাটা মেলে ঘরে ঢোকে তিতির। আয়নার সামনে টুলটা টেনে বসে। হাতে চিরুনি। টুপটুপ টুপটুপ করে জল পড়ছে চুল থেকে। ছোটবেলা থেকেই তিতিরের এই সমস্যা। হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই ও কোনদিনও মাথা মুছতে পারেনা ভালো করে। আগে দিদিমা যত্ন করে ও স্নান সেরে বেরোলে মাথা মুছিয়ে দিত। তারপর একদিন দিদিমা চলে গেল। ও তখন ক্লাস টুয়েলভ। মা অফিস সামলাতে হিমসিম খায়। মেয়ের পিছনে সময় দেওয়ার মত বিলাসিতা কখনোই করতে পারেনি। ভেজা চুল থেকে সমানে সর্দি কাশি হতে থাকত ওর। সেই বছর পুজোর ছুটি পড়তে পার্লারে গিয়ে একদিন তিতির নিজের কোমর ছাপানো চুলগুলো কেটে একেবারে বয়কাট করে এলো। মায়ের কাছে খুব বকুনি খেয়েছিল। বাবা তাও ওর হয়ে ওকালতি করেছিলও মায়ের কাছে, কিন্তু বরাবরের মতোই মায়ের কাছে কেউই টিকতে পারেনি। সেই থেকে আজ বারো বছর হয়ে গেল, তিতিরের চুল কখনো কাঁধ ছাড়ায়নি আর। অথচ চুল নিয়ে স্টাইল করা, নানান এক্সপিরেমেন্ট করা ছিল তিতিরের সখ। কলেজ জীবনেও বন্ধুরা ওঁর কাছে আসত হেয়ার স্টাইল করতে কোন অনুষ্ঠানের আগে। মনের ভিতরে সুপ্ত বাসনা ছিল, কোনদিনও নিজের কন্যাসন্তান হলে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে। নিজের ছোটবেলায় মায়ের কাছে যে আদর পায়নি, সেই ভালোবাসায় মুড়ে রাখবে মেয়েকে। সপ্তর্ষি যেদিন ল্যাব থেকে এলো প্রেগ্নেন্সি রিপোর্টটা হাতে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় তিতির।
" দেখো সপ্তর্ষি, আমাদের মেয়ে হবে। আমার একটা জ্যান্ত পুতুল হবেই। দেখো। আমার এতদিনের সখ।"
" আচ্ছা বাবা, তাইই হবে। তবে ছেলে হক বা মেয়ে, দুজনেই আমাদের কাছে কিন্তু সমান ভালোবাসা পাবে। তাই না তিতির? "
" হুম। কিন্তু আমার মেয়েই হবে। "
তিতিরের প্রেগ্নেন্সিটা বেশ কমপ্লিকেটেড হয়ে যায়। তৃতীয় মাস থেকে ডাক্তারের পরামর্শে ছুটি নিতে চেয়েছিল, ছুটি পেলোনা। বাধ্য হল চাকরিটা ছাড়তে। তখন সারাদিন অফুরন্ত সময়। শ্বশুরবাড়ির দিকেও ওর কোন কাছের আত্মীয়া নেই। মা নেই। এই ক'মাস তিতিরের নিজেকে বড় একা লাগত। যদিও সপ্তর্ষি চেষ্টা করতও যথাসাধ্য ওকে সাহচর্য দেওয়ার। কিন্তু কর্পোরেট চাকরি। কাজের প্রেশার। চাইলেও বিশেষ সুবিধে হতনা। তিতিরের বাবা এসে ছিল কিছু দিন ওর কাছে। সারাদিন বাবা মেয়েতে বসে গল্প করে টিভি দেখিয়ে কাটিয়ে দিত। সাথে চলত টুকটাক উল বোনা। উল বুনতে তিতির জানত না। স্কুলেও শেখেনি। কিন্তু মাতৃত্ব মানুষকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। তিতিরও তার ব্যাতিক্রম না। ইয়ুট্যুব খুলে দেখে শিখে আস্তে আস্তে বুনতে শুরু করল। প্রথমে মোজা, তারপরে টুপি, তারপর শুরু করেছিল একটা বেবি পিঙ্ক রঙের সোয়েটার। সাত মাস পূর্ণ হতে, একদিন দুপুরে হঠাৎ শুরু হল সাংঘাতিক পেটে ব্যথা। সাথে ব্লিডিং। তড়িঘড়ি নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হল তিতিরকে। কিন্তু বাঁচানো গেলনা ওর ফুটফুটে কন্যাসন্তানকে। তিতির ঢলে পড়ল সাংঘাতিক ডিপ্রেশনে। শুরু হল থেরাপি। এখন বছরখানেক থেরাপি চলার পর অবস্থা কিছুটা হলেও সামলেছে ওরা। কিন্তু সপ্তর্ষি আর তিতিরের জীবন আর এক থাকেনি। তিতির নিজের চারিপাশে একটা বিশাল দেওয়াল তুলে নিয়েছে। খুব দরকার ছাড়া ওই দেওয়ালের বাইরে বেরোয়না ও। দিন রাত চুপচাপ থাকে। গান চলে। টিভি চলে। কিন্তু কোনদিকেই মন থাকেনা। যন্ত্রের মত দিনযাপন করে তিতির। সপ্তর্ষিও অফিসের কাজে নিজেকে পুরোদমে ডুবিয়ে দিয়েছে। সকাল নটায় বেরিয়ে রাত দশটার আগে ফেরেনা। এই কমাসে এত কাজ করেছে যে খুব সহজেই দুই ধাপ পেরিয়ে প্রোমোশন পেয়ে গিয়েছে। বসেদের প্রিয়পাত্র এখন ও। হবে নাই বা কেন, এত করমপ্রিয় যে আর কেউ নেই।
ভিজে চুলে চিরুনি চালিয়ে তিতির ধীর পায়ে ডাইনিং রুমে এলো। ঘড়ির কাঁটায় আড়াইটে। টেবিলে মলয়ার রেখে যাওয়া রান্নার বাসনের ঢাকনা খুলে খুলে দেখে একটা থালায় অল্প ভাত আর খানিকটা ডাল ঢেলে নিলো তিতির। সাথে নিলো একটা বাটিতে কেটে রাখা স্যালাড। খাবারটা নিয়ে আবার নিজের প্রিয় জায়গা, জানলার ধারে এসে বসল তিতির। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। রোদ উঠে গিয়েছে। ঝলমল করছে চারিদিক।
পাশের বাড়ির রেডিয়োতে তখন চলছে নাটক। হাল্কা আবছা সংলাপ শোনা যাচ্ছে। একটা সময়ে নাটক শুনতে খুব ভালোবাসতো তিতির। সপ্তর্ষি আর ও মাঝে মাঝেই রবিবার করে একাডেমী, মধুসূদন মঞ্চ চলে যেত নতুন নাটকের সন্ধানে। শেষ কবে গিয়েছে, মনে পড়েনা।
কাকটা গাছের ডালে বসে ওর ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। রোজের অভ্যেস। জানে চুপ করে বসে থাকলে তিতির ওকে খেতে দেবেই। কপাল ভালো থাকলে (যা ইদানীং প্রায়ই হচ্ছে), পুরো থালাটাই ওর কপালে নাচছে। দু চামচ মুখে তুলল তিতির। তারপর "আয়, খেয়ে যা" বলে কাকটিকে দিয়ে দিল সমস্তটা।


