হেমন্তের বিকেল। পড়ন্ত সূর্যের ম্লান আলো এসে পড়েছে হিমানীর ফ্যাকাশে গালে। কাঠের জানলার পাল্লা ধরে বসে থাকে ও এই সময়ে, সারাদিনের মতোই। সামনের লেকের ওপর সূর্যাস্ত ওর খুব প্রিয়, আর একটু পরেই শুরু হয়ে যাবে আশেপাশের বাড়িগুলি থেকে পরিণত অপরিণত কণ্ঠে সরগমের রেওয়াজ। বড় ভালো লাগে হিমানীর। মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার দিনগুলি। সন্ধ্যেবেলা খেলার মাঠ থেকে ফিরেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসাতো মা, শিবানী আর ও, ওরা দুই বোন গলা খুলে গাইত গান। দুই বোনেরই অসামান্য গানের গলা। পাড়ার ক্লাবে, স্কুলে সমস্ত অনুষ্ঠানে ওরা দুজনে মাটিয়ে রাখতো ওদের কোকিলের কলতানে।
" বৌদি এসো। তোমায় রেডি করে দিই। দাদা আবার নইলে আমায় বকবে দেরি হলে।"
হিমানী কিছু বলে না, ঠায় তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে। পশ্চিমের আকাশ এখন হাল্কা বেগুনী, সার দিয়ে একে একে সব পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের বাসায়। আজকের মতো সমস্ত সংগ্রাম শেষ, আবার কাল ঊষার নতুন আলোয় শুরু হবে দিনযাপনের যুদ্ধ।
" কী গো? এসো? কোন শাড়িটা পড়বে, বলো।"
রমার কথায় সম্বিৎ ফেরে হিমানীর। আস্তে আস্তে বিছানায় বসে আলমারিতে রাখা শাড়িগুলোর দিকে তাকায়। কত দামী দামী পোশাক, এক কালে রজতের সাথে পার্টিগুলোতে যেত যখন সেজেগুজে, এক্কেবারে রাজরানী লাগত। কত বছর পর আবার আজ একটা পার্টি হতে চলেছে বাড়িতে। চায়নি ও একদম, কিন্তু রজতকে বলতে পারল কই? বিয়ের পঁচিশ বছর উদযাপন করবে বলে নাছোড়বান্দা সে।
বাঁ হাত দিয়ে পছন্দের হলুদ বেনারসিটা দেখায় রমাকে।
" ওই হলদে শাড়িটা? ঠিক তো? "
মাথা নাড়ে হিমানী।
রমা ওকে সাজাতে সাজাতে করে চলে রাজ্যের গল্প, টিভি সিরিয়াল থেকে শুরু করে হাউজিং কমপ্লেক্সের খুঁটিনাটি। গত দশ বছর ধরে ও আছে হিমানীর দেখাশোনা করার জন্য। একেবারে ছায়ার মত থেকে আগলে আগলে রাখে ওকে। যখন প্রথম আসে এ বাড়িতে নার্সের কাজ নিয়ে, তখন দেখত সারাদিন পুরনো ফটো এলবাম হাতে নিয়ে হিমানী পড়ে পড়ে কাঁদত, দুই চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে নেমে আসত অঝোর অশ্রুধারা। কিন্তু একটা শব্দ বের হত না। অমন লক্ষ্মীপ্রতিমার ন্যায় চেহারার মানুষটাকে কান্নাকাটি করতে দেখতে কোমলহৃদয়ের রমা ভেঙ্গে পড়ত।
এখন আর বৃষ্টি পড়েনা, চারিদিক শান্ত, স্তব্ধ। গাড়ির ভয়াবহ এক্সিডেন্ট আর তাতে ছেলের অকালমৃত্যু নির্বাক করে দেয় হিমানীকে। বহু চেষ্টা করেও আর বাণী ফেরাতে পারেনি ওর কণ্ঠে কেউ। রজত নিজের অফিস, ব্যবসা সব মিলিয়ে অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে। বহির্বিশ্বের সাথে নিত্য কেজো সম্পর্কের ফলে আর সূক্ষ্ম অনুভূতি, দুঃখ কষ্টরা বুঝি কবেই বিদায় নিয়েছে, বুকের মাঝে একটা বিশাল ফাঁক সেও অনুভব করে, তবে হিমানীর মত না।
" কী সুন্দর লাগছে তোমায় দেখতে গো বৌদি। আহা, ঠিক যেন মা লক্ষ্মী। " রমার কথায় ম্লান হাসে ও।
" কই গো, এসো। লোকজন যে আসা শুরু করে দিয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার। চলো। "
রজতের এগিয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে হিমানী বেরোয় নিজের ঘর থেকে। আজ এতগুলো বছর পরে ও বাড়ির ছাদে এলো। সেই ছাদ, যেখান থেকে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত ওর প্রিয় শহরটিকে। ধোঁয়ায় ঢাকা রাতের আকাশে তারারা গরহাজির। কিন্তু ফেয়ারি লাইটস দিয়েছে কৃত্রিম সৌন্দর্য। ম্যুজিক সিস্টেমে লো ভল্যুমে চলছে কিশোর রফি লতার রেট্রো। রঙিন পানীয় আর হরেকরকম সুখাদ্যের গন্ধে সন্ধ্যে জমজমাট।
আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সাথে সৌজন্যের হাসি হেসে কেটে গেল সারা সন্ধ্যেটা। রাত্রে রমার ছুটি করে দিয়ে রজত হিমানীকে নিয়ে গেলো নিজেদের বেডরুমে। ঘর অন্ধকার।
" দাঁড়াও, এক মিনিট। " এই বলে রজত চট করে একটা কাপড়ের ফালি এনে হিমানীর চোখ বেঁধে আস্তে আস্তে ঘে ঢুকল ওর হাত ধরে। হিমানী টের পেল ঘরের আলো জ্বলে উঠেছে। রজত ওর চোখ থেকে ফিতে খুলতেই,
" সারপ্রাইজ! দেখো তো? পছন্দ হল তো? "
ওর সামনে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো, ঠিক যেমনটা পঁচিশ বছর আগে হানিমুনে ইংরেজ আমলের চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে দেখে দুই চোখ চিকচিক করে উঠেছিল হিমানীর।
আজ আবার হিমানীর দুই চোখ ছলছল করছে। এত বছরে, এত ঝড়ঝাপটাতেও রজত ভোলেনি ওর এই ইচ্ছাটিকে। খুব সন্তর্পণে ও এসে বসল পিয়ানোতে। বাংলোতে বাজানো গানটাই আবার বাজিয়ে গাইল ও আজ, নাই বা শুনতে পাক ওর গলার স্বর আজ কেউ। হিমানীর আঙুলের ছোঁয়ায় তখন পিয়ানো থেকে যে সুরঝঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে, রজত যেন তাতেই ডুবে যাচ্ছে, আরো প্রেমে, আরো প্রেমে।
No comments:
Post a Comment