Sunday, February 12, 2017

ওং ভ্রিং বৃহস্পতায়েঃ নমহঃ


টুপুর ওঠ। কত বেলা হয়ে গেল,স্কুলে যেতে হবে তো। ওঠ বাবা ওঠ।”

মায়ের ডাকে চোখ খুলে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সিলিং ফ্যানের দিকে। মা ইতিমধ্যে আলমারি থেকে জামাকাপড় বের করতে শুরু করে দিয়েছে। আজ স্কুলে রেজাল্ট। অ্যানুয়াল এক্সামের পর লম্বা ছুটি পড়েছিল। আজ আবার রেজাল্ট আনতে যেতে হবে। বছরের এই একটি দিন টুপুর ভারী ভয় পায়। সকাল থেকেই বুক ধড়ফড়, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। যত না বেশী ভয় হেডস্যার অমল বাবুর কড়া চাহনির, তার চেয়ে বেশী বরং ভয় লাগে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বকুনি খেতে। কয়েক ঘা উত্তম মধ্যম তো লেগেই আছে। এই তো গেলবারের আগের বছর, পরিষ্কার মনে আছে ওই সময়ের ঘটনাগুলি, একদম সিনেমার মত পরপর বলেও দিতে পারে টুপুর, ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার পরীক্ষায় যেবার ও অঙ্কে ১০০’র মধ্যে ২৩ পেল, সেইবারে মায়ের হাতে এমন মার খেয়েছিল যে চোখ ফেটে জল এসে গিয়েছিল। এমনিতে যাকে বলে হাতে-পায়ে দুষ্টু টুপুর। তাই ছোট থেকেই স্কেল, গরম খুন্তি থেকে শুরু করে বেলন চাকি দিয়েও মার খেয়ে অভ্যস্ত। আজকাল তাই চড়চাপড় খেলেও টুপুর কাঁদেনা। তবে সেবার ঠাকুমা এসে মাকে সরালো বলে, নইলে দুই গাল বেয়ে চোখের জল বেরিয়ে গিয়েছিল; ওই পরীক্ষায় আবার ইতিহাসে একটুর জন্য ফেল করতে করতে বেঁচে গিয়েছিল। কপাল জোরে বাকি সব সাবজেক্টে পাস মার্কস পাওয়ায় ক্লাসে প্রোমোশন পেলেও রেজাল্টের পরেরদিন পেরেন্টস কল হয়েছিল।

সেই মিটিং থেকে বেরোতেই এক অদ্ভুত দেখতে ভদ্রলোক সেদিন টুপুর আর ওর মা বাবাকে একটি লিফ্লেট ধরিয়ে দিয়ে যান। অভ্যেসবশত হাতে সেটা রেখে ওরা তিনজনেই অটো ধরে বাড়ির পথে। গড়িয়াহাট মোড়ে অটোটা বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। টুপুরের মা হাতের কাগজটা অন্যমনস্কভাবে খুলেই ফেলল। বেশ একটা এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজের ওপর বড় করে লেখা “জুপিটার রেমেডিয়াল ক্লাসেস। প্রপ্রাইটর শ্রী রত্নদীপ ভট্ট।” দুই বছরের ক্র্যাশ কোর্স সহ আরও কত কি লেখা। পছন্দসই রেজাল্ট না হলে সমস্ত টাকা ফেরত। ভাল রেজাল্টের গ্যারান্টিসহ যত্নসহকারে অত্যাধুনিক গ্যাজেটের সাহায্যে অঙ্ক বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোল ইংরাজি বাংলা শেখানোর প্রতিশ্রুতি।