৪।

" বৌদি, আজ একটু তাড়াতাড়ি যাব। ছেলেটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। "
" ডাক্তার? কেন কী হলো? "
" ওর পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে কদিন ধরে। খাওয়াদাওয়া করতে পারেছেনা। গ্রামের হাসপাতালে বলল শহরে দেখাতে। "
" কোথায় নিয়ে যাবে? ডাক্তার ঠিক করেছো? "
" ভাঙ্গরে নিয়ে যাবো। গ্রামের সবাই বলছিল, নাকি ভালো। "
" যেতে পারো। তবে আমি বলি কী, পিজিতেও যেতে পারো। বেশী ভালো হবে। "
" সে কোথায় বৌদি? "
" ভবানীপুর ছাড়িয়ে। আমি বাসের নম্বর বলে দেবো। "
" ঠিক আছে বৌদি। তাহলে তাই যাই। "
" আর হ্যাঁ শোনো, যাওয়ার আগে আমার থেকে টাকা নিয়ে যেয়ো। "
" আচ্ছা বৌদি। "
" আর সোনালীকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হবেনা। ও আমার এখানে থাকুক। ফেরার পথে ওকে নিয়ে যেয়ো। "
লাজুক সোনালীর দিকে তাকিয়ে ওর মা বলল, " ও কি রাজি হবে বৌদি? আমায় বা মিলুকে ছাড়া থাকতেই চায় না। "
" না সোনালী, ওই রুগীর ভিড়ে তোমায় যেতে হবেনা। আমার কাছে থেকো। আমরা ভালো থাকব। তোমার খারাপ লাগবেনা। দেখো। "
" তাহলে ওই কথাই রইলো বৌদি। আমরা বেরোই। সোনা মামীকে বিরক্ত করবি না একদম " সোনালীকে তিতিরের জিম্মায় রেখে ঘন্টাখানেক বাদে মিলুকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল মলয়া।

ওদের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। বাড়ি এসে মলয়া দেখে, সোনালী আর তিতির বারান্দায় বসে। ওদের সামনে নানান রঙিন বই ছড়িয়ে রাখা। সেই বইয়ের পাতায় চোখ দুজনেরই। চিরুনি হাতে চুল আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছে তিতির। দুজনে খুব গল্প করতে ব্যস্ত, হাসির কলকাকলিতে ভরপুর ওদের বারান্দা। কে বলবে লাজুক মেয়ে সোনালির সাথে আজই পরিচয় হয়েছে তিতিরের।

