Wednesday, November 29, 2017

ভালোবাসাবাসি

১।
আজ কপালটা ভালো বলতে হয়, স্টপে আসতে না আসতেই ২৩৪/১টা ঠিক পেয়ে গেলো তিতির। আর কী সৌভাগ্য, লেডিজ সীট সব ফাঁকা। ভেবেচিন্তে টু-সিটারে জানলার ধারটাতে এসে বসল ও। এই কাঠের বাসগুলির একটাই সমস্যা, যতই ছোটবেলার নস্টালজিয়া মাখা থাকুক না কেনো, জানলার ধার বড্ড কম। যাই হোক, আজ অন্তত আমহারস্ট স্ট্রিট থেকে গলফগ্রীন এবার ঘন্টা খানেকের জন্য কানে ইয়ারফোন গুঁজে বেশ আনন্দেই কাটানো যাবে। সারাদিন ইয়ুনিভারসিটিতে হাজার একটা টেনশান, কাজের প্রেশার সব মিলিয়ে বেশ নাস্তানুবুদ অবস্থা হয় তিতিরের। তারপর বাড়ি ফিরেই রান্নাঘরে ছোটো। রিসার্চ করে দেশ উদ্ধার করো আর যাই করো, বাড়ির বৌ হয়ে এসছো, সন্ধ্যে হলে রান্নাঘরে শাশুড়ির সাথে সাথে থাকতে হবে, এটাই বাড়ির নিদান। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো তিতিরের। মা বাবার কাছে থাকাকালীন বাস পেয়েই মাকে জানিয়ে রাখলেই বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই হাতে পছন্দের রুহ আফজার গেলাসটা ঠিক পেয়ে যেতো। তারপরে তিনজনে মিলে চলত চা জলখাবার সহযোগে টিভি চালিয়ে রাজ্যের গল্প করা। পি এইচ ডি শেষ না করে বিয়ে করার এক্টুও ইচ্ছা ছিল না ওর। ল্যাবের কাজরীদিকে ল্যাজেগোবরে হতে দেখেই এমনটা ভেবেছিল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। পিসিমণির আনা "হীরের টুকরো" ছেলেকে হাতছাড়া করা উচিৎ না বলে গত মাঘেই সায়নের সাথে তিতিরের বিয়েটা হয়ে গেলো। হ্যাঁ, সায়ন হীরের টুকরোই বটে। বরাবর স্কুলের টপার। রামকৃষ্ণ মিশন, আই আই টি বম্বে, জার্মানি থেকে স্কুল, বিটেক, মাস্টারস আর পি এইচ ডি করে এখন এন আই টি দুর্গাপুরে পড়ায়। শুক্রবার সন্ধ্যের বাস ধরে কলকাতা আসে, আবার সোমবার সক্কাল হতে না হতেই ফেরত চলে যায়। উইকেন্ডের দাম্পত্যটুকু বেশ চলে। সারা সপ্তাহের জমানো ভালোবাসা, আদর, সব ওই দুটো দিনেই লুটেপুটে নেয় দুজনেই। কিন্তু তারপরে সারা সপ্তাহের বিরহ। শ্বশুর শাশুড়ি টিভি সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তিতিরের সাথে তেমনভাবে দুটো কথা বলারও কেউ নেই। পি এইচ ডিটা শেষ হলে ও ও চেষ্টা করবে দুর্গাপুরে চাকরির। সোজা না, তাও।
 পি এইচ ডির ফিফথ ইয়ার চলছে, থিসিস লেখা শুরু করবে করবেও হচ্ছেনা, ল্যাবে গাইডের মুখ ঝামটা, এক্সপেরিমেন্ট ফেল করার যন্ত্রণা, কাজ করতে করতে দেরি হয়ে গেলে বাড়ি এসে শাশুড়ির বাংলার পাঁচের মতো মুখ, সব মিলিয়ে যে থমথমে পরিবেশের মধ্যে আজকাল কাটে তিতিরের, তার মধ্যে যেন এক ঝাঁক ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো কাটে এই বাসের জার্নিটা। গান শুনতে শুনতে কখনো কখনো পাশে সহযাত্রী না থাকলে গুনগুন করেও ওঠে ও। আজও তাই করছিল, এমন সময় বাসটা হাজরার মোড়ে থামতে হন্তদন্ত হয়ে উঠল যে, তাকে দেখে এক ধাক্কায় তিতির পিছিয়ে গেলো অনেকগুলো বছর। 

