Monday, October 21, 2019

পটলের দোরমা

অফিস থেকে ফিরে সবে চায়ের কাপ হাতে টিভি খুলে বসেছি, ভাবছি আজ রাত্রে কী খাবার খাওয়া যায়, কোত্থেকে অর্ডার করবো, এমন সময়ে মল্লিকার ফোন। মল্লিকা আমার কলিগ, বিগত তিন বছর ধরে আমরা একই ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি। সরকারি অফিস। খুব বাড়াবাড়ি রকমের কাজের চাপ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সারাদিনে মোটামুটি গল্পগুজব ভালোই হয়। দুজনেই কাছাকাছি বয়সের হওয়ায়, এই অজ পাড়াগাঁয়ের অফিসের সহকর্মী দুজনের মধ্যে ভাব বেশ ভালো। মল্লিকার দিক থেকে ব্যাপারটা ভাবেই সীমিত। তবে আমার দিক থেকে ভালোবাসার চেষ্টাও যে নেই, তা বলা মিথ্যে।

মল্লিকা ভারী মিষ্টি একটি মেয়ে। লম্বায় প্রায় আমার সমান। ছিপছিপে চেহারা। ব্যক্তিত্বময়ী। ও আমার চেয়ে ঠিক এক বছরের বড়। শুরুতে আমি ওকে মল্লিকাদি বললেও, ওই একদিন বললো, "রুদ্র, এই দিদি দিদি বলিস না তো। বড্ড অসুবিধে হয়" ব্যস। আমিও লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। মনে মনে যাকে অল্প হলেও ভালোবাসি, তাকে দিদি বলে ডাকতে অস্বস্তি হতই। যতই হোক, মধ্যবিত্ত বাঙালি বলে কথা। তা এ হেন অলিখিত পারমিশন পাওয়ার পর থেকে আমায় কে আটকায়। শুরু হয়ে গেল ভালোমতন ঠাট্টা ইয়ার্কি গুলতানি। সেই সুযোগে মাঝে মাঝেই হালকা ফ্লার্টও করেছি।

মল্লিকা সিঙ্গল। বছরখানেক আগে তনয়ের সাথে ওর ব্রেক আপ হয়েছে। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই ওকে মনে মনে পছন্দ করি। মনের মধ্যে চাপ। ব্রেক আপের সময় ভালো বন্ধুর মতো ওকে সান্ত্বনা দিয়েছি, সঙ্গ দিয়েছি। সামনাসামনি খুব মন খারাপের ভান করলেও ভিতরে ভিতরে খুশিতে নেচেছি। মল্লিকা বোঝেনি। হয়তো। কিন্তু ইদানিং আমার ফ্লার্ট করাটা বেড়ে গিয়েছে। মল্লিকা বুঝতেও পারে। মানে, আমি বোঝাতে চাই বলেই বোঝে। যদিও পাত্তা দেয়না বিশেষ। তবু আমি মনে মনে আশা করে থাকি। যদি কোনোদিনও ওর মন গলে।

আমরা একসাথে মাঝে মাঝে টাউনে যাই। বাজারহাট করতে। সিনেমা দেখতে। আমি একদমই বলা চলে  রান্না করতে পারি না। কাজের দিদি এসে রোজ রান্না করে দিয়ে যায়। মল্লিকা মাঝেসাঝে এটা ওটা রেঁধে নিয়ে আসে আমার জন্য। মল্লিকা আমিষ নিরামিষ সব রান্নায় পটু। আমি অনেকবার ওকে বলেছি আমার মায়ের হাতের পটলের দোরমা আমার খুব প্রিয় খাবার। কাজের দিদি একদম বানাতে পারে না। ও এতো রন্ধনপটিয়সী। ও যেন আমায় বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু পটলের নামে ও এক্কেবারে মুখ ভ্যাটকায়। পটল নাকি ওর মতে সবচেয়ে খারাপ খেতে। অখাদ্য। টাউনে খেতে গেলে অর্ডার করতে দেয়না। এদিকে আমায় বসে বসে ওর সাথে বেগুনের বাসন্তী খেতে হয়।  আমার  বেগুনে চরম এলার্জি। যাই হোক।

মল্লিকার ফোনে ফিরি। ও বেশ উত্তেজিত অথচ আমুদে কণ্ঠে বললো, "শোন, রাত্রে তোর বাড়ি খাবো। ভাত বসা। বাকি আমি আসছি।" কে জানে, কী প্ল্যান ওর। এইরকম হুটহাট প্ল্যান অবশ্য ও আগেও করেছে। ও রেঁধেছে। আমরা একসাথে খেয়েছি। তারপর বসে ল্যাপটপে সিনেমা দেখেছি। আজও নিশ্চয়ই এর অন্যথা হবে না।

আধ ঘন্টার মধ্যে মল্লিকা এলো। এসেই দরজায় ধাক্কা। আমি দরজা খুলে দিলাম। ও ভিতরে ঢুকলো। একটা হালকা কমলা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। ভারী সুন্দর লাগছে খোলা চুলে। ওর হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ওকে বললাম, "তুমি বসো। আমি এটা টেবিলে রেখে আসছি। ভাত বসিয়েছি রাইসকুকারে। এক্ষুণি হয়ে যাবে।"

মল্লিকা বসলো না। হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে আমার পিছন পিছন খাবার ঘরে এলো। এক টুকরো হাসি মুখে মেখে বেশ একটা আদুরে গলায় বললো, "ভাত হলো? নিয়ে আয়। সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে।" বাবাঃ, এত উৎসাহ? ব্যাপার কী? আমি  বললাম, "তুমি বসো না। আমি খাবার বেড়ে আনছি।" মল্লিকা রহস্যময়ী হাসি হেসে উত্তর দিলো, "উঁহু। আমিও থাকি। তুই ভাত আন। আমি বাড়বো।" মল্লিকা যখন ঠিক করেছে ও করবে, মানে ওই করবে। আমি হাজার বললেও শুনবে না। আমি চুপচাপ আর কোনো কথা না বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। দুজনের জন্য দুটো থালায় ভাত বেড়ে ঘরে ঢুকতেই নাকে এলো একটা সুগন্ধি ঝাপ্টা। এ কী, এই গন্ধটা তো আমার ভীষণ চেনা। ভীষণ প্রিয়।

বড় জামবাটিতে জ্বলজ্বল করছে তেল মসলার রসায় নধর পটল। পটলের দোরমা। মায়ের রেসিপি।

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মল্লিকা মুচকি মুচকি হাসছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো, "কী, কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?" আমি কী উত্তর দেবো, ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় মল্লিকা আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, "পটলের দোরমাটা যদি সাকসেসফুল হয়, তাহলে ভাবছি কাকিমার কাছে এপ্লিকেশন দেবো। বৌমা পদের জন্য। ভালো রেকমেন্ডেশন দিবি তো?"

আমি এর কী উত্তর দিই? আমার গালদুটো তখন সামনে রাখা স্যালাডের টমেটোর মতোই লাল।

No comments:

Post a Comment