" এই, তুই বৌদিকে বিরক্ত করছিস কেন সোনালী? " মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরলও সোনালীর। হরফর করে উঠে দাঁড়ালো।
" না মলয়া দি। ও একটুও আমায় জ্বালাতন করেনি। বরং ও থাকায় আমার খুব ভালো সময় কেটেছে। মাঝে মাঝে ওকে আনবে আমার কাছে। ডাক্তার কী বলল? "
" পেটের ফটক তুলল। কিছু ওষুধ দিল। আবার এক সপ্তাহ পর আসতে বলেছে। "
"  ঠিক আছে। সেদিনও সোনালিকে এখানে রেখে যেয়ো। কি রে, থাকবি তো? "
" হ্যাঁ মামী। বাকি গল্প শুনতে হবে তো। এই দাদা জানিস তো মামী আমায় কি সহজে অঙ্ক কষা শিখিয়েছে। তোকে বলে দেব। দেখবি তুইও আর ভুল করবিনা। "

 মলয়া ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে ল্যাপটপ খুলে বসলো তিতির। আজ যেন অনেকদিন পর ওর সারাদিনটা ভালো কেটেছে। প্রাণ খুলে হেসেছে। কথা বলেছে। গল্প করে লেখাপড়া শিখিয়েছে। ইচ্ছে করছে, ঠিক এরকম করেই যদি প্রতি দিন কাটানো যায়। খানিক ভেবে তারপর গুগুল খুলে তাই তিতির সার্চ করল কাছাকাছির মধ্যে কোন স্কুলে বা মন্টেসরিতে চাকরি আছে কি না। নিজের ডিগ্রিটা নইলে মর্চে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল যে। তিতিরকে যে ফিরতেই হবে স্বাভাবিক জীবনে। তিতিরদের হারতে নাই, হারিয়ে যেতে নেই।



Sunday, December 10, 2017

সখ পূরণ

১।

ছায়া ঘনাইছে বনে বনে।

গগনে গগনে ডাকে দেয়া।

গাড়িতে স্টার্ট দিতেই শুরু হয়ে গেল শ্রীকান্ত আচার্যর গলায় আমার অন্যতম প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতটি শুরু হল। আমার প্রতিদিনের অভ্যেস, গাড়ি চালিয়ে অফিস পৌঁছনো অবধি রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার চাইই চাই। শুনতে শুনতে গুনগুন করি, মন মেজাজ ভালো থাকলে আর রাস্তায় ট্রাফিক না পেলে গলা ছেড়ে গাইও। দক্ষিণীর স্টুডেন্ট আমি, একটা সময় অনেক স্টেজ শো করেছি। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে লন্ডনের থেকে একটু দূরে আমি থাকি, চাকরি করি একটি ব্যাঙ্কে। সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেরোই, ঘন্টাখানেকের পথ। তার মধ্যেই হ্যান্ডসফ্রিতে চলে বাড়িতে কথাবার্তা। সারাদিন অফিসে কাজের চাপ, সামলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা। এসেই কোনমতে খেয়ে দেয়ে আবার পরেরদিনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি। এই গতে বাঁধা জীবনের খপ্পরে পড়ে আমি গান গাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছি। কলেজে পড়াকালীন সখের লেখালিখি একটু যা করতাম, তাও আর হয়ে ওঠে না। এই জীবনে হাঁপিয়ে যাই তো বটেই। কিন্তু তখনই মনে হয়, এমন জীবনই তো চেয়েছিলাম, সেই ছোট থেকে। মস্ত চাকরি করব, আমার গর্বে গরবিনী হবে আমার মা। বিদেশে থাকব, প্রচুর নাম ডাক হবে, অনেক অনেক টাকা রোজগার করব, মায়ের সমস্ত স্বপ্নপূরণ করব। এই তো চাইতাম ছোট হেকে। আর তাই যখন স্কলারশিপের টাকায় বিদেশে এলাম, তখন মনে হয়েছিল। এই তো সুযোগ তিতির। এইবারে এর পুরো সদ্ব্যবহার করে সমস্ত সখ আহ্লাদ পূর্ণ করব। এম এসের পরে লন্ডনের চাকরিটা তখন ছিল আমার কাছে আমার স্বপ্নের জগতের ভিসা। আসলে ছোট থেকে দেখে এসেছি, মা কত কষ্ট করে একা হাতে আমায় বড় করেছে। কখনো কোন স্বাদ আহ্লাদ পূরণ করতে কমতি রাখেনি বটে, কিন্তু আমি বুঝতাম। দিনের পর দিন স্কুলে পড়িয়ে, তারপর বাড়তি রোজগারের জন্য ট্যুটোরিয়ালে ক্লাস করিয়ে ক্লান্ত মা ফিরত বাড়ি। কত করে তখন বলতাম মা কে ছুটি নিতে, কিন্তু তাহলে আমার স্কুলের ফিজ, গানের স্কুলের ফিজ আটকে যেত, এই বলে মা আমার খেটে চলত অমানুষিক ভাবে। আমার সেই ইচ্ছা এখন সবটাই পূর্ণ হয়েছে। এখন প্রতি মাসে যত পাউন্ড পাঠাই মা কে, তার মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় অনেকটাই। মা কে আর পরিশ্রম করতে হয় না। নিজের মতো করে একটা এন জি ওর সাথে যুক্ত হয়ে কিছু অভাবী মেধাবী ছেলেমেয়েদের পড়ায়, স্কুল থেকেও রিটায়ার করেছে। সবই হয়েছে, শুধু কোথায় যেন নিজের বলে যেটুকু সখ আহ্লাদ ছিল, সেগুলি আর নেই। কোথায় কোন বিজনেস মিটিং, ক্লায়েন্ট কলের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে। কবিতার ছন্দ লুকিয়েছে পাওয়ার পয়েন্টের স্লাইডে। আর গান? সে এই বাড়ি থেকে অফিসের পথটুকুতে, নীরবে, নিভৃতে।