২।
সালটা ২০০৪। সবে মাধ্যমিক দিয়েছে। এখনো রেজাল্ট বেরোয়নি। কিন্তু ট্যুশন ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তিতির আর ওর স্কুলের বান্ধবী সোহিনী সাদারন এভিন্যুতে অঙ্ক করতে আসে দিলীপ স্যারের ক্লাসে। ক্লাসের দ্বিতীয় দিন সেখানে এলো রোহিত। বালিগঞ্জ গভরমেন্ট স্কুলের টপার। কী শান্তশিষ্ট নিরীহ ছেলেটি। প্রথম দেখাতেই এক্কেবারে লাট্টুর মতো অবস্থা হয়ে যায় তিতিরের। একটু বড় মাথা (ঠিক যেমন পাথফাইন্ডারের ব্রোশ্যারগুলোতে টপারদের ছবিতে হয়), চৌকো সরু ফ্রেমের চশমা নাকের ডগার ওপর খালি এসে এসে পড়ে। তেমন ভাবে কারুর সাথে মিশত না শুরুর দিকে, শুধু নিজের স্কুলের দুই তিনজন ছাড়া। তবে আস্তে আস্তে সোহিনীর পাল্লায় পড়ে ওরা সবাই ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। সোহিনী, তিতির, রোহিত, সৌম্য, ত্রিদিব। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর তিতির আর রোহিত দুজনে ওদের অঙ্ক ক্লাসের সবার মধ্যে টপ করায় পাঁচজনে মিলে সেলিব্রেট করতে বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা খেতে গিয়েছিল। 
ক্লাস চলতে লাগল ক্লাসে মতো। সারডস ইন্ডিসেসের সাথে সাথে তখন তিতির একই সাথে "রাধার কি হইল পূর্বরাগ" সিন্ড্রোমেও আক্রান্ত। লাজুক ছেলে রোহিত, যে কিনা রেজাল্টের দিন "সাকসেস" লেখা টিশার্ট পড়ে এসেছিল আর তারপর হ্যান্ডশেক করে তিতিরকে "কনগ্রাটস, আমি ৭৩০, তুমি?"  বলেছিল বলে বাড়ি ফিরে দিদির সাথে কী হাসিটাই না হেসেছিল তিতির, সেই মেয়ে গিয়ে পড়ল এই ছেলেরই প্রেমে। তারপর আর কী, প্রতি ক্লাসে হাঁ করে রোহিতের দিকে তাকিয়ে থাকা, তারপরে ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে সটান প্রিয় বান্ধবী রাকাকে ফোন করে, "উফ, আজ কী দারুণ লাগছিল রে। বটল গ্রিন টিশার্ট, বেইজ কালারের প্যান্টে, ওরে না রে"র বন্যা বয়ে যেত। তবে ব্যাপারটা যে ছিল সম্পূরণভাবেই একতরফা, তা বুঝতে বেশিদিন লাগেনি তিতিরের। ইলেভেনের পুজোর ছুটির পরে পরেই সোহিনীর কথায় শুধু কনফার্মেশনটি পেয়েছিল। হ্যাঁ, রোহিত ভালোবাসে সোহিনীকে। প্রোপোজ করেছিল ওকে পুজোয়, ম্যাডক্স স্কোয়ারে গিয়ে। তিন রাত্তির কেঁদে কেটে ঘুমোতেই পারেনি প্রায় তিতির, ফোঁপাতে ফোঁপাতে রাকার কাছে সান্ত্বনা বাণী শুনেছে কত। তারপর আস্তে আস্তে দিন কেটেছে। ইলেভেন থেকে ট্যুএল্ভ, উচ্চ মাধ্যমিক, জয়েন্ট, বি এস সিতে প্রেসিডেন্সি, মাস্টার্সে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। সেই সব গন্ডি পেরিয়ে তিতির এখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কেমিস্ট্রিতে পি এইচ ডি ফাইনাল ইয়ার। সাথে সাথে ডঃ সায়ন চক্রবর্তীর প্রেমে ভরপুর আদুরে স্ত্রী। 