রাত্রে বাবা অফিস থেকে ফেরার পর টুপুর দেখল মা-বাবা অনেকক্ষণ বেশ গম্ভীরভাবে কিসব আলোচনা করল। তারপরের দিন দুপুরবেলা মা কোথাও একটা বেরোল। সাথে অ্যানুয়ালের মার্কশীট নিতে ভুলল না। রেজাল্টে আরেকবার চোখ পড়তেই টুপুরের আরেকপ্রস্থ কানমলা জুটে গেল। রাত্রে খাবারের সময়ে বোমাটা ফেলল বাবা। দাদু ঠাকুমার সামনেই বাবা বলে উঠল, “আমি আর টুপুরের মা ঠিক করেছি পরের সপ্তাহ থেকে ওকে একটা টিউশন ক্লাসে ভর্তি করাবো। শুক্রবার বিকেলে ওকে ওখানে রেখে আসতে হবে, আর ফেরত আসবে রবিবার রাত্রে। গোটা উইকেন্ডটা ওখানে পড়াশোনা করবে। দুই বছরের কড়া রুটিনে থেকে যদি গোবরের জায়গায় কিছু জ্ঞান ঢোকে মাথায়। বছরে কেবলমাত্র মহালয়া থেকে লক্ষ্মীপুজো ছুটি। টুপুর এইটাই কিন্তু তোমার শেষ সুযোগ। এইটার সদ্ব্যবহার না করতে পারলে কিন্তু তোমার স্কুল ছাড়িয়ে দেব, তারপরে গলির চায়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেব। এই বলে রাখলাম।” টুপুর তো বাবার কথা শুনে হতভম্ব। এ আবার কেমন টিউটোরিয়াল ক্লাস রে বাবা, কই মাণিক, বিল্টু ওরা যে স্যার ম্যাডামের কাছে পড়তে যায়, সেখানে তো এরকম কিছু নেই। তারস্বরে কান্নাকাটি লাগিয়ে দিল। ঠাকুমা আদর করে শান্ত করার চেষ্টা করল বটে, তবে ওর কান্না কিছুতেই থামেনা। এবং যথারীতি বাবা-মা ও তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

অবশেষে টিউশন ক্লাসে যাওয়ার দিন এল। শুক্রবার বাবা ছুটি নিয়েছিল, দুপুর তিনটে বাজতেই বই-খাতা-কলমসহ দুদিনের জামা ইত্যাদি একটা ছোট্ট পিঠের ব্যাগে ভরে ওরা তিনজনে বাড়ির থেকে বেরল। রত্নদীপ বাবুর অফিসে যেতে টুপুর দেখল ওর বয়সী বেশ অনেক ছেলেমেয়ে রয়েছে। লাইন দিয়ে ওদের দাঁড় করিয়ে গেল এক ব্যাক্তি। সবাইকে একটা করে আইডেন্টিটি কার্ডও ধরিয়ে দিয়ে গেলেন, বললেন ক্লাসে যতক্ষণ থাকবে, সবসময় যেন গলায় ঝোলে ওটা। এরপর ওদেরকে একটা বিরাট বড় ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। মা-বাবাদের সাথে আর কোনরকম যোগাযোগ রইলনা। ইতিমধ্যে টুপুর বন্ধুত্ব করে নিয়েছে ঝুলনের সাথে। ঝুলনও ওরই বয়সী, ও পড়াশোনায় বেশ কাঁচা, টুপুরের মতোই অঙ্ক আর ইতিহাসে অবস্থা খুবই শোচনীয়। পাঁচ দশ মিনিটে প্রায় ২০০ ছেলেমেয়ে ঘরে বসে পড়ল। তারপরে স্টেজে এলেন এক ভদ্রলোক। পিছনে স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করে একটি সোলার সিস্টেমের ছবিসহ নাম ভেসে উঠলো, “শ্রী রত্নদীপ ভট্ট”। বেঁটে খাটো, মোটাসোটা এক ফর্সা লোক। পরনে সিল্কের ধুতি-পাঞ্জাবি। মাইকে দুইবার টোকা দিয়ে শুরু করলেন।

