Sunday, December 3, 2017

খাইয়ে সুখ

কড়াইতে তেল গরম করতে দিয়ে ঝটপট লুচিগুলো বেলতে লাগল অঙ্গনা। প্রায় দেড়শো লুচি ভাজতে হবে, হাতে সময় খুব কম। সেপ্টেম্বর মাসের ভ্যাপ্সা গরম, এই আদ্যিকালের পুরনো বাড়ির রান্নাঘরটাতে হাওয়া চলাচল প্রায় নেই বলাই চলে, কিন্তু থামার কোন উপায় নেই। ঘামতে জোরে হাত চালাতে থাকে ও। প্রথম লুচিটা তেলে ছাড়তে ছাড়তেই প্রায় ফুলে উঠল, ব্যস, এবারে বাকী সবগুলোও এমন ফুলকো হলে নিশ্চিন্ত হয় অঙ্গনা। পাশের গ্যাসে ফুটতে থাকে ফুলকপি আলুর ডালনাটা। কখনো ওটা নাড়তে থাকে, কখনো লুচির কড়াইয়ে ভাজতে থাকে। সমান তালে চলতে থাকে বেলা।
" বৌদি, আমি বরং তরকারিটা গরম করছি। তুমি লুচি সামলাও। "
" না না পারো, আমি ম্যানেজ করে ফেলব। তুই বরং ততক্ষণে মাংসটা ম্যারিনেট করে রাখ। আমি বলে বলে দিচ্ছি। লুচিটা নামিয়েই মাংসটা ধরতে হবে। "
" আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমায় পর পর বলতে থাকো। "
" ওই তো তোর আন্দাজ মতো মাপ দিস। মোটামুটি মাপ করেই রেখেছি। "
" হ্যাঁ ঠিক আছে। কতটা মাংস আছে? "
" ছয় কিলো রে। নে ওই টক দই আদা রসুন বাটা, নুন হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, পিঁয়াজ বাটা, অল্প করে গরম মসলা গুঁড়ো আর খানিকটা সর্ষের তেল দিয়ে মাখিয়ে রাখ। "
" নুন চিনি? "
" চিনি লাগবে না। নুন ভালো করে খেয়াল রাখিস কতটা দিলি। কষানোর সময় কিন্তু তোকে ডাকব নুনের মাপ বুঝতে। "
" বেশ। "
গরমটা আজ বেশ ভালো মতোই পড়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে টেনশন। অঙ্গনার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী ও না। দায়িত্ব নিয়েছে যখন, ভালো ভাবে কাজটা করতেই হবে। বসু মল্লিক বাড়ির একমাত্র বৌমা, অঙ্গনা আর ওর ননদ, পারোমিতা, মাস তিনেক হল  নিজেদের বাড়ি থেকেই জয়েন্ট ভেঞ্চারে শুরু করেছে ওদের নতুন ব্যবসা, "খেয়ে সুখ"। নিয়মিত কিছু বাড়িতে দুবেলার খাবার ডেলিভারির সাথে সাথে ছোটখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানের খাবার সরবরাহ করাটাও ওদের সার্ভিস, এমনই লিখে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ওরা। তবে তিন মাস পর এই প্রথম ওরা এমন একটি অর্ডার পেয়েছে। পাড়াতেই একটি বাচ্চার জন্মদিনের পার্টি, পঞ্চাশ প্লেট ডিনার ওদের দায়িত্বে।

শ্বশুর শাশুড়ি দেশের বাড়ি ছেড়ে আসবেন না। আর স্বামী মিহির চাকরি করে সেলসে, মাসের মধ্যে আদ্ধেকেরই বেশী সময় বাইরে বাইরে ঘুরে বেরিয়ে কাজ।  পারোমিতারও কলেজ শেষ। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে নেবে করছে।  সারাদিন বাড়িতে বসে বসে ননদ বৌদি চরম বোরডমে আক্রান্ত। সারাক্ষণ ওই ফেসবুক আর টিভি আর শপিং করতে করতে যখন একঘেয়ে অবস্থা, তখন হঠাৎ লোকাল কেবিল টিভির এক চ্যানেলে কিছু না ভেবেই অংশগ্রহণ করেছিল অঙ্গনা আর পারোমিতা। বিষয় ছিল, রোজগেরে গিন্নি। ঘরকন্নার বিভিন্ন কাজ ঝটপট সারতে পারলেই প্রাইজ, মোটা অঙ্কের টাকা। অঙ্গনা-পারোর জুটি অনুষ্ঠানে পায় দ্বিতীয় স্থান। তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কারের সদ্ব্যবহার কীভাবে করা যায়, ভাবতে ভাবতেই "খেয়ে সুখ"এর জন্ম। বরাবরই রান্নার হাত ভালো অঙ্গনার, তার সাথে ছিল পারোর উৎসাহ। এবারে পুরস্কারের টাকাটাকে ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট ধরে অনেক চেষ্টা করে, ফেসবুক পেজ খুলে, লোকাল টিভিটে বিজ্ঞাপন দিয়ে এখন তিন মাস পর ওদের  খাবারের নিয়মিত কাস্টোমারের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এর সাথে সাথে পেল আজকের এই জন্মদিনের পার্টির অর্ডার। যা শুনেছে বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষ নিমন্ত্রিত এই পার্টিতে। আর তাই এটা ভালোয় ভালোয় সামলে দিতে পারলে ওদের ব্যবসার পক্ষে একটা দারুণ বুস্ট হবে।