৩।
রোহিতের সাথে আজ এক ভদ্রমহিলা, স্ত্রী কিনা জানা নেই। সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই বলে তিতির আর যোগাযোগ রেখে ওঠেনি রোহিতের সাথে। এতগুলো বছর পরেও অবশ্য তাও ওকে চিনে নিতে অসুবিধে হলো না। সেই একইরকম রয়েছে, শুধু বয়সের সাথে সাথে মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হয়েছে। আজও পড়েছে সেই বটল গ্রিন রঙেরই একটা শার্ট আর ক্রিম কালারের প্যান্ট। চোখের চশমার ফ্রেমটা একটু মোটা হয়েছে। আর সামনের দিকের চুল অল্প পাতলা হওয়ার দিকে। 
বাসে ইতিমধ্যে ভিড় হয়েছে, রোহিত ও মেয়েটি সামনের দিকে দাঁড়িয়েছিল। বাস যখন টালিগঞ্জ থানা পৌঁছল, দেখল, রোহিত বসার জায়গা পেয়েছে, সামনের দিকে সিনিয়র সিটিজেনের সিটে। তিতির একবার ভাবল, কথা বলবে না কি? কিন্ত অদ্ভুত ভাবে বেশিক্ষণ এই দোলাচলটা টিকল না, আনোয়ার শার মোড়ে পৌঁছতেই তিতির উঠে গেল সামনের দিকে। 
" আরে রোহিত না? কেমন আছিস বল।"
মুহূর্তের জন্য কি রোহিত ভ্যাবাচ্যাকা খেলো? খেলেও খুব দক্ষতার সাথে মেকআপ দিয়ে উত্তর দিল, " তিতির যে! ভালো। তুই কেমন আছিস? এদিকে কোথায়?"
ভাগ্যিস লরডসের মোড় অবধি তারপর বাসটা লম্বা জ্যামে পড়ল। দুই বন্ধুতে চলল কত পুরনো স্মৃতি রোমন্থন। রোহিত এখন একটি সরকারি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, মাস তিনেক আগে বিয়ে হয়েছে। ওর স্ত্রী সুকন্যা একটি বেসরকারি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। ওরা থাকে ভবানীপুরেই, সুনন্দার বাপের বাড়ি লেক গারডেন্স যাচ্ছিল। ভাগ্যিস কোন ক্যাব পায়নি সেদিন, তাই তো বাসে উঠতে হল আর দেখা হয়ে গেলো। নামার আগে নম্বর এক্সেঞ্জ করতে ভুলল না কেউই। 
ওরা নেমে যাওয়ার পর তিতির ওদের দুজনকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। ভারী মিষ্টি মেয়ে সুনন্দা। রোহিতের সাথে খুব মানিয়েছে। সোহিনীকে জানাতে হবে ওদের সাথে দেখা হয়েছে যে। সোহিনী এখন বুদ্ধর সাথে হ্যাপিলি ম্যারিড, ইয়ু কে তে থাকে। একটা সময়ে যে রোহিতের সাথে কথা বলতে বুকের মধ্যে দুরুদুরু করত, যার জন্য সোহিনীর সাথে বন্ধুত্ত্বের ভাঙ্গন ধরেছিল, আজ একটুও তো কিছু হল না। না বাজল ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন, না হাত পা ঠান্ডা হল। দিন আসে, দিন যায়। সময়ের সাথে সাথে কেমন সব সমীকরণ পাল্টে গিয়েছে, ভাবলেও হাসি পায়। 

