Friday, September 27, 2019

কোনো ফ্লাইটে জানলার ধারের সীটটা সচারচর রুমুনের ভালো লাগে না। বরং আইলটাই ওর প্রেফারড সীট। কিন্তু ওই যে, পেঁজা তুলোর মধ্যে দিয়ে যখন প্লেনটা নামবে ক্রমশ, নীচে সেই চিরপরিচিত কংক্রিটের জঙ্গল, সরু সুতোর মতো গঙ্গা, কালো ধোঁয়ার আস্তরণ। কাঁচের জানলায় মাথা এলিয়ে দিয়ে তখন দু চোখ ভরে দেখতে ভালোবাসে ও। দীর্ঘ সাত আট ঘণ্টার বিমানযাত্রার শেষে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে "উই আর অ্যাবাউট টু ল্যান্ড অ্যাট দ্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ইন কলকাতা" যেন সেই ছোটবেলায় পড়া রূপকথার সোনার কাঠি। রুমুনের মনের মধ্যে তখন বাজতে থাকে ঢাকের ঢ্যাংকুরকুর, বিলিতি পারফিউমকে উপেক্ষা করে নাকে ভেসে আসে ছাতিম ফুলের পাগলকরা গন্ধ। বিদেশি বিমানসংস্থার সীটের কাভারে যেন দেখতে পায় ভোরের শিশির ভেজা সাদা শিউলির ঢেউ। 
বিমানবন্দরের হইহই, রাস্তার যানজট, প্রিপেড ট্যাক্সির লম্বা লাইন। কেউ না। কেউ এই মুহূর্তে ওর জীবনে ভিলেন হয়ে আসতে পারবে না। আগামী কটাদিন শুধুই আনন্দ। শুধুই উৎসব। 
ঘরে ফিরছে রুমুন। আরো অনেকের মতোই। 
শারদোৎসবের আনন্দে মাততে। মায়ের স্নেহে। বাবার আদরে। বন্ধুদের আলিঙ্গনে। সদ্য কেনা শারদীয়ার সাদা কালো অক্ষরে। 
এই পুজো সর্বজনীন। এই পুজো সার্বজনীন।

Wednesday, September 25, 2019

অষ্টমীর অঞ্জলি চলছে দফায় দফায়। পাড়ার কাকীমারা ভিড় সামলে সকলকে পুজোর ফুল দিতে ব্যস্ত। রুমুনও সাধ্যমতো ওদের সাহায্য করছে। হাতে হাতে ফুল এগিয়ে দেওয়া, এক রাউন্ড অঞ্জলি হয়ে গেলে পুজোর ফুল ফেরত নেওয়ার জন্য ঝুড়ি এগিয়ে দেওয়া, এইসব। ছোট থেকেই ও ওদের এই কমপ্লেক্সের পুজোতে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে গিয়েছে, তাই এটা নতুন কিছু না। আশেপাশে আরো কিছু বাড়ি আছে, ওখানে পুজো হয় না। তাই ভিড়টা বরাবরই লেগেই থাকে ওদের পুজোয়, বিশেষ করে অষ্টমীর সকালে।
সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে সাদা আর গোলাপি রঙা লিনেনের শাড়ি পরে মণ্ডপে চলে এসেছে ও। মায়ের তাড়া খেয়ে বিশেষ সাজগোজ করা হয়ে ওঠেনি। ছোট্ট একটা টিপ, লিপগ্লস আর আলতো করে একটু কাজল। ভিজে চুল দিয়ে এখনো টপটপ করে জল পড়ছে। তবুও, দেখতে যে ওকে বেশ ভালো লাগছে, এ কথা রুমুন ভালোভাবেই বুঝেছে। অনেক্ষণ ধরেই মণ্ডপের এক কোণায় সাদা চেয়ারে বসে থাকা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা এক সুদর্শন যুবকের মুগ্ধ দৃষ্টি ওকে অনুসরণ করে চলেছে। চোখাচুখি হতেই আলতো হেসে ঈষৎ রক্তিমবর্ণ গন্ডদেশকে উপেক্ষা করেই মাঝেমাঝেই চোখাচুখিটা দিব্যি বজায় রয়েছে। বেশ একটা রোমাঞ্চ লাগছে রুমুনের।
আর ঠিক এমনই সময় বিলিতি পাখির মিষ্টি টুইট টুইট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল রুমুনের। অন্যান্যদিন এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলে বড্ড বিরক্ত লাগে। কিন্তু আজ যে তার ভালোই ব্যতিক্রম, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে এখনো হালকা হাসি ছুঁয়ে আছে। রুমুন একবার এলার্মটা স্নুজ করলো। আলতো করে পর্দা সরিয়ে দেখলো, বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। উঁহু। এই ওয়েদারে কম্বলের তলা থেকে বেরোনো মহা পাপ। আজ স্টিভও ডে অফ নিয়েছে। পেন্ডিং কাজও তেমন নেই। একটু আলসেমি করাই যায়। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। প্যান্ডেলের কোণে বসে মুগ্ধ এক জোড়া চোখ যে ব্যাকুল হয়ে খুঁজে চলেছে সাদা গোলাপি লিনেনকে। মনে মনেই হেসে রুমুন আবার ঢুকে গেলো কম্বলের ওমে। হোকই না স্বপ্ন। মনটা ভালো তো হবে। তা ছাড়া, ভোরের স্বপ্ন। সত্যি না হয়ে যায় কোথায়...
পুজোয় তো সেও আছে এবারে।
"যা দেবী সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা"