“স্বাগতম। জুপিটার রেমেডিয়াল ক্লাসে তোমাদের সকলকে আমি আনন্দ সহকারে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আগামী দুই বছরে তোমরা বিশিষ্ট কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে সিলেবাসের অনেক কিছু শিখবে। দেখবে আমরা এখানে কত মজার ছলে কত কিছু শেখাব। আমাদের ব্যবহার করা পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে ঋষি-মুনিরা রেকমেন্ড করে গিয়েছেন। বৃহস্পতি ঋষি খুব পণ্ডিত ব্যাক্তি ছিলেন, তিনি নিজে বৈদিক ম্যাথেমেটিক্স নামে এক অতি সহজ উপায় বের করেছিলেন। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ওই জ্ঞানের সাথে আরও এক্সটেন্সিভ রিসার্চ করে অত্যাধুনিক গ্যাজেটসের সাহায্যে তোমাদের কাছে পড়াশোনাটা অনেকটাই সহজ করে দেবেন।” ভট্টবাবু আরও কত কী এইরকম বলে চলেছিলেন। সোলার সিস্টেম, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত মণি-মুক্ত আরও কত কিছু। টুপুর স্ক্রীনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়ালই করেনি। ঘুম ভাঙল ঝুলনের ধাক্কায়।

এই টুপুর ওঠ। দেখ স্যার একটা কী অ্যাপ নিয়ে বলছেন। দেখ দেখ। কোনমতে চোখ কচলে শুনল রত্নদীপ বাবু বলছেন, “প্রত্যেকে দেখ নিজেদের সীটের নীচে রাখা ওয়েলকাম কিট আছে, ওর ভিতরে একটা ট্যাব পাবে। সবাই বের করে ফেল।” টুপুর নিজের ট্যাবটা বের করে দেখল। অনেকটা বাবার ট্যাবের মতই। ক্যান্ডি ক্রাশ, টেম্পেল রান সব গেমস আছে। ভালোই হল, পড়ার একঘেয়েমি কাটানো যাবে। ওদের এরপরে ক্লাস অনুযায়ী ডরমিটরিতে নিয়ে গেল প্রথম ভদ্রলোক। পরে জেনেছিল যে উনি টুপুরদের ওয়ার্ডেন স্যার।

পরদিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করার পর ওরা ক্লাস্রুম গেল। রত্নদীপ স্যার ইতিমধ্যেই চলে এসছেন। “সবাই ট্যাবটা খুলে হোম স্ক্রীন দেখ। আমরা এখানে একটা অ্যাপ ব্যবহার করব, যাতে বেশ একটা সিমুলেটেড এনভাইরনমেন্ট পাব। মনে করবে আমরা যেন বৃহস্পতি গ্রহে বসে পড়ছি। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে কথিত আছে যে বৃহস্পতি বিদ্যার সাথে যুক্ত। ওই পরিবেশে গেলে দেখবে কত সহজেই শিখতে পারবে। স্ক্রীনে দেখ জুপিটার প্ল্যানেটের আইকন আছে, ওটা ট্যাপ কর। এবার ডেস্টিনেশন লেভেলে পাঁচ টিপবে। ভুলেও কিন্তু অন্যকিছু টিপবেনা। ১-৯ বাকিগুলি সমস্ত অন্যান্য ধাপের। সেখানে গেলে ঘোর বিপদ।”

