Scene 1
Knock
নিখিল: may I come in Raima di?
রাইমা : নিখিল? আয়! কিন্তু এটাই শেষবার।
নিখিল: মানে?
রাইমা: মানে এরপর থেকে আমার ঘরে ঢুকতে হলে আসবো কিনা জিজ্ঞেস করবি, মে আই কাম ইন বললে আর অনুমতি পাবিনা। বস।
নিখিল: কী? মানে??
রা: কীসের কী?
নি: আই মিন, কলকাতা শহরের ঝাঁ চকচকে প্রাইভেট এফ এম স্টেশনে বসে আমার কেন বলোতো সুবালা দেবী বালিকা বিদ্যালয় ভাইবস আসছে?
রা: সুবালা দেবী বালিকা বিদ্যালয় ভাইবস? মানে কী?
নি: না মানে ওই বাংলা বাঁচাও টাইপ।
রা: প্রাইভেট এফ এম বলে কি ভাষার প্রতি একটা দায়িত্ব থাকে না নাকি?
নি: সে থাকে। বাট, তুমি এত সকাল সকাল রেগে কেন? পুরো বেগুন ইন অয়েল সিনড্রোম। কে ডুব দিলো, ছায়াদি? না বর চললো মায়ামি?
রা: চুপ কর নিখিল। খালি ফাজলামি, না?
নি: এই সরি সরি। বলো বলো। সিরিয়াস হয়ে শুনছি। কেসটা কী, বলো।
রাইমা: কেসটা শর্টে হলো, এই স্টেশনে টিকতে হলে তোকে বাঙলাতেই কথা বলতে হবে।
নিখিল : বাংলা??
রাইমা : কেন? মাতৃভাষা নয়? নাকি বাংলা টাংলা আসেনা?
নিক: ইয়ে মানে বাংলাই তো বলি।
রাইমা : না, বলছিস না। কি একটা জগাখিচুড়ী ভাষা আমদানি করেছিস তোরা কে জানে! পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলায় কথা না বলতে পারলে আর আর জে গিরি করতে হবেনা।
নিক : কিন্তু রাইমাদি the last time I checked আমার শোটার ফিডব্যাক তো বেশ ভালই ছিল।
রা: আর ফেসবুক ইউটিউবের কমেন্টস?
নি: সে তো কিছু লোকজন অর্বাচিনের মতো কথা বলবেই। প্লাস, দেখো, এই টাইম স্লটে সব চ্যানেলের মধ্যে আমার শোতেই সবচেয়ে বেশি লিসনার্স। সেলস টিমকে দেখো জিজ্ঞেস করে, আমার শোতে ad এর রেট কত!
রাইমা : ব্যস! হয়ে গেলো তো? বাংলা শব্দভাণ্ডারে আর কুলালোনা? একটা অর্বাচীন বলেই শেষ? এই করে করে তোরা শো টার বারোটা বাজিয়েছিস। কি অখাদ্য বাক্য বলিস এক একটা। হে ফ্রেন্ডস, আমি নিক এন্ড ইউ ক্যান কাম হিয়ার এন্ড স্পিক।
নিক : বাহ রে, শোটার নামই তো স্পিক টু নিক। সেখানে একটু আধটু ইংলিশ না বললে
রাইমা : শো টার এরকম ভয়নক নাম যে অনুমোদন করেছিল, তোদের আগের প্রোডাকশন ম্যানেজার, তাকে সরিয়ে আমাকে কেনো এই চেয়ারে বসানো হয়েছে সেটা পরিষ্কার হলো তাহলে? বম্বে থেকে কড়া নির্দেশ আছে, ইয়োর শো নীডস আ ড্রাস্টিক মেক-ওভার। তার প্রথম ধাপই হলো, নাম পরিবর্তন। দ্বিতীয়, কন্টেন্ট।
নিক : অ্যা? নামটাই চেঞ্জ, মানে পরিবর্তন করে দেবে??
রাইমা : হ্যাঁ, দেখ, সামনেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ওইদিন থেকেই এই পরিবর্তনটা করা হবে। এবং অনুষ্ঠানের নাম এমন রাখা হবে যাতে তুই আর একটিও খিচুড়ি বাক্য বললেই তোকে সরিয়ে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। স্পিক টু নিক! হাঃ!
নিক: এটা কিন্তু... মানে এই তো তুমিই বললে প্রোডাকশন ম্যানেজার, ইংরেজি শব্দ, সে বেলা ...
রাইমা : উৎপাদন ব্যবস্থাপক বলতেই পারতাম আমি, কিন্তু তোর নিরেট মাথায় সেটা ঢুকতো কি?
নিক : সেটাই তো....
রাইমা : আর একটাও কথা নয় নিখিল, বাংলা ভাষার পিঠ দেওয়ালে থেকে গেছে। যে বাংলার ওপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তাকে রক্ষা আমাদেরই করতে হবে। করতেই হবে।
নিক : আচ্ছা, বুঝলাম। আসি।
রাইমা : আয়, (গলা উঁচু করে) আর আজ থেকে মোনালি ঠাকুর নয়, চন্দ্রিল ভটচাজ এর ভিডিও গুলো দেখবি।।
নিঃ হু।
Scene 2
নিঃ নমস্কার আমি নিক, আই মিন, আমি নিখিল। আর আপনারা শুনছেন ১০৮.৩ রেডিও মস্তি।
রাঃ অ্যাই অ্যাই অ্যাই। থাম থাম (রাগতস্বরে)
নিঃ what? কী হল রাইমাদি? Why are you looking like Mount Vesuvius, about to explode?
রাঃ নিখিল, আর ঠিক দশ মিনিটে তুই লাইভ যাবি। অন-এয়ার। আর এখনও ওপেনিং সেন্টেন্স বলতে গিয়ে ছড়াচ্ছিস?
নিঃ রাইমাদি, চিল। এই যে প্র্যাকটিস করে নিচ্ছি, থুড়ি, ঝালিয়ে নিচ্ছি, এতেই দেখবে। এক্কেবারে কেল্লা ফতে। আমি তো জাস্ট তোমার লেগ পুল করছি। দেখো না শুধু, অন-এয়ার যাই, সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাঃ ও গড, আই অ্যাম ফিলিং সো নার্ভাস। তুই এখনও গোটা একটা বাক্য ইংরেজি শব্দ না ব্যবহার করে বলতে পারলি না, এই তুই নাকি শুদ্ধ বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান করবি?
নিঃ আহ দি, তুমি বড্ড টেনশন করো। চেষ্টা করলে এবং চাইলে এই শর্মা যে অসাধ্য সাধন করতে পারবে না, তা কী করে হয়? তুমি শুধু আমার ক্যাপা, ইয়ে, মানে কী জানি বলে?
রাঃ নিখিল?
নিঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার ক্ষমতা দেখো।
রাঃ ঠিক আছে। নে এবার হেডফোনটা কানে নে। এই জিঙ্গলটা শেষ হলেই লাইভ যাবি।
নিঃ (ব্যাঙও করে সুরে করে) পাঁচতলা মল, সবই শাড়ি
ভাষা নিয়ে এদের ঢং দেখে, আমি হেসেই গড়িয়ে পড়ি।
নিঃ নমস্কার বন্ধুরা, সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পাখিরা ফিরে চলেছে যে যার বাসায়, জানি তোমরাও ফিরছো ঘরমুখো যেখানে অপেক্ষা করে আছে তোমার প্রিয়জন, আর আমি নিখিল, তোমার বেতার বন্ধু, রয়েছি এই ফিরতি পথে তোমায় সঙ্গ দিতে। কি হলো? হিসেব মিলছেনা? ভাবছো এখন তো আর জে নিক এর স্পিক টু নিক নিয়ে আসার কথা? কনফিউশন মানে দ্বিধা দূর করে দিচ্ছি ছু মন্তরে, কিন্তু তার আগে বলোতো আজ কি দিন? হ্যাঁ, ঠিক তাই, আজ ইন্টারন্যাশনাল মানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আর তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আজ থেকে বাংরেজি তে কথা এক্কেবারে বন্ধ! আর আমিও তাই আর নিক নই, নিখিল। আরে বাবা, বাংলার মত একটা tradi... থুড়ি ঐতিহ্যবাহী ভাষার কদর না করে ঝুড়ি ঝুড়ি ইংরেজি শব্দে বাক্য বোঝাই করাতে কোনো পারদর্শিতা নেই। স্মার্টনেস তো নয়ই। এই রে, আবার স্মার্টনেস বলে ফেললাম। আসলে কিছু কিছু শব্দের বুঝলে তো, বাংলা যে কি, অনভ্যাসে ভুলতে বসেছি। দেখো তো, তোমরা মনে করতে পারো কিনা! আর একবার বলি, স্মার্টনেস এর বাংলা খুঁজে পেলেই ফোন করো ৯৮৩০০১০৮৩০ এই নম্বরে, ততক্ষণে আমি বরং তোমাদের শোনাই ভীষণ মিষ্টি একটা বাংলা গান।
অন্বেষা : হেলো।
নিখিল : হেলো, হ্যাঁ বলো। নিকের সাথে মনের কথা ভাগ করে নিতে কে আছো অপর প্রান্তে?