Tuesday, September 24, 2019

এ কদিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে রুমুনের। একগাদা ডেডলাইন। গুচ্ছের প্রেজেন্টেশন। লেখালিখি। প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। রিসার্চটা একদম গুটিয়ে এনেছে প্রায়। তারই মধ্যে শেষ মুহূর্তের হাজার ব্যস্ততার ভিতরেও কোথাও গিয়ে একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে আছে রুমুনের মন।
এই তো যেমন আজ। ভারলেট এলগরিদ্ম সল্ভ করতে বসে নাকানি চোবানি অবস্থা। এক ঘন্টার মধ্যে সলিউশন বের করে সুপারভাইজরকে দিতে হবেই হবে। তারই মধ্যে হঠাৎ করে ইউটিউবের অটো প্লেলিস্টে বেজে উঠলো "মঙ্গলদীপ জ্বেলে"। মনে পড়ে গেলো, সেই নার্সারি ক্লাসে পড়াকালীন হাউজিং কমপ্লেক্সের পুজোর অনুষ্ঠানের কথা। মা সেবার কালীঘাট থেকে কিনে এনে দিয়েছিল লাল পাড় সাদা শাড়ি। ওই পুঁচকি বয়সে সে কী আনন্দ। পাড়ার দোকান থেকে কেনা লাল সাদা প্লাস্টিকের ব্যাঙ্গেল। বাড়িতে সেই ছবি মা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছে। লাল লিপস্টিকের পাকাবুড়ি।
সেদিনও যেমন ভয়ানক স্টেজ ফ্রাইট কাটিয়ে মিষ্টি করে গান গেয়ে সবার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিয়েছিল সেই ছোট্ট রুমুন, এবারও তো অমন সুযোগ এলো বলে।
সপ্তমীর রিহার্সাল যে ইতিমধ্যেই স্কাইপে পুরোদমে চলছে।
পেন্ডিং যাবতীয় কাজ শেষ করেই মুক্তি। এক রাশ আনন্দ। ভালোলাগা। উৎসব। নতুন করে কুড়িয়ে পাওয়া উদ্যম নিয়ে রুমুন লেগে পড়ে অঙ্কের জালে।
"যা দেবী সর্বভূতেষু, বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা"

Sunday, September 22, 2019

সুদূর লন্ডনে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে রুমুনের। ভোর চারটে। গতকাল অনেক রাত অবধি জেগে ক্লাসের প্রেজেন্টেশন বানিয়েছিল ও। এখনো তাই চোখে ঘুম লেগে আছে। সেই ঘুম ঘুম চোখেই এলেক্সাকে বলে, "প্লে মহিষাসুরমর্দিনী এলেক্সা।" ইকো ডট স্পিকারে গমগম করে ওঠে শঙ্খধ্বনি। আর সাথে সাথেই সেই চিরপরিচিত ব্যারিটোনের হাত ধরেই সূচনা হয় দেবীপক্ষের।
বাইরে বেশ শিরশিরে ঠান্ডা। গায়ের কম্বলটা আরো একটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় রুমুন। হাতে মোবাইল। হোয়াটসআপে স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপে ছোট্ট একটা মেসেজ ছেড়ে রাখে ও। "তাহলে ষষ্ঠী, যাদবপুর থানা। ১১:৩০টা তো?" স্কুল ছাড়ার এতগুলো বছর পর, আবার চারমূর্তির পুজোয় একসাথে বেরোনোর প্ল্যান। চোখ বুজে আসে আরামে। আনন্দে।
ঘুম ভাঙে "রূপং দেহি জয়ং দেহি"র সুরে।
কিছু কিছু জিনিস সেই সনাতনী রয়েই যায়। ভাগ্যিস।