নিজের নির্ধারিত স্টপে নেমে আবার আজ ডিনারে কী রাঁধতে হবে, পটলের ডালনা নাকি বর্বটির চচ্চড়ি ভাবতে ভাবতে তিতির ফ্ল্যাটের বেল বাজালো। পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় আজ মন ভালো, চোখে মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে আছে। যদিও চাবি নিয়ে বেরোয়, তাও বাড়ির ভিতর থেকে টিভির আওয়াজ পেয়ে আর তা বের করেনি। তবে একটু অবাক লাগল ওর, ঘর অন্ধকার। মিনিট তিনেক অপেক্ষার পর দরজা খুলতে সায়নকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেল তিতির।
" এ কী, তুমি?"
" কী? সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম বলো? "
" তার মানে আমি ল্যাব থেকে বেরিয়ে যখন ফোন করলাম, তখন তুমি এখানেই? "
" আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি তখন তোমার জন্য ডিনার বানাচ্ছিলাম। "
" ডিনার? মা বাবা কোথায়? "
" ওরা দিভাইয়ের ওখানে গিয়েছে। এক সপ্তাহ থেকে ফিরবে। আর তাই আমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসছি। আমার বউটার সাথে একটু সংসার সংসার খেলতে। "
" মা বাবা তার মানে এইসব জানতো? "
" তোমার মা বাবাও। সবাই জানে, এক্সেপ্ট ইয়ু।"
" হায় কপাল। পুরো ভেব্লু হয়ে গেলাম? "
" তা ভেব্লু সুন্দরী, মাঝে মাঝে এমনটা হওয়া ভালো কিন্তু। থিসিস লেখা তাড়াতাড়ি শুরু করো। তার আগে রসদ জোগাতে এলাম। "

গ্লাসে করে শরবৎ এনে তিতিরের হাতে ধরাতে ধরাতে সায়ন বলল, " তা তোমায় আজ যে বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছিল। আই হোল দিয়ে দেখলাম। এই যে অন্যদিন মুখ ব্যাজার করে বাড়ি আসো, আজ কী ব্যাপার? আমি আসছি, টের পেয়েছিলে নাকি?"
" আরে তা না। আজ বাসে অনেক বছর পর রোহিতের সাথে দেখা হল গো। তাই। "
" রোহিত? সে আবার কে? আমার সতান? "
" সতান আবার কী শব্দ? "
" ওই শয়তান আর সতীন মিলিয়ে একটা বানিয়ে ফেল্লুম! "
" ধ্যাত। রোহিত মোটেই শয়তান না। "
" তাহলে অন্তত মেল সতীন?"
" উফ। হিংসুটে কোথাকার। "
" আহা, একেই আমার বউটা আমার থেকে এত দূরে থাকে, এমনিতেই আমি কমপ্লেক্সে ভুগি। বিরহে থাকি। হুঠহাঠ এমন ফিল্মি নামধাম শুনলে ভিরমি খাব না? "
" আরে বাবা।বলছি ওর গল্প পরে। আগে বলো কী খাওয়াবে ডিনারে? ভেরি হাংরি! "
" চিজ চিকেন অগ্রাতা।"
"ওয়াও! চিইইইইইইজ।"
" হ্যাঁ, আরো খাও। আর আরো ভেব্লু হও।" বলতে বলতেই দুজনেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল সোফায়। 

সায়ন আর তিতিরের হঠাৎ পাওয়া এই দাম্পত্যের শুরুটা সেদিন নেহাৎ চিজি রোমান্টিক ভাবেই শুরু হল।  



"আমার  অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া   আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
                   হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে " - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