সেই শুরু। এরপর থেকে প্রত্যেক ক্লাসের শুরুতেই ওরা এই অ্যাপে লেভেল ৫এ গিয়ে একটা পূর্বনির্ধারিত সিমুলাটেড এনভাইরনমেন্টে পৌঁছোয়। টুপুর লক্ষ্য করেছে ওখানে কত সহজেই পড়াগুলো মাথায় ঢুকে যায়। অঙ্কের ফর্মুলাগুলি আগে যেমন পড়লেও মাথার বাইরে টুক করে উড়ে যেত, আজকাল যেন ক্লাসে মনে হয় এতটাই ভারী যে মাথার বাইরে বেরোচ্ছেইনা, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বুঝি হঠাত বেড়ে গিয়েছে আর লেসনগুলো মাথায় দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। যে ল সা গু - গ সা গু নিয়ে স্কুলে হিমসিম খেত, কি সহজেই আর কি চটপট সেগুলি কষে ফেলছে। ইতিহাসের সন-তারিখ, কোন সম্রাট কার সাথে কোন ঘোটক চেপে কোথায় যুদ্ধ জয় করেছিলেন – সমস্ত যেন চোখ বুজলেই দেখতে পারে। যার ফলে ক্লাস-টেস্টে দারুণ ফল করতে লাগল জুপিটারের ক্লাসে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্কুলের পরীক্ষাগুলিতে টুপুর একটুও ভালো করছিলনা।

মা-বাবা তো হাফ-ইয়ারলির পর রত্নদীপ স্যারের সাথে দেখা করতে গেল বেশ চিন্তিত হয়ে। কে জানে স্যার কী বললেন, মায়ের টেনশন আর কাটেনা। টুপুরের স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট আর যাই হোক না কেন, টিউটোরিয়ালে ক্লাস করতে কিন্তু বেশ ভালো লাগে। পড়াশোনায় যেন ভয়টা অনেকটাই কেটেছে আস্তে আস্তে এই দুই বছরে। এমনকি এইবারে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার পরীক্ষা নিয়ে টুপুর বেশ সন্তুষ্ট। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় এই যে রেজাল্টের ভয়টা যেন প্রায় নেই বললেই চলে। মায়ের ডাকে তাই ঘুম ভাঙতে ও আজ অনেকটাই স্বাভাবিক বোধ করছে। যথাসময়ে স্কুলেও গেল মায়ের সাথে। হেডস্যার যখন ওকে ডেকে রেজাল্ট দিলেন, খুব হাসিমুখে টুপুরের পিঠ চাপড়ে বললেন, “ বাঃ, তোমার রেজাল্টে খুব উন্নতি হয়েছে। এই চিঠিটা গার্জেনকে দিয়ো।“

পরীক্ষায় প্রথম পাঁচে না এলেও, টুপুর সমস্ত সাব্জেক্টে ৭৫এর উপর নম্বর পেয়ে পাস করেছে। অঙ্কে তো ১০০তে ৮৫ আর ইতিহাসে ৭৮। দাদু ঠাকুমার আদর খেতে যখন টুপুর ব্যাস্ত, ওর মা চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।

“মিঃ ও মিসেস মৈত্র,

আমরা খুবই আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে শ্রীমান দীপ্যমান মৈত্র পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করেছে। ওর পড়াশোনায় অনেক উন্নতি আমরা লক্ষ্য করেছি। এই উন্নতির জন্য আপনারা অনেক পরিশ্রম করেছেন। আপনাদের তাই অনেক অভিবাদন জানাই।

ইতি

স্কুল কর্তৃপক্ষ”

টুপুরের মা হেসে চিঠিটা ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে বলল, “যার তুঙ্গে বৃহস্পতি, তাকে আটকায় কে! রত্নদীপ স্যার তো বলেইছিলেন, সিমুলেটেড এনভাইরনমেন্টে যত তাড়াতাড়ি ফল পাবে টুপুর, বাস্তব পরিবেশে একটু সময় লাগবেই। তবে ফল মিলবেই মিলবে। এ তো শত শত বছরের এক পবিত্র শাস্ত্রেরই বর্তমান যুগের ইমপ্লিমেন্টেশন। ভাগ্যিস স্যারের কথায় ভরসা রেখে দুটো বছর অপেক্ষা করেছিলেন ওরা। তাই তো আজ টুপুরের লেখাপড়ায় এত অভাবনীয় উন্নতি হল।


http://www.dakkhinerbaranda.com/?content=58443d18bd966f5f1ef1c957

No comments:

Post a Comment