Sunday, September 8, 2019

দেবী

গতকাল রাত্রে মুম্বাইয়ের এক লাউঞ্জ বারের ঘটনা। দেবিকা ওর সহকর্মীদের সাথে গিয়েছে, একটা সাংঘাতিক ব্যস্ত সপ্তাহের শেষে একটু রিল্যাক্স করতে। বেশ কয়েক রাউন্ড মদ্যপান ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। দেবিকার মাথাটা কেমন জানি ঝিম মেরে আছে। ভেবেছিল হাল্কা হবে, হয়নি। উল্টে যেন আরো বেশিই অস্বস্তি হচ্ছে। ও আসতে চায়নি। কিন্তু রুহি, ওর রুমমেট, যে কিনা আবার কলিগও, ওকে একটু জোর করলো। বললো, "আরে ইয়ার, আর কত এমনি আপনে আপ কে কষ্ট দিবি। এক তো অফিস কা ইতনা ঝুট ঝামেলে। উপর সে তেরা ও আশিক। বস কর। একদিন দারু পী লে। মজা আয়গা।" দেবিকা না বলতে পারেনি। ভেবেছিল রুহির কথায় যুক্তি আছে। রোহন যেন ওর জীবনে আবার ফিরবো ফিরবো করছে। বাড়তি ঝঞ্ঝাট।
রোহন ওর প্রাক্তন। স্কুলজীবনের বন্ধু। প্রায় দশ বছর ডেট করার পর যখন দুই বাড়ি থেকে কথাবার্তা বলে বিয়ের ডেট পর্যন্ত ঠিক হয়ে যায়, রোহন অফিসের কাজে লন্ডন যায় দু মাসের জন্য। এবং সেখানে গিয়ে এক পাকিস্তানী মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খায়। সৌভাগ্যক্রমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও কম পটু হওয়ায়, দেবিকা জানতে পারে গোটা ব্যাপারটা। রোহন প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। দুই বাড়ির মধ্যে ঝগড়াঝাটি, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি বাদানুবাদ চলে। বিয়ে বাতিল হয়। আস্তে আস্তে সব চাপাও পড়ে যায়। দেবিকার হৃদয়ের ক্ষতস্থান এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। অন্তত এমনটাই ভেবেছিল।
কিন্তু নিজের ভুল বুঝলো এক মাস আগে। ওদের মুম্বাই অফিসে যোগ দিল রোহন। দেবিকারই টিমে। এখন একটা বড় প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই সর্বক্ষণ একসাথে ওঠা বসা। দেবিকার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। কথায় কথায় রোহনের ওর সাথে দরকারের চেয়ে বেশিই কথা বলার চেষ্টা, ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা। দেবিকা সহ্য করতে পারে না। একবার দুবার ও স্পষ্ট করে বলেছে রোহনকে। কিন্তু রোহন পাত্তা দেয়নি। দেবিকা ঠিক করেছে, এইচ আরে কমপ্লেন করবে।
এইসবের মধ্যেই এই লাউঞ্জে আসা। রুহি, শালিনী আর মধুরের সাথে। এবং এখানে এসেও শক। অদূরে একটা টেবিলে বসে আছে রোহন। একা এক ড্রিংক করছে। আর সমানে দেবিকাদের টেবিলের দিকে তাকাচ্ছে। দেবিকার মাথা গরম হতে লাগলো। রাগে কপালের শিরা দপদপ করছে। লাউঞ্জে মিউজিক আরো জোরে বাজছে। ডিজে মনের সুখে ফ্রাইডে নাইট পালন করছে। এমন সময়, রোহন হঠাৎ করেই এগিয়ে এলো ওদের টেবিলের দিকে। এসে সোজা দাঁড়ালো দেবিকার সামনে। হাঁটু গেড়ে বসে ওর দিকে এক হাত বাড়িয়ে বললো, "উইল ইউ ডান্স উইথ মি? প্লিজ?" দেবিকা থ। রুহি শালিনী মধুর সব্বাই হতবাক। আসে পাশের টেবিলের লোকজন অবশ্য গান, মদ আর খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত। এদিকে কারুর চোখ কান নেই। দেবিকা ঠান্ডা গলায় বলল, "সিন ক্রিয়েট করোনা রোহন। জাস্ট লিভ।" রোহন নাছোড়বান্দা। বসেই রইলো। দেবিকার হাতটা এবার সাহস করে ধরে আবার বললো, কাতর কণ্ঠে, "প্লিজ, ওয়ান ডান্স?" দেবিকা রাগে ঘামছে। ঠোঁটের ওপর, কপালের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। ও এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, "লিভ, এলস আই উইল কল সিকিউরিটি।" রোহন আচ্ছা জেদী। কোনো মেয়ে ওর কথায় সায় দিচ্ছে না, পৌরুষে গিয়ে আঘাত করলো। হিংস্র স্বরে ও চিৎকার করে বললো, "নাচবি না মানে? নাচতেই হবে। সবার সাথে নাচবি। সবার সাথে শুবি। আর আমার সাথে নাচতে হলেই এই? আমি সব জানি। শালী, নাচতে তো তোকে হবেই। শুতেও হবে আমার সাথে।"