২।

গাড়িটা পার্ক করতে গিয়ে দেখলাম পাশেই অন্তরা। অন্তরা ছাড়াও আমার অফিসে বেশ কয়েকজন ভারতীয় চাকরি করে, তাদের সাথে তেমন বাড়াবাড়ি রকমের অন্তরঙ্গতা না থাকলেও অন্তরার সাথে আমার খুব জমে। ও ভারী মিশুকে হাসিখুশি মেয়ে। গল্প করে আপন করে নিতে ওস্তাদ। আমার আগে থেকে লন্ডন অফিসে আছে। ওই আমায় এখানে প্রথম দিন থেকেই এমন আপন করে দিয়েছে যে হোম সিকনেসটা আমার খুব কম হয়। পারকিং লট থেকে বেরোতে বেরোতে এক ছুট্টে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল ও। "কী সুন্দর লাগছে তোমায় আজ তিতির দি।" হ্যাঁ, ও এরকমই পাগল। প্রতিদিনের মতোই আজও বিজনেস স্যুট পড়েই এসেছি। চুলও একইভাবে টপনট করে রাখা, তাও যে কি করে আমায় আজ সুন্দর দেখে, ওই জানে। "পাগলি!" বলে হেসে উত্তর দিলাম। অন্তরা আর আমি পাশাপাশি ডেস্কে বসি, নিজের নিজের জায়গায় এসে কম্প্যুটার লগ ইন করতে করতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম আজকের টু ডু লিস্টটাতে। বেশ লম্বা আজ, অনেকক্ষণ টানা কাজ করতে হবে। মেইল চেক করে দিন শুরু হয় আমার। ইনবক্স ভর্তি বিভিন্ন দরকারি অদরকারি মেলে। পরপর সাব্জেক্ট দেখে দেখে স্ক্যান করতে করতে একটা সাব্জেক্টে এসে চোখ আটকে গেলো। এইচ আর থেকে এসেছে, ন্যু ইয়ার ব্যাশ হবে অফিসে। থিম ইন্টারন্যাশ্নাল ফ্লেভার। একত্রিশ তারিখ লাঞ্চ পার্টি হবে অফিসের সকলের, আর ওই দিন সকলকে যার যার নিজের দেশের পোশাক পড়ে আসতে হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্লটের জন্যও বলেছে।

" তিতির দি। দেখলে এইচ আরের মেইল?" পাশের ডেস্ক থেকে অন্তরার ডাকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "হ্যাঁ রে। তাই তো দেখছিলাম। ভালোই হল। পুজোয় যে শাড়িটা পড়েছিলাম, সেটাই না হয় পড়ে নেবো। "

" আরে সে তো পড়বেই। কিন্তু তার আগে তুমি কালচারালে নাম লেখাও। সাহেবগুলো একটু শুনুক তো আমাদের গান। সারাক্ষণ ওই কি যে অপেরা অপেরা আর কয়ের করে চলে। কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমাদের মিষ্টি গান শুনিয়ে ওদের তাক করে দাও তো দিদি।"

"আরে ধুর, গানের রিহার্সাল নেই কতদিন। এখন কি আর পারব নাকি?"

" হাতে কম করেও এক মাস সময় আছে। তুমি রোজ প্র্যাক্টিস করো। ঠিক পারবে। "

" না রে অন্তরা। সত্যি বলছি। সময় নেই। পরশু মা আসছে এখানে। মায়ের সাথে সময় কাটাবো না গানের রেওয়াজ করব?"

" আরে কাকিমা খুব কন্সিডারেট। কিছু মনে করবে না। আমি তোমার নাম দিয়ে দিচ্ছি। "

" না রে। প্লীজ। সোনা আমার।"

" নো সোনা মোনা তিতির দি। আমি রিকিকে বলে দেবো যে তুমি গাইবে। এ কী, ইন্ডিয়ান কন্টিনজেন্টকে রিপ্রেসেন্ট করতে হবে তো! "

" মোহিনী নাচুক। আমি কেন?"

