Wednesday, December 20, 2017

বছর শেষের হিসেব নিকেশ

ওরে বাবা, ভাবতেই পারছিনা, এই সেই টুংটাং করে ফোনে মেসেজ ঢুকছিল এত হ্যাপি ন্যু ইয়ার বলে, তারপরে ৩৫৪ দিন শেষ? কী কাণ্ড, এত তাড়াতাড়ি শেষ হল কি করে এই একটা আস্ত বছর, কে জানে বাবা। কত কিছু করব বলে গত বছর এমন সময়ে লম্বা লিস্ট করলাম, তার তো বোধহয় সিকিভাগও পুরণ হয়নি। এখনো রোগা হওয়াটা বাকি। ওজন কমা তো দূর অস্ত, উল্টে কিলো পাঁচেক অন্তত বেড়েছে। (এবার সেটা বুদ্ধি না ফ্যাট, টু বি ভেরি স্পেসিফিক, বার বার কিলো কিলো চকোলেট, সেটা নিয়ে আমার এখনো সন্দেহ আছে যথেষ্ট পরিমাণে।) এখনো একটা পাব্লিকেশন হলো না ফার্স্ট অথরে। (শুনুন, পি এইচ ডি স্টুডেন্ট, তায় ফিফথ ইয়ার চলছে, এই সময়ে এইসব ভাবনা আপনা আপনি না চাইতেই মাথায় আসে।) ম্যানুয়াল মোডে ডি এস এল আর চালানো শিখলাম না (এদিকে যতক্ষণ না কিনছিলাম, ততক্ষণ নিজেকে রঘু রাইয়ের মাস্টার ভাবছিলাম। কিছু কিছু লোককে কচুপোড়া দেখিয়ে একটা পৈশাচিক হাসি হাসতে পারলাম না (ওটা আমার হেব্বি সখ, কী করব)। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স যেমন ছিল, বাড়ে তো নি, বরং আরো কমেছে (গরীব রিসার্চ স্কলার। আমাদের ওইসব পে কমিশন হ্যান কমিশন কিচ্ছু হয় না)। বছর শেষ হচ্ছে ভাবতে বসেই যদি এতগুলো হা পিত্যেশ মাথায়া সে প্রথমে, না জানি ব্যালেন্স শিট বানাতে বসলে কি দাঁড়াবে। না মানে জানি, না পাওয়াগুলো অনেক অনেক বেশী হবে সংখ্যায়। চেষ্টা করি মাস ধরে ধরে একটু হিসেব নিকেশ করার (আমি আদপে একটুও হিসেবী না হলেও...)।

