Sunday, November 26, 2017

রুক্মিনীর কথা।

কিছুতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাজটুকু পছন্দ হচ্ছেনা তিতিরের। অর্ঘ্যর অফিস পার্টি, বেশ কিছু বছর পরে যাচ্ছে তিতির। অর্ঘ্য বসুর এই অফিসে সাম্প্রতিক এক বিশেষ ডিল ক্র্যাক করা উদযাপন করতে এই সারপ্রাইজ পার্টি, তাই মিসেস বসুকে অবশ্য করেই যেতে হচ্ছে। ফিটফাট হয়ে না গেলে ওই রাগারাগি করবে, অন্তত আগে তাই হত। কেন লাল কালো সিল্ক পড়েছে, কমলা নীল পড়েনি থেকে শুরু করে কেন সোনার গয়না পড়েছে যেখানে তখন হাল ফ্যাশনের কস্ট্যুম জ্যুয়েলারি পড়ে পার্টি মাতায় অর্ঘ্যর সব ফিমেল কলিগরা ও বন্ধুদের সঙ্গিনীরা, সেই নিয়ে চলত বিস্তর রাগারাগি, মন কষাকষি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে অনেকখানি। তবুও আজ তিতিরের খুব ইচ্ছে করছে এমনভাবে সাজতে যেন রাজরাণী লাগে ওকে। সারা সকাল দুপুর ধরে আলমারি থেকে কাপড় বের করে গায়ে ফেলে ফেলে দেখে অবশেষে পছন্দ করেছে লাল রেশমের শাড়ীটি। খুব স্পেশ্যাল এইটা ওর কাছে। অর্ঘ্য পাটিয়ালা থেকে এনেছিল ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে। অসম্ভব সুন্দর দেখতে শাড়ীটি পেয়ে তিতিরের সে কী আনন্দ। অর্ঘ্যর এস্থেটিক সেন্স বরাবরই চমৎকার। সেই ছিল বিয়ের পরে অর্ঘ্যর প্রথম অফিস ট্যুরে যাওয়া, বছরে এক থেকে দুইবারের ট্যুরগুলো থেকে ফিরত যখন, প্রত্যেকবার তিতিরের জন্য আসত বাহারি উপহার।  এখন ট্যুরের সংখ্যা মাসে একাধিক হলেও উপহারের ঝুলি শূন্য। প্রথম যৌবনের প্রেম বুঝি এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে, আর তাই কমতে কমতে এখন তলানিতে ঠেকেছে তার উচ্ছ্বাস, বহিঃপ্রকাশ।

ছটা নাগাদ উবার ডেকে চৌরঙ্গীর অফিসের দিকে রওনা দিল তিতির। কথামতো মিঃ চক্রবর্তী ওকে রিসিভ করে নিয়ে গেলেন স্টেজের পিছনের ঘরে। বললেন খানিক অপেক্ষা করতে। অনুষ্ঠান শুরু হলেই ডেকে নিয়ে যাবেন। তিতির বুঝল ওকে গ্রিন্রুমে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, বেশ কিছু ছেলে মেয়েকে দেখল অনুষ্ঠানের আগের ফাইনাল টাচ আপ করছে।