" মোহিনী দি ও নাচুক। তুমিও গাইবে। ব্যস। আর কোন কথা শুনব না। "

৩।

অন্তরার জোরাজুরি আর পাগলামির ফলে সেই আমায় গানের জন্য নাম লেখাতে হল। স্লট পেয়েছি দশ মিনিটের। জানিনা দশ মিনিটে কী গাইব। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া তো কিছুই বুঝি না। গাইতেই পারি না। অথচ ওরা কি আদৌ সেটার মাহাত্ম্য বুঝবে? কীভাবে যে প্রেসেন্ট করা যায় ওদের সামনে, লেখা আর গানের সংমিশ্রণ, কিছু একটা এরকম করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে আমি এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। আজ মা আসছে আমার কাছে। মাস চারেক থাকবে। তারপরে এপ্রিলে জন্মদিন পালন করতে আমরা সুইজারল্যান্ড যাবো। এটা আমার পুরনো সখ। ছোটবেলায় এটলাস বের করে ইয়ুরোপের ম্যাপ খুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। যাদবপুরের ভাড়ার বাড়িটায় আমার পড়ার ডেস্কে একটা গ্লোব ছিল। দশ বছরের জন্মদিনে মাসি কিনে দিয়েছিল। খালি খালি গ্লোব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আঙুল থমকে যেত ইয়ুরোপের ওপর। আল্পস পর্বতমালা, ফ্রান্স, ব্রিটেন এইসব জায়গা যেন মনে হত স্বপ্ন। চাকরিসূত্রে ব্রিটেন ফ্রান্স ঘুরে ফেললেও আল্পস দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। মা খুব বেড়াতে ভালোবাসে। কিন্তু তখন সামর্থ্য বলতে ওই পুরী দীঘা দার্জিলিং। একবার মামাবাড়ির সবাই মিলে গিয়েছিলাম হরিদ্বার মুসৌরি দেহরাদুন। ব্যস। আর কোথাও না। যেতে পারতাম না ঠিকই। কিন্তু লাইব্রেরি থেকে ভ্রমণ পত্রিকা এনে মা মেয়ে মিলে গোগ্রাসে গিলে ফেলতাম। এখন সামর্থ্য থাকলেও সময়ের অভাব। সারাক্ষণ অফিস অফিস করেই পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাও তার মধ্যেই মা এখানে আসছে বলে প্ল্যান করা। জানি না কেমন কি হয়। এপ্রিল আসতে ঢের দেরি। তার আগে সামনেই অনুষ্ঠান। শিরে সংক্রান্তি অবস্থা আমার। কী যে করি, কী যে করি।

এরাইভালে দেখাচ্ছে দিল্লি থেকে মায়ের ফ্লাইটটা ল্যান্ড করেছে। ব্যস, আর খানিক্ষনের অপেক্ষা। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরব। এক বছর পর মা কে দেখব। কাছে পাব। ভাবতেই মন ভালো হয়ে যায়। ওই তো মা। একটা হলুদ সিল্কের শাড়ী পড়েছে। পিছন দিক করে চুলটা টেনে একটা খোঁপা করা। কপালে ছোট্ট টিপ, মেরুন রঙের। এক ঝটকায় যেন স্কুলের দিনগুলিতে চলে গেলাম। স্কুল ছুটির সময়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ঘেমে নেয়ে সারাদিন স্কুলে বাচ্চা পড়িয়ে তাঁতের শাড়ি পড়া আমার মা আসত, আমায় বাড়ি ফেরাতে। তখনের মতোই আমি আজও দৌড়ে গেলাম মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরলাম। প্রাণভরে নিলাম মা মা গন্ধটা। আহ! কী আরাম।

৪।

" তিতির দি, কেমন চলছে রিহার্সাল? "

" ভালো না রে অন্তরা। গান সিলেক্ট করেছি। তবে শিয়োর না। জানিনা সবাই বুঝবে কি না। "

" কী নিয়ে করবে ভেবেছ?"

" আমি ভাবছিলাম রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর চেতনা নিয়ে যদি কয়েকটা গান করি। মাঝে ইংরেজিতে কিছু কিছু লাইন বলে দেবো। "

" ধুর। ওরা ওসব বুঝবেই না। এমন সুন্দর লিরিক ওরা মানেই বুঝবে না। "

" তাহলে? "

" আমি যদিও তোমার মতো পারদর্শী না। কিন্তু একটা আইডিয়া দিতে পারি তোমায়। "

" কী বল? "

" বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বিদেশী সুর থেকে অনুপ্রাণিত। তুমি সেই অরিজিনাল আর বাংলা, দুটোই গাও না। গানগুলির রচনার ইতিহাস বলো। তুমি নিশ্চয়ই পারবে সেগুলো জোগাড় করতে। "

" হ্যাঁ, নট আ ব্যাড আইডিয়া। বাট..."

" নো বাট অ্যান্ড নো ইফ। তুমি শুরু করো প্র্যাক্টিস। "

" হুম। দেখছি। মাকেও জিজ্ঞেস করব। মার এসব ব্যাপারে সেন্স বেশ ভালো। "

" হ্যাঁ হ্যাঁ করো। দেখো, এই সাহেবগুলোকে দেখিয়ে দিতে হবে। ওদের ওই অপেরার চেয়ে কত রিচ আমাদের সঙ্গীত। "

" তোর যে কেন অপেরার ওপর এত শত্রুতা কে জানে। ওটা এক ধরণের শিল্প, আমাদেরটা আমাদের। তুলনা হয় কেন? দুটোই দুইভাবে সুন্দর। "

" তিতির দি, ওই সব জ্ঞানের কথা ছাড়ো। যাও গান গাও। "

" পাগলি! এখন অনেক কাজ আছে। রাত্রে বাড়ি গিয়ে করব। "

" কোন হেল্প লাগলে বলো। "

"একদম।"