রুহি অল্প অল্প বাংলা বোঝে। ইতিমধ্যে যে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ও বুদ্ধি করে মধুরের মারফত লাউঞ্জ বারের সিকিউরিটি ডাকিয়ে নেয়। তারপর সিকিউরিটির সাথে চলে রোহনের এক প্রস্থ হাতাহাতি মারামারি। ধস্তাধস্তিতে টেবিলের কোণে ধাক্কা লেগে রোহনের ঠোঁটের পাশে কেটে যায়। রক্ত বেরোতে থাকে। সিকিউরিটি ওকে বের করে দেয়। ম্যানেজার এসে দেবিকাদের কাছে প্রভূত ক্ষমা চেয়ে যায়। "ইয়ার ইসনে পুরা মুড খরাব কর দিয়া", রুহি আক্ষেপ করে। শালিনী আর মধুরেরও ইচ্ছে নেই বসে থাকার। দেবিকা ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ফ্ল্যাটে ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটে শুয়ে কাঁদতে থাকে দেবিকা। এত অপমান? এত রাগ? এত ঘেন্না? যাকে একদিন ভালোবেসেছিল, তার থেকে এরকম ব্যবহার? আদৌ কি কোনদিনও রোহন ওকে ভালোবাসতো? নাকি সবই দেখনদারী। দেবিকা বিহ্বল হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলে সিনেমার মতো আগে একসাথে কাটানো ভালো ভালো মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আর সেই মিষ্টি দৃশ্যের মধ্যে তাল কাটতে আসে আজকের লাউঞ্জ বারের এই কর্কশ চিৎকার, দুর্ব্যবহার। রোহনের রক্তাক্ত মুখটা ভাবতে ভাবতে এক ঝটকায় চোখ খুলে ফেলে। সারা রাত দেবিকা এপাশ ওপাশ করতে থাকে খাটে। মধ্যে মধ্যে উঠে বেসিন থেকে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দেয় মুখে চোখে। কিন্তু আরাম পায় না। জানলার ধারে এসে চুপ করে বসে থাকে ও। ক্রমে আকাশ ফর্সা হয়।
কফি বানায়। কফি খেতে খেতে দেবিকা সিদ্ধান্ত নেয়। রোহনের সাথে দেখা করবে। ঝটপট তৈরি হয়ে ক্যাব ডাকে। পনেরো মিনিটে পৌঁছে যায় রোহনের বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়ে। বেশ খানিকক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খোলা রোহন। গা দিয়ে বিদেশি মদের গন্ধ। চোখগুলো ঢুলুঢুলু। দেবিকাকে দরজায় দেখে একটু অবাক হয়েই বললো,
- গুড মর্নিং বেবি। এসো।
- রোহন..
- এসো। বসো।
- না রোহন। বসতে আসিনি। কিছু কথা বলার ছিল।
- সে বলবে। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাকি?
- রোহন কাল রাতে..
- কাল রাতে?
- যা ঘটলো, তা ঠিক..
- আই নো, আই নো বেবি।
- লুক, রোহন। আই
- ইটস নট ওকে বেবি। বাট আই ক্যান ফোর্গেট ইট ইফ..
দেবিকা অধৈর্য্য হয়ে উঠছে। কিছুতেই ওকে কথা শেষ করতে দিচ্ছে না। এবারে প্রায় মরিয়া হয়েই ও বললো, "লেট মি ফিনিশ রোহন।"
- ফিনিশ করতে হবে না বেবি। আই নো। কাল আমার টাচ পেয়ে পরে তুমি আরাউজড হয়েছিলে। এন্ড লেটার ইউ রিপেন্টেড। রাইট? ইউ ওয়ান্ট টু কাম ব্যাক টু মি? লেটস হ্যাভ এ ট্রায়াল ফার্স্ট বেবি।"
- লিসিন রোহন, লেট মি প্রিক ইয়োর বাবল। আমি এটাই বলতে এসেছিলাম যে কাল রাত যা হলো লাউঞ্জে, ঠিক হয়েছে। আই এম নট সরি ফর ইট এট অল। ইউ ডিজার্ভড ইট। আই কেম টু ওয়ার্ন ইউ। কালকের ঘটনার সাক্ষী অনেকেই আছে। তুমি যদি আর একবার আমায় ডিস্টার্ব করতে আসো, আই উইল গো টু দ্য পুলিস। ডু ইউ গেট দ্যাট? নাউ গো টু হেল ড্যাম ইট।"
রোহনের নেশা এক লহমায় গায়েব। চিরকাল যে নিজে অন্যের ওপর জোর খাটিয়ে গিয়েছে, একদা নরম স্বভাবের একটা মেয়ে এসে এরকম কথা শুনিয়ে গেল। ও ভাবতে পারছে না। নেশা উড়ে গিয়েছে। মাথায় হাত চেপে সোফা ভর করে মেঝেতে বসে ও।
দেবিকা গটগট করে শব্দ করে এগিয়ে যায় লিফটের দিকে। অনেক দিন পর, আজ ও মাথা উঁচু করে হাঁটছে।
ফ্ল্যাটের মার্বেলের মেঝেটা ঠান্ডা। খুব ঠান্ডা। কিন্তু আরো ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যায় রোহনের শিরদাঁড়া দিয়ে। মনে পড়ে যায় হঠাৎ, দেবীপক্ষ আসতে আর বেশিদিন নেই।

No comments:

Post a Comment