Sunday, September 1, 2019

আলোতে আলো ঢাকা ৬

সন্ধ্যে নেমে আসে বম্বের রাস্তায়। চিকচিক করছে সমুদ্রের তট। পৃথা আর উপমন্যু আস্তে আস্তে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে ব্যান্ডরার রাস্তা বরাবর। পাশ দিয়ে ঝাঁ চকচকে গাড়ি হুহু করে ছুটে চলে। অটোগুলো যেতে যেতে একবার ওদের পাশে এসে স্পিড কমায়, সওয়ারীর আশায়। পৃথা একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনো। সব শাহরুখ ফ্যানের মতোই ও আজ উপমন্যুর সাথে এসেছিল "মন্নত" দেখতে। খুব মন দিয়ে হাঁ করে উপরে তাকিয়ে ছিল, বারান্দার দিকে। যদি ভুলেও এক ঝলক দেখতে পাওয়া যায় স্বপ্নের মানুষটাকে। না, দেখা মেলেনি ঠিকই। আরো কিছু এস আর কে ফ্যানদের মতোই মন্নত লেখাটার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেছে বটে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই মন ভালো করে দিয়েছে।
উপমন্যু গোটা সময়টা পৃথার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। একটা আপাত ধীর স্থির ম্যাচিয়র্ড মেয়ে যে এক ফিল্ম স্টারের বাড়ির সামনে এসে এরকম পাগলামি করতে পারে, ভেবেই অবাক। তবু, ভালো লাগে ওর। এই ছেলেমানুষি, এই আবেগ, এগুলোই তো বেঁচে থাকার রসদ। ওরা হাঁটতে থাকে। এদিক ওদিক গল্প করে। শাহরুখের সিনেমা নিয়ে। বলিউড নিয়ে। নাইন্টিজের গান নিয়ে। এমন সময় পৃথার মোবাইলটা বেজে ওঠে। উফ। "বড্ড ভিলেন তো দেখি আপনার এই ফোনটা?" উপমন্যু মিথ্যে রাগের স্বরে বলে। পৃথা হাসে। ফোনের স্ক্রিনে দেখে আবারও ঋষির নাম। নাঃ। এইবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। উপমন্যুকে একটু থামতে বলে। তারপর ফোনটা রিসিভ করে বলে, "কেমন আছো ঋষি?"
- ভালো। তুমি?
- খুউউব ভালো।
- একটা কথা বলার ছিল।
- বিয়ে করছো, জানি। সুদেষ্ণা বলেছে। কংগ্র্যাটস। অন্য কোনো বক্তব্য থাকলে বলো?
- পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবে প্লিজ? আমি তোমায় ঠকিয়েছি।
- রিয়েলাইজ করেছ তো? এতেই হবে। ভালো থেকো। আর প্লিজ, যোগাযোগ, রেখো না।

পৃথা ফোনটা ছেড়ে দেয়। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। খুব। খুউউব। পাশে দাঁড়ানো উপমন্যু বিহ্বল হয়ে যায়। কী করবে, কিচ্ছু বোঝে না। স্ক্রিপ্টের পর স্ক্রিপ্ট লিখতে পারে, বিজ্ঞাপনের কপি লিখতে এক্সপার্ট। কিন্তু পাশে দাঁড়ানো খুব কাছের মানুষটাকে কাঁদতে দেখে যে কী করবে, ভেবে পায় না। পৃথা ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখ নাক মুছতে মুছতে বলে, "দেখছেন আমি কাঁদছি, একটু কান্না থামানোর চেষ্টাও করবেন না?" উপমন্যু ভ্যাবলার মতোই দাঁড়িয়ে থাকে এখনো। "সবই দেখি আমায় বলতে হবে। উফ। নিন। রুমাল দেওয়ার সুযোগ হারালেন। এবার অন্তত আইসক্রিম খাওয়াতে অফার করুন!"
উপমন্যুর মনে পড়ে যায় নিজের লেখা পুরোনো স্ক্রিপ্ট। একটু ইতস্তত করেই ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে পৃথার কাঁধে। পৃথা যেন এই স্পর্শেরই অপেক্ষায় ছিল। সেঁটে আসে উপমন্যুর দিকে। উপমন্যুও কনফিডেন্স ফিরে পায়। পৃথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে, "দেখো, যা হবার তা হয়েই গিয়েছে। গুরুর কথায় বড়ে বড়ে দেশো মে এইসি ছোটি ছোটি চিজে হোতি রেহতি হ্যায় সেনরিটা। কাজেই পুরোনোকে ভুলে এগিয়ে চলা ভালো। ক্যা পতা, কাল হো না হো?" পৃথা হাঁটা থামিয়ে দেয়। বাঁদিকে মুখ তুলে উপমন্যুর দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে বলে, "তুম তো বড়ে ফিল্মি নিকলে?" উপমন্যু হেসে বলে, "কাম হি এইসা হ্যায়। ক্যা করে?"
এক জোড়া হাত একে অপরের নরম স্পর্শ পেয়ে এগিয়ে চলে স্বপ্নের নগরী দিয়ে। সারা শহর আলোতে ঝলমল করতে থাকে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ওরা। দুজন। ওদের কথাও ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে।

"ভাবছি পুজোয় বাড়ি যাবো। টিকিট কেটে নিই?"
"চলো। একসাথেই যাই। আমারটাও কাটো একইসাথে।"
"হ্যাঁ অবশ্যই। পাশে পাশে থাকি। নইলে আবার কে না কে সহযাত্রী পটিয়ে নেবে।"
"সেই তো।"
"এই তো। সস্তা টিকিট। বুক করি। পৃথা সোম। ইশ। কী ছোট্ট নাম।"
"শর্ট এন্ড সুইট। তোমার মত নাকি? উপমন্যু রায় চৌধুরী। উফ। ২০টা লেটার।"
"তাও গোনা হয়ে গিয়েছে দেখছিই। গুড গুড। বাই দ্য ওয়ে, তুমি এস এইচ ও এম ই লেখো তো?"
"হ্যাঁ।"
"বেশ। তাহলে তোমার ২৩ হবে। এইবার সমানে সমানে হবে।"
"মানে?"
"পৃথা সোম রায় চৌধুরী। ২৩টা লেটার।"
"ডিড ইউ জাস্ট প্রোপোজ ম্যারেজ?"
"হ্যাঁ! ওল্ড স্কুল রোমান্সে বিশ্বাসী।"
"আমিও..."

আর শোনা যায় না ওদের কথা। না শোনাই ভালো। বাকিটা তো ব্যক্তিগত, না?

No comments:

Post a Comment