আজ কপালটা ভালো বলতে হয়, স্টপে আসতে না আসতেই ২৩৪/১টা ঠিক পেয়ে গেলো তিতির। আর কী সৌভাগ্য, লেডিজ সীট সব ফাঁকা। ভেবেচিন্তে টু-সিটারে জানলার ধারটাতে এসে বসল ও। এই কাঠের বাসগুলির একটাই সমস্যা, যতই ছোটবেলার নস্টালজিয়া মাখা থাকুক না কেনো, জানলার ধার বড্ড কম। যাই হোক, আজ অন্তত আমহারস্ট স্ট্রিট থেকে গলফগ্রীন এবার ঘন্টা খানেকের জন্য কানে ইয়ারফোন গুঁজে বেশ আনন্দেই কাটানো যাবে। সারাদিন ইয়ুনিভারসিটিতে হাজার একটা টেনশান, কাজের প্রেশার সব মিলিয়ে বেশ নাস্তানুবুদ অবস্থা হয় তিতিরের। তারপর বাড়ি ফিরেই রান্নাঘরে ছোটো। রিসার্চ করে দেশ উদ্ধার করো আর যাই করো, বাড়ির বৌ হয়ে এসছো, সন্ধ্যে হলে রান্নাঘরে শাশুড়ির সাথে সাথে থাকতে হবে, এটাই বাড়ির নিদান। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো তিতিরের। মা বাবার কাছে থাকাকালীন বাস পেয়েই মাকে জানিয়ে রাখলেই বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই হাতে পছন্দের রুহ আফজার গেলাসটা ঠিক পেয়ে যেতো। তারপরে তিনজনে মিলে চলত চা জলখাবার সহযোগে টিভি চালিয়ে রাজ্যের গল্প করা। পি এইচ ডি শেষ না করে বিয়ে করার এক্টুও ইচ্ছা ছিল না ওর। ল্যাবের কাজরীদিকে ল্যাজেগোবরে হতে দেখেই এমনটা ভেবেছিল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। পিসিমণির আনা "হীরের টুকরো" ছেলেকে হাতছাড়া করা উচিৎ না বলে গত মাঘেই সায়নের সাথে তিতিরের বিয়েটা হয়ে গেলো। হ্যাঁ, সায়ন হীরের টুকরোই বটে। বরাবর স্কুলের টপার। রামকৃষ্ণ মিশন, আই আই টি বম্বে, জার্মানি থেকে স্কুল, বিটেক, মাস্টারস আর পি এইচ ডি করে এখন এন আই টি দুর্গাপুরে পড়ায়। শুক্রবার সন্ধ্যের বাস ধরে কলকাতা আসে, আবার সোমবার সক্কাল হতে না হতেই ফেরত চলে যায়। উইকেন্ডের দাম্পত্যটুকু বেশ চলে। সারা সপ্তাহের জমানো ভালোবাসা, আদর, সব ওই দুটো দিনেই লুটেপুটে নেয় দুজনেই। কিন্তু তারপরে সারা সপ্তাহের বিরহ। শ্বশুর শাশুড়ি টিভি সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তিতিরের সাথে তেমনভাবে দুটো কথা বলারও কেউ নেই। পি এইচ ডিটা শেষ হলে ও ও চেষ্টা করবে দুর্গাপুরে চাকরির। সোজা না, তাও।
পি এইচ ডির ফিফথ ইয়ার চলছে, থিসিস লেখা শুরু করবে করবেও হচ্ছেনা, ল্যাবে গাইডের মুখ ঝামটা, এক্সপেরিমেন্ট ফেল করার যন্ত্রণা, কাজ করতে করতে দেরি হয়ে গেলে বাড়ি এসে শাশুড়ির বাংলার পাঁচের মতো মুখ, সব মিলিয়ে যে থমথমে পরিবেশের মধ্যে আজকাল কাটে তিতিরের, তার মধ্যে যেন এক ঝাঁক ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো কাটে এই বাসের জার্নিটা। গান শুনতে শুনতে কখনো কখনো পাশে সহযাত্রী না থাকলে গুনগুন করেও ওঠে ও। আজও তাই করছিল, এমন সময় বাসটা হাজরার মোড়ে থামতে হন্তদন্ত হয়ে উঠল যে, তাকে দেখে এক ধাক্কায় তিতির পিছিয়ে গেলো অনেকগুলো বছর।
২।