অন্বেষা: হাই, আমি অন্বেষা (বিতিকিচ্ছিরি উচ্চারণে)।
নিখিল : অন্বেষা? মানে অন্বেষা। আমাদের প্রথম কলার মানে কলার খোসায় পা পিছলে পড়লে যে জিনিসটা নেই বলে ধরে নেওয়া যায়, সেই স্মার্টনেস এর বাংলা খুঁজে দিতে এসেছে আমাদের প্রথম বন্ধু। স্বাগতম অন্বেষা।
অন্বেষা : ইসস, কি হয়েছে তোমার? All okay? Ki clown er Moto bokcho ?
নিখিল : ইয়ে মানে আজ আমাদের অনুষ্ঠানটার একটা বিশেষত্ব হলো আমরা আজ খাঁটি বাংলায় কথা বলছি। আমি যে শব্দগুলোর বাংলা জানিনা সেগুলোতে সাহায্য করবে তোমরা, মানে আমার শ্রোতা বন্ধুরা। তো অন্বেষা, স্মার্টনেস এর বাংলা তুমি তো জানোই, আমাদের সাথে ভাগ করে নাও এবার।
অন্বেষা: ওহ প্লিজ! ওসব শব্দের বাংলা টাঙলা আমি জানিনা। অনেকদিন ধরে তোমাকে ফোন করতে চেষ্টা করি, জাস্ট বিকজ আই লাভ ইউর ভয়েস and I am a regular listener of your show. আজকে কল কানেক্ট হয়ে গেল। ব্যস।
Nik : আচ্ছা, মানে বলতে চাইছো, আমার অনুষ্ঠান তোমার খুব ভালো লাগে। সেটা খুব ভালো কথা। শুনতে থাকো। তবে কথা ছিল স্মার্টনেস এর বাংলা জানাতে ফোন করার। তো একটু ভেবে বলো দেখি মাথায় আসছে কিনা?
অন্বেষা: স্মার্টনেস? চালাক চতুর? নট কনভিনসিং। এনিওয়ে, ওসব কে ভাবতে বসবে এখন? এমনিতেই লাইফে এত চাপ, last ek mas ধরে কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া। ক্যান ইউ বিলিভ আই failed the exam (ফুঁপিয়ে ওঠে)। নেক্সট টু উইকস আমার পরপর রিটেন আর প্র্যাকটিক্যাল সাপ্লি একজ্যামস। গড নোজ আমি কী করে ক্লিয়ার করবো। সেসব না ভেবে ইউ এক্সপেক্ট মি টু প্লে ডিকশনারি গেম নিক? নো ডিয়ার, নট টুডে।
নিক : ওকে (একটু টেনে সুর করে)। আই অ্যাম সো সরি !
অন্বেষা: তার ওপর ক্যাম্পাসিং, ক্যাট। এই সব কিছুর প্রেপ নেওয়া। আই ডোন্ট নো। আই ফিল সো লো অল দ্য টাইম। সো লস্ট। বাবা মাকে বলে বোঝাতে পারিনা। ওরা এক তো আমার স্ট্রেসের কথা বোঝেই না। উল্টে এমনিই বকে বকে লাইফ টা হেল করে দিয়েছে! সবকিছুর মাঝে ইউ আর the only source of fresh air নিক, মানে তুমি আমার extended family e hoye gecho. মানে বুঝতে পারছো?
নিক : হ্যাঁ অন্বেষা, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারলে যে গত তিন মিনিটে তুমি ২৪ টা ইংরেজি শব্দ বললে?
অন্বেষা: হ্যাঁ, বলেছি, তো?
নিক: না মানে basically আমাদের তো বলার কথা ছিল শুধু বাংলায়। আমরা না ঠিক করেছিলাম আজ থেকে জগা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবো না?
অন্বেষা : তুমিও তো বললে , basically?
নিক : আহা, সে তো পার্ট of the line।
অন্বেষা : হ্যাঁ, কিন্তু পার্ট of the line ' কথাটা তো আর পার্ট of the line noy, tahole?
নিক : হ্যাঁ , ঠিক এটাই আমি বলতে চাইছি যে ভাষার অন্তর্গত হলে
অন্বেষা : আই নো নিক, সকাল থেকে লোকজনের ফেসবুক আর ইন্সটাতে ওই বাংলা ভাষা, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ এটসেটরা দেখে দেখে আই এম বোর্ড। আমি সব জ্ঞানের কথা জানি। অল এবাউট হাউ উই, আওয়ার জেনেরশন ইস spoiling দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড অল দ্যাট crap।
নি: হ্যাঁ কিন্তু ভেবে দেখো...
অ(থামিয়ে দিয়ে): নিক, ভাষার আসল কাজ হলো মনের ভাব প্রকাশ করা। সেটা হয়ে গিয়ে থাকলেই I am more than happy. ভাভনাও কো সমঝো। বুঝে গেছো তো কী বলতে চাইছি? তাহলেই হলো।
নিক : হ্যাঁ কিন্তু -
অন্বেষা: আর শোনো না, যা বলতে তোমায় কল করলাম। ইউ আর টু গুড। তুমি বড্ড ভালো, সেনসিটিভ। আই থিংক আই হ্যাভ এ ক্রাশ অন ইউ।
নি: আচ্ছা.. তাই?
অ: হ্যাঁ। ইয়া, আই মিন, নো, নট ক্রাশ। আই থিংক আই লাভ ইউ নিক। একদিন মিট করবে প্লিজ?
নি: অনেক ধন্যবাদ অন্বেষা, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। কিন্তু এভাবে দেখা তো করা যায়না, তুমি বরং শুনতে থেকো আমার অনুষ্ঠান
অন্বেষা: yes!
নিঃ কী হলো?
অন্বেষা : আমার ক্রাশ ফোন করছে। ফর the first time he is calling me up! ওহ নিক ইউ আর সো লাকি ফর মী। Muah! Gotta go। U take care। Bye bye
( ফোন রাখার শব্দ)
নিক : এই দেখো, অন্বেষা, তোমার ভালো সময় শুরু হয়েই গেলো। তবে বন্ধুরা, স্মার্টনেস এর বাংলার খোঁজ কিন্তু এখনও পাওয়া গেলো না। ফোন লাইন খোলা আছে, চটপট চলে এসো সেই চেনা নম্বরে। আর শুনতে থাকো এক্কেবারে আনকোরা বাংলা গান ১০৮ দশমিক তিন এফ এমে।
(বাংলা গান background a)
রাইমা: এই নিখিল এই! কি হচ্ছে এটা?
নিক : কেনো? আমি তো বাঙলাতেই...
রাইমা: বাঙলাতেই?? ' ওহ আই এম সো সরি ' টা বাংলা??? আর কারা কারা ফোন করে তোকে? দেখছিস তো কি অডিয়েন্স বানিয়েছিস!
নিক : আরে যে ফোন করছে তার ভাষা আমি কি করে কন্ট্রোল করবো!
