- হ্যালো?
- মিতু কী করছিস বাবু?
- সকাল সকাল কী করব বলো? এই তো ক্যাম্পে বসে আছি।
- এখনো কোন পেশেন্ট আসেনি?
- এসছে তো, ওই তিন চার জন।
- কতক্ষণ চলবে?
- বিকেল পাঁচটা অবধি।
- সবে এগারোটা বাজে। বলছি ব্রেকফাস্ট করেছিস?
- না, সময় হয়নি।
- সে কী? কতবার বলব ব্রেকফাস্ট স্কিপ করবি না?
- উফ মা, সময় পাইনি বলছি তো।
- সময় পাইনিটা কোন কথা হল? শরীর খারাপ হয় জানিস?
- মা পাঁচ বছর ধরে কষ্ট করে ডাক্তারিটা না আমি পাস করেছি মা, তুমি না। তাই প্লীজ আমার ব্যাপারটা আমায় বুঝতে দাও।
- ধুর বাবা, ভালো লাগেনা। তোকে কিছু বলতে গেলেই এমনভাবে রিএক্ট করিস আমার ভীষণ খারাপ লাগে।
- বলতে আসোই বা কেনো বলো তো? কাজের সময় ফোন করে জ্ঞান দিতে এলে আমি কিভাবে উত্তর দেবো?
- ছাড়। আমি রাখছি।
- হ্যাঁ রাখো।
মনটা তেতো হয়ে গেলো মিতু, অর্থাৎ ডঃ মিতালি দাসশর্মার। একেই কাল রাত্তির থেকে হবু বর সুপ্রিয়র সাথে এক প্রস্থ ঝগড়া চলছে। মিতু ওর ফাইনাল ইয়ার থেকে একটি এন জি ওর সাথে যুক্ত। দুই মাস অন্তর অন্তর ও তাদের সাথে আসে সাঁওতাল পরগণার এই ছোট গ্রামে। স্থানীয় মানুষজনের চিকিৎসার জন্য। বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় থেকেই সুপ্রিয় জানে এই ব্যাপারটা, শুরুতে এই নিয়ে কোনরকম মনোমালিন্য হয়নি। কিন্তু ইদানীং মিতু দেখছে, বিয়ে যত এগিয় আসছে, সুপ্রিয়র যেন দুই চোখের বিষ হয়ে উঠছে মিতুর এই ক্যাম্প। কাল রাত্রে অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটির পর দুজনেই পরেরদিন কাজ আছে এই অজুহাতে ঝগড়া স্থগিত রেখেছে, তাই মুড অফ। এর মধ্যে মায়ের ফোন আসায় বেচারির উপর চোটপাট করে দিল। কিই বা করে মিতু, এই নিয়ে সকাল থেকে দুবার ফোন, পাঁচবার মেসেজ হয়ে গিয়েছে মায়ের সাথে, তারপরেও বার বার ফোন এলে বিরক্ত হবে না? এক কথা শুনতে ভালো লাগে? ও নিজেও জানে, ব্রেকফাস্ট মিস করা খারাপ। কিন্তু মুড ভালো নেই। ইচ্ছে করছেনা। জোর করে খাবে নাকি? মা যেন কিচ্ছু বুঝতে চায় না। ধুর, পেশেন্টও আসছেনা কোন।
নিজের মেকশিফট চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাইরেটা দেখল মিতু। আশেপাশে তেমন লোকজন নেই ক্যাম্পের ওরা কয়েকজন ছাড়া। রাঙ্গারও দেখা নেই।
প্রতিবার ও যখন ক্যাম্পে আসে, রাঙ্গা আর ওর ছেলে বিশু এসে ওর সাথে দেখা করে যায়। পুলের পাশেই ওদের ঘর। গত বর্ষায় কোন বিষাক্ত পোকার কামড় খেয়ে বিশুর অবস্থা যায় যায় প্রায়। রাঙ্গা কাঁদতে কাঁদতে প্রায় হাতে পায়ে ধরে ক্যাম্প থেকে মিতুকে নিয়ে যায় ওদের ঘরে। প্রাথমিক চিকিৎসা করে তারপর এম্ব্যুলেন্স করে সদর হাসপাতালে গিয়ে বিশুর চিকিৎসা চলে দুদিন। পুরোপুরি যতক্ষণ ও সুস্থ না হয়, মিতু ওখানেই ছিল। তারপর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বিশুকে আর রাঙ্গাকে ওদের ঘরে পৌঁছে ওর ছুটি হয়েছিল। সেই থেকে রাঙ্গা আর বিশু প্রতিবার এসে ওদের ডাক্তার দিদির সাথে দেখা করে যায় ক্যাম্প বসলেই। বড় ভালো লাগে এই গ্রামের মানুষগুলোকে মিতুর, কী সরল, কী ভালো। শহুরে আধুনিকতা যতদিন না ওদের ছুঁতে পারে, ততদিনই ওদের মঙ্গল। নইলে তো সেই সব একেকটা স্বার্থপর জীব হবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই মিতু দেখল দূরে হলুদ শাড়ী পরে রাঙ্গা। সাথে হাত ধরে দৌড়তে দৌড়তে আসছে বিশু।
- ও দিদি, কেমন আছো?