গত বছর শেষ করেছিলাম হাতে ভালো মতো চোট পেয়ে। তাই নতুন বছরকে স্বাগত করি হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে! বেশ বিরক্ত লাগত, হুটহাট লেগে যেত হাতে, ব্যথা পেতাম। তারই মধ্যে পুণা গেলাম কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করতে। আই আই টি তে আসার পর আমার স্বভাবের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। যে আমি কি না এক সপ্তাহ বাকি থাকতে সব পেন্ডিং কাজ সেরে ফেলতাম এক কালে, সেই আমিই কি না আজকাল সব ইলেভেন্থ আওয়ার অবধি মিনিমাম ফেলে রাখি। তা হয়েছে কি, পোস্টার প্রিন্ট করতে গিয়ে যারপরনাই বিচ্ছিরি অবস্থায় পড়েছিলাম। একদম হিসেবের বাইরে ছিল যে তামিল নাড়ুতে পোঙ্গাল রীতিমতো বিরাট উৎসব যখন দোকান পাট সব বন্ধ থাকে।  লাস্ট মোমেন্টে কোনমতে সুপারভাইসারের সাথে কম কারেকশনের রফা করে যা হোক করে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে, আর ছাপানোর সময় পাবো না, ইত্যাদি ইত্যাদি করে কোনমতে তো পোস্টার সহ গেলাম পুণাতে। তা কনফারেন্সে আগেই বলে রেখেছিল যে ওরাল টকের জন্যও প্রস্তুত হয়ে আসতে, বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তেও পারে। আমি কে আমি, এত কনফিডেন্স নিজের ওপর, ধরেই নিলাম। এই তো ভারী কাজ করেছি, নেহাত সরকারি টাকায় দেশভ্রমণ হবে, তাই যাচ্ছি। আমি তো জেতার ধারেকাছেও থাকবনা। তার উপর আবার এরকম জঘন্য ভাবে শেষ মুহূর্তে বানানো পোস্টার। তাই কোনরকম  প্রস্তুতি না নিয়েই এমনিই গিয়েছিলাম। কেলোটা করল কনফারেন্সের তৃতীয় দিন। দুইদিন পোস্টারের পর তারা রেজাল্টে হঠাৎ করেই আমার নাম ঘোষণা করে দিলেন, নাকি টক দিতে হবে। খুব নার্ভাস হয়ে গিয়ে সেই টক তো দিলামও। আবার ভগবান জানেন কি করে, সেখানে আবার প্রথম পুরস্কারও পেয়ে গেলাম। আমার সুপারভাইজার তো শুনে হতবাক, ফোনে জানাতে উনি প্রথম যে কথাটি বলেন, " সে কী? কেউ আদৌ এসছিল তোমার কাজ নিয়ে শুনতে? কি করে জিতলে? যাই হোক, কংগ্র্যাটস।" বছরের শুরুতেই একটা মোক্ষম শিক্ষা পেলাম। বা বলা চলে, নিজের সম্বন্ধে জানলাম। টেনশন না করে কাজ করলে, বেশী এক্সপেক্টেশন না রাখলে অনেক কিছু প্রাপ্তি হয়। এখন পদে পদে তা মানার চেষ্টা করলেও ম্যাক্সিমাম সময়েই মানতে পারিনা। সামান্য কিছুতেই হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায়। তাও যাই হোক, বছর শুরু হল বেশ কাজের স্বীকৃতি পেয়ে। দিব্যি মন খুশি। এক্সট্রা খুশি হলাম তারপর যখন একটা মোটামুটি ভালো জারনালে সেকেন্ড অথরে পেপার বেরোলো মার্চ মাসে। যারা রিসারচের সাথে যুক্ত নন, তাদের বলি। এই পেপার পাব্লিশ করাটা অনেকটা সাধারণের সরকারি চাকরি পাওয়ার মতো বলা চলে। ফার্স্ট অথর মানে ওই আই এ এস, আই এফ এস। আর সেকেন্ড অথর মানে হয়তো স্টেট ব্যাঙ্কের পি ও। নিজে রিসারচার বলে লেখায় মাঝে মাঝে এই প্রসঙ্গ আসতে পারে। আগাম ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
এপ্রিল মাস, আমার জন্ম মাস। আমার ক্যাম্পাসের ভাই বোনদের কথা তো আগে ম্যাড্রাস প্রসঙ্গে লেখায় বলেছি। তা এবার হলো কি, ভাইরা মিলে সব আমার জন্মদিন পালন করল। মাঝরাতে, ক্যাম্পাসের বেশ একদম মধ্যমা জায়গায় আমায় মধ্যমণি করে চলল সেলিব্রেশন। বয়স হচ্ছে, জীবনে কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা। এইসব ভাবতে ভাবতে আমার কেন জানিনা নিজের জন্মদিনটা বড্ড মন খারাপ মন কেমন করা লাগে। জন্মদিনের আগেরদিন থেকেই কেমন অকারণে ডিপ্রেশন হয়। গতবারে বাবা মায়ের সাথে মুন্নারে পালিয়েছিলাম। এইবারে মন খারাপ নিয়ে ছিলাম যে জন্মদিনে মা বাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। তবে ভাইগুলো এক্কেবারে ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করে দারুন সুন্দর করে আমার জন্মদিন পালন করল। সারাদিন বেশ খাওয়াদাওয়া, ছবি তোলা, কেক কাটা, উপহার পাওয়া, সব মিলিয়ে খুব ভালো কেটেছিল। মানে অভাবনীয় ভালোই বলা চলে। প্রবাসে আত্মীয়তা পেলে যা হয় আর কী।
মে মাসটা আমার খুব খারাপ কেটেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু মানুষের সাথে চরম মতানৈক্য হওয়ার ফলে নিজের অত্যন্ত একটা প্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে চিরতরে সরিয়ে নিই। খুব খুব কষ্ট হয়েছিল, বেশ অনেক রাত কেঁদেকেটে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু ওই যে বলে না, অন্ধকারের পরে আলোর উৎস আছেই। সব কিছু ভালোর জন্য হয়। তা আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এই অভিশপ্ত দিনগুলির মন খারাপ করা কাটাতে আমি লেখালিখিতে অনেক অনেক বেশী মনোযোগ দিতে লাগলাম। আগে যেটা সপ্তাহে একটা কি আরো কম লিখতাম, সেই আমি হঠাৎ শুরু করলাম প্রায় রোজ নতুন নতুন লেখার। রসেবশে বলে একটা গ্রুপে লিখতাম। অনেকের ভালোবাসা পেয়েছি। প্রচুর গুণীজনের সান্নিধ্যও পেয়েছিলাম। কিন্তু বাঙ্গালী একসাথে দুইজন থাকলেই অন্তত তিনটে দুর্গাপুজো হয়, বেশিদিন রসেবশেতে থাকতে পারিনি। অর্ণবের হাত ধরে এসছিলাম বছরের মাঝামাঝি আত্মপ্রকাশে। খুচখাচ লিখতে লিখতে তারপরে কখন যে এত আত্মীয় পেয়ে গেলাম, এই বছরের একটা বিরাট প্রাপ্তি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। সেই একই সাথে সাথে এলো আমার নিজস্ব একটি পেজ, সাম্পান। সাম্পান নামে আমার বাবা তাঁর কলেজ জীবনে লিটল ম্যাগাজিন চালাতেন। কয়েকটা সংখ্যাই বেরিয়েছিল। যখন নিজের পেজ বানাই, তাই নাম নিয়ে ভাবতে দুইবারের বেশী চিন্তা করতে হয়নি। বাবার ম্যাগাজিনের লিগ্যাসি চালানোর চেষ্টা করে চলেছি প্রতিনিয়ত। সাম্পান সন্তানসম প্রিয়।