"ও হ্যালো, আপনি নিশ্চয়ই মিসেস বসু? আমি অন্তরা, অন্তরা সিংহ।" তিতির মন দিয়ে একটি মেয়ের খোঁপা বাঁধা দেখছিল। আজ অবধি হাজার চেষ্টা করেও কোন হেয়ারস্টাইল ঠিক করে করতে পারেনি। সাজগোজ, কিচ্ছুটি পারেনা। চমকে উঠল ও অন্তরার কন্ঠস্বরে।
"আমি অর্ঘ্যর পার্টনার। আরে? চমকে গেলেন যে? পার্টনার বলতে, এই ডিভিশনে আমিও সেম পোস্ট হোল্ড করি। আমরা একসাথেই হ্যান্ডল করি সব।"
" ও আচ্ছা। নমস্কার। আমি মণিকর্ণিকা বসু।"
" বাহ! কী সুন্দর নাম তোমার। এই যাহ্‌, দেখুন তুমি করে বলে ফেললাম। সো সরি। আসলে অর্ঘ্যর সাথে আমার সম্পর্কটা এমনই ক্লোজ যে..."
" কোন ব্যাপার না। নিশ্চিন্তে তুমি বলুন।"
" মণি, তুমি বসো। আমি একটু অর্ঘ্যকে দেখে আসি। ওকে এখানে আনার দায়িত্ব তো আমায়ই দিয়েছে চক্রবর্তীদা। তোমার সাথে পরে কথা বলছি। এমন মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি, ভালো করে আলাপ করতে হবে।"
তিতির হাল্কা হাসি হেসে প্রতিনমস্কার করল অন্তরাকে। অন্তরা সিংহ, নামটা খুব চেনা ওর। অর্ঘ্যর ফোনে বহুবার দেখেছে এই নাম। খেতে বসে, টিভি দেখতে গিয়ে, স্পেন্সারসে শাক সবজি বাছতে গিয়ে, যখনই ফোনে এই নামটি দেখেছে, অর্ঘ্য, "ইয়ু ক্যারি অন। দিস উইল টেক সাম টাইম" বলে সরে গিয়েছে। ড্রউইং রুমে বসে বারান্দা থেকে ভেসে আসা হাসির উচ্ছ্বাস, "ও স্যুইটহার্ট, স্টপ ফিলিং ডাউন, লেটস হ্যাভ আ ড্রিঙ্ক টুনাইট", এসবই তাহলে এই রমণীর জন্য। আচ্ছা, কী এমন আছে ওর মধ্যে যা তিতিরের নেই? কেন আজকাল আর ওদের বিবাহিত জীবনে সেই আগের মতো ভালোবাসা নেই? সবকিছুই কেন অভ্যেসে এসে ঠেকেছে?

" ম্যাডাম, সো সরি। আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। অর্ঘ্যর আসতে আরেকটু দেরি আছে। অন্তরা গিয়েছে ওকে ডাকতে। হঠাৎ কিছু লাস্ট মোমেন্ট ডিস্কাশান মনে পড়েছে ওর, খানিক বাদে আসছে। অন্তরা আমায় মেসেজ করে জানালো। আপনার জন্য কফি বলি?"
" না না। ঠিক আছে। অসুবিধে নেই। "
" তাহলে চলুন আপনাকে বরং অফিসটা দেখিয়ে দিই একটু, ঘুরবেন চলুন। "
" ইটস ওকে মিঃ চক্রবর্তী। আমি আগে এসেছি এই অফিসে। "
" ও তাই? আপনাকে কক্ষনো দেখিনি কোন ফ্যামিলি ডে বা পার্টিতে। অর্ঘ্যকে বললেই বলত হয় আপনার শরীর ভালো নেই, নয় আপনি বাপের বাড়ি গিয়েছেন। অবশ্য আমি সবে দুই বছর এসেছি এই ব্রাঞ্চে। "
" হ্যাঁ, আমি অনেকদিন পরে এলাম। ইন ফ্যাক্ট আপনি এত করে বললেন, তাই এলাম আর কী। "

তিতিরের সাথে মিঃ চক্রবর্তী এক এক করে বেশ কিছু অফিস স্টাফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নানান কথাবার্তা চলছিল। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে অন্তরা এলেন গ্রিন্রুমে।
" চক্রবর্তী দা, অর্ঘ্যকে আনছি নীচে এবারে। সব রেডি কি না দেখতে ছুটে এলাম। "
" হ্যাঁ, অন্তরা। আনো। আমি মিসেস বসুকে নিয়ে যাচ্ছি।"