সালটা ২০০৪। সবে মাধ্যমিক দিয়েছে। এখনো রেজাল্ট বেরোয়নি। কিন্তু ট্যুশন ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তিতির আর ওর স্কুলের বান্ধবী সোহিনী সাদারন এভিন্যুতে অঙ্ক করতে আসে দিলীপ স্যারের ক্লাসে। ক্লাসের দ্বিতীয় দিন সেখানে এলো রোহিত। বালিগঞ্জ গভরমেন্ট স্কুলের টপার। কী শান্তশিষ্ট নিরীহ ছেলেটি। প্রথম দেখাতেই এক্কেবারে লাট্টুর মতো অবস্থা হয়ে যায় তিতিরের। একটু বড় মাথা (ঠিক যেমন পাথফাইন্ডারের ব্রোশ্যারগুলোতে টপারদের ছবিতে হয়), চৌকো সরু ফ্রেমের চশমা নাকের ডগার ওপর খালি এসে এসে পড়ে। তেমন ভাবে কারুর সাথে মিশত না শুরুর দিকে, শুধু নিজের স্কুলের দুই তিনজন ছাড়া। তবে আস্তে আস্তে সোহিনীর পাল্লায় পড়ে ওরা সবাই ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। সোহিনী, তিতির, রোহিত, সৌম্য, ত্রিদিব। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর তিতির আর রোহিত দুজনে ওদের অঙ্ক ক্লাসের সবার মধ্যে টপ করায় পাঁচজনে মিলে সেলিব্রেট করতে বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা খেতে গিয়েছিল।
ক্লাস চলতে লাগল ক্লাসে মতো। সারডস ইন্ডিসেসের সাথে সাথে তখন তিতির একই সাথে "রাধার কি হইল পূর্বরাগ" সিন্ড্রোমেও আক্রান্ত। লাজুক ছেলে রোহিত, যে কিনা রেজাল্টের দিন "সাকসেস" লেখা টিশার্ট পড়ে এসেছিল আর তারপর হ্যান্ডশেক করে তিতিরকে "কনগ্রাটস, আমি ৭৩০, তুমি?" বলেছিল বলে বাড়ি ফিরে দিদির সাথে কী হাসিটাই না হেসেছিল তিতির, সেই মেয়ে গিয়ে পড়ল এই ছেলেরই প্রেমে। তারপর আর কী, প্রতি ক্লাসে হাঁ করে রোহিতের দিকে তাকিয়ে থাকা, তারপরে ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে সটান প্রিয় বান্ধবী রাকাকে ফোন করে, "উফ, আজ কী দারুণ লাগছিল রে। বটল গ্রিন টিশার্ট, বেইজ কালারের প্যান্টে, ওরে না রে"র বন্যা বয়ে যেত। তবে ব্যাপারটা যে ছিল সম্পূরণভাবেই একতরফা, তা বুঝতে বেশিদিন লাগেনি তিতিরের। ইলেভেনের পুজোর ছুটির পরে পরেই সোহিনীর কথায় শুধু কনফার্মেশনটি পেয়েছিল। হ্যাঁ, রোহিত ভালোবাসে সোহিনীকে। প্রোপোজ করেছিল ওকে পুজোয়, ম্যাডক্স স্কোয়ারে গিয়ে। তিন রাত্তির কেঁদে কেটে ঘুমোতেই পারেনি প্রায় তিতির, ফোঁপাতে ফোঁপাতে রাকার কাছে সান্ত্বনা বাণী শুনেছে কত। তারপর আস্তে আস্তে দিন কেটেছে। ইলেভেন থেকে ট্যুএল্ভ, উচ্চ মাধ্যমিক, জয়েন্ট, বি এস সিতে প্রেসিডেন্সি, মাস্টার্সে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। সেই সব গন্ডি পেরিয়ে তিতির এখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কেমিস্ট্রিতে পি এইচ ডি ফাইনাল ইয়ার। সাথে সাথে ডঃ সায়ন চক্রবর্তীর প্রেমে ভরপুর আদুরে স্ত্রী।
৩।
