১।
অক্টোবরের শেষ। কিন্তু তবুও আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। অকালের বৃষ্টি। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তিতির আনমনে তাকিয়ে রয়েছে পাশের বাড়ির নিমগাছের দিকে। ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়ছে পাতাগুলির থেকে। জানলার গ্রিলে জলের ফোঁটারা আলপনা দিচ্ছে যেন। পাশের ফ্ল্যাট থেকে দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একে এক করে ভেসে আসছে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, আহা আজি এ বসন্তে, হৃদয় বসন্তবনে। মাঝে মাঝে তাতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে মেঘেদের গুরুগম্ভীর ডাক। সামনের কাঞ্চনগাছটাতে একটা কাক সেই কখন থেকে বসে ভিজেই চলেছে। রাস্তার ওপারের নেড়িটা বন্ধ দোকানের শাটারের তলায় কোনমতে ঘুপচি করে বসেছে। আজ সোমবার। পাড়ার সব দোকান বন্ধ। আর দুপুর বলে রাস্তায় এমনিও অনেক লোক কম। ক্রমশ বৃষ্টিটা বাড়ছে। লোক চলাচলও কমে আসছে।
" ও বৌদি, ভাতটা নামিয়ে নেবে? আমি বাকি সব রেঁধে টেবিলে গুছিয়ে এসছি। ভাতটা নামানো অবধি থাকতে গেলে একটার ট্রেনটা মিস করবো।"
রান্নার লোক মলয়ার কন্ঠস্বরে চমকে উঠলো তিতির।
" অ্যাঁ? ও হ্যাঁ। ঠিক আছে। আমি ভাতটা নামিয়ে নেবো। তুমি এসো। কাল কামাই করোনা কিন্তু। আমার কাল একটু বেরোনোর আছে। "
" হ্যাঁ হ্যাঁ, কামাই করবোনি। এবার যাই। "
" যাই না। বলো আসি। "
" হ্যাঁ, আসছিইইইইই।"
একটা সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি পড়ে এসছিল আজ মলয়া। বৃষ্টির মরসুম বলেই বোধহয়। ছোটবেলা থেকে তিতির মা কে দেখত, বর্ষাকালে অফিস করতে যেত গার্ডেনের দোকান থেকে কেনা সুন্দর সুন্দর প্রিন্টের সিন্থেটিক শাড়িগুলো পড়ে। কী নরম হত, মায়ের আঁচলে মুখ ঢেকে কত খেলাই খেলত ও। মায়ের শাড়ির কালেকশান অতুলনীয়। আলমারি ভর্তি ভর্তি ঢাকাই, জামদানি, বিভিন্ন প্রদেশের নানান সিল্কের নানান ডিসাইনের নানান রঙের শাড়ি। মা চলে যাওয়ার পর বাবা একবার ডেকে আলমারির চাবি হাতে তুলে দিয়ে ওকে পছন্দসই শাড়ি বেছে নিতে বলেছিলও তিতিরকে। কিন্তু তিতির শাড়ি পড়েনা। শাড়িতে স্বচ্ছন্দবোধ করেনা। কাজের জায়গায় তো বটেই, এমনকি অনুষ্ঠানবাড়িতেও জিন্স কুর্তি নইলে চুড়িদার কুর্তা। এই এখন ঘরে রয়েছে, একটা সাদা খয়েরি ছাপা লঙ স্কারট আর সাদা এমব্রয়ডারি করা টপ। তাই মায়ের বিয়ের বেনারসি আর দু তিনটে সিল্ক ছাড়া একটাও কিছু নেয়নি সে। বাবাকে বলেছিল মাসতুতো বৌদিদের ডেকে দিয়ে দিতে। কিন্তু তিতির জানে। বাবা সেগুলো দেয়নি। এখনো আগলে বসে আছে। বসার ঘরে জানলার ধারের ওর প্রিয় জায়গা থেকে উঠে রান্নাঘরে গেল তিতির। চামচ দিয়ে একটু ভাত তুলে দেখে নিলো হয়েছে কি না, তারপর গ্যাসটা অফ করে দিলো। রান্নাঘরের ঘড়িতে চোখ যেতে তিতির খেয়াল করল প্রায় একটা বাজতে যায়, এখনো স্নান হয়নি ওর। চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বাড়িতে থাকতে থাকতে সব রুটিন ভেস্তে গিয়েছে।