Sunday, November 26, 2017

রুক্মিনীর কথা।

কিছুতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাজটুকু পছন্দ হচ্ছেনা তিতিরের। অর্ঘ্যর অফিস পার্টি, বেশ কিছু বছর পরে যাচ্ছে তিতির। অর্ঘ্য বসুর এই অফিসে সাম্প্রতিক এক বিশেষ ডিল ক্র্যাক করা উদযাপন করতে এই সারপ্রাইজ পার্টি, তাই মিসেস বসুকে অবশ্য করেই যেতে হচ্ছে। ফিটফাট হয়ে না গেলে ওই রাগারাগি করবে, অন্তত আগে তাই হত। কেন লাল কালো সিল্ক পড়েছে, কমলা নীল পড়েনি থেকে শুরু করে কেন সোনার গয়না পড়েছে যেখানে তখন হাল ফ্যাশনের কস্ট্যুম জ্যুয়েলারি পড়ে পার্টি মাতায় অর্ঘ্যর সব ফিমেল কলিগরা ও বন্ধুদের সঙ্গিনীরা, সেই নিয়ে চলত বিস্তর রাগারাগি, মন কষাকষি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে অনেকখানি। তবুও আজ তিতিরের খুব ইচ্ছে করছে এমনভাবে সাজতে যেন রাজরাণী লাগে ওকে। সারা সকাল দুপুর ধরে আলমারি থেকে কাপড় বের করে গায়ে ফেলে ফেলে দেখে অবশেষে পছন্দ করেছে লাল রেশমের শাড়ীটি। খুব স্পেশ্যাল এইটা ওর কাছে। অর্ঘ্য পাটিয়ালা থেকে এনেছিল ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে। অসম্ভব সুন্দর দেখতে শাড়ীটি পেয়ে তিতিরের সে কী আনন্দ। অর্ঘ্যর এস্থেটিক সেন্স বরাবরই চমৎকার। সেই ছিল বিয়ের পরে অর্ঘ্যর প্রথম অফিস ট্যুরে যাওয়া, বছরে এক থেকে দুইবারের ট্যুরগুলো থেকে ফিরত যখন, প্রত্যেকবার তিতিরের জন্য আসত বাহারি উপহার।  এখন ট্যুরের সংখ্যা মাসে একাধিক হলেও উপহারের ঝুলি শূন্য। প্রথম যৌবনের প্রেম বুঝি এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে, আর তাই কমতে কমতে এখন তলানিতে ঠেকেছে তার উচ্ছ্বাস, বহিঃপ্রকাশ।

ছটা নাগাদ উবার ডেকে চৌরঙ্গীর অফিসের দিকে রওনা দিল তিতির। কথামতো মিঃ চক্রবর্তী ওকে রিসিভ করে নিয়ে গেলেন স্টেজের পিছনের ঘরে। বললেন খানিক অপেক্ষা করতে। অনুষ্ঠান শুরু হলেই ডেকে নিয়ে যাবেন। তিতির বুঝল ওকে গ্রিন্রুমে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, বেশ কিছু ছেলে মেয়েকে দেখল অনুষ্ঠানের আগের ফাইনাল টাচ আপ করছে।