Sunday, September 8, 2019

দেবী

গতকাল রাত্রে মুম্বাইয়ের এক লাউঞ্জ বারের ঘটনা। দেবিকা ওর সহকর্মীদের সাথে গিয়েছে, একটা সাংঘাতিক ব্যস্ত সপ্তাহের শেষে একটু রিল্যাক্স করতে। বেশ কয়েক রাউন্ড মদ্যপান ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। দেবিকার মাথাটা কেমন জানি ঝিম মেরে আছে। ভেবেছিল হাল্কা হবে, হয়নি। উল্টে যেন আরো বেশিই অস্বস্তি হচ্ছে। ও আসতে চায়নি। কিন্তু রুহি, ওর রুমমেট, যে কিনা আবার কলিগও, ওকে একটু জোর করলো। বললো, "আরে ইয়ার, আর কত এমনি আপনে আপ কে কষ্ট দিবি। এক তো অফিস কা ইতনা ঝুট ঝামেলে। উপর সে তেরা ও আশিক। বস কর। একদিন দারু পী লে। মজা আয়গা।" দেবিকা না বলতে পারেনি। ভেবেছিল রুহির কথায় যুক্তি আছে। রোহন যেন ওর জীবনে আবার ফিরবো ফিরবো করছে। বাড়তি ঝঞ্ঝাট।
রোহন ওর প্রাক্তন। স্কুলজীবনের বন্ধু। প্রায় দশ বছর ডেট করার পর যখন দুই বাড়ি থেকে কথাবার্তা বলে বিয়ের ডেট পর্যন্ত ঠিক হয়ে যায়, রোহন অফিসের কাজে লন্ডন যায় দু মাসের জন্য। এবং সেখানে গিয়ে এক পাকিস্তানী মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খায়। সৌভাগ্যক্রমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও কম পটু হওয়ায়, দেবিকা জানতে পারে গোটা ব্যাপারটা। রোহন প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। দুই বাড়ির মধ্যে ঝগড়াঝাটি, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি বাদানুবাদ চলে। বিয়ে বাতিল হয়। আস্তে আস্তে সব চাপাও পড়ে যায়। দেবিকার হৃদয়ের ক্ষতস্থান এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। অন্তত এমনটাই ভেবেছিল।
কিন্তু নিজের ভুল বুঝলো এক মাস আগে। ওদের মুম্বাই অফিসে যোগ দিল রোহন। দেবিকারই টিমে। এখন একটা বড় প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই সর্বক্ষণ একসাথে ওঠা বসা। দেবিকার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। কথায় কথায় রোহনের ওর সাথে দরকারের চেয়ে বেশিই কথা বলার চেষ্টা, ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা। দেবিকা সহ্য করতে পারে না। একবার দুবার ও স্পষ্ট করে বলেছে রোহনকে। কিন্তু রোহন পাত্তা দেয়নি। দেবিকা ঠিক করেছে, এইচ আরে কমপ্লেন করবে।
এইসবের মধ্যেই এই লাউঞ্জে আসা। রুহি, শালিনী আর মধুরের সাথে। এবং এখানে এসেও শক। অদূরে একটা টেবিলে বসে আছে রোহন। একা এক ড্রিংক করছে। আর সমানে দেবিকাদের টেবিলের দিকে তাকাচ্ছে। দেবিকার মাথা গরম হতে লাগলো। রাগে কপালের শিরা দপদপ করছে। লাউঞ্জে মিউজিক আরো জোরে বাজছে। ডিজে মনের সুখে ফ্রাইডে নাইট পালন করছে। এমন সময়, রোহন হঠাৎ করেই এগিয়ে এলো ওদের টেবিলের দিকে। এসে সোজা দাঁড়ালো দেবিকার সামনে। হাঁটু গেড়ে বসে ওর দিকে এক হাত বাড়িয়ে বললো, "উইল ইউ ডান্স উইথ মি? প্লিজ?" দেবিকা থ। রুহি শালিনী মধুর সব্বাই হতবাক। আসে পাশের টেবিলের লোকজন অবশ্য গান, মদ আর খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত। এদিকে কারুর চোখ কান নেই। দেবিকা ঠান্ডা গলায় বলল, "সিন ক্রিয়েট করোনা রোহন। জাস্ট লিভ।" রোহন নাছোড়বান্দা। বসেই রইলো। দেবিকার হাতটা এবার সাহস করে ধরে আবার বললো, কাতর কণ্ঠে, "প্লিজ, ওয়ান ডান্স?" দেবিকা রাগে ঘামছে। ঠোঁটের ওপর, কপালের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। ও এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, "লিভ, এলস আই উইল কল সিকিউরিটি।" রোহন আচ্ছা জেদী। কোনো মেয়ে ওর কথায় সায় দিচ্ছে না, পৌরুষে গিয়ে আঘাত করলো। হিংস্র স্বরে ও চিৎকার করে বললো, "নাচবি না মানে? নাচতেই হবে। সবার সাথে নাচবি। সবার সাথে শুবি। আর আমার সাথে নাচতে হলেই এই? আমি সব জানি। শালী, নাচতে তো তোকে হবেই। শুতেও হবে আমার সাথে।"