রাইমা : আজ যেটা পাচ্ছিস সেটা গতকালের কর্মের ফল তো। এতদিন ধরে শো টা এইভাবে চালিয়েছিস বলেই তো এরা ফোন করার সাহস পেয়েছে!
নিক : রাইমা দি, শো টা যে এত মানুষ শুনছে আর ভালোবাসছে, সেটার কি কোনো দাম নেই?
রাইমা: বাংলায় ভালোলাগা নিখিল। গোটা কথোপকথন বাংলায় বলতে না পারাটা কুল নয় নিখিল। এন্ড ইট ইজ নট ইম্পসিবল আইদার। সরকারি বেতার কেন্দ্রে শুনিস না? বাংলাকে ভালোবাস। বাংলায় কথা বল। লোককে বাংলায় কথা বলা। না পারলে, দায়িত্ব থেকে সরে যা।
নিঃ আমি চেষ্টা করছি রাইমাদি।
রাঃ দেখ নিখিল, আই নো, তুই পারবি। একটু এফরট দে। টেক স্মল স্টেপস। সারাক্ষণ কনশাসলি বাংলাতেই কথা বলে যা, ঠিক পারবি। আমি এলাম রে। ক্লায়েন্ট মিটিং আছে।
নিঃ হুম। (চাপা গলায়) নিজে বাংরেজিতে কথা বলবে, এদিকে আমি বললেই দোষ। আরে বাবা, ভাষা কি আর এখন সেই বিশ বছর আগের মতো আছে? ধুস।
জুঁই: কীরে নিখিল, মুখ ব্যাজার করে কেন?
নি: লম্বা গল্প।
জু: ভাষা বিভ্রাট?
নি: হুম।
জু: এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা মনে পড়লো। দাঁড়া ট্র্যাফিক আপডেটটা দিয়ে নিই। গানটা চালিয়ে বলছি।
নমস্কার কলকাতা। শুনছো ১০৮.৩। আর তোমার সাথে এসে গিয়েছি, তোমার বন্ধু, জুঁই। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। এইমুহুর্তে কোত্থাও কোনো যানজটের খবর নেই। রাস্তাঘাট এক্কেবারে মসৃণ। গাড়ি নিয়ে একটা লম্বা সফরে বেরোলে জমে যাবে কিন্তু, বলো? শুধু একটাই কথা, গাড়িটা কিন্তু সাবধানে চালিও। সঙ্গে রইলো তোমাদের জন্য একটা টাটকা গান।
(গান বাজবে)
নি: ইশ, কি ভালো বাংলা বলিস রে তুই!।
জু: বাংলা দিয়েই তো মন আর পেট দুইই ভরাচ্ছি রে। যাকগে, মজার কথাটা শোন। বাজারে যে নতুন ফোন টা এসেছে, রাস্তার ধারে বড় বড় করে তার হোরডিং ভরা বিজ্ঞাপন দেখেছিস? বলে নাকি BSI ক্যামেরা দেওয়া।
নিক: BSI, ব্যাকসাইড ইলুমিনেটেড?
জুঁই : তুই বল, ব্যাকসাইড মানে তো পশ্চাৎদেশ! পশ্চাৎদেশ আলোকিত। কোনো মানে হয়?
(দুজনেই হেসে ওঠে)
Scene 3
(মা মনের সুখে গুনগুন করে গান গাইছে কোন)
নিঃ মাতেঃ, আপনার সুপুত্রের ক্ষুধা পাইয়াছে। অনুগ্রহ করিয়া উহার ক্ষুধার অগ্নি নির্বাপণ করুন।
(মা গান গেয়েই চলেছে)
নিঃ (উচ্চ স্বরে) মাতেঃ? আপনি কি শুনিতে পাইতেছেন?
মাঃ ( গান থামিয়ে) কি? কি বলছিস? চিৎকার করছিস কেনো? এটা ভদ্রলোকের পাড়া তো, নাকি?
নিঃ বলিতেছিলাম মাতেঃ, আপনার সুপুত্র ক্ষুধায় একান্তই কাতর। উহাকে খাদ্য দাও। তুমি পুণ্যবতী হইবে।
(কোন কমিক গান/লাইন )
মাঃ সোজাসুজি বল না, খিদে পেয়েছে। পুরো যাত্রাদলের পাঁচ টাকা পাই এর মত ডায়লগ বলছিস কেন?
নিঃ মাতেঃ, আপনার পুত্রের জীবনে চরম সঙ্কট উপস্থিত। উহার দপ্তরে নির্দেশিকা এসেছে উপরমহল থেকে, অনুষ্ঠান সঞ্চালনার সময় বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে হবে। অগত্যা...
মাঃ অগত্যা?
নিঃ অগত্যা আমি সঙ্কল্প লইয়াছি, শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলিব। সম্ভব হইলে একটি দুইটি সংস্কৃত শব্দও ব্যবহার করিব।
মাঃ (হেসে) তাই বুঝি?
নিঃ নিশ্চয়! ইয়ে, অদ্য সকালে আপনার অলাবু সহযোগে চিঙ্গোরি মৎস্যের তরিকারী রন্ধন করিবার কথা ছিল। পাকশালে আপনি এমনটাই বলিতেছিলেন কৃষ্ণা মৎসীকে। উহা কি হইয়াছে?
মাঃ চিঙ্গোরী? তরিকারী? মতসী? কীসব আবোল তাবোল বলে যাচ্ছিস রে। হ্যাঁ রে বাবু, অদ্য টদ্য কী বলছিস রে? আদা বেটে দিবি? ও মা, আমার সোনা ছেলেটার আজ দেখছি মতিগতি শুধরে গিয়েছে। বাহ, দাঁড়া, ফ্রিজে আদা আছে। বের করে আনি। বেটে দে না মিক্সিতে। ছেলের আমার সুমতি হয়েছে দেখছি। শরৎ বাবু বেঁচে থাকলে আজ নতুন করে লিখতেন, নিখিলের সুমতি। আহা, ভাবলেও মন ভালো হয়ে যায়।
নিঃ দূর ছাই, তখন থেকে বলছি খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। তুমি সমানে অকারণে অন্য টপিকে কীসব ভুলভাল বকেই চলেছ।
মাঃ অ্যাই, একদম বাজে কথা বলবি না বলে দিলাম। মায়ের ওপর চিৎকার করা হচ্ছে? রোজের ওই তিড়িং বিরিং ছাইপাঁশ বকবকের পর একদিন একটু ভালো করে কথা বলছিস দেখে আমি অবাক হবো না বল? বললাম বলেই ওমনি মেজাজ দেখানো আমাকে? একটা বাড়ির কাজ করিস না। জানিস আমি একা হাতে এই বাড়ি সংসার সব সামলাই। তুই আর তোর বাবা, কেউ কুটোটি পর্যন্ত নেড়ে দিস না। ভালো লাগে না আমার। বাবু, একদম ভালো লাগে না।
নিঃ উফ, মা, নট আগেন। সারাদিন বসে বসে ও মাগো গিলবে আর আমার ওপরে সেই ডায়লগ ঝাড়বে! প্লিজ খ্যামা দাও! শোনো না যা বলছিলাম, সকালে লাউ চিংড়ি করবে বলেছিলে না?
মাঃ হ্যাঁ, করা আছে তো।
নিঃ (জিভ দিয়ে একটু লোভ লোভ গোছের শব্দ করে) তাহা হইলে উহাই দাও মাতেঃ। সাথে একটু গোধূমচূর্ণ এবং সলিলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাহাকে ভালো করিয়া দলিয়া ও মলিয়া আমাকে রোট্টিকা বেলিয়া দাও।
মাঃ গোধূমচূর্ণ, রোট্টিকা? কৃষ্ণাকে বলছি, ফ্রিজে আটা মাখা আছে। কয়েকটা রুটি বেলে দেবে। লাউ চিংড়ি দিয়ে খাও। আর আমায় উদ্ধার করো।
নিঃ মাতেঃ, তাইই তো বলছি তোমায় তখন থেকে। তুমি আমার আকুলি বিকুলি কাকুতি মিনতি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছ না।
মাঃ ভুলভাল বাংলা বললে আমি কী করে বুঝব? চিঙ্গোরি? রোট্টিকা? মতসী? যা ইচ্ছে তাই?
