Monday, February 27, 2017

ক্রাশ কাহিনী

সাতটা বেজে কুড়ি মিনিট। শুনছেন রেডিও মির্চি, ৯৮.৩ এফ এম। এরিজ টু ভার্গো শুনে নিন আপনার দিনটা আজ কেমন যাবে। 
Aries। কর্মক্ষেত্রে আজ সাময়িক বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। অনেকদিন ধরে যাকে মনের কথা বলবেন ভাবছিলেন, আজ বলেই ফেলুন। লাকি সংখ্যা ৩,৬,৯; লাকি রঙ হাল্কা বেগুনি, চকলেট ব্রাউন ও কালো।

বেশ, তাহলে পুজোয় কেনা ব্রাউন শার্টটা আজ পরলেই হয়। সাথে কালো জিন্স। কিন্তু বেগুনি? কিছু তো নেই। আগে জানলে গেঞ্জিটা একটু না হয় বেশী উজালা দিয়ে কাচলে হত। কি মুশকিল! এখন কী করা যায়?



বছর সাতাশের সুদীপ, সব সময় বড়ই দোনামনায় ভোগে। প্রতি মুহূর্তে কী করব, এটা না ওটা, এই করতে করতেই বেশিরভাগ সুযোগ হাতছাড়া হওয়াটা প্রায় গা সওয়া হয়েই গিয়েছে ওর। এর থেকে একটু সুরাহা পেতে, মাসতুতো বৌদির পরামর্শে এখন সুদীপের অন্যতম প্রিয় হবি রাশিফল দেখা বা শোনা। আনন্দবাজারের ভিতরের পাতায় আজ অবধি যত জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, মনে হয় সকলের কাছে একবার অন্তত গিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করালেও কোনদিনও সন্তোষজনক কিছু শোনেনি। দুই হাত মিলিয়ে কম পক্ষে আটখানা আংটি তো আছেই; এছাড়া গলায় তাবিজ, কোমরে মাদুলি, সব রয়েছে। সকাল সকাল উঠে রেডিওতে ও আনন্দবাজারের রাশিফল না শুনে অফিস যায়না। এবং এটা বেশ কিছু বছরের অভ্যেসই বটে। ওর বিশ্বাস, রেডিওতে শুনে হলুদ রুমাল পকেটে রেখেছিল বলেই এই চাকরিটা ওর হয়েছে, নইলে ইন্টারভ্যুতে যা ছড়ান ছড়িয়েছিল ও। চাকরিটা হওয়ার কোন চান্সই ছিল না।

সুদীপের ইদানীং জীবনে এক "সমস্যা" হয়েছে। না না। ঘাবড়ানোর মতো কিছু না। হৃদয়ঘটিতই। একটু বুকের বামদিকে চিনচিনে ব্যথা। তবে এটা যেহেতু ওর ক্রনিক অসুখ, এখুনি "ডাক্তার বদ্যি" করার তো প্রয়োজন নেই। অমৃতলাভ করতে পারলেই কেল্লাফতে। তা আমাদের সুদীপ বড়ই লাজুক ছেলে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মোটামুটি ভালোই কথাবার্তা বলতে পারলেও মেয়েদের সামনে গেলে রীতিমত তোতলায়। ইয়ে মানে ওই আর কী, এইসবের জ্বালায় বহু সুন্দরীর প্রতি হৃদয়ের গহিন গহ্বর থেকে প্রেম রসের উদ্রেক হলেও কোনটাই পরের স্টেজে পৌঁছতে পারেনি। 