রুহি অল্প অল্প বাংলা বোঝে। ইতিমধ্যে যে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ও বুদ্ধি করে মধুরের মারফত লাউঞ্জ বারের সিকিউরিটি ডাকিয়ে নেয়। তারপর সিকিউরিটির সাথে চলে রোহনের এক প্রস্থ হাতাহাতি মারামারি। ধস্তাধস্তিতে টেবিলের কোণে ধাক্কা লেগে রোহনের ঠোঁটের পাশে কেটে যায়। রক্ত বেরোতে থাকে। সিকিউরিটি ওকে বের করে দেয়। ম্যানেজার এসে দেবিকাদের কাছে প্রভূত ক্ষমা চেয়ে যায়। "ইয়ার ইসনে পুরা মুড খরাব কর দিয়া", রুহি আক্ষেপ করে। শালিনী আর মধুরেরও ইচ্ছে নেই বসে থাকার। দেবিকা ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ফ্ল্যাটে ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটে শুয়ে কাঁদতে থাকে দেবিকা। এত অপমান? এত রাগ? এত ঘেন্না? যাকে একদিন ভালোবেসেছিল, তার থেকে এরকম ব্যবহার? আদৌ কি কোনদিনও রোহন ওকে ভালোবাসতো? নাকি সবই দেখনদারী। দেবিকা বিহ্বল হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলে সিনেমার মতো আগে একসাথে কাটানো ভালো ভালো মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আর সেই মিষ্টি দৃশ্যের মধ্যে তাল কাটতে আসে আজকের লাউঞ্জ বারের এই কর্কশ চিৎকার, দুর্ব্যবহার। রোহনের রক্তাক্ত মুখটা ভাবতে ভাবতে এক ঝটকায় চোখ খুলে ফেলে। সারা রাত দেবিকা এপাশ ওপাশ করতে থাকে খাটে। মধ্যে মধ্যে উঠে বেসিন থেকে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দেয় মুখে চোখে। কিন্তু আরাম পায় না। জানলার ধারে এসে চুপ করে বসে থাকে ও। ক্রমে আকাশ ফর্সা হয়।
কফি বানায়। কফি খেতে খেতে দেবিকা সিদ্ধান্ত নেয়। রোহনের সাথে দেখা করবে। ঝটপট তৈরি হয়ে ক্যাব ডাকে। পনেরো মিনিটে পৌঁছে যায় রোহনের বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়ে। বেশ খানিকক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খোলা রোহন। গা দিয়ে বিদেশি মদের গন্ধ। চোখগুলো ঢুলুঢুলু। দেবিকাকে দরজায় দেখে একটু অবাক হয়েই বললো,
- গুড মর্নিং বেবি। এসো।
- রোহন..
- এসো। বসো।
- না রোহন। বসতে আসিনি। কিছু কথা বলার ছিল।
- সে বলবে। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাকি?
- রোহন কাল রাতে..
- কাল রাতে?
- যা ঘটলো, তা ঠিক..
- আই নো, আই নো বেবি।
- লুক, রোহন। আই
- ইটস নট ওকে বেবি। বাট আই ক্যান ফোর্গেট ইট ইফ..
দেবিকা অধৈর্য্য হয়ে উঠছে। কিছুতেই ওকে কথা শেষ করতে দিচ্ছে না। এবারে প্রায় মরিয়া হয়েই ও বললো, "লেট মি ফিনিশ রোহন।"
- ফিনিশ করতে হবে না বেবি। আই নো। কাল আমার টাচ পেয়ে পরে তুমি আরাউজড হয়েছিলে। এন্ড লেটার ইউ রিপেন্টেড। রাইট? ইউ ওয়ান্ট টু কাম ব্যাক টু মি? লেটস হ্যাভ এ ট্রায়াল ফার্স্ট বেবি।"
- লিসিন রোহন, লেট মি প্রিক ইয়োর বাবল। আমি এটাই বলতে এসেছিলাম যে কাল রাত যা হলো লাউঞ্জে, ঠিক হয়েছে। আই এম নট সরি ফর ইট এট অল। ইউ ডিজার্ভড ইট। আই কেম টু ওয়ার্ন ইউ। কালকের ঘটনার সাক্ষী অনেকেই আছে। তুমি যদি আর একবার আমায় ডিস্টার্ব করতে আসো, আই উইল গো টু দ্য পুলিস। ডু ইউ গেট দ্যাট? নাউ গো টু হেল ড্যাম ইট।"
রোহনের নেশা এক লহমায় গায়েব। চিরকাল যে নিজে অন্যের ওপর জোর খাটিয়ে গিয়েছে, একদা নরম স্বভাবের একটা মেয়ে এসে এরকম কথা শুনিয়ে গেল। ও ভাবতে পারছে না। নেশা উড়ে গিয়েছে। মাথায় হাত চেপে সোফা ভর করে মেঝেতে বসে ও।
দেবিকা গটগট করে শব্দ করে এগিয়ে যায় লিফটের দিকে। অনেক দিন পর, আজ ও মাথা উঁচু করে হাঁটছে।
ফ্ল্যাটের মার্বেলের মেঝেটা ঠান্ডা। খুব ঠান্ডা। কিন্তু আরো ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যায় রোহনের শিরদাঁড়া দিয়ে। মনে পড়ে যায় হঠাৎ, দেবীপক্ষ আসতে আর বেশিদিন নেই।

