Friday, October 25, 2019

কালী পুজো

বছর ষাটের মীরা। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের এক প্রাচীন বাড়িতে থাকেন। একলাই। বাড়িতে উনি ছাড়া লোক বলতে দিনরাত্তিরের কাজের লোক মঞ্জু। সেও আছে প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেলো। মীরার ছেলে শোভন কলকাতাতেই থাকে। নিজের এবং স্ত্রী সৃজার অফিসের যাতায়াতের সুবিধার্থে ভবানীপুর ছেড়ে নিউ সংসার পেতেছে নিউ টাউনে।  সারাদিন একা একা মীরার মোটেই ভালো লাগেনা। শোভনের যখন বিয়ে দেন, নিজে পছন্দ করে, সম্বন্ধ দেখে, ভেবেছিলেন বৌমা, নাতি নাতনি ছেলে নিয়ে ভরা সংসার হবে। নাহ। মায়ের সাথে সেই যে বিয়ে নিয়ে শোভনের মনোমালিন্য হয়েছিল, তার রেশ এখনও বজায় আছে। ছেলে আর কিছুতেই মায়ের কাছে ফেরেনি। বম্বে থেকে পোস্টিং নিয়ে কলকাতায় এসেও তাই এ মুখো হয়নি। নিয়ম করে কর্তব্যের খাতিরে মাসান্তে মায়ের অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা ঢুকে যায় ঠিকই, তবে মা পায়না ছেলেকে। নাতনির সাথেও দেখা হয়না। এমনকি এত পছন্দ করে আনা বৌমা সৃজা, সেও সময়ই পায়না একবার ফোন পর্যন্ত করার।
রোজ সকালের মতোই ঠাকুরঘরের কাজ সেরে বারান্দার বেতের চেয়ারে এসে বসলেন মীরা। সবে সাড়ে নটা। গোটা দিন সামনে পড়ে। মঞ্জু এসে এক কাপ চা আর দু পিস পাউরুটি আর ছানা রেখে গেলো সাইড টেবিলে। মীরা চশমার বাক্স থেকে চশমা বের করতে করতে আনন্দবাজারটা হাতে নিলেন। প্রথম পাতায় বড় বড় করে হেডলাইন। "দেওয়ালির রাতে শিশু পাচার চক্র থেকে ২৫ জন শিশু উদ্ধার করলেন তরুণী পুলিশ অফিসার।" সাথে সেই উদ্ধার হওয়া ২৫টি শিশুর সাথে এক পুলিশ অফিসারের ছবি। একটু চেনা চেনা লাগছে যেন ছবিটা। মীরা চশমাটা ঠিক করে পরে হাতে কাগজটা তুলে দেখলেন।
জ্বলজ্বল করছে তরুণী অফিসারের নাম। সোমদত্তা গুহ। কাগজটা চোখের সামনে এনে ধরলেন মীরা। ঠিকই তো। সেই একই মানুষ। রোগা, লম্বা। কালো। দু চোখে অসম্ভব এক দীপ্তি। পরনে পুলিশের উর্দি। চোখে মুখে এক দারুণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। এতগুলো শিশুকে উদ্ধার করার তৃপ্তি। এই মুখটা যেন অনেক বেশী উজ্জ্বল, অনেক বেশী দৃপ্ত, দৃঢ়। পাঁচ বছর আগের সেই সোমদত্তার চেয়ে। যেদিন ওকে বাড়িতে ডেকে মীরা নিজে বলেছিলেন, "শোনো সোমদত্তা, তুমি শোভনের খুব ভালো বন্ধু হতে পারো। কিন্তু দেখো, তোমার সাথে ওর বিয়ে আমি কিছুতেই দিতে পারবো না। কিছু মনে করো না, তুমি লেখাপড়ায় ভালো, তোমার ফ্যামিলিও ভালো। কিন্তু আমার শোভনের পাশে তোমায় মানাবে না। তোমার ইয়ে, মানে, গায়ের রঙটা তো..." সেদিন সোমদত্তা কিচ্ছু বলেনি। মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। এবং আশ্চর্যভাবে শোভনের সাথেও আর কোন সম্পর্কও রাখেনি। শোভন অবাক হয়ে গিয়েছিল। মীরার সাথে সোমের এই কথোপকথন জানতো না।
মীরা খবরের কাগজটা হাতে ধরে বসে থাকে খানিকক্ষণ। চোখ বারান্দার বাইরে, শূন্যে। মঞ্জু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। একবার আলতো করে মীরার কাঁধে টোকা দিয়ে বলে, "এই সেই দিদিটা না মা? দাদার কাছে খুব আসতো আগে?  কাগজে ছবি এলো কেন? কী করেছে?" মীরা নীচুস্বরে উত্তর দেয়, "ও মেয়ে মস্ত বড় হয়েছে। ওই তো কতজনকে অন্ধকার থেকে আজ আলোয় এনেছে। বড্ড ভুল করেছিলাম আমি সেদিন। বড্ড ভুল..." এই বলে মীরা পাশে রাখা এফ এম রেডিওটা ছালায়। আকাশবাণী কেন্দ্রে তখন চলছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
আরেক কালো মেয়েকে বিখ্যাত করে দেওয়া শিল্পী তখন গাইছেন,

"আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো--
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।" 

No comments:

Post a Comment