রোহিতের সাথে আজ এক ভদ্রমহিলা, স্ত্রী কিনা জানা নেই। সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই বলে তিতির আর যোগাযোগ রেখে ওঠেনি রোহিতের সাথে। এতগুলো বছর পরেও অবশ্য তাও ওকে চিনে নিতে অসুবিধে হলো না। সেই একইরকম রয়েছে, শুধু বয়সের সাথে সাথে মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হয়েছে। আজও পড়েছে সেই বটল গ্রিন রঙেরই একটা শার্ট আর ক্রিম কালারের প্যান্ট। চোখের চশমার ফ্রেমটা একটু মোটা হয়েছে। আর সামনের দিকের চুল অল্প পাতলা হওয়ার দিকে।
বাসে ইতিমধ্যে ভিড় হয়েছে, রোহিত ও মেয়েটি সামনের দিকে দাঁড়িয়েছিল। বাস যখন টালিগঞ্জ থানা পৌঁছল, দেখল, রোহিত বসার জায়গা পেয়েছে, সামনের দিকে সিনিয়র সিটিজেনের সিটে। তিতির একবার ভাবল, কথা বলবে না কি? কিন্ত অদ্ভুত ভাবে বেশিক্ষণ এই দোলাচলটা টিকল না, আনোয়ার শার মোড়ে পৌঁছতেই তিতির উঠে গেল সামনের দিকে।
" আরে রোহিত না? কেমন আছিস বল।"
মুহূর্তের জন্য কি রোহিত ভ্যাবাচ্যাকা খেলো? খেলেও খুব দক্ষতার সাথে মেকআপ দিয়ে উত্তর দিল, " তিতির যে! ভালো। তুই কেমন আছিস? এদিকে কোথায়?"
ভাগ্যিস লরডসের মোড় অবধি তারপর বাসটা লম্বা জ্যামে পড়ল। দুই বন্ধুতে চলল কত পুরনো স্মৃতি রোমন্থন। রোহিত এখন একটি সরকারি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, মাস তিনেক আগে বিয়ে হয়েছে। ওর স্ত্রী সুকন্যা একটি বেসরকারি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। ওরা থাকে ভবানীপুরেই, সুনন্দার বাপের বাড়ি লেক গারডেন্স যাচ্ছিল। ভাগ্যিস কোন ক্যাব পায়নি সেদিন, তাই তো বাসে উঠতে হল আর দেখা হয়ে গেলো। নামার আগে নম্বর এক্সেঞ্জ করতে ভুলল না কেউই।
ওরা নেমে যাওয়ার পর তিতির ওদের দুজনকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। ভারী মিষ্টি মেয়ে সুনন্দা। রোহিতের সাথে খুব মানিয়েছে। সোহিনীকে জানাতে হবে ওদের সাথে দেখা হয়েছে যে। সোহিনী এখন বুদ্ধর সাথে হ্যাপিলি ম্যারিড, ইয়ু কে তে থাকে। একটা সময়ে যে রোহিতের সাথে কথা বলতে বুকের মধ্যে দুরুদুরু করত, যার জন্য সোহিনীর সাথে বন্ধুত্ত্বের ভাঙ্গন ধরেছিল, আজ একটুও তো কিছু হল না। না বাজল ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন, না হাত পা ঠান্ডা হল। দিন আসে, দিন যায়। সময়ের সাথে সাথে কেমন সব সমীকরণ পাল্টে গিয়েছে, ভাবলেও হাসি পায়।
নিজের নির্ধারিত স্টপে নেমে আবার আজ ডিনারে কী রাঁধতে হবে, পটলের ডালনা নাকি বর্বটির চচ্চড়ি ভাবতে ভাবতে তিতির ফ্ল্যাটের বেল বাজালো। পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় আজ মন ভালো, চোখে মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে আছে। যদিও চাবি নিয়ে বেরোয়, তাও বাড়ির ভিতর থেকে টিভির আওয়াজ পেয়ে আর তা বের করেনি। তবে একটু অবাক লাগল ওর, ঘর অন্ধকার। মিনিট তিনেক অপেক্ষার পর দরজা খুলতে সায়নকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেল তিতির।
" এ কী, তুমি?"