Sunday, September 1, 2019

আলোতে আলো ঢাকা ৬

সন্ধ্যে নেমে আসে বম্বের রাস্তায়। চিকচিক করছে সমুদ্রের তট। পৃথা আর উপমন্যু আস্তে আস্তে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে ব্যান্ডরার রাস্তা বরাবর। পাশ দিয়ে ঝাঁ চকচকে গাড়ি হুহু করে ছুটে চলে। অটোগুলো যেতে যেতে একবার ওদের পাশে এসে স্পিড কমায়, সওয়ারীর আশায়। পৃথা একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনো। সব শাহরুখ ফ্যানের মতোই ও আজ উপমন্যুর সাথে এসেছিল "মন্নত" দেখতে। খুব মন দিয়ে হাঁ করে উপরে তাকিয়ে ছিল, বারান্দার দিকে। যদি ভুলেও এক ঝলক দেখতে পাওয়া যায় স্বপ্নের মানুষটাকে। না, দেখা মেলেনি ঠিকই। আরো কিছু এস আর কে ফ্যানদের মতোই মন্নত লেখাটার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেছে বটে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই মন ভালো করে দিয়েছে।
উপমন্যু গোটা সময়টা পৃথার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। একটা আপাত ধীর স্থির ম্যাচিয়র্ড মেয়ে যে এক ফিল্ম স্টারের বাড়ির সামনে এসে এরকম পাগলামি করতে পারে, ভেবেই অবাক। তবু, ভালো লাগে ওর। এই ছেলেমানুষি, এই আবেগ, এগুলোই তো বেঁচে থাকার রসদ। ওরা হাঁটতে থাকে। এদিক ওদিক গল্প করে। শাহরুখের সিনেমা নিয়ে। বলিউড নিয়ে। নাইন্টিজের গান নিয়ে। এমন সময় পৃথার মোবাইলটা বেজে ওঠে। উফ। "বড্ড ভিলেন তো দেখি আপনার এই ফোনটা?" উপমন্যু মিথ্যে রাগের স্বরে বলে। পৃথা হাসে। ফোনের স্ক্রিনে দেখে আবারও ঋষির নাম। নাঃ। এইবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। উপমন্যুকে একটু থামতে বলে। তারপর ফোনটা রিসিভ করে বলে, "কেমন আছো ঋষি?"
- ভালো। তুমি?
- খুউউব ভালো।
- একটা কথা বলার ছিল।
- বিয়ে করছো, জানি। সুদেষ্ণা বলেছে। কংগ্র্যাটস। অন্য কোনো বক্তব্য থাকলে বলো?
- পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবে প্লিজ? আমি তোমায় ঠকিয়েছি।
- রিয়েলাইজ করেছ তো? এতেই হবে। ভালো থেকো। আর প্লিজ, যোগাযোগ, রেখো না।