২।
" কি রে মিলু তুই আবার নামতা ভুল করেছিস? তেরোর নামতা এখনো মুখস্থ হয়নি? কাল বাদে পরশু পরীক্ষা না তোর?" কোন ভোরবেলা বেরিয়ে সারাদিন শহরের দাদা বৌদিদের হেঁসেল ঠেলে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মলয়ার প্রথম কাজই হল সাত বছরের ছেলে মিলন আর পাঁচ বছরের মেয়ে সোনালীর স্কুলের খাতাগুলোতে চোখ বোলানো। মলয়া নিজে গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেন অবধি লেখাপড়া করেছিল, খুব যে ভালো মাথা ছিল, তা না। কিন্তু পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল। তবে অবশ্য বাপ মা মরা মেয়ে, তায় মামাবাড়িতে মামীর দয়ায় মানুষ। মামা নিজে ওর স্কুল ছাড়িয়ে পাশের গ্রামের এক জুটমিল করমচারীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় মলয়ার। রঞ্জিত, ওর স্বামী, ওর থেকে অন্তত দশ বছরের বড়। বিয়ের পর ওর লেখাপড়ায় ইচ্ছে আছে জেনে খুশি হয়ে আবার নাইট স্কুলে ভর্তি করার কথা বলেছিল বটে রঞ্জিত। কিন্তু স্বামীর সংসার আর ছেলে মেয়ে মানুষ করতে করতে মলয়ার আর লেখাপড়ার সময় হল না। দিব্যি চলছিল সংসার। তারপর হঠাৎ শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি একদিন এক অজানা জ্বরের কবলে পড়ল রঞ্জিত। এক সপ্তাহ যমে মানুষে টানাটানি করেও আর ওকে বাঁচানো গেলোনা। জমানো টাকা যেটুকু ছিল, তা শেষ হওয়ার মুখে। অগত্যা মলয়াকে শহরে বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ নিতে হল। সেই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে উঠে ছেলেমেয়ে আর নিজের জন্য অল্প পান্তা ভাতের ব্যবস্থা করে ওদের স্কুলের জন্য রেডি করে নিজে ছোটে ছটার ট্রেন ধরতে। আর তারপর সারা সকাল চার বাড়ি রেঁধে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি এসে আবার শুরু জীবনযাপন। মলয়ার খুব সখ ছেলে মেয়ে দুটোকে অনেক দূর পড়াবে, ওরা মস্ত বড় মানুষ হবে। নিজের যেটুকু সাধ্য, সেই দিয়ে একটু আধটু ওদের দেখিয়ে দেয় ও। আজও তাই করতে বসে অঙ্কর খাতাতে একগাদা ভুল দেখে ছেলেকে মৃদু বকা দিল ও।
" মা দাদা না নামতা খালি ভুল করছিল। আমার অঙ্কও দেখাতে গিয়ে ভুল করে। আমি ঠিক করে দিলাম।" সোনালীর কথায় অবাক হয়ে মলয়া জিজ্ঞেস করে মিলনকে। "হ্যাঁ রে? সত্যি?"