সুদীপ আমাদের কর্মঠ ছেলে। অফিস কলিগ অমৃতার ওপর যবে থেকে ক্রাশ হয়েছে, তবে থেকে শুরু করেছে রিসার্চ। এবং প্রথমেই খেয়েছে ধাক্কা। HR এ থাকার সুবাদে খুব সহজেই অমৃতার পার্সোনাল ডিটেলস জানতে পেরেছে। দেখেছে ওর জন্মদিন ১০ই জানুয়ারী। এই রে! এ যে দেখি Capricorn, আর সুদীপ কিনা Aries। কেলেঙ্কারি কাণ্ড; বেজান দাড়িওয়ালা, গোঁফওয়ালা সব্বাই সারাক্ষণ বলে গেছে যে এই জুটি নাকি সবচেয়ে incompatible। যাহ। এবার কী হবে? জানা ইস্তক ও খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাজে মন নেই, রাত্রে ঘুম আসেনা। বড়ই শোচনীয় ব্যাপারস্যাপার। প্রাণের বন্ধু, দেবেশকে শেষে একদিন বলেই ফেলল অনেক কিন্তু কিন্তু করতে করতে। দেবেশ তো শুনে হাহা হোহো করে প্রায় উড়িয়েই দিচ্ছিল। এই যুগে এসে কেউ এমন বিদঘুটে কারণে সাফার করে, এ তো কল্পনাতীত।  অনেক অট্টহাসির পর সে সুদীপের ক্যাবলা ভ্যাবলা অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়ে সুচিন্তিত পরামর্শ হিসেবে অমৃতা কে মনের কথা খুলে বলতে বলল। 


সুদীপ রোজই রাত্রে ভাবে, হ্যাঁ, কাল অমৃতাকে বলবেই বলবে। এমন কী, ঠিক কীভাবে কথা শুরু করবে, সেইসবেরও প্ল্যান এ বি সি বানিয়ে ফেলে। কিন্তু ওর কপাল ভালো না। প্রতিদিনই আর জে বলছে যে রোম্যান্সের পক্ষে এখন সময় ভালো যাচ্ছেনা। বেটার লেট ড্যাং সরি। পাছে আবার এইটাও ফেল করে, সেই নিয়ে বেশ চিন্তিত। অমৃতাকে বলবে কি বলবে না, এই করতে করতে ইতিমধ্যে আরো এক সপ্তাহ কেটে গেল প্রায়। তবুও শেষমেশ মনে জোর এনে একদিন ভাবল যে নাহ, আজ বলবেই বলবে। সেইদিন নানান অছিলায় ওর সাথে কথা বলতে এগোলও। তবে চিরকালের লাজুক ছেলে সে, তার ওপর আবার বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করা, বয়েজ স্কুলে। অমৃতার মত নামী ইংরেজী মিডিয়ামের স্মার্ট মেয়েটির সাথে কথা বলতে গেলেই কিরকম জিভ জড়িয়ে যায়। 

আবার গত দুই তিনদিন ধরে যা দেখছে, আর রিস্ক নিতে সাহস হচ্ছে না। আইটির নতুন ছোঁড়া, রজত, তার সাথে খুব হেসে হেসে গল্প করতে দেখা যাচ্ছে অমৃতাকে। কানাঘুষোয় শুনেছে রজত নাকি আবার বসের কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয়। বলা যায়না, অমৃতাকে সেই সুবাদে পটিয়ে ফেলল হয়ত। তবে সুদীপ এখনও হাল ছাড়েনি। 

রোজ রাশিফল দেখে শুনে শুভক্ষণ খোঁজে মন হাল্কা করার; কিন্তু কপাল ভালো না। তবে অনেক কষ্টে আজ মীরের মুখে এইরকম বচন শুনে যারপরনাই খুশী হয়েছে। ঠিক করেছে, যে করেই হোক, অমৃতার কাছে আজ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবেই, যে করেই হোক। লাকি রঙের জামা কাপড় পরে, ভালো করে দাড়ি কামিয়ে, অনেকটা আফটারশেভ ঢেলে রীতিমত প্রচুর মাঞ্জা দিয়ে তাই সে আজ অফিস গেল। 