এই করতে করতে এসে গেলো পুজোর কটাদিন। আগের লেখাতেই বলেছি। চেন্নাইতে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার পুজো কাটালাম। একটাবারের জন্যও মনে হয়নি পরিবারের থেকে দূরে আছি। আসলে রক্তের সম্পর্ক দিয়েই তো সব সময় আত্মীয়তা হয় না। মনের টান, প্রাণের টান লাগেই। এটা আমি খুব বিশ্বাস করি। এবং আমার জীবনে এর বহু বহু উদাহরণ। পুজো দারুণ কাটিয়েছি। বিশাল প্রাপ্তিস্বরুপ নতুন করে বানানো এখানে অনেকের সাথে আত্মীয়তা।

"কান্না হাসির দোল দোলানো
পৌষ ফাগুনের পালা।"
এত আনন্দের মধ্যে তারপর হঠাৎ একদিন আমার অতি নিকটাত্মীয়ার অকাল মৃত্যু সংবাদ সাঙ্ঘাতিকভাবে নাড়িয়ে দিলো আমায়। শোকের থেকে নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশী সময় নিতে পারিনি। কারণ সাথে যোগ হয়েছিল বাড়তি কিছু দায়িত্ব, দায়বদ্ধ্বতা, পরিবারের প্রতি।

এই করতে করতে এসে গেলো শীত। মানে মোটামুটি আপনাদের সকলের শীতকাল। আমাদের এখানে অল্প গরম। আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি বেশ কিছু মাস পরে। তারপরে শনিবারে বেড়াতে যাবো রাজস্থান, বাবা মায়ের সাথে। বছর দুই পরে আবার সপরিবারে আমাদের বেরানো। একটা সময়ে বছরে অন্তত দুইবার বেরানো হতোই হত। চেন্নাই আসার পর থেকে সেটা বন্ধ হতেই বসেছিল। তাই এই বেরানো নিয়ে খুব উদ্গ্রীব হয়ে আছি।

এই যে, লিখতে লিখতে বেশ একটা আত্মসমীক্ষণও হয়ে গেল। বছরের শুরুতে যেমন করে কাটাব ভেবেছিলাম, অবশ্যই তা মেলেনি। তাই মিললে বোধহয় জীবন থেকে সারপ্রাইজ এলিমেন্ট চলে যেত। একটা গতে বাঁধা জীবন কাটাতে হত। নিজেকে রোবট মনে হত। বরং এই বেশ ভালো। জীবন প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। যতটা পেরেছি মোকাবিলা করেছি। অনেক অনেক কিছু শেখা বাকি। অনেক কিছু একমপ্লিশ করা বাকি। সামনের বছরের রেজোল্যুশনে সেসব থাকবে। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, সামনের বছর যেন এরকম সময়ে বসে এই বছরের মতই বলতে পারি, ভালো মন্দ মিশিয়ে কাটলেও, মূলত ভালোর ওপর দিয়েই সব গিয়েছে। এইটুকুই আশা। আপনাদের সকলের জন্যও এইটুকুই প্রার্থনা রইলো। আগামী বছর খুব ভালো কাটুক।

No comments:

Post a Comment