মিলু খানিক চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মায়ের ক্রমশ রাগ হচ্ছে টের পেয়ে এক ছুটে সদর দরজা দিয়ে দৌড় লাগায়।
" মিলুউউউউ। ফেরত আয়।" মলয়ার ডাকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই মিলু ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যায় পুকুরের ধারে। ওইদিকটা নির্জন একটু। খানিক গাছের ছায়ায় বসে কাটিয়ে তারপর মায়ের রাগ কমলে ঘরে ফেরার কথা ভাবে মিলু। মা কিছুতেই যে কেন বুঝতে চায় না কে জানে। এইসব একগাদা নম্বর, হিসেব নিকেশ একদম ঢোকেনা ওর পুচকে মাথাটায়। অনেক চেষ্টা করেছে। তাও হয়না। মা খালি রেগে যায় আর পিটুনি দেয়। ভালো লাগেনা। কই বাবা থাকতে তো এমন হতনা। বাবা কী সুন্দর গুছিয়ে বসে গল্পের ছলে বুঝিয়ে দিতো সব।
কিছুক্ষণ পরে সোনালী গুটিগুটি পায়ে এসে বসলো মিলুর পাশে, গাছের ছায়ায়। নরম হাতদুটো ওর হাতে রেখে বলল, "দাদা চল। মা ডাকছে। খাবার বেড়ে দিয়েছে। "
" আমি যাবো না। তুই যা। "
" ওরকম বললে হয় নাকি দাদা? চল চল। তুই না খেলে আমরা কেউ খেতে বসতে পারছিনা। "
" মা কেন খালি বকে আমায়? আমি যাবো না। তুইই বা কেন মা কে বলতে গেলি? "
" আচ্ছা আর বলব না। নে কান ধরছি। এবার আয়। "
খানিক বোনের দিকে তাকিয়ে মায়াভরা চোখদুটির আকুতিতে সারা দিয়ে মিলু ফেরত চলল মায়ের কাছে।
৩।
বারান্দায় দড়িতে গামছাটা মেলে ঘরে ঢোকে তিতির। আয়নার সামনে টুলটা টেনে বসে। হাতে চিরুনি। টুপটুপ টুপটুপ করে জল পড়ছে চুল থেকে। ছোটবেলা থেকেই তিতিরের এই সমস্যা। হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই ও কোনদিনও মাথা মুছতে পারেনা ভালো করে। আগে দিদিমা যত্ন করে ও স্নান সেরে বেরোলে মাথা মুছিয়ে দিত। তারপর একদিন দিদিমা চলে গেল। ও তখন ক্লাস টুয়েলভ। মা অফিস সামলাতে হিমসিম খায়। মেয়ের পিছনে সময় দেওয়ার মত বিলাসিতা কখনোই করতে পারেনি। ভেজা চুল থেকে সমানে সর্দি কাশি হতে থাকত ওর। সেই বছর পুজোর ছুটি পড়তে পার্লারে গিয়ে একদিন তিতির নিজের কোমর ছাপানো চুলগুলো কেটে একেবারে বয়কাট করে এলো। মায়ের কাছে খুব বকুনি খেয়েছিল। বাবা তাও ওর হয়ে ওকালতি করেছিলও মায়ের কাছে, কিন্তু বরাবরের মতোই মায়ের কাছে কেউই টিকতে পারেনি। সেই থেকে আজ বারো বছর হয়ে গেল, তিতিরের চুল কখনো কাঁধ ছাড়ায়নি আর। অথচ চুল নিয়ে স্টাইল করা, নানান এক্সপিরেমেন্ট করা ছিল তিতিরের সখ। কলেজ জীবনেও বন্ধুরা ওঁর কাছে আসত হেয়ার স্টাইল করতে কোন অনুষ্ঠানের আগে। মনের ভিতরে সুপ্ত বাসনা ছিল, কোনদিনও নিজের কন্যাসন্তান হলে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে। নিজের ছোটবেলায় মায়ের কাছে যে আদর পায়নি, সেই ভালোবাসায় মুড়ে রাখবে মেয়েকে। সপ্তর্ষি যেদিন ল্যাব থেকে এলো প্রেগ্নেন্সি রিপোর্টটা হাতে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় তিতির।
" দেখো সপ্তর্ষি, আমাদের মেয়ে হবে। আমার একটা জ্যান্ত পুতুল হবেই। দেখো। আমার এতদিনের সখ।"
" আচ্ছা বাবা, তাইই হবে। তবে ছেলে হক বা মেয়ে, দুজনেই আমাদের কাছে কিন্তু সমান ভালোবাসা পাবে। তাই না তিতির? "