নিঃ এই মা, গোধূমচূর্ণ indeed is a word... শরদিন্দু ঐতিহাসিক উপন্যাসে আছে। বের করো, তৃতীয় খণ্ড।
মাঃ শরদিন্দু আবার কী? শরদিন্দু? বলো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমায়? এত কষ্ট করে ছোট থেকে ভালো স্কুলে ভালো টিচারের কাছে পড়িয়েছি, এই তার ফল? শোনো, কত রাত জেগে থেকেছি আমি, যাতে অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে এডমিশনের ফর্মের লাইনে দাঁড়াতে পারি। তোমার বাবা কিচ্ছুটি করেনি। কিচ্ছু না। উল্টে আমায় বারবার কথা শুনিয়েছে, টাকা খরচের জন্য। আটকাতে চেয়েছে। শিক্ষার মূল্য কেউ দিতে জানে এ বাড়িতে? মাকে বলেছিলাম, এই বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়ো না। শুনলো না। জীবনটা আমার শেষ হয়ে গেলো।
নিঃ আরে আবার শুরু হলো! কোথায় ভাবলাম পেটের জ্বালা জলদি মিটিয়ে তোমার সাথে একটু আলোচনা করবো। তুমি আফটার অল, সাহিত্যে এম এ। তা না...
মাঃ (গলা নামিয়ে সহানুভূতির সুরে) কিসের আলোচনা? কি হয়েছে বলবি খুলে? এত তখন থেকে বাংলা শুদ্ধ শব্দের পিছনে পড়েছিস?
নিখিল : (হতাশ গলায়) ধুর, চাকরি টা মনে হচ্ছে থাকবেনা বুঝলে?
মা : সেকি? কেনো রে?
নিক : আরে আর বলোনা, নতুন প্রোডাকশন ম্যানেজার এসেছেন না, রাইমা দি? তাঁর দাবি হলো, গোটা শো টা শুদ্ধ বাংলায় করতে হবে। আরে তুমি বলো, এখন সবাই ইংলিশ মেদিয়াম স্কুলে পড়ে। হলিউড এর সিনেমা, ওয়েব সিরিজ দেখে, সেখানে শুধু বাংলা বলতেই হবে বলে uncommon Kichu Bangla শব্দ ঢোকাতে হবে? এটাই কি আরো অবাস্তব করে দেবে না শো টা কে?
মা : হুম, তুই বলতে মনে পড়লো, দেখছিলাম বটে আজকাল খুব লেখালেখি হচ্ছে যে বেতার মাধ্যমের সঞ্চালোকেরা খিচুড়ি বাংলা বলেছেন। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব এমনিতেই বিপন্ন, তার মধ্যে..
নিক: ধুস! আজ try করেছিলাম। ধেরিয়েছি প্রোগ্রাম টা। ভালো লাগছেনা কিসসু।
মা: অ। তা শুদ্ধ বাংলা মানে? সমস্যাটা শুধুই ইংরেজি শব্দ নিয়ে নাকি যে কোনো অবাঙলা শব্দ?
নি: কি ডিফারেন্স?
মা: আছে আছে। বাংলায় এমন অনেক শব্দই আছে যার অরিজিন কিন্তু বিদেশি ভাষা। তবে ইংলিশ না।
নি: যেমন?
মা: যেমন ধর, বাবা বা দাদা। দুটোই তুর্কি শব্দ।
নি: ইন্টারেস্টিং
মা: ইভেন কমনস্য কমন শব্দ, যেমন ধর, খবর, এলাকা। এগুলো আরবি।
নি: দাঁড়াও, আমি নোট করে নিই। আরো কিছু বলো। কাল রাইমাদিকে বলবো। এগুলোই হবে আমার তুরুপের তাস।
মা: তুরুপ বললি, ওটাও ওলন্দাজ শব্দ জানিস তো।
নি: বাবাঃ!
মা: তোর রাইমাদিকে বলবি, ওইসব শুদ্ধ ভাষা চাইলে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপপুঞ্জে যেতে। ওখানে ছাড়া দুনিয়ায় আর কোথাও uninfluenced pure ভাষা কিচ্ছু পাবে না।
নি: ওহ মা! তুমিই জগৎ জননী, তুমিই বিপত্তারিনি মা আমার!
মা: এই শোনো, তা বলে ভেবোনা পার পাবে। মা বা রাইমাদি সহ্য করে নিলেও তোমার এই ওঁচা ভাষা বউ কিন্তু সহ্য করবেনা!
নিক : হেঁ হেঁ বউ তো ( ও মা গো -র মত ভঙ্গিতে)... এই দাঁড়াও, বউ? কে বউ?
মা : (মৃদু হেসে) কেনো জুঁই? ওর সব প্রোগ্রাম শুনি তো আমি, কি ভালো বাংলা বলে মেয়েটা! আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো?
নিক : এই যাহ, কি যে তুমি.... আচ্ছা শোনো না, বলছি যে সত্যিই আমাকে একটু বাংলাটা পড়াবে? মানে জুঁই না সত্যিই বাংলাটা এত admire kore...
মাঃ এই রুটি দিয়ে লাউ চিংড়ি খেয়ে আমায় উদ্ধার করো এখন, তারপর বামনদেবের বইটা নামাস, আমার আলমারির তিন নম্বর তাকে আছে। আর কাল থেকে রোজ পাঁচটা করে বাংলা শব্দ মুখস্থ করবি।
( কিছুক্ষণের পজ। )
হালকা ' মোদের গরব মোদের আশা ' বাজে, সাথে শোনা যায় নিখিল মুখস্থ করছে :
নিক : ক্রকচ মানে করাত, রিরংসা মানে অদম্য হিংসে, অন্বীক্ষা মানে অনুসন্ধান করিবার ইচ্ছে, ফ্রিকুয়ান্সি র বাংলা কম্পাঙ্ক, মডুলেশন এর বাংলা সামঞ্জস্য বিধান, মেগাহার্টজ এর বাংলা.... (আটকে যায়)
ও মা মেগাহার্টজ এর বাংলা কি??? (গলা উঁচিয়ে) মাআআ?
( গানের ভলিউম ধীরে ধীরে বাড়ে)
সমাপ্ত
Wednesday, October 30, 2019
Saturday, October 26, 2019
কালীপুজো, বাজি, ইত্যাদি...