৫।

অবশেষে আজ সেই বহুকাঙ্খিত দিনটি এসেই পড়েছে। কাল সারা সন্ধ্যে মা আর অন্তরার সাথে ঝগড়া করে করে শেষমেশ আজকের ড্রেস সিলেক্ট করেছি। আমি যত বলি সাদা শাড়ী রঙিন পাড় পড়বো, গানের স্কুলের অনুষ্ঠানগুলির মতো, তত এরা রেগে যায়। "এইটুকু মেয়ে সাদা পড়বে কেন।" "দি তুমি কিছুতেই ঢাকাই পড়বেনা। সিল্ক পড়ো।" ইত্যাদি। ইত্যাদি। এই সব শুনতে শুনতে শেষে তিনজনে মিলে রফা করে একটা হাল্কা ঘি রঙের তসর যার পাড় আর আঁচলে মেরুন রঙের রেশমি সুতো দিয়ে গুজরাটি স্টিচের কাজ ফাইনাল হয়েছে। কাল রাত্তিরটা অন্তরা আমার এখানে ছিল, সকালে আমায় সাজাবে বলে। সকাল ছটা বাজতেই উঠে পড়লাম। কোনমতে কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে স্নান সেরে এসে নিজেকে তুলে দিলাম মা আর অন্তরার হাতে। এক ঘণ্টা পরে যখন নিজেকে আয়নার সামনে দেখলাম, সত্যি বলছি, নিজেই চমকে গিয়েছি। একটু ঘষামাজা করলে যে আমিও সুন্দর দেখতে লাগতে পারি, এ যেন ভুলতে বসেছিলাম। সাড়ে সাতটা নাগাদ রওনা দিলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। সাথে মা ছিল। স্পেশাল অনুষ্ঠান বলে পরিবারের লোকজন আজ আমন্ত্রিত।

অফিসটাকে আজ দারুণ সুন্দর করে সাজিয়েছে, বেলুন, স্ট্রিমার, রিবন দিয়ে। বিভিন্ন দেশের পতাকা দিয়ে একটা গ্লোবের আকৃতি বানানো রয়েছে অডিটোরিয়ামের ঠিক বাইরে। যথসময়ে আমিও গেলাম স্টেজে। একটু ভয় ভয় করছে। এর আগেই মোহিনী এক্কেবারে ভুবনমোহিনী পারফরমেন্স করে উপস্থিত সকলকে মাতিয়ে দিয়েছে। মাইকে হাল্কা টোকা মেরে শুরু করলাম আমার বক্তব্য। "Drink to me only with" গানটির ইতিহাস বললাম। তারপরে একই সুরে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত "কতবার ভেবেছিনু" গানটির উল্লেখ করলাম। যতটা সম্ভব সহজ করে গানের মানে বোঝালাম। তারপর দুটো গান গেয়ে শোনালাম। গোটা হল হাততালিতে কাঁপিয়ে দিল। মাঝের সাড়িতে দেখলাম মা আর অন্তরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। আমার তখন দুই চোখ ঝাপসা হওয়ার জোগাড়। অনুষ্ঠান শেষে এইচ আর ম্যানেজার এসে করলেন সারপ্রাইজ এনাউন্সমেন্ট। অনুষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ তিন প্রতিযোগী পাবে পুরস্কার। আমি পেলাম যুগ্ম প্রথম, কেনিয়ার একটি মেয়ে, রওয়ান্ডার সাথে। পুরস্কার হিসেবে পেলাম স্কটল্যান্ডের এক ক্যাসলে তিন দিন দুই রাত্তিরের ছুটির ভাউচার।

হঠাৎ করেই সব ইচ্ছে যেন একে একে পূরণ হয়ে গেলো আমার। একটা সব পেয়েছির আনন্দ আচ্ছন্ন করে দিল আমায়। আহ্লাদে আটখানা হয়ে মায়ের সাথে অন্তরার সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে হবে এখন। বাড়ি ফিরেও অনেক কাজ। প্যাকিং করতে হবে যে। পরশুদিনই বেরোনো।