" হুম। কিন্তু আমার মেয়েই হবে। "
তিতিরের প্রেগ্নেন্সিটা বেশ কমপ্লিকেটেড হয়ে যায়। তৃতীয় মাস থেকে ডাক্তারের পরামর্শে ছুটি নিতে চেয়েছিল, ছুটি পেলোনা। বাধ্য হল চাকরিটা ছাড়তে। তখন সারাদিন অফুরন্ত সময়। শ্বশুরবাড়ির দিকেও ওর কোন কাছের আত্মীয়া নেই। মা নেই। এই ক'মাস তিতিরের নিজেকে বড় একা লাগত। যদিও সপ্তর্ষি চেষ্টা করতও যথাসাধ্য ওকে সাহচর্য দেওয়ার। কিন্তু কর্পোরেট চাকরি। কাজের প্রেশার। চাইলেও বিশেষ সুবিধে হতনা। তিতিরের বাবা এসে ছিল কিছু দিন ওর কাছে। সারাদিন বাবা মেয়েতে বসে গল্প করে টিভি দেখিয়ে কাটিয়ে দিত। সাথে চলত টুকটাক উল বোনা। উল বুনতে তিতির জানত না। স্কুলেও শেখেনি। কিন্তু মাতৃত্ব মানুষকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। তিতিরও তার ব্যাতিক্রম না। ইয়ুট্যুব খুলে দেখে শিখে আস্তে আস্তে বুনতে শুরু করল। প্রথমে মোজা, তারপরে টুপি, তারপর শুরু করেছিল একটা বেবি পিঙ্ক রঙের সোয়েটার। সাত মাস পূর্ণ হতে, একদিন দুপুরে হঠাৎ শুরু হল সাংঘাতিক পেটে ব্যথা। সাথে ব্লিডিং। তড়িঘড়ি নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হল তিতিরকে। কিন্তু বাঁচানো গেলনা ওর ফুটফুটে কন্যাসন্তানকে। তিতির ঢলে পড়ল সাংঘাতিক ডিপ্রেশনে। শুরু হল থেরাপি। এখন বছরখানেক থেরাপি চলার পর অবস্থা কিছুটা হলেও সামলেছে ওরা। কিন্তু সপ্তর্ষি আর তিতিরের জীবন আর এক থাকেনি। তিতির নিজের চারিপাশে একটা বিশাল দেওয়াল তুলে নিয়েছে। খুব দরকার ছাড়া ওই দেওয়ালের বাইরে বেরোয়না ও। দিন রাত চুপচাপ থাকে। গান চলে। টিভি চলে। কিন্তু কোনদিকেই মন থাকেনা। যন্ত্রের মত দিনযাপন করে তিতির। সপ্তর্ষিও অফিসের কাজে নিজেকে পুরোদমে ডুবিয়ে দিয়েছে। সকাল নটায় বেরিয়ে রাত দশটার আগে ফেরেনা। এই কমাসে এত কাজ করেছে যে খুব সহজেই দুই ধাপ পেরিয়ে প্রোমোশন পেয়ে গিয়েছে। বসেদের প্রিয়পাত্র এখন ও। হবে নাই বা কেন, এত করমপ্রিয় যে আর কেউ নেই।
ভিজে চুলে চিরুনি চালিয়ে তিতির ধীর পায়ে ডাইনিং রুমে এলো। ঘড়ির কাঁটায় আড়াইটে। টেবিলে মলয়ার রেখে যাওয়া রান্নার বাসনের ঢাকনা খুলে খুলে দেখে একটা থালায় অল্প ভাত আর খানিকটা ডাল ঢেলে নিলো তিতির। সাথে নিলো একটা বাটিতে কেটে রাখা স্যালাড। খাবারটা নিয়ে আবার নিজের প্রিয় জায়গা, জানলার ধারে এসে বসল তিতির। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। রোদ উঠে গিয়েছে। ঝলমল করছে চারিদিক।
পাশের বাড়ির রেডিয়োতে তখন চলছে নাটক। হাল্কা আবছা সংলাপ শোনা যাচ্ছে। একটা সময়ে নাটক শুনতে খুব ভালোবাসতো তিতির। সপ্তর্ষি আর ও মাঝে মাঝেই রবিবার করে একাডেমী, মধুসূদন মঞ্চ চলে যেত নতুন নাটকের সন্ধানে। শেষ কবে গিয়েছে, মনে পড়েনা।
কাকটা গাছের ডালে বসে ওর ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। রোজের অভ্যেস। জানে চুপ করে বসে থাকলে তিতির ওকে খেতে দেবেই। কপাল ভালো থাকলে (যা ইদানীং প্রায়ই হচ্ছে), পুরো থালাটাই ওর কপালে নাচছে। দু চামচ মুখে তুলল তিতির। তারপর "আয়, খেয়ে যা" বলে কাকটিকে দিয়ে দিল সমস্তটা।
৪।