আমার ছোটবেলায় কালীপুজোটা দাদাইবাড়ি কাটাতাম, হাওড়ায়। দাদাই, মানে আমার মায়ের বাবা। আমার দাদাভাই তখন পুজোর দিনে নিয়ম করে ছোট্ট করে একটা কালীমূর্তি কিনে এনে নিজের মতো করে পুজো করতও। সেই পুজোয় ছিলনা তেমনভাবে কোন মন্ত্র বা আড়ম্বর। ছিল অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। মইমা, মানে আমার দিদিমা, আমার মা আর মামণি, মানে আমার মাসি, ওরা তিনজনে মিলেই পুজোর প্রসাদের ব্যবস্থা করতো। ফল মিষ্টি লুচি সুজি এইসবই বোধহয়। ভালো মনে নেই কারণ এই পুজো বেশিদিন চলেনি। দাদাই চলে গেলো যখন আমি সবে ছয়, আর তারপর দাদাভাইয়ের পড়ার চাপ, ইত্যাদি। যাই হোক, পুজোর পরে শুরু হতো বাজি ফাটানো। তখন আমরা কেউই পরিবেশ বিষয়ে এমন সচেতন ছিলাম না (ধরে নিচ্ছি আজ আমরা সক্কলেই সচেতন)। এন্তার চকলেট বোম, কালীপটকা ফাটত। আমি অবশ্য সেইসবে খুবই ভয় পেতাম। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল তাই ফুলঝুরি। এবং ওই অত ছোটবেলায়, ফুলঝুরিও নিজে হাতে ধরতে সাহস পেতাম না। পাশের বাড়ির অলকা (?) কাকীমা প্যাঁকাটি দিয়ে ফুলঝুরি ধরিয়ে আমায় দিতো। বেশ ইয়া লম্বা দাঁড়াত ব্যাপারটা। অনেকটা দূরে আমার থেকে, অথচ কন্ট্রোল আমারই হাতে। বেশ লাগতো। হইহই করে জ্বালাতাম। দাদাইবাড়ির উঠোনে তারপর চড়কি জ্বালানো হতো। জ্বালানো হতো তুবড়িও। তবে ওই যে, আমার বরাবরের শব্দবাজি বা আগুন থেকে খুব ভয়।
আরেকটু বড় হয়েও ভয় কাটেনি। চিরকাল তাই ওই ফুলঝুরি চড়কিতেই আমার বাজি সীমাবদ্ধ। তাও চড়কিও নিজে জ্বালাইনি। বাবা কিংবা মা ওই কাজটি করত। ওই দু তিন প্যাকেট ফুলঝুরি আর এক বাক্স চড়কি, এই ছিল আমার বাজির বাজার। এর জন্য ঘটা করে বাজি বাজার থেকেও বাজি আনতে হতো না। পাড়ার দোকানেই পাওয়া যেত। কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই ভাইফোঁটা। মামা মামী মামণি দাদাভাই এরা সক্কলে আসতো আমাদের বাড়ি। সেদিন বেশ সুন্দর ফ্যামিলি গেট টুগেদার হতো আমাদের। পাঁঠার মাংসও ফিস ফ্রাই চিংড়ি পাবদা এইসব সাঁটানোর পর আমাদের সকলেরই মন একটু স্প্রাইট আর পান পান করতো। খেয়ে উঠে তাই মামা আর আমি বেরোতাম। একই দোকানে বিক্রি হতো বাজি। তখন ওই পড়ে থাকা কিছু। তবুও তাঁরই মধ্যে থেকে মামা কিনত রঙ মশাল, ইলেকট্রিক তার (এরকমই কিছু নাম তো ছিল মনে হচ্ছে), ছুঁচো বাজি, তুবড়ি, চড়কি, বিভিন্ন রঙের ফুলঝুরি। আমি হলাম গিয়ে মামার আদরের ভাগ্নি, তাই সব স্পেশাল এবং জাম্বো প্যাক আসতো আমার জন্য। মনের সুখে বাজি নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মায়ের মুখ ভার। হম্বিতম্বি। কেন এইসব কেনা হলো? আমার একেই সর্দি কাশির ধাত। পরশু থেকে স্কুল। এখন এইসব থেকে নতুন করে জ্বর জ্বালা হলে কে দেখবে? স্কুল খুললেই সেকেন্ড টার্ম। হ্যানা ত্যানা। তবুও তারই মধ্যে বেশ বিকেল হতে না হতে মামার দৌলতে ঝটপট চা পর্ব মিটে যেতেই মা চলে আসতো রসগোল্লার ট্রে নিয়ে। এটাই হলো সিগন্যাল। উৎসব পর্ব এই বছরের মতো শেষ। কিন্তু, উঁহু। হাতে গরম বাজিগুলো এখনও রয়েছে। সবাই চলে গেলে, বই খুলে পড়তে বসতে হতো। ওই যে? সেকেন্ড টার্ম। ফার্স্ট টার্মে এমন ধ্যারান ধেড়িয়েছি, কোন কথা বলার সাহস নেই আমার। কোনমতে সাড়ে নটা বাজতেই ডিনার। আর তারপরেই ম্যাজিকের রাজ্য। কালীপুজোর পরেও আনন্দ শুষে নিতে আরো বাজি, অনেক আলো, অনেক রঙ। তুবড়িগুলো অবধারিত ফেটে যেতো অল্প উঠেই, চড়কিও ফেটেছে। রাত্তিরে মামাকে ফোন করে বাজির ফিডব্যাক দিয়েছি। প্রতিবার ঠিক করি, না, আর এইগুলো কিনব না। ঠকায়। তবুও, এই ট্র্যাডিশন চলেই এসেছে। অনেকগুলো বছর পর্যন্ত।
এখন অবশ্য ক্যাম্পাসে বাজি ফাটানো নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। আর ওই এন্থুও নেই ঘুরে ঘুরে বাজি কেনার। এখন তাই কালীপুজো মানে আমার ঘরটাকে একটু আলো দিয়ে সাজানো। আর কালীবাড়ি গিয়ে পুজো দেখা, অঞ্জলি দেওয়া আর ভোগ খাওয়া। পালটাচ্ছে অনেক কিছুই, তবুও, ভালোই তো লাগে।
আমার ছোটবেলায় কালীপুজোটা দাদাইবাড়ি কাটাতাম, হাওড়ায়। দাদাই, মানে আমার মায়ের বাবা। আমার দাদাভাই তখন পুজোর দিনে নিয়ম করে ছোট্ট করে একটা কালীমূর্তি কিনে এনে নিজের মতো করে পুজো করতও। সেই পুজোয় ছিলনা তেমনভাবে কোন মন্ত্র বা আড়ম্বর। ছিল অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। মইমা, মানে আমার দিদিমা, আমার মা আর মামণি, মানে আমার মাসি, ওরা তিনজনে মিলেই পুজোর প্রসাদের ব্যবস্থা করতো। ফল মিষ্টি লুচি সুজি এইসবই বোধহয়। ভালো মনে নেই কারণ এই পুজো বেশিদিন চলেনি। দাদাই চলে গেলো যখন আমি সবে ছয়, আর তারপর দাদাভাইয়ের পড়ার চাপ, ইত্যাদি। যাই হোক, পুজোর পরে শুরু হতো বাজি ফাটানো। তখন আমরা কেউই পরিবেশ বিষয়ে এমন সচেতন ছিলাম না (ধরে নিচ্ছি আজ আমরা সক্কলেই সচেতন)। এন্তার চকলেট বোম, কালীপটকা ফাটত। আমি অবশ্য সেইসবে খুবই ভয় পেতাম। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল তাই ফুলঝুরি। এবং ওই অত ছোটবেলায়, ফুলঝুরিও নিজে হাতে ধরতে সাহস পেতাম না। পাশের বাড়ির অলকা (?) কাকীমা প্যাঁকাটি দিয়ে ফুলঝুরি ধরিয়ে আমায় দিতো। বেশ ইয়া লম্বা দাঁড়াত ব্যাপারটা। অনেকটা দূরে আমার থেকে, অথচ কন্ট্রোল আমারই হাতে। বেশ লাগতো। হইহই করে জ্বালাতাম। দাদাইবাড়ির উঠোনে তারপর চড়কি জ্বালানো হতো। জ্বালানো হতো তুবড়িও। তবে ওই যে, আমার বরাবরের শব্দবাজি বা আগুন থেকে খুব ভয়।
আরেকটু বড় হয়েও ভয় কাটেনি। চিরকাল তাই ওই ফুলঝুরি চড়কিতেই আমার বাজি সীমাবদ্ধ। তাও চড়কিও নিজে জ্বালাইনি। বাবা কিংবা মা ওই কাজটি করত। ওই দু তিন প্যাকেট ফুলঝুরি আর এক বাক্স চড়কি, এই ছিল আমার বাজির বাজার। এর জন্য ঘটা করে বাজি বাজার থেকেও বাজি আনতে হতো না। পাড়ার দোকানেই পাওয়া যেত। কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই ভাইফোঁটা। মামা মামী মামণি দাদাভাই এরা সক্কলে আসতো আমাদের বাড়ি। সেদিন বেশ সুন্দর ফ্যামিলি গেট টুগেদার হতো আমাদের। পাঁঠার মাংসও ফিস ফ্রাই চিংড়ি পাবদা এইসব সাঁটানোর পর আমাদের সকলেরই মন একটু স্প্রাইট আর পান পান করতো। খেয়ে উঠে তাই মামা আর আমি বেরোতাম। একই দোকানে বিক্রি হতো বাজি। তখন ওই পড়ে থাকা কিছু। তবুও তাঁরই মধ্যে থেকে মামা কিনত রঙ মশাল, ইলেকট্রিক তার (এরকমই কিছু নাম তো ছিল মনে হচ্ছে), ছুঁচো বাজি, তুবড়ি, চড়কি, বিভিন্ন রঙের ফুলঝুরি। আমি হলাম গিয়ে মামার