Sunday, December 3, 2017

খাইয়ে সুখ

কড়াইতে তেল গরম করতে দিয়ে ঝটপট লুচিগুলো বেলতে লাগল অঙ্গনা। প্রায় দেড়শো লুচি ভাজতে হবে, হাতে সময় খুব কম। সেপ্টেম্বর মাসের ভ্যাপ্সা গরম, এই আদ্যিকালের পুরনো বাড়ির রান্নাঘরটাতে হাওয়া চলাচল প্রায় নেই বলাই চলে, কিন্তু থামার কোন উপায় নেই। ঘামতে জোরে হাত চালাতে থাকে ও। প্রথম লুচিটা তেলে ছাড়তে ছাড়তেই প্রায় ফুলে উঠল, ব্যস, এবারে বাকী সবগুলোও এমন ফুলকো হলে নিশ্চিন্ত হয় অঙ্গনা। পাশের গ্যাসে ফুটতে থাকে ফুলকপি আলুর ডালনাটা। কখনো ওটা নাড়তে থাকে, কখনো লুচির কড়াইয়ে ভাজতে থাকে। সমান তালে চলতে থাকে বেলা।
" বৌদি, আমি বরং তরকারিটা গরম করছি। তুমি লুচি সামলাও। "
" না না পারো, আমি ম্যানেজ করে ফেলব। তুই বরং ততক্ষণে মাংসটা ম্যারিনেট করে রাখ। আমি বলে বলে দিচ্ছি। লুচিটা নামিয়েই মাংসটা ধরতে হবে। "
" আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমায় পর পর বলতে থাকো। "
" ওই তো তোর আন্দাজ মতো মাপ দিস। মোটামুটি মাপ করেই রেখেছি। "
" হ্যাঁ ঠিক আছে। কতটা মাংস আছে? "
" ছয় কিলো রে। নে ওই টক দই আদা রসুন বাটা, নুন হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, পিঁয়াজ বাটা, অল্প করে গরম মসলা গুঁড়ো আর খানিকটা সর্ষের তেল দিয়ে মাখিয়ে রাখ। "
" নুন চিনি? "
" চিনি লাগবে না। নুন ভালো করে খেয়াল রাখিস কতটা দিলি। কষানোর সময় কিন্তু তোকে ডাকব নুনের মাপ বুঝতে। "
" বেশ। "
গরমটা আজ বেশ ভালো মতোই পড়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে টেনশন। অঙ্গনার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী ও না। দায়িত্ব নিয়েছে যখন, ভালো ভাবে কাজটা করতেই হবে। বসু মল্লিক বাড়ির একমাত্র বৌমা, অঙ্গনা আর ওর ননদ, পারোমিতা, মাস তিনেক হল  নিজেদের বাড়ি থেকেই জয়েন্ট ভেঞ্চারে শুরু করেছে ওদের নতুন ব্যবসা, "খেয়ে সুখ"। নিয়মিত কিছু বাড়িতে দুবেলার খাবার ডেলিভারির সাথে সাথে ছোটখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানের খাবার সরবরাহ করাটাও ওদের সার্ভিস, এমনই লিখে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ওরা। তবে তিন মাস পর এই প্রথম ওরা এমন একটি অর্ডার পেয়েছে। পাড়াতেই একটি বাচ্চার জন্মদিনের পার্টি, পঞ্চাশ প্লেট ডিনার ওদের দায়িত্বে।

শ্বশুর শাশুড়ি দেশের বাড়ি ছেড়ে আসবেন না। আর স্বামী মিহির চাকরি করে সেলসে, মাসের মধ্যে আদ্ধেকেরই বেশী সময় বাইরে বাইরে ঘুরে বেরিয়ে কাজ।  পারোমিতারও কলেজ শেষ। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে নেবে করছে।  সারাদিন বাড়িতে বসে বসে ননদ বৌদি চরম বোরডমে আক্রান্ত। সারাক্ষণ ওই ফেসবুক আর টিভি আর শপিং করতে করতে যখন একঘেয়ে অবস্থা, তখন হঠাৎ লোকাল কেবিল টিভির এক চ্যানেলে কিছু না ভেবেই অংশগ্রহণ করেছিল অঙ্গনা আর পারোমিতা। বিষয় ছিল, রোজগেরে গিন্নি। ঘরকন্নার বিভিন্ন কাজ ঝটপট সারতে পারলেই প্রাইজ, মোটা অঙ্কের টাকা। অঙ্গনা-পারোর জুটি অনুষ্ঠানে পায় দ্বিতীয় স্থান। তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কারের সদ্ব্যবহার কীভাবে করা যায়, ভাবতে ভাবতেই "খেয়ে সুখ"এর জন্ম। বরাবরই রান্নার হাত ভালো অঙ্গনার, তার সাথে ছিল পারোর উৎসাহ। এবারে পুরস্কারের টাকাটাকে ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট ধরে অনেক চেষ্টা করে, ফেসবুক পেজ খুলে, লোকাল টিভিটে বিজ্ঞাপন দিয়ে এখন তিন মাস পর ওদের  খাবারের নিয়মিত কাস্টোমারের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এর সাথে সাথে পেল আজকের এই জন্মদিনের পার্টির অর্ডার। যা শুনেছে বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষ নিমন্ত্রিত এই পার্টিতে। আর তাই এটা ভালোয় ভালোয় সামলে দিতে পারলে ওদের ব্যবসার পক্ষে একটা দারুণ বুস্ট হবে।

যত্ন করে শেষ লুচিটা থেকে তেল ঝরিয়ে গামলায় রাখল অঙ্গনা। পারো মাংসটা করছে। বেশ সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে, আর খানিকটা সিদ্ধ হলেই ওপর থেকে একটু গরম মসলা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই রেডি হয়ে যাবে। যাক, তিনটে আইটেম বাকি ছিল, হয়ে এলো। ফ্রিজ থেকে গতকাল রাত্রে বানিয়ে রাখা চালের পায়েসের বাসনটা বের করতে করতে মোবাইলে ফোন এলো।
" হ্যাঁ, মিসেস রায়, অঙ্গনা বলছি।"
" "
" হ্যাঁ, রান্না অলমোস্ট ডান। আমরা এবার প্যাক করে এক ঘন্টার মধ্যে রেডি করে ফেলব। আপনি চিন্তা করবেন না। আটটার মধ্যে ঠিক ঢুকে যাব আপনার ওখানে। "