পৃথা ফোনটা ছেড়ে দেয়। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। খুব। খুউউব। পাশে দাঁড়ানো উপমন্যু বিহ্বল হয়ে যায়। কী করবে, কিচ্ছু বোঝে না। স্ক্রিপ্টের পর স্ক্রিপ্ট লিখতে পারে, বিজ্ঞাপনের কপি লিখতে এক্সপার্ট। কিন্তু পাশে দাঁড়ানো খুব কাছের মানুষটাকে কাঁদতে দেখে যে কী করবে, ভেবে পায় না। পৃথা ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখ নাক মুছতে মুছতে বলে, "দেখছেন আমি কাঁদছি, একটু কান্না থামানোর চেষ্টাও করবেন না?" উপমন্যু ভ্যাবলার মতোই দাঁড়িয়ে থাকে এখনো। "সবই দেখি আমায় বলতে হবে। উফ। নিন। রুমাল দেওয়ার সুযোগ হারালেন। এবার অন্তত আইসক্রিম খাওয়াতে অফার করুন!"
উপমন্যুর মনে পড়ে যায় নিজের লেখা পুরোনো স্ক্রিপ্ট। একটু ইতস্তত করেই ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে পৃথার কাঁধে। পৃথা যেন এই স্পর্শেরই অপেক্ষায় ছিল। সেঁটে আসে উপমন্যুর দিকে। উপমন্যুও কনফিডেন্স ফিরে পায়। পৃথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে, "দেখো, যা হবার তা হয়েই গিয়েছে। গুরুর কথায় বড়ে বড়ে দেশো মে এইসি ছোটি ছোটি চিজে হোতি রেহতি হ্যায় সেনরিটা। কাজেই পুরোনোকে ভুলে এগিয়ে চলা ভালো। ক্যা পতা, কাল হো না হো?" পৃথা হাঁটা থামিয়ে দেয়। বাঁদিকে মুখ তুলে উপমন্যুর দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে বলে, "তুম তো বড়ে ফিল্মি নিকলে?" উপমন্যু হেসে বলে, "কাম হি এইসা হ্যায়। ক্যা করে?"
এক জোড়া হাত একে অপরের নরম স্পর্শ পেয়ে এগিয়ে চলে স্বপ্নের নগরী দিয়ে। সারা শহর আলোতে ঝলমল করতে থাকে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ওরা। দুজন। ওদের কথাও ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে।

"ভাবছি পুজোয় বাড়ি যাবো। টিকিট কেটে নিই?"
"চলো। একসাথেই যাই। আমারটাও কাটো একইসাথে।"
"হ্যাঁ অবশ্যই। পাশে পাশে থাকি। নইলে আবার কে না কে সহযাত্রী পটিয়ে নেবে।"
"সেই তো।"
"এই তো। সস্তা টিকিট। বুক করি। পৃথা সোম। ইশ। কী ছোট্ট নাম।"
"শর্ট এন্ড সুইট। তোমার মত নাকি? উপমন্যু রায় চৌধুরী। উফ। ২০টা লেটার।"
"তাও গোনা হয়ে গিয়েছে দেখছিই। গুড গুড। বাই দ্য ওয়ে, তুমি এস এইচ ও এম ই লেখো তো?"
"হ্যাঁ।"
"বেশ। তাহলে তোমার ২৩ হবে। এইবার সমানে সমানে হবে।"
"মানে?"
"পৃথা সোম রায় চৌধুরী। ২৩টা লেটার।"
"ডিড ইউ জাস্ট প্রোপোজ ম্যারেজ?"
"হ্যাঁ! ওল্ড স্কুল রোমান্সে বিশ্বাসী।"
"আমিও..."

আর শোনা যায় না ওদের কথা। না শোনাই ভালো। বাকিটা তো ব্যক্তিগত, না?