"ও হ্যালো, আপনি নিশ্চয়ই মিসেস বসু? আমি অন্তরা, অন্তরা সিংহ।" তিতির মন দিয়ে একটি মেয়ের খোঁপা বাঁধা দেখছিল। আজ অবধি হাজার চেষ্টা করেও কোন হেয়ারস্টাইল ঠিক করে করতে পারেনি। সাজগোজ, কিচ্ছুটি পারেনা। চমকে উঠল ও অন্তরার কন্ঠস্বরে।
"আমি অর্ঘ্যর পার্টনার। আরে? চমকে গেলেন যে? পার্টনার বলতে, এই ডিভিশনে আমিও সেম পোস্ট হোল্ড করি। আমরা একসাথেই হ্যান্ডল করি সব।"
" ও আচ্ছা। নমস্কার। আমি মণিকর্ণিকা বসু।"
" বাহ! কী সুন্দর নাম তোমার। এই যাহ্‌, দেখুন তুমি করে বলে ফেললাম। সো সরি। আসলে অর্ঘ্যর সাথে আমার সম্পর্কটা এমনই ক্লোজ যে..."
" কোন ব্যাপার না। নিশ্চিন্তে তুমি বলুন।"
" মণি, তুমি বসো। আমি একটু অর্ঘ্যকে দেখে আসি। ওকে এখানে আনার দায়িত্ব তো আমায়ই দিয়েছে চক্রবর্তীদা। তোমার সাথে পরে কথা বলছি। এমন মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি, ভালো করে আলাপ করতে হবে।"
তিতির হাল্কা হাসি হেসে প্রতিনমস্কার করল অন্তরাকে। অন্তরা সিংহ, নামটা খুব চেনা ওর। অর্ঘ্যর ফোনে বহুবার দেখেছে এই নাম। খেতে বসে, টিভি দেখতে গিয়ে, স্পেন্সারসে শাক সবজি বাছতে গিয়ে, যখনই ফোনে এই নামটি দেখেছে, অর্ঘ্য, "ইয়ু ক্যারি অন। দিস উইল টেক সাম টাইম" বলে সরে গিয়েছে। ড্রউইং রুমে বসে বারান্দা থেকে ভেসে আসা হাসির উচ্ছ্বাস, "ও স্যুইটহার্ট, স্টপ ফিলিং ডাউন, লেটস হ্যাভ আ ড্রিঙ্ক টুনাইট", এসবই তাহলে এই রমণীর জন্য। আচ্ছা, কী এমন আছে ওর মধ্যে যা তিতিরের নেই? কেন আজকাল আর ওদের বিবাহিত জীবনে সেই আগের মতো ভালোবাসা নেই? সবকিছুই কেন অভ্যেসে এসে ঠেকেছে?

" ম্যাডাম, সো সরি। আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। অর্ঘ্যর আসতে আরেকটু দেরি আছে। অন্তরা গিয়েছে ওকে ডাকতে। হঠাৎ কিছু লাস্ট মোমেন্ট ডিস্কাশান মনে পড়েছে ওর, খানিক বাদে আসছে। অন্তরা আমায় মেসেজ করে জানালো। আপনার জন্য কফি বলি?"
" না না। ঠিক আছে। অসুবিধে নেই। "
" তাহলে চলুন আপনাকে বরং অফিসটা দেখিয়ে দিই একটু, ঘুরবেন চলুন। "
" ইটস ওকে মিঃ চক্রবর্তী। আমি আগে এসেছি এই অফিসে। "
" ও তাই? আপনাকে কক্ষনো দেখিনি কোন ফ্যামিলি ডে বা পার্টিতে। অর্ঘ্যকে বললেই বলত হয় আপনার শরীর ভালো নেই, নয় আপনি বাপের বাড়ি গিয়েছেন। অবশ্য আমি সবে দুই বছর এসেছি এই ব্রাঞ্চে। "
" হ্যাঁ, আমি অনেকদিন পরে এলাম। ইন ফ্যাক্ট আপনি এত করে বললেন, তাই এলাম আর কী। "

তিতিরের সাথে মিঃ চক্রবর্তী এক এক করে বেশ কিছু অফিস স্টাফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নানান কথাবার্তা চলছিল। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে অন্তরা এলেন গ্রিন্রুমে।
" চক্রবর্তী দা, অর্ঘ্যকে আনছি নীচে এবারে। সব রেডি কি না দেখতে ছুটে এলাম। "
" হ্যাঁ, অন্তরা। আনো। আমি মিসেস বসুকে নিয়ে যাচ্ছি।"