" বৌদি, আজ একটু তাড়াতাড়ি যাব। ছেলেটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। "
" ডাক্তার? কেন কী হলো? "
" ওর পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে কদিন ধরে। খাওয়াদাওয়া করতে পারেছেনা। গ্রামের হাসপাতালে বলল শহরে দেখাতে। "
" কোথায় নিয়ে যাবে? ডাক্তার ঠিক করেছো? "
" ভাঙ্গরে নিয়ে যাবো। গ্রামের সবাই বলছিল, নাকি ভালো। "
" যেতে পারো। তবে আমি বলি কী, পিজিতেও যেতে পারো। বেশী ভালো হবে। "
" সে কোথায় বৌদি? "
" ভবানীপুর ছাড়িয়ে। আমি বাসের নম্বর বলে দেবো। "
" ঠিক আছে বৌদি। তাহলে তাই যাই। "
" আর হ্যাঁ শোনো, যাওয়ার আগে আমার থেকে টাকা নিয়ে যেয়ো। "
" আচ্ছা বৌদি। "
" আর সোনালীকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হবেনা। ও আমার এখানে থাকুক। ফেরার পথে ওকে নিয়ে যেয়ো। "
লাজুক সোনালীর দিকে তাকিয়ে ওর মা বলল, " ও কি রাজি হবে বৌদি? আমায় বা মিলুকে ছাড়া থাকতেই চায় না। "
" না সোনালী, ওই রুগীর ভিড়ে তোমায় যেতে হবেনা। আমার কাছে থেকো। আমরা ভালো থাকব। তোমার খারাপ লাগবেনা। দেখো। "
" তাহলে ওই কথাই রইলো বৌদি। আমরা বেরোই। সোনা মামীকে বিরক্ত করবি না একদম " সোনালীকে তিতিরের জিম্মায় রেখে ঘন্টাখানেক বাদে মিলুকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল মলয়া।
ওদের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। বাড়ি এসে মলয়া দেখে, সোনালী আর তিতির বারান্দায় বসে। ওদের সামনে নানান রঙিন বই ছড়িয়ে রাখা। সেই বইয়ের পাতায় চোখ দুজনেরই। চিরুনি হাতে চুল আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছে তিতির। দুজনে খুব গল্প করতে ব্যস্ত, হাসির কলকাকলিতে ভরপুর ওদের বারান্দা। কে বলবে লাজুক মেয়ে সোনালির সাথে আজই পরিচয় হয়েছে তিতিরের।
" এই, তুই বৌদিকে বিরক্ত করছিস কেন সোনালী? " মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরলও সোনালীর। হরফর করে উঠে দাঁড়ালো।
" না মলয়া দি। ও একটুও আমায় জ্বালাতন করেনি। বরং ও থাকায় আমার খুব ভালো সময় কেটেছে। মাঝে মাঝে ওকে আনবে আমার কাছে। ডাক্তার কী বলল? "
" পেটের ফটক তুলল। কিছু ওষুধ দিল। আবার এক সপ্তাহ পর আসতে বলেছে। "
" ঠিক আছে। সেদিনও সোনালিকে এখানে রেখে যেয়ো। কি রে, থাকবি তো? "
" হ্যাঁ মামী। বাকি গল্প শুনতে হবে তো। এই দাদা জানিস তো মামী আমায় কি সহজে অঙ্ক কষা শিখিয়েছে। তোকে বলে দেব। দেখবি তুইও আর ভুল করবিনা। "
মলয়া ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে ল্যাপটপ খুলে বসলো তিতির। আজ যেন অনেকদিন পর ওর সারাদিনটা ভালো কেটেছে। প্রাণ খুলে হেসেছে। কথা বলেছে। গল্প করে লেখাপড়া শিখিয়েছে। ইচ্ছে করছে, ঠিক এরকম করেই যদি প্রতি দিন কাটানো যায়। খানিক ভেবে তারপর গুগুল খুলে তাই তিতির সার্চ করল কাছাকাছির মধ্যে কোন স্কুলে বা মন্টেসরিতে চাকরি আছে কি না। নিজের ডিগ্রিটা নইলে মর্চে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল যে। তিতিরকে যে ফিরতেই হবে স্বাভাবিক জীবনে। তিতিরদের হারতে নাই, হারিয়ে যেতে নেই।
No comments:
Post a Comment