অনুষ্ঠান শুরু হল অর্ঘ্যকে সংবর্ধনা দিয়ে। তারপর অন্তরা খানিকক্ষণ বক্তব্য রাখল ওর আর অর্ঘ্যর পার্টনারশিপ নিয়ে। তারপর একে একে আরো বিশিষ্ট লোকজন এলেন স্টেজে, অর্ঘ্যর স্তুতিতে। ডায়াসে বসে পাশাপাশি অর্ঘ্য আর অন্তরা। আশেপাশে অফিসের বেশ কিছু কর্মকর্তাও আছেন, কিন্তু ওদের দুজনের থেকে যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা, তিতির মন্ত্রমুগ্ধের মতো (নাকি অবাক বিস্ময়ে) হাঁ করে দেখছে ওদের দুজনকে। কী দারুণ কেমিস্ট্রি, একসাথে হাসছে, কথা বলছে, মাঝে মাঝে তো হাসির চোটে একে অপরের ওপর প্রায় ঢলে পড়ছে। হাজার চেষ্টা করেও তিতির মনে করতে পারল না, শেষ কবে ও আর অর্ঘ্য এত হেসেছে একসাথে।

একবার নিজের দিকে দেখল তিতির, হ্যাঁ, এখন বোঝে মায়ের পইপই করে বলা কথাগুলো। শরীরের দিকে নজরই দেয়নি। দিনদিন মোটা হয়েছে বয়সের সাথে সাথে। অথচ অন্তরাকে দেখো, কী ছিমছাম ফিটফাট চেহারা, বয়স কম না, অথচ বয়সের ছাপ নেই এতটুকু, মেদবিহীন। শাড়ীটা পড়েছে কী দারুণ, নির্ঘাত কোন ডিসাইনারের বিশাল দামী প্রোডাক্ট, ব্লাউজটার দামই অন্তত হাজার তিন চারেক হবে, সেটাও ডিসাইনার। ওর সুতন্বী চেহারাকে দারুণভাবে বাড়তি সৌন্দর্য দিয়েছে। চুলের স্টাইলও দামী। গ্রিন্রুমে ও যখন তিতিরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, পারফ্যুমের সুগন্ধে মাতোয়ারা হওয়ার জোগাড় ওর। একেবারে যাকে বলে ওয়েল গ্রুমড, যে কোন পুরুষকে মাতিয়ে রাখার মতো মোহিনী চেহারা। তার উপরে আবার ডিভোর্সি, চক্রবর্তীর থেকে যা জেনেছে, থাকে বয়স্কা মা ছাড়া তিন কূলে কেউ নেই। জীবনের কোন ঝঞ্ঝাট নেই। বাড়িতে রান্নার লোকের পিছনে, ঠিকে ঝির পিছনে পিছনে সর্বক্ষণ টিকটিক করে যেতে হয়না। অফিস আর রূপচর্চা করেই সময় কাটে। তিতির বিয়ের দশ বছর কাটিয়ে দিল শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করে, সেই চক্করে নিজের ভালোবাসার জিনিসগুলো যে কখন ওর জীবন থেকে চলে গিয়েছে, টেরই পায়নি। কিছুদিন আগে চিলেকোঠার ঘরটা সাফাই করতে গিয়ে পুরোনো গানের খাতাগুলো দেখল, ড্যাম্প লেগে কালিগুলো আবছা হয়ে গিয়েছে, ঠিক যেন ওর জীবনের মতোই, বর্ণহীন।  অর্ঘ্যকে দোষ দেয় কিভাবে ও? পেহলে দর্শনধারি, ফির গুণ বিচারি সমাজে যে মেয়ের এত চটক, তার প্রতি আকর্ষণটাই কি স্বাভাবিক না? এই তো আজকেও এত ভাবল ভালো করে সেজেগুজে আসবে, তাও কি পারল? ঠিক শেষ মুহূর্তে ইয়ুট্যুবে দেখা হেয়ারস্টাইলটা ফেইল করল, সেই চিরাচরিত হাতখোঁপা করেই এলো। ক্যাব এসে যাওয়ায় সেন্টটাও লাগাতে ভুলে গেল। ছোট থেকেই তিতির এমন, সাজগোজের প্রতি একদম নজর নেই। মায়ের কাছে কম কথা শোনেনি এই জন্য, কিন্তু তার মাশুল যে এইভাবে দিতে হবে, অকল্পনীয় ছিল ওর কাছে। অর্ঘ্য তো ওকে দেখে খুব যে খুশি হয়েছে, মনে হল না। কেমন একটা দায়সারা ভাবে স্টেজে ওর সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলল। বরং তারপর অন্তরার পাশে বসেই ওর মুখের হাসি ফিরল।