" হ্যাঁ রে পারো, আর কতক্ষন তোর? "
" এই আর মিনিট পাঁচেক বৌদি। তুমি লুচি আর নাগেটগুলো প্যাক করা শুরু করো। "
" হ্যাঁ, তুই মাংসটা নামিয়ে ফ্যানের তলায় রাখিস। ফুল স্পিডে চালাবি। ঠাণ্ডা না হলে প্যাক করতে পারব না। "
" ঠিক আছে। তুমি করো বাকিগুলো, আমি এদিকটা দেখছি। "
" কে জানে কেমন হয়েছে রান্না। ওদের পছন্দ হলে হয়। জানিস তো খুব টেনশন হচ্ছে আমার। "
" ধুর টেনশনের কিছু নেই। দিব্যি ভালো হয়েছে, টেস্ট করলাম তো। "
" বলছিস? "
" হুম। "
" আচ্ছা বেশ। যা এবার গ্যাসটা অফ কর। হয়ে গিয়েছে মাংস। "
" হ্যাঁ, আমি ফ্যানের তলায় ওটা রেখে এসে তোমায় প্যাকিঙে সাহায্য করতে আসছি। "


চল্লিশ মিনিট পর যখন সুন্দর করে এলুমিনিয়াম ফয়েল আর প্লাস্টিক বক্সে করে পঞ্চাশজনের খাবার প্যাক শেষ হল অবশেষে, অঙ্গনা আর পারোর মুখে বিশ্বজয়ের পরিতৃপ্তি। অঙ্গনা শিল্পী মানুষ, ইচ্ছে হল, রেগুলার কেটারারের থেকে একটু আলাদা হবে। খাবারের সাথে সাথে যোগ করবে একটা কিছু বাড়তি জিনিস। কী করা যায়, কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে টুক করে মাথায় খেলে গেলো একটা আইডিয়া। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কোনমতে হাওয়াই চপ্পলটা পায়ে গলিয়ে ছুটল পাশের স্টেশনারি দোকানে। ঢুকল কিচু চার্ট পেপার আর রঙিন কলম নিয়ে। আর তারপর নিজের ছাপার মতো হাতের লেখায় টুকরো টুকরো কাগজে লিখল,

" ভ্যাপ্সা গরম, তাই বলে কি খাবার খাবেন না?
চেখে তো দেখুন, আমি বলছি, হতাশ হবেন না।
সাদা সাদা ফুলকো লুচি, মাংস ভাজা আর সাথে ফুলকপি,
মাটন আছে, আছে পায়েস, আরো আছে কি কি?
শেষ পাতে আমসত্ত্ব খেজুর কিশমিশের পায়েস।
এবার বলুন, "খেয়ে সুখ", করবেন তো আয়েশ?
যদি হয় পছন্দ,
করবেননা তো দ্বন্দ্ব?
আমরা আছি এই ঠিকানায়,
আসুন একদিন মোদের বাসায়।
"খেয়ে সুখ"।  চৌদ্দর দুই ভূপতি বোস লেন।।
সব রকম অনুষ্ঠানের জন্য অর্ডার নেওয়া হয়।। "


"এগুলো কী করবে বৌদি? "
" প্রত্যেকটা প্যাকের ওপর তুই সাঁটিয়ে দে। "
" লেখাটা ভালো হয়েছে। কিন্তু কী হবে? লোকে তো পড়ে খেয়ে ফেলে দেবে। "
" সে দিক। কিন্তু পড়বে তো। মাথায় খানিক হলেও রেজিস্টার করবে। "
" বলছ? "
" হুম। অ্যাড দেওয়া, আর কিছু না। "
" দাদার থেকে ভালোই সেলস শিখছো। "
" নে রিক্সা এসে গিয়েছে। তুই গিয়ে বোস। আমি এক এক করে প্যাকেটগুলো তুলে দিই। পৌঁছে দিয়ে আসি চল। "
" চলো। অল ইজ ওয়েল! "
"একদম।"

বলাই বাহুল্য, সেদিনের অর্ডার একেবারে সুপারহিট।


তিন মাস পর।

" নমস্কার, খেয়ে সুখ। আপনার রিকয়ারমেন্টস বলুন "
" "
" হ্যাঁ হ্যাঁ। আমরা পঞ্চাশজনের অর্ডার ইজিলি হ্যান্ডল করব। আপনি মেন্যুটা ডিস্কাস করতে বরং আজ চলে আসুন।"
" "
" হ্যাঁ, কাল আসুন তাহলে। বেশী দেরি করবেন না। আমাদের ওইদিনে অন্য বুকিং এসে গেলে কিন্তু আপনারটা আর নিতে পারব না। "

" "
" হ্যাঁ, থ্যাঙ্ক ইয়ু। আসুন। "


"খেয়ে সুখ" এখন পাড়ার গন্ডি ছাড়িয়ে এলাকায় বেশ নাম করেছে। অঙ্গনা আর পারোমিতা এখন দুই "সাক্সেস্ফুল অন্ত্রেপ্রেন্যোর"।