আদরের ভাগ্নি, তাই সব স্পেশাল এবং জাম্বো প্যাক আসতো আমার জন্য। মনের সুখে বাজি নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মায়ের মুখ ভার। হম্বিতম্বি। কেন এইসব কেনা হলো? আমার একেই সর্দি কাশির ধাত। পরশু থেকে স্কুল। এখন এইসব থেকে নতুন করে জ্বর জ্বালা হলে কে দেখবে? স্কুল খুললেই সেকেন্ড টার্ম। হ্যানা ত্যানা। তবুও তারই মধ্যে বেশ বিকেল হতে না হতে মামার দৌলতে ঝটপট চা পর্ব মিটে যেতেই মা চলে আসতো রসগোল্লার ট্রে নিয়ে। এটাই হলো সিগন্যাল। উৎসব পর্ব এই বছরের মতো শেষ। কিন্তু, উঁহু। হাতে গরম বাজিগুলো এখনও রয়েছে। সবাই চলে গেলে, বই খুলে পড়তে বসতে হতো। ওই যে? সেকেন্ড টার্ম। ফার্স্ট টার্মে এমন ধ্যারান ধেড়িয়েছি, কোন কথা বলার সাহস নেই আমার। কোনমতে সাড়ে নটা বাজতেই ডিনার। আর তারপরেই ম্যাজিকের রাজ্য। কালীপুজোর পরেও আনন্দ শুষে নিতে আরো বাজি, অনেক আলো, অনেক রঙ। তুবড়িগুলো অবধারিত ফেটে যেতো অল্প উঠেই, চড়কিও ফেটেছে। রাত্তিরে মামাকে ফোন করে বাজির ফিডব্যাক দিয়েছি। প্রতিবার ঠিক করি, না, আর এইগুলো কিনব না। ঠকায়। তবুও, এই ট্র্যাডিশন চলেই এসেছে। অনেকগুলো বছর পর্যন্ত।
এখন অবশ্য ক্যাম্পাসে বাজি ফাটানো নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। আর ওই এন্থুও নেই ঘুরে ঘুরে বাজি কেনার। এখন তাই কালীপুজো মানে আমার ঘরটাকে একটু আলো দিয়ে সাজানো। আর কালীবাড়ি গিয়ে পুজো দেখা, অঞ্জলি দেওয়া আর ভোগ খাওয়া। পালটাচ্ছে অনেক কিছুই, তবুও, ভালোই তো লাগে।
Friday, October 25, 2019
কালী পুজো
বছর ষাটের মীরা। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের এক প্রাচীন বাড়িতে থাকেন। একলাই। বাড়িতে উনি ছাড়া লোক বলতে দিনরাত্তিরের কাজের লোক মঞ্জু। সেও আছে প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেলো। মীরার ছেলে শোভন কলকাতাতেই থাকে। নিজের এবং স্ত্রী সৃজার অফিসের যাতায়াতের সুবিধার্থে ভবানীপুর ছেড়ে নিউ সংসার পেতেছে নিউ টাউনে। সারাদিন একা একা মীরার মোটেই ভালো লাগেনা। শোভনের যখন বিয়ে দেন, নিজে পছন্দ করে, সম্বন্ধ দেখে, ভেবেছিলেন বৌমা, নাতি নাতনি ছেলে নিয়ে ভরা সংসার হবে। নাহ। মায়ের সাথে সেই যে বিয়ে নিয়ে শোভনের মনোমালিন্য হয়েছিল, তার রেশ এখনও বজায় আছে। ছেলে আর কিছুতেই মায়ের কাছে ফেরেনি। বম্বে থেকে পোস্টিং নিয়ে কলকাতায় এসেও তাই এ মুখো হয়নি। নিয়ম করে কর্তব্যের খাতিরে মাসান্তে মায়ের অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা ঢুকে যায় ঠিকই, তবে মা পায়না ছেলেকে। নাতনির সাথেও দেখা হয়না। এমনকি এত পছন্দ করে আনা বৌমা সৃজা, সেও সময়ই পায়না একবার ফোন পর্যন্ত করার।
রোজ সকালের মতোই ঠাকুরঘরের কাজ সেরে বারান্দার বেতের চেয়ারে এসে বসলেন মীরা। সবে সাড়ে নটা। গোটা দিন সামনে পড়ে। মঞ্জু এসে এক কাপ চা আর দু পিস পাউরুটি আর ছানা রেখে গেলো সাইড টেবিলে। মীরা চশমার বাক্স থেকে চশমা বের করতে করতে আনন্দবাজারটা হাতে নিলেন। প্রথম পাতায় বড় বড় করে হেডলাইন। "দেওয়ালির রাতে শিশু পাচার চক্র থেকে ২৫ জন শিশু উদ্ধার করলেন তরুণী পুলিশ অফিসার।" সাথে সেই উদ্ধার হওয়া ২৫টি শিশুর সাথে এক পুলিশ অফিসারের ছবি। একটু চেনা চেনা লাগছে যেন ছবিটা। মীরা চশমাটা ঠিক করে পরে হাতে কাগজটা তুলে দেখলেন।
জ্বলজ্বল করছে তরুণী অফিসারের নাম। সোমদত্তা গুহ। কাগজটা চোখের সামনে এনে ধরলেন মীরা। ঠিকই তো। সেই একই মানুষ। রোগা, লম্বা। কালো। দু চোখে অসম্ভব এক দীপ্তি। পরনে পুলিশের উর্দি। চোখে মুখে এক দারুণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। এতগুলো শিশুকে উদ্ধার করার তৃপ্তি। এই মুখটা যেন অনেক বেশী উজ্জ্বল, অনেক বেশী দৃপ্ত, দৃঢ়। পাঁচ বছর আগের সেই সোমদত্তার চেয়ে। যেদিন ওকে বাড়িতে ডেকে মীরা নিজে বলেছিলেন, "শোনো সোমদত্তা, তুমি শোভনের খুব ভালো বন্ধু হতে পারো। কিন্তু দেখো, তোমার সাথে ওর বিয়ে আমি কিছুতেই দিতে পারবো না। কিছু মনে করো না, তুমি লেখাপড়ায় ভালো, তোমার ফ্যামিলিও ভালো। কিন্তু আমার শোভনের পাশে তোমায় মানাবে না। তোমার ইয়ে, মানে, গায়ের রঙটা তো..." সেদিন সোমদত্তা কিচ্ছু বলেনি। মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। এবং আশ্চর্যভাবে শোভনের সাথেও আর কোন সম্পর্কও রাখেনি। শোভন অবাক হয়ে গিয়েছিল। মীরার সাথে সোমের এই কথোপকথন জানতো না।
মীরা খবরের কাগজটা হাতে ধরে বসে থাকে খানিকক্ষণ। চোখ বারান্দার বাইরে, শূন্যে। মঞ্জু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। একবার আলতো করে মীরার কাঁধে টোকা দিয়ে বলে, "এই সেই দিদিটা না মা? দাদার কাছে খুব আসতো আগে? কাগজে ছবি এলো কেন? কী করেছে?" মীরা নীচুস্বরে উত্তর দেয়, "ও মেয়ে মস্ত বড় হয়েছে। ওই তো কতজনকে অন্ধকার থেকে আজ আলোয় এনেছে। বড্ড ভুল করেছিলাম আমি সেদিন। বড্ড ভুল..." এই বলে মীরা পাশে রাখা এফ এম রেডিওটা ছালায়। আকাশবাণী কেন্দ্রে তখন চলছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
আরেক কালো মেয়েকে বিখ্যাত করে দেওয়া শিল্পী তখন গাইছেন,
"আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো--
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।"
রোজ সকালের মতোই ঠাকুরঘরের কাজ সেরে বারান্দার বেতের চেয়ারে এসে বসলেন মীরা। সবে সাড়ে নটা। গোটা দিন সামনে পড়ে। মঞ্জু এসে এক কাপ চা আর দু পিস পাউরুটি আর ছানা রেখে গেলো সাইড টেবিলে। মীরা চশমার বাক্স থেকে চশমা বের করতে করতে আনন্দবাজারটা হাতে নিলেন। প্রথম পাতায় বড় বড় করে হেডলাইন। "দেওয়ালির রাতে শিশু পাচার চক্র থেকে ২৫ জন শিশু উদ্ধার করলেন তরুণী পুলিশ অফিসার।" সাথে সেই উদ্ধার হওয়া ২৫টি শিশুর সাথে এক পুলিশ অফিসারের ছবি। একটু চেনা চেনা লাগছে যেন ছবিটা। মীরা চশমাটা ঠিক করে পরে হাতে কাগজটা তুলে দেখলেন।