" কী? সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম বলো? "
" তার মানে আমি ল্যাব থেকে বেরিয়ে যখন ফোন করলাম, তখন তুমি এখানেই? "
" আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি তখন তোমার জন্য ডিনার বানাচ্ছিলাম। "
" ডিনার? মা বাবা কোথায়? "
" ওরা দিভাইয়ের ওখানে গিয়েছে। এক সপ্তাহ থেকে ফিরবে। আর তাই আমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসছি। আমার বউটার সাথে একটু সংসার সংসার খেলতে। "
" মা বাবা তার মানে এইসব জানতো? "
" তোমার মা বাবাও। সবাই জানে, এক্সেপ্ট ইয়ু।"
" হায় কপাল। পুরো ভেব্লু হয়ে গেলাম? "
" তা ভেব্লু সুন্দরী, মাঝে মাঝে এমনটা হওয়া ভালো কিন্তু। থিসিস লেখা তাড়াতাড়ি শুরু করো। তার আগে রসদ জোগাতে এলাম। "
গ্লাসে করে শরবৎ এনে তিতিরের হাতে ধরাতে ধরাতে সায়ন বলল, " তা তোমায় আজ যে বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছিল। আই হোল দিয়ে দেখলাম। এই যে অন্যদিন মুখ ব্যাজার করে বাড়ি আসো, আজ কী ব্যাপার? আমি আসছি, টের পেয়েছিলে নাকি?"
" আরে তা না। আজ বাসে অনেক বছর পর রোহিতের সাথে দেখা হল গো। তাই। "
" রোহিত? সে আবার কে? আমার সতান? "
" সতান আবার কী শব্দ? "
" ওই শয়তান আর সতীন মিলিয়ে একটা বানিয়ে ফেল্লুম! "
" ধ্যাত। রোহিত মোটেই শয়তান না। "
" তাহলে অন্তত মেল সতীন?"
" উফ। হিংসুটে কোথাকার। "
" আহা, একেই আমার বউটা আমার থেকে এত দূরে থাকে, এমনিতেই আমি কমপ্লেক্সে ভুগি। বিরহে থাকি। হুঠহাঠ এমন ফিল্মি নামধাম শুনলে ভিরমি খাব না? "
" আরে বাবা।বলছি ওর গল্প পরে। আগে বলো কী খাওয়াবে ডিনারে? ভেরি হাংরি! "
" চিজ চিকেন অগ্রাতা।"
"ওয়াও! চিইইইইইইজ।"
" হ্যাঁ, আরো খাও। আর আরো ভেব্লু হও।" বলতে বলতেই দুজনেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল সোফায়।
সায়ন আর তিতিরের হঠাৎ পাওয়া এই দাম্পত্যের শুরুটা সেদিন নেহাৎ চিজি রোমান্টিক ভাবেই শুরু হল।
"আমার অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে " - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
No comments:
Post a Comment