অনুষ্ঠান শুরু হল অর্ঘ্যকে সংবর্ধনা দিয়ে। তারপর অন্তরা খানিকক্ষণ বক্তব্য রাখল ওর আর অর্ঘ্যর পার্টনারশিপ নিয়ে। তারপর একে একে আরো বিশিষ্ট লোকজন এলেন স্টেজে, অর্ঘ্যর স্তুতিতে। ডায়াসে বসে পাশাপাশি অর্ঘ্য আর অন্তরা। আশেপাশে অফিসের বেশ কিছু কর্মকর্তাও আছেন, কিন্তু ওদের দুজনের থেকে যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা, তিতির মন্ত্রমুগ্ধের মতো (নাকি অবাক বিস্ময়ে) হাঁ করে দেখছে ওদের দুজনকে। কী দারুণ কেমিস্ট্রি, একসাথে হাসছে, কথা বলছে, মাঝে মাঝে তো হাসির চোটে একে অপরের ওপর প্রায় ঢলে পড়ছে। হাজার চেষ্টা করেও তিতির মনে করতে পারল না, শেষ কবে ও আর অর্ঘ্য এত হেসেছে একসাথে।

একবার নিজের দিকে দেখল তিতির, হ্যাঁ, এখন বোঝে মায়ের পইপই করে বলা কথাগুলো। শরীরের দিকে নজরই দেয়নি। দিনদিন মোটা হয়েছে বয়সের সাথে সাথে। অথচ অন্তরাকে দেখো, কী ছিমছাম ফিটফাট চেহারা, বয়স কম না, অথচ বয়সের ছাপ নেই এতটুকু, মেদবিহীন। শাড়ীটা পড়েছে কী দারুণ, নির্ঘাত কোন ডিসাইনারের বিশাল দামী প্রোডাক্ট, ব্লাউজটার দামই অন্তত হাজার তিন চারেক হবে, সেটাও ডিসাইনার। ওর সুতন্বী চেহারাকে দারুণভাবে বাড়তি সৌন্দর্য দিয়েছে। চুলের স্টাইলও দামী। গ্রিন্রুমে ও যখন তিতিরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, পারফ্যুমের সুগন্ধে মাতোয়ারা হওয়ার জোগাড় ওর। একেবারে যাকে বলে ওয়েল গ্রুমড, যে কোন পুরুষকে মাতিয়ে রাখার মতো মোহিনী চেহারা। তার উপরে আবার ডিভোর্সি, চক্রবর্তীর থেকে যা জেনেছে, থাকে বয়স্কা মা ছাড়া তিন কূলে কেউ নেই। জীবনের কোন ঝঞ্ঝাট নেই। বাড়িতে রান্নার লোকের পিছনে, ঠিকে ঝির পিছনে পিছনে সর্বক্ষণ টিকটিক করে যেতে হয়না। অফিস আর রূপচর্চা করেই সময় কাটে। তিতির বিয়ের দশ বছর কাটিয়ে দিল শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করে, সেই চক্করে নিজের ভালোবাসার জিনিসগুলো যে কখন ওর জীবন থেকে চলে গিয়েছে, টেরই পায়নি। কিছুদিন আগে চিলেকোঠার ঘরটা সাফাই করতে গিয়ে পুরোনো গানের খাতাগুলো দেখল, ড্যাম্প লেগে কালিগুলো আবছা হয়ে গিয়েছে, ঠিক যেন ওর জীবনের মতোই, বর্ণহীন।  অর্ঘ্যকে দোষ দেয় কিভাবে ও? পেহলে দর্শনধারি, ফির গুণ বিচারি সমাজে যে মেয়ের এত চটক, তার প্রতি আকর্ষণটাই কি স্বাভাবিক না? এই তো আজকেও এত ভাবল ভালো করে সেজেগুজে আসবে, তাও কি পারল? ঠিক শেষ মুহূর্তে ইয়ুট্যুবে দেখা হেয়ারস্টাইলটা ফেইল করল, সেই চিরাচরিত হাতখোঁপা করেই এলো। ক্যাব এসে যাওয়ায় সেন্টটাও লাগাতে ভুলে গেল। ছোট থেকেই তিতির এমন, সাজগোজের প্রতি একদম নজর নেই। মায়ের কাছে কম কথা শোনেনি এই জন্য, কিন্তু তার মাশুল যে এইভাবে দিতে হবে, অকল্পনীয় ছিল ওর কাছে। অর্ঘ্য তো ওকে দেখে খুব যে খুশি হয়েছে, মনে হল না। কেমন একটা দায়সারা ভাবে স্টেজে ওর সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলল। বরং তারপর অন্তরার পাশে বসেই ওর মুখের হাসি ফিরল।