যত্ন করে শেষ লুচিটা থেকে তেল ঝরিয়ে গামলায় রাখল অঙ্গনা। পারো মাংসটা করছে। বেশ সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে, আর খানিকটা সিদ্ধ হলেই ওপর থেকে একটু গরম মসলা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই রেডি হয়ে যাবে। যাক, তিনটে আইটেম বাকি ছিল, হয়ে এলো। ফ্রিজ থেকে গতকাল রাত্রে বানিয়ে রাখা চালের পায়েসের বাসনটা বের করতে করতে মোবাইলে ফোন এলো।
" হ্যাঁ, মিসেস রায়, অঙ্গনা বলছি।"
" "
" হ্যাঁ, রান্না অলমোস্ট ডান। আমরা এবার প্যাক করে এক ঘন্টার মধ্যে রেডি করে ফেলব। আপনি চিন্তা করবেন না। আটটার মধ্যে ঠিক ঢুকে যাব আপনার ওখানে। "

" হ্যাঁ রে পারো, আর কতক্ষন তোর? "
" এই আর মিনিট পাঁচেক বৌদি। তুমি লুচি আর নাগেটগুলো প্যাক করা শুরু করো। "
" হ্যাঁ, তুই মাংসটা নামিয়ে ফ্যানের তলায় রাখিস। ফুল স্পিডে চালাবি। ঠাণ্ডা না হলে প্যাক করতে পারব না। "
" ঠিক আছে। তুমি করো বাকিগুলো, আমি এদিকটা দেখছি। "
" কে জানে কেমন হয়েছে রান্না। ওদের পছন্দ হলে হয়। জানিস তো খুব টেনশন হচ্ছে আমার। "
" ধুর টেনশনের কিছু নেই। দিব্যি ভালো হয়েছে, টেস্ট করলাম তো। "
" বলছিস? "
" হুম। "
" আচ্ছা বেশ। যা এবার গ্যাসটা অফ কর। হয়ে গিয়েছে মাংস। "
" হ্যাঁ, আমি ফ্যানের তলায় ওটা রেখে এসে তোমায় প্যাকিঙে সাহায্য করতে আসছি। "


চল্লিশ মিনিট পর যখন সুন্দর করে এলুমিনিয়াম ফয়েল আর প্লাস্টিক বক্সে করে পঞ্চাশজনের খাবার প্যাক শেষ হল অবশেষে, অঙ্গনা আর পারোর মুখে বিশ্বজয়ের পরিতৃপ্তি। অঙ্গনা শিল্পী মানুষ, ইচ্ছে হল, রেগুলার কেটারারের থেকে একটু আলাদা হবে। খাবারের সাথে সাথে যোগ করবে একটা কিছু বাড়তি জিনিস। কী করা যায়, কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে টুক করে মাথায় খেলে গেলো একটা আইডিয়া। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কোনমতে হাওয়াই চপ্পলটা পায়ে গলিয়ে ছুটল পাশের স্টেশনারি দোকানে। ঢুকল কিচু চার্ট পেপার আর রঙিন কলম নিয়ে। আর তারপর নিজের ছাপার মতো হাতের লেখায় টুকরো টুকরো কাগজে লিখল,

" ভ্যাপ্সা গরম, তাই বলে কি খাবার খাবেন না?
চেখে তো দেখুন, আমি বলছি, হতাশ হবেন না।
সাদা সাদা ফুলকো লুচি, মাংস ভাজা আর সাথে ফুলকপি,
মাটন আছে, আছে পায়েস, আরো আছে কি কি?
শেষ পাতে আমসত্ত্ব খেজুর কিশমিশের পায়েস।
এবার বলুন, "খেয়ে সুখ", করবেন তো আয়েশ?
যদি হয় পছন্দ,
করবেননা তো দ্বন্দ্ব?
আমরা আছি এই ঠিকানায়,
আসুন একদিন মোদের বাসায়।
"খেয়ে সুখ"।  চৌদ্দর দুই ভূপতি বোস লেন।।
সব রকম অনুষ্ঠানের জন্য অর্ডার নেওয়া হয়।। "


"এগুলো কী করবে বৌদি? "
" প্রত্যেকটা প্যাকের ওপর তুই সাঁটিয়ে দে। "
" লেখাটা ভালো হয়েছে। কিন্তু কী হবে? লোকে তো পড়ে খেয়ে ফেলে দেবে। "
" সে দিক। কিন্তু পড়বে তো। মাথায় খানিক হলেও রেজিস্টার করবে। "
" বলছ? "
" হুম। অ্যাড দেওয়া, আর কিছু না। "
" দাদার থেকে ভালোই সেলস শিখছো। "
" নে রিক্সা এসে গিয়েছে। তুই গিয়ে বোস। আমি এক এক করে প্যাকেটগুলো তুলে দিই। পৌঁছে দিয়ে আসি চল। "
" চলো। অল ইজ ওয়েল! "
"একদম।"

বলাই বাহুল্য, সেদিনের অর্ডার একেবারে সুপারহিট।


তিন মাস পর।

" নমস্কার, খেয়ে সুখ। আপনার রিকয়ারমেন্টস বলুন "
" "
" হ্যাঁ হ্যাঁ। আমরা পঞ্চাশজনের অর্ডার ইজিলি হ্যান্ডল করব। আপনি মেন্যুটা ডিস্কাস করতে বরং আজ চলে আসুন।"
" "
" হ্যাঁ, কাল আসুন তাহলে। বেশী দেরি করবেন না। আমাদের ওইদিনে অন্য বুকিং এসে গেলে কিন্তু আপনারটা আর নিতে পারব না। "

" "
" হ্যাঁ, থ্যাঙ্ক ইয়ু। আসুন। "


"খেয়ে সুখ" এখন পাড়ার গন্ডি ছাড়িয়ে এলাকায় বেশ নাম করেছে। অঙ্গনা আর পারোমিতা এখন দুই "সাক্সেস্ফুল অন্ত্রেপ্রেন্যোর"।




No comments:

Post a Comment