জ্বলজ্বল করছে তরুণী অফিসারের নাম। সোমদত্তা গুহ। কাগজটা চোখের সামনে এনে ধরলেন মীরা। ঠিকই তো। সেই একই মানুষ। রোগা, লম্বা। কালো। দু চোখে অসম্ভব এক দীপ্তি। পরনে পুলিশের উর্দি। চোখে মুখে এক দারুণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। এতগুলো শিশুকে উদ্ধার করার তৃপ্তি। এই মুখটা যেন অনেক বেশী উজ্জ্বল, অনেক বেশী দৃপ্ত, দৃঢ়। পাঁচ বছর আগের সেই সোমদত্তার চেয়ে। যেদিন ওকে বাড়িতে ডেকে মীরা নিজে বলেছিলেন, "শোনো সোমদত্তা, তুমি শোভনের খুব ভালো বন্ধু হতে পারো। কিন্তু দেখো, তোমার সাথে ওর বিয়ে আমি কিছুতেই দিতে পারবো না। কিছু মনে করো না, তুমি লেখাপড়ায় ভালো, তোমার ফ্যামিলিও ভালো। কিন্তু আমার শোভনের পাশে তোমায় মানাবে না। তোমার ইয়ে, মানে, গায়ের রঙটা তো..." সেদিন সোমদত্তা কিচ্ছু বলেনি। মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। এবং আশ্চর্যভাবে শোভনের সাথেও আর কোন সম্পর্কও রাখেনি। শোভন অবাক হয়ে গিয়েছিল। মীরার সাথে সোমের এই কথোপকথন জানতো না।
মীরা খবরের কাগজটা হাতে ধরে বসে থাকে খানিকক্ষণ। চোখ বারান্দার বাইরে, শূন্যে। মঞ্জু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। একবার আলতো করে মীরার কাঁধে টোকা দিয়ে বলে, "এই সেই দিদিটা না মা? দাদার কাছে খুব আসতো আগে? কাগজে ছবি এলো কেন? কী করেছে?" মীরা নীচুস্বরে উত্তর দেয়, "ও মেয়ে মস্ত বড় হয়েছে। ওই তো কতজনকে অন্ধকার থেকে আজ আলোয় এনেছে। বড্ড ভুল করেছিলাম আমি সেদিন। বড্ড ভুল..." এই বলে মীরা পাশে রাখা এফ এম রেডিওটা ছালায়। আকাশবাণী কেন্দ্রে তখন চলছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
আরেক কালো মেয়েকে বিখ্যাত করে দেওয়া শিল্পী তখন গাইছেন,
"আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো--
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।"
Monday, October 21, 2019
পটলের দোরমা
অফিস থেকে ফিরে সবে চায়ের কাপ হাতে টিভি খুলে বসেছি, ভাবছি আজ রাত্রে কী খাবার খাওয়া যায়, কোত্থেকে অর্ডার করবো, এমন সময়ে মল্লিকার ফোন। মল্লিকা আমার কলিগ, বিগত তিন বছর ধরে আমরা একই ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি। সরকারি অফিস। খুব বাড়াবাড়ি রকমের কাজের চাপ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সারাদিনে মোটামুটি গল্পগুজব ভালোই হয়। দুজনেই কাছাকাছি বয়সের হওয়ায়, এই অজ পাড়াগাঁয়ের অফিসের সহকর্মী দুজনের মধ্যে ভাব বেশ ভালো। মল্লিকার দিক থেকে ব্যাপারটা ভাবেই সীমিত। তবে আমার দিক থেকে ভালোবাসার চেষ্টাও যে নেই, তা বলা মিথ্যে।
মল্লিকা ভারী মিষ্টি একটি মেয়ে। লম্বায় প্রায় আমার সমান। ছিপছিপে চেহারা। ব্যক্তিত্বময়ী। ও আমার চেয়ে ঠিক এক বছরের বড়। শুরুতে আমি ওকে মল্লিকাদি বললেও, ওই একদিন বললো, "রুদ্র, এই দিদি দিদি বলিস না তো। বড্ড অসুবিধে হয়" ব্যস। আমিও লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। মনে মনে যাকে অল্প হলেও ভালোবাসি, তাকে দিদি বলে ডাকতে অস্বস্তি হতই। যতই হোক, মধ্যবিত্ত বাঙালি বলে কথা। তা এ হেন অলিখিত পারমিশন পাওয়ার পর থেকে আমায় কে আটকায়। শুরু হয়ে গেল ভালোমতন ঠাট্টা ইয়ার্কি গুলতানি। সেই সুযোগে মাঝে মাঝেই হালকা ফ্লার্টও করেছি।
মল্লিকা সিঙ্গল। বছরখানেক আগে তনয়ের সাথে ওর ব্রেক আপ হয়েছে। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই ওকে মনে মনে পছন্দ করি। মনের মধ্যে চাপ। ব্রেক আপের সময় ভালো বন্ধুর মতো ওকে সান্ত্বনা দিয়েছি, সঙ্গ দিয়েছি। সামনাসামনি খুব মন খারাপের ভান করলেও ভিতরে ভিতরে খুশিতে নেচেছি। মল্লিকা বোঝেনি। হয়তো। কিন্তু ইদানিং আমার ফ্লার্ট করাটা বেড়ে গিয়েছে। মল্লিকা বুঝতেও পারে। মানে, আমি বোঝাতে চাই বলেই বোঝে। যদিও পাত্তা দেয়না বিশেষ। তবু আমি মনে মনে আশা করে থাকি। যদি কোনোদিনও ওর মন গলে।
আমরা একসাথে মাঝে মাঝে টাউনে যাই। বাজারহাট করতে। সিনেমা দেখতে। আমি একদমই বলা চলে রান্না করতে পারি না। কাজের দিদি এসে রোজ রান্না করে দিয়ে যায়। মল্লিকা মাঝেসাঝে এটা ওটা রেঁধে নিয়ে আসে আমার জন্য। মল্লিকা আমিষ নিরামিষ সব রান্নায় পটু। আমি অনেকবার ওকে বলেছি আমার মায়ের হাতের পটলের দোরমা আমার খুব প্রিয় খাবার। কাজের দিদি একদম বানাতে পারে না। ও এতো রন্ধনপটিয়সী। ও যেন আমায় বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু পটলের নামে ও এক্কেবারে মুখ ভ্যাটকায়। পটল নাকি ওর মতে সবচেয়ে খারাপ খেতে। অখাদ্য। টাউনে খেতে গেলে অর্ডার করতে দেয়না। এদিকে আমায় বসে বসে ওর সাথে বেগুনের বাসন্তী খেতে হয়। আমার বেগুনে চরম এলার্জি। যাই হোক।
মল্লিকার ফোনে ফিরি। ও বেশ উত্তেজিত অথচ আমুদে কণ্ঠে বললো, "শোন, রাত্রে তোর বাড়ি খাবো। ভাত বসা। বাকি আমি আসছি।" কে জানে, কী প্ল্যান ওর। এইরকম হুটহাট প্ল্যান অবশ্য ও আগেও করেছে। ও রেঁধেছে। আমরা একসাথে খেয়েছি। তারপর বসে ল্যাপটপে সিনেমা দেখেছি। আজও নিশ্চয়ই এর অন্যথা হবে না।
আধ ঘন্টার মধ্যে মল্লিকা এলো। এসেই দরজায় ধাক্কা। আমি দরজা খুলে দিলাম। ও ভিতরে ঢুকলো। একটা হালকা কমলা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। ভারী সুন্দর লাগছে খোলা চুলে। ওর হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ওকে বললাম, "তুমি বসো। আমি এটা টেবিলে রেখে আসছি। ভাত বসিয়েছি রাইসকুকারে। এক্ষুণি হয়ে যাবে।"
মল্লিকা বসলো না। হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে আমার পিছন পিছন খাবার ঘরে এলো। এক টুকরো হাসি মুখে মেখে বেশ একটা আদুরে গলায় বললো, "ভাত হলো? নিয়ে আয়। সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে।" বাবাঃ, এত উৎসাহ? ব্যাপার কী? আমি বললাম, "তুমি বসো না। আমি খাবার বেড়ে আনছি।" মল্লিকা রহস্যময়ী হাসি হেসে উত্তর দিলো, "উঁহু। আমিও থাকি। তুই ভাত আন। আমি বাড়বো।" মল্লিকা যখন ঠিক করেছে ও করবে, মানে ওই করবে। আমি হাজার বললেও শুনবে না। আমি চুপচাপ আর কোনো কথা না বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। দুজনের জন্য দুটো থালায় ভাত বেড়ে ঘরে ঢুকতেই নাকে এলো একটা সুগন্ধি ঝাপ্টা। এ কী, এই গন্ধটা তো আমার ভীষণ চেনা। ভীষণ প্রিয়।
বড় জামবাটিতে জ্বলজ্বল করছে তেল মসলার রসায় নধর পটল। পটলের দোরমা। মায়ের রেসিপি।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মল্লিকা মুচকি মুচকি হাসছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো, "কী, কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?" আমি কী উত্তর দেবো, ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় মল্লিকা আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, "পটলের দোরমাটা যদি সাকসেসফুল হয়, তাহলে ভাবছি কাকিমার কাছে এপ্লিকেশন দেবো। বৌমা পদের জন্য। ভালো রেকমেন্ডেশন দিবি তো?"