"আজকাল তেরে মেরে প্যার কে চরচে হর জুবান পর
সবকো মালুম হ্যায় অউর সবকো খবর হো গয়ি।"


চিন্তার জাল কাটল তিতিরের স্টেজের গানে। সারা অডিটরিয়াম তখন অন্ধকার। স্পটলাইটের নীচে তখন অন্তরা। কী গলা! কী স্টেজ প্রেসেন্স! এই মেয়ে এক্কেবারে স্টার! গাইতে গাইতে সমান তালে নেচেও গেল, আর প্রথম সারির থেকে বেশ কিছু লোককে তুলে নাচালোও বটে। ওকে আর অর্ঘ্যকেও নাচতে স্টেজে তুলল বটে, কিন্তু তিতিরের বরাবরই স্টেজে উঠলেই কোল্ড ফিট হয়, এক পাও নাচতে পারেনা। একটু কষ্ট করে হাত পা নেড়ে ও সরে এলো, বুঝল যে ওইটুকুতেই অর্ঘ্য বিরক্ত। হবে নাই বা কেনো? সামান্য একটা পার্টিতে নাচতেও পারেনা তিতির? কেনো? শুধুই ঘরকন্না করলেই হয়? আজকের যুগে অন্তত? অর্ঘ্যর কি ইচ্ছে করে না নাকি কোন স্মার্ট সাথী পায়? অন্তরা তো প্রতিপদে প্রতিক্ষেত্রে অর্ঘ্যর সাথে সমান তালে চলতে পারে, সেখানে তিতিরের জায়গা কোথায়? নাহ, এ মিড লাইফ ক্রাইসিস না। এটা বরং তিতিরেরই পারসোনালিটির এক্সিস্টেন্সের ক্রাইসিস। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মডার্ন হতে পারলো না, এখনো ১৫/১ শ্যাম পুকুর লেনের মানসিকতা আঁকড়ে রইলো বলে সাউথ সিটির তিরিশ তলায় থাকতে পারলেও বোধহয় খাপ খাওয়াতে পারলনা। আর অর্ঘ্য? ও কি করবে? ঘরে যে সুখ পেলো না, সেই সুখের সন্ধানে অন্যত্র যাবে না কেনো? তিতির নিজে ওই জায়গায় থাকলে কি তা করত না? করতো? প্রশ্নের উত্তর পায় না তিতির। শুধু ভেসে আসে সারা সন্ধ্যের কিছু কিছু মুহূর্ত, সিনেমার মতো।

দু চোখ ভরে আসে জলে। কোনমতে অডিটোরিয়ামের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফেরে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় খোলা হাওয়ায়। জীবনের সব জমে থাকা দুঃখ হঠাৎ একসাথে যেন ওর গলা টিপে দিচ্ছে।  চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, নিজের ভাগ্যের ওপর। গলার কাছে একটা বড্ড বড় রকমের কান্নার দলা পাকিয়ে ওঠে ওর। হাতে ব্লেড নিয়ে একবার ভাবে শেষ করে দেয় সব যন্ত্রণা, সব দুঃখ কষ্ট এক মুহূর্তে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চাপ দিতে পারেনা ব্লেডে। বড্ড ভিতু যে। এই পরীক্ষায়ও হেরে যায় তিতির, সবের মতোই। সেই "গুড ফর নাথিং"ই রয়ে যায়।







No comments:

Post a Comment