মাদ্রাস নিয়ে লিখছি, সেখানে বলব যাদের কথা, তাদেরই একজনের কথা আজ বলি আলাদা করে। ওর জীবনটা হয়তো অনেকের সাথেই মিলে যাবে, আবার নাও মিলতে পারে, কিন্তু আমি যতজনকে চিনেছি আজ অবধি, এইরকম অধ্যাবসায় বোধহয় কারুর দেখিনি।
সকাল থেকে রাত অবধি সাঙ্ঘাতিকভাবে লেখাপড়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। অনেক সময় রাতের পর রাত জেগেও কাজ করে। শরীর খারাপ হয়ে যাবে, একটু বিরতি নে বললেও কথা শোনেনা; কারুর সাথে নিজের রিসার্চের কাজের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে দুই চোখ চকচক করে ওঠে। কোন কিছু করবে ভাবলে এক অদম্য জেদের সাথে শেষ দেখেই ছাড়ে। আমরা যখন ওকে বলি যে এত অমানুষিক পরিশ্রম করছিস কেন, তার উত্তর পাই, আমাকে অনেকটা বড় হতে হবে। জীবনে দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। তোমরা বুঝবে না।
সত্যিই তাই। ওর জীবনের স্ট্রাগলের কথা যতদিন জানিনি, ততদিন ভাবতে পারতাম না, ওর এত খাটুনির পিছনের আসল উদ্দেশ্যটা কী। আসলে যখন ছোট থেকে বড় হয়েছে ও, দুই চোখে ছিল এক স্বপ্ন, সে স্বপ্ন একদিন অনেক বড় হবে, দূর হবে জীবনের বাধা।
মেদিনীপুর শহরের এক বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের ছেলে ও। বড় হয়েছে দারিদ্র্য ও অভাবের মধ্যে। তবে কখনোই তা মুছে ফেলতে পারেনি ওর দুই চোখের এই স্বপ্নকে। বরং প্রতি মুহূর্তে ওকে এই অভাব অনটনের সংসার মনে করিয়ে দিতো যে আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের থেকে ওকে যে অনেক বেশী খাটতে হবে। স্কুলে পড়াকালীন আই আই টি জয়েন্টের কথা জানত না, তাই স্টেট জয়েন্ট ছাড়া অন্য কোন পরীক্ষায় বসেনি। এবং সেখানেও অসম্ভব ভালো র্যাঙ্ক করে যাদবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙে চান্স পায়। অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতা না থাকায় ট্যুশন করে নিজের খরচ চালাত। বছর দেড়েক চাকরি করে টাকা জমিয়ে এখন ও আই আই টিতে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিঙে রিসার্চ করছে। ও আমাদের সকলের গর্ব। যেখানেই যায় নিজের কাজ প্রেসেন্ট করতে, প্রথম স্থান পেয়ে আসে। ও আমাদের সোনার ছেলে। সমস্ত ফ্যাকাল্টিদের, সিনিয়রদের আর জুনিয়রদের ও প্রিয়পাত্র।
আমার খুব গর্ব হয় ওকে চিনি বলে। ওর থেকে প্রতি মুহূর্তে শিখি যে অদম্য ইচ্ছা আর সাহস থাকলে, কঠিন অধ্যাবসায়ের মারফত কীভাবে মানুষ তার স্বপ্ন সফল করতে পারে। যেভাবে ওর কেরিয়ার এখনও অবধি চলছে, আমি হলফ করে বলতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে ও একাডেমিক ফিল্ডে খুব নাম করবে।
শুধু লেখাপড়াতেই ওর গুণ সীমিত না। ভীষণ ভাবে ভালো মনের একটা মানুষ, কোনরকম বিপদে আপদে এগিয়ে যায়। যথাসাধ্য সাহায্যও করে। এছাড়া বড় ভালো ছবি আঁকে, গান গায়, লেখালিখি করে। গিটার বাজায়। এই প্রসঙ্গে বলি, ওকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে চিনি। গিটার বাজাতো আমি গান গাইলে, তখন ওকে গানের কর্ড দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু এই কবছরে নিজের চেষ্টায় গিটারটাকে ভালোমতোই রপ্ত করে ফেলেছে, নিজে নিজে সুর বানায়, বাজায়।
গর্ব হয় প্রতি মুহূর্তে আমার ওর জন্য। ও আমার সবচেয়ে প্রিয় ভাই, চন্দন বোস।
No comments:
Post a Comment