পৌনে নটায় অফিসে ঢুকে প্রথমেই নিজের কম্পিউটার অন করল। অটোতে আসতে আসতে প্ল্যান ছকে ফেলেছে। লাকি নম্বর অনুযায়ী ঠিক ৯টায় অমৃতাকে একটা ইমেল করবে। বাংলায় বরাবর ভালো সে, তাই ঝটপট একটা প্রেমপত্র লিখে ফেলতে বিশেষ অসুবিধে হলনা। তাছাড়া বয়ান তো এতদিনের প্ল্যানিং পর্বে বহুবার রিভাইসড হয়ে এখন মুখস্থ। নিজের ভালোবাসার কথা বলে চিঠিটা শেষ করল এই বলে যে অমৃতা যেন ওকে শীগগিরই নিজের মনোভাব জানায়।


দশটার একটু আগে অমৃতা ঢুকল। আজ পরেছে একটা সাদা রঙের চিকন কাজের চুড়িদার কুর্তা। আর একটা হাল্কা বেগুনি রঙের ওড়না। ঠিক যেন ডানাকাটা পরী। সুদীপের ডেস্ক থেকে তেড়ছা করে তাকালে অমৃতার টেবিলটা দিব্যি দেখা যায়। হাঁ করে তাকালে অবশ্য ব্যাপারটা বেশ বাজে হয়ে যাবে, তাই মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখে নিচ্ছিল ওদিকে। আজ যেন একবারও অমৃতা পেপারওয়ার্ক থেকে মুক্তি পাচ্ছেনা। কম্পিউটার খুলবার সময়ই পায়নি। একগাদা ফাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছে। মাঝে এক দুইবার চোখাচোখি হতে অদ্ভুত বিরক্ত মুখে তাকালো অমৃতা।

এই সেরেছে, মুড অফ নাকি? চিঠির এই প্রতিক্রিয়া? কেস করেছে। এটাও ফেলিওর? ধিক্কার সুদীপ, ধিক্কার। এইসব ভাবতে ভাবতে মাঝে এক সময় সুদীপ দেখল অমৃতা ক্যান্টিন যাচ্ছে। সুযোগ বুঝে সুুদীপও পিছু নিল। লাইনে একদম পরপর হয়ে যাবে ভেবে ইচ্ছে করেই একটু আসতে আসতে গেল। যতক্ষণে স্যান্ডউইচ নিয়ে টেবিলের দিকে যাবে সুদীপ, কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কী, অমৃতা ততক্ষণে সখী পরিবৃত হয়ে অন্য টেবিলে হাসির কলতান শুরু করে দিয়েছে। সুদীপেকে দেখে মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল। 