আমি এর কী উত্তর দিই? আমার গালদুটো তখন সামনে রাখা স্যালাডের টমেটোর মতোই লাল।
মল্লিকা ভারী মিষ্টি একটি মেয়ে। লম্বায় প্রায় আমার সমান। ছিপছিপে চেহারা। ব্যক্তিত্বময়ী। ও আমার চেয়ে ঠিক এক বছরের বড়। শুরুতে আমি ওকে মল্লিকাদি বললেও, ওই একদিন বললো, "রুদ্র, এই দিদি দিদি বলিস না তো। বড্ড অসুবিধে হয়" ব্যস। আমিও লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। মনে মনে যাকে অল্প হলেও ভালোবাসি, তাকে দিদি বলে ডাকতে অস্বস্তি হতই। যতই হোক, মধ্যবিত্ত বাঙালি বলে কথা। তা এ হেন অলিখিত পারমিশন পাওয়ার পর থেকে আমায় কে আটকায়। শুরু হয়ে গেল ভালোমতন ঠাট্টা ইয়ার্কি গুলতানি। সেই সুযোগে মাঝে মাঝেই হালকা ফ্লার্টও করেছি।
মল্লিকা সিঙ্গল। বছরখানেক আগে তনয়ের সাথে ওর ব্রেক আপ হয়েছে। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই ওকে মনে মনে পছন্দ করি। মনের মধ্যে চাপ। ব্রেক আপের সময় ভালো বন্ধুর মতো ওকে সান্ত্বনা দিয়েছি, সঙ্গ দিয়েছি। সামনাসামনি খুব মন খারাপের ভান করলেও ভিতরে ভিতরে খুশিতে নেচেছি। মল্লিকা বোঝেনি। হয়তো। কিন্তু ইদানিং আমার ফ্লার্ট করাটা বেড়ে গিয়েছে। মল্লিকা বুঝতেও পারে। মানে, আমি বোঝাতে চাই বলেই বোঝে। যদিও পাত্তা দেয়না বিশেষ। তবু আমি মনে মনে আশা করে থাকি। যদি কোনোদিনও ওর মন গলে।
আমরা একসাথে মাঝে মাঝে টাউনে যাই। বাজারহাট করতে। সিনেমা দেখতে। আমি একদমই বলা চলে রান্না করতে পারি না। কাজের দিদি এসে রোজ রান্না করে দিয়ে যায়। মল্লিকা মাঝেসাঝে এটা ওটা রেঁধে নিয়ে আসে আমার জন্য। মল্লিকা আমিষ নিরামিষ সব রান্নায় পটু। আমি অনেকবার ওকে বলেছি আমার মায়ের হাতের পটলের দোরমা আমার খুব প্রিয় খাবার। কাজের দিদি একদম বানাতে পারে না। ও এতো রন্ধনপটিয়সী। ও যেন আমায় বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু পটলের নামে ও এক্কেবারে মুখ ভ্যাটকায়। পটল নাকি ওর মতে সবচেয়ে খারাপ খেতে। অখাদ্য। টাউনে খেতে গেলে অর্ডার করতে দেয়না। এদিকে আমায় বসে বসে ওর সাথে বেগুনের বাসন্তী খেতে হয়। আমার বেগুনে চরম এলার্জি। যাই হোক।
মল্লিকার ফোনে ফিরি। ও বেশ উত্তেজিত অথচ আমুদে কণ্ঠে বললো, "শোন, রাত্রে তোর বাড়ি খাবো। ভাত বসা। বাকি আমি আসছি।" কে জানে, কী প্ল্যান ওর। এইরকম হুটহাট প্ল্যান অবশ্য ও আগেও করেছে। ও রেঁধেছে। আমরা একসাথে খেয়েছি। তারপর বসে ল্যাপটপে সিনেমা দেখেছি। আজও নিশ্চয়ই এর অন্যথা হবে না।
আধ ঘন্টার মধ্যে মল্লিকা এলো। এসেই দরজায় ধাক্কা। আমি দরজা খুলে দিলাম। ও ভিতরে ঢুকলো। একটা হালকা কমলা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। ভারী সুন্দর লাগছে খোলা চুলে। ওর হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ওকে বললাম, "তুমি বসো। আমি এটা টেবিলে রেখে আসছি। ভাত বসিয়েছি রাইসকুকারে। এক্ষুণি হয়ে যাবে।"
মল্লিকা বসলো না। হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে আমার পিছন পিছন খাবার ঘরে এলো। এক টুকরো হাসি মুখে মেখে বেশ একটা আদুরে গলায় বললো, "ভাত হলো? নিয়ে আয়। সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে।" বাবাঃ, এত উৎসাহ? ব্যাপার কী? আমি বললাম, "তুমি বসো না। আমি খাবার বেড়ে আনছি।" মল্লিকা রহস্যময়ী হাসি হেসে উত্তর দিলো, "উঁহু। আমিও থাকি। তুই ভাত আন। আমি বাড়বো।" মল্লিকা যখন ঠিক করেছে ও করবে, মানে ওই করবে। আমি হাজার বললেও শুনবে না। আমি চুপচাপ আর কোনো কথা না বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। দুজনের জন্য দুটো থালায় ভাত বেড়ে ঘরে ঢুকতেই নাকে এলো একটা সুগন্ধি ঝাপ্টা। এ কী, এই গন্ধটা তো আমার ভীষণ চেনা। ভীষণ প্রিয়।
বড় জামবাটিতে জ্বলজ্বল করছে তেল মসলার রসায় নধর পটল। পটলের দোরমা। মায়ের রেসিপি।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মল্লিকা মুচকি মুচকি হাসছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো, "কী, কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?" আমি কী উত্তর দেবো, ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় মল্লিকা আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, "পটলের দোরমাটা যদি সাকসেসফুল হয়, তাহলে ভাবছি কাকিমার কাছে এপ্লিকেশন দেবো। বৌমা পদের জন্য। ভালো রেকমেন্ডেশন দিবি তো?"
আমি এর কী উত্তর দিই? আমার গালদুটো তখন সামনে রাখা স্যালাডের টমেটোর মতোই লাল।
Subscribe to:
Posts (Atom)