কালীপুজো, বাজি, ইত্যাদি...
আমার ছোটবেলায় কালীপুজোটা দাদাইবাড়ি
কাটাতাম, হাওড়ায়। দাদাই, মানে আমার মায়ের বাবা। আমার দাদাভাই তখন পুজোর
দিনে নিয়ম করে ছোট্ট করে একটা কালীমূর্তি কিনে এনে নিজের মতো করে পুজো
করতও। সেই পুজোয় ছিলনা তেমনভাবে কোন মন্ত্র বা আড়ম্বর। ছিল অগাধ ভক্তি ও
শ্রদ্ধা। মইমা, মানে আমার দিদিমা, আমার মা আর মামণি, মানে আমার মাসি, ওরা
তিনজনে মিলেই পুজোর প্রসাদের ব্যবস্থা করতো। ফল মিষ্টি লুচি সুজি এইসবই
বোধহয়। ভালো মনে নেই কারণ এই পুজো বেশিদিন চলেনি। দাদাই চলে গেলো যখন আমি
সবে ছয়, আর তারপর দাদাভাইয়ের পড়ার চাপ, ইত্যাদি। যাই হোক, পুজোর পরে শুরু
হতো বাজি ফাটানো। তখন আমরা কেউই পরিবেশ বিষয়ে এমন সচেতন ছিলাম না (ধরে
নিচ্ছি আজ আমরা সক্কলেই সচেতন)। এন্তার চকলেট বোম, কালীপটকা ফাটত। আমি
অবশ্য সেইসবে খুবই ভয় পেতাম। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল তাই ফুলঝুরি। এবং ওই অত
ছোটবেলায়, ফুলঝুরিও নিজে হাতে ধরতে সাহস পেতাম না। পাশের বাড়ির অলকা (?)
কাকীমা প্যাঁকাটি দিয়ে ফুলঝুরি ধরিয়ে আমায় দিতো। বেশ ইয়া লম্বা দাঁড়াত
ব্যাপারটা। অনেকটা দূরে আমার থেকে, অথচ কন্ট্রোল আমারই হাতে। বেশ লাগতো।
হইহই করে জ্বালাতাম। দাদাইবাড়ির উঠোনে তারপর চড়কি জ্বালানো হতো। জ্বালানো
হতো তুবড়িও। তবে ওই যে, আমার বরাবরের শব্দবাজি বা আগুন থেকে খুব ভয়।
আরেকটু বড় হয়েও ভয় কাটেনি। চিরকাল তাই ওই ফুলঝুরি চড়কিতেই আমার বাজি
সীমাবদ্ধ। তাও চড়কিও নিজে জ্বালাইনি। বাবা কিংবা মা ওই কাজটি করত। ওই দু
তিন প্যাকেট ফুলঝুরি আর এক বাক্স চড়কি, এই ছিল আমার বাজির বাজার। এর জন্য
ঘটা করে বাজি বাজার থেকেও বাজি আনতে হতো না। পাড়ার দোকানেই পাওয়া যেত।
কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই ভাইফোঁটা। মামা মামী মামণি দাদাভাই এরা
সক্কলে আসতো আমাদের বাড়ি। সেদিন বেশ সুন্দর ফ্যামিলি গেট টুগেদার হতো
আমাদের। পাঁঠার মাংসও ফিস ফ্রাই চিংড়ি পাবদা এইসব সাঁটানোর পর আমাদের
সকলেরই মন একটু স্প্রাইট আর পান পান করতো। খেয়ে উঠে তাই মামা আর আমি
বেরোতাম। একই দোকানে বিক্রি হতো বাজি। তখন ওই পড়ে থাকা কিছু। তবুও তাঁরই
মধ্যে থেকে মামা কিনত রঙ মশাল, ইলেকট্রিক তার (এরকমই কিছু নাম তো ছিল মনে
হচ্ছে), ছুঁচো বাজি, তুবড়ি, চড়কি, বিভিন্ন রঙের ফুলঝুরি। আমি হলাম গিয়ে
মামার আদরের ভাগ্নি, তাই সব স্পেশাল এবং জাম্বো প্যাক আসতো আমার জন্য। মনের
সুখে বাজি নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মায়ের মুখ ভার। হম্বিতম্বি। কেন এইসব কেনা
হলো? আমার একেই সর্দি কাশির ধাত। পরশু থেকে স্কুল। এখন এইসব থেকে নতুন করে
জ্বর জ্বালা হলে কে দেখবে? স্কুল খুললেই সেকেন্ড টার্ম। হ্যানা ত্যানা।
তবুও তারই মধ্যে বেশ বিকেল হতে না হতে মামার দৌলতে ঝটপট চা পর্ব মিটে যেতেই
মা চলে আসতো রসগোল্লার ট্রে নিয়ে। এটাই হলো সিগন্যাল। উৎসব পর্ব এই বছরের
মতো শেষ। কিন্তু, উঁহু। হাতে গরম বাজিগুলো এখনও রয়েছে। সবাই চলে গেলে, বই
খুলে পড়তে বসতে হতো। ওই যে? সেকেন্ড টার্ম। ফার্স্ট টার্মে এমন ধ্যারান
ধেড়িয়েছি, কোন কথা বলার সাহস নেই আমার। কোনমতে সাড়ে নটা বাজতেই ডিনার। আর
তারপরেই ম্যাজিকের রাজ্য। কালীপুজোর পরেও আনন্দ শুষে নিতে আরো বাজি, অনেক
আলো, অনেক রঙ। তুবড়িগুলো অবধারিত ফেটে যেতো অল্প উঠেই, চড়কিও ফেটেছে।
রাত্তিরে মামাকে ফোন করে বাজির ফিডব্যাক দিয়েছি। প্রতিবার ঠিক করি, না, আর
এইগুলো কিনব না। ঠকায়। তবুও, এই ট্র্যাডিশন চলেই এসেছে। অনেকগুলো বছর
পর্যন্ত।
এখন অবশ্য ক্যাম্পাসে বাজি ফাটানো নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। আর ওই
এন্থুও নেই ঘুরে ঘুরে বাজি কেনার। এখন তাই কালীপুজো মানে আমার ঘরটাকে একটু
আলো দিয়ে সাজানো। আর কালীবাড়ি গিয়ে পুজো দেখা, অঞ্জলি দেওয়া আর ভোগ খাওয়া।
পালটাচ্ছে অনেক কিছুই, তবুও, ভালোই তো লাগে।
No comments:
Post a Comment