লাঞ্চের পর ডেস্কে ফিরল সকলেই, কিন্তু অমৃতার রুটিন একই রয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে তিনটে পেরিয়ে চারটে, চারটে পেরিয়ে পাঁচটার দিকে যেতে গেল বলে। সুদীপদের অফিস ঠিক সাড়ে পাঁচটা বাজলেই খালি হয়ে যায়। যাহ। এটাও তবে আনসাকসেসফুল। সামনাসামনি উত্তর না পেলেও অন্তত ভেবেছিল চিঠিটা পেয়ে অমৃতার কী রিএকশন হয়, নিদেনপক্ষে সেইটুকু দেখবে। কিন্তু তাও কপালে নেই। নির্ঘাত ওই হাল্কা বেগুনি কিছু সাথে নেয়নি বলে এমনটা হল। আচ্ছা বিচার তো ওপরওয়ালার! ও যে ব্রাউন আর কালোটা মেন্টেন করল, সেইবেলা? উনিও কি কর্পোরেট অফিসের মতোই নাকি? ভালোটা চোখে পড়েনা, কেবলমাত্র একটু পান থেকে চুন খসল কি, সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টি। ধুর। ভাল্লাগেনা।
এই শেষ, আর প্রেমে পড়বেনা। আর ক্রাশ টাশ হবেনা। মা এবার বিয়ে নিয়ে কথা পাড়লেই আর কাটিয়ে দেবেনা, বরং মা কেই বলবে পাত্রী জোগাড় করতে। ওর দ্বারা তো আর এ জন্মে প্রেম করা হলনা একটাও, এদিকে ওর কিছু বন্ধু বান্ধবরা তো প্রায় তিন চারটে প্রেম করে ফেলল। হতাশ হয়ে সাড়ে পাঁচটা বাজতে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে লিফটের দিকে মাথা নিচু করে এগোল সুদীপ। আর কপালও এমন, ঠিক একটুর জন্য মিসও করল। পরেরটা ওদের এই তেরোতলা পৌঁছতে দেরি আছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ব্যাঙ্কের পাঠানো এক গাদা এস এম এস ডিলিট করতে লাগল।  তখনই কাঁধে একটা হাল্কা টোকা টের পেল। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে, আরে অমৃতা! ঠিকঠাক দেখছে তো?
"কী হল? উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যাচ্ছ যে? কৌতূহল নেই নাকি?"
(এ যে মেঘ না চাইতেই জল)
"তু-আপনি চিঠিটা পড়েছেন?"
"হ্যাঁ! না পড়লে কি করে বলছি?"
"না মানে আপনাকে সারাদিন তো একবারও কম্পিউটার খুলতে দেখলাম না, তাই ভাবছিলাম বুঝি আপনি ইমেলটা দেখেননি।"
"হুম, আজ খুব কাজের চাপ ছিল, তবে তোমার মেলটা আমি বাসে আসতে আসতে ফোনে পড়েছি।"
"ও আচ্ছা। আমার আসলে সাধারণ ফোন তো, তাই খেয়াল থাকেনা।"
"বেশ।"

ইতিমধ্যে লিফট এসে গিয়েছিল। দুজনেই ঢুকল ভিতরে। সুদীপ তো বরাবরের ক্যাবলা, ক্যাবলাই রয়ে গেল। মনে মনে খুব উসখুস করছিল অমৃতার উত্তর জানবার, কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা আর করতেই পারছেনা। এটা যদি সিনেমা হত, পাক্কা ব্যাকগ্রাউন্ডে এখন প্রাণ চায় চক্ষু না চায় বাজত। মেন গেট অবধি একসাথে হাঁটলও দুজনে। "বেশ, কাল তাহলে দেখা হবে, আজ আসি।" এই বলে অল্প হেসে সুদীপ অটো স্ট্যান্ডের দিকে চলতে শুরু করতেই, পিছন থেকে অমৃতা ডেকে উঠল। "আচ্ছা, উত্তরটা তো শুনলেইনা। চল অন্তত একটা আইস্ক্রিম খাওয়া যাক। "
(বেটা মন মে লড্ডু ফুটা!)
"আইস্ক্রিম? আসলে আমার না টন্সিলের প্রব্লেম আছে, ঠান্ডা খাওয়া বারণ। আপনি বরং যান। একা খান।"
"আরে ধুর ছাই, তোমার মত ক্যাবলা ছেলে জীবনে দেখলাম না আমি। ডেটে ডাকছে ক্রাশ, আর উনি নাকি টন্সিলের ছুঁতো করছেন। উফফ। চল। তুমি নাহয় কফি খাবে। আর হ্যাঁ, প্লীজ আপনি বলাটা থামাবে?"

এই প্রথম অনেকদিন বাদে সুদীপের মুখে চওড়া হাসি ফুটলো। তাহলে ব্রাউন শার্টের এফেক্টে বেগুনির না থাকাটা পুষিয়ে গেল।

2 comments:

  1. Aha! Khasa :D
    Khub mishti lekha. Ektai kotha bolbo... Arektu natokiyota thakle golpo hisebe aro bhalo hoto, bujhli.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thanks re :) next time, nischoi cheshta korbo! :)

      Delete