- ভালো রাঙ্গা। তুমি? এই বিশু কেমন আছিস?
- ভালো পিসি।
- তোমাদের আজ দেরি হল? আমি ভাবছিলাম এখনো আসলে না কেন?
- আজ বিশুর ইস্কুলে ডেকেছিল। ওখান হতে এলাম।
- কেন রে বিশু? লেখাপড়া করছিস না নাকি?
- না পিসি। আমি ফার্স্ট হয়েছি ক্লাসে। তাই মা কে ডেকে বলল।
- বাহ! খুব ভালো। দাঁড়া, তোকে কী দিই?
- কিচ্ছু দিয়োনি দিদি। ছেলেটা খুব বদমাশ হচ্ছে।
- কেন রাঙ্গা?
- কোন কথা শোনেনা। সকাল থেকে জানো খায়নি কিচ্ছু। না খেয়ে ইস্কুলে পালায়, খেলবে বলে। তুমি ওকে একটু বকে দাও না দিদি।
মনে পড়ে গেল মায়ের কথা। মায়েদের চিন্তা বোধহয় স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে এক থাকে। সাঁওতাল পল্লীর অশিক্ষিত রাঙ্গা হোক কী দক্ষিণ কলকাতার নামী কলেজের প্রিন্সিপাল মলয়া, নিজের সন্তানের সুস্বাস্থ্য ছাড়া মায়েদের জীবনে বোধহয় আর কিচ্ছু বড় না। হঠাৎই তাই সকাল বেলা মায়ের ওপর চোটপাট করার জন্য একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল মিতুর। চেম্বার থেকে নিজের হাতব্যাগটা এনে, সেখান থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে বিশুকে দিতে দিতে বলল, " এই বিশু পাগল, আমি যেন পরেরবার এসে মায়ের কাছে তোর নামে কোন নালিশ না শুনি। ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া করবি। মা কে জ্বালাতন করলেই শহরে নিয়ে যাব। বুঝবি ঠ্যালা তখন! "
শহরের নামেই বিশুর গায়ে জ্বর আসে, আর তাই এইবারে যে মোক্ষম ডোজটা পড়েছে, বুঝল মিতু। " যা বাড়ি গিয়ে স্নান করে শিগগিরি খা কিছু। রাঙ্গা নিয়ে যাও ওকে। ভালো থেকো। "
" দিদি তুমিও ভালো থেকো। আবার এসো।"
মিতুর চোখের সামনে দিয়ে মায়ের হাতে বিস্কুটের প্যাকেটটা দিয়ে, মুখে একটা পুরে, তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে চলল আট বছরের বিশু, এক হাতে মায়ের হাত শক্ত করে জাপ্টে ধরে; এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর তো দুটো হয় না। এই বোধও হয়তো দেশ কাল সবকিছুর বাধা ছাড়িয়ে যায় এসে যায় মানব মনে। চোখের কোণের জল রুমালে মুছে মিতু চলল ফোন বের করতে। মা কে একটা সরি বলতেই হবে, এখুনি।
No comments:
Post a Comment