"আজকাল তেরে মেরে প্যার কে চরচে হর জুবান পর
সবকো মালুম হ্যায় অউর সবকো খবর হো গয়ি।"


চিন্তার জাল কাটল তিতিরের স্টেজের গানে। সারা অডিটরিয়াম তখন অন্ধকার। স্পটলাইটের নীচে তখন অন্তরা। কী গলা! কী স্টেজ প্রেসেন্স! এই মেয়ে এক্কেবারে স্টার! গাইতে গাইতে সমান তালে নেচেও গেল, আর প্রথম সারির থেকে বেশ কিছু লোককে তুলে নাচালোও বটে। ওকে আর অর্ঘ্যকেও নাচতে স্টেজে তুলল বটে, কিন্তু তিতিরের বরাবরই স্টেজে উঠলেই কোল্ড ফিট হয়, এক পাও নাচতে পারেনা। একটু কষ্ট করে হাত পা নেড়ে ও সরে এলো, বুঝল যে ওইটুকুতেই অর্ঘ্য বিরক্ত। হবে নাই বা কেনো? সামান্য একটা পার্টিতে নাচতেও পারেনা তিতির? কেনো? শুধুই ঘরকন্না করলেই হয়? আজকের যুগে অন্তত? অর্ঘ্যর কি ইচ্ছে করে না নাকি কোন স্মার্ট সাথী পায়? অন্তরা তো প্রতিপদে প্রতিক্ষেত্রে অর্ঘ্যর সাথে সমান তালে চলতে পারে, সেখানে তিতিরের জায়গা কোথায়? নাহ, এ মিড লাইফ ক্রাইসিস না। এটা বরং তিতিরেরই পারসোনালিটির এক্সিস্টেন্সের ক্রাইসিস। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মডার্ন হতে পারলো না, এখনো ১৫/১ শ্যাম পুকুর লেনের মানসিকতা আঁকড়ে রইলো বলে সাউথ সিটির তিরিশ তলায় থাকতে পারলেও বোধহয় খাপ খাওয়াতে পারলনা। আর অর্ঘ্য? ও কি করবে? ঘরে যে সুখ পেলো না, সেই সুখের সন্ধানে অন্যত্র যাবে না কেনো? তিতির নিজে ওই জায়গায় থাকলে কি তা করত না? করতো? প্রশ্নের উত্তর পায় না তিতির। শুধু ভেসে আসে সারা সন্ধ্যের কিছু কিছু মুহূর্ত, সিনেমার মতো।

দু চোখ ভরে আসে জলে। কোনমতে অডিটোরিয়ামের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফেরে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় খোলা হাওয়ায়। জীবনের সব জমে থাকা দুঃখ হঠাৎ একসাথে যেন ওর গলা টিপে দিচ্ছে।  চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, নিজের ভাগ্যের ওপর। গলার কাছে একটা বড্ড বড় রকমের কান্নার দলা পাকিয়ে ওঠে ওর। হাতে ব্লেড নিয়ে একবার ভাবে শেষ করে দেয় সব যন্ত্রণা, সব দুঃখ কষ্ট এক মুহূর্তে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চাপ দিতে পারেনা ব্লেডে। বড্ড ভিতু যে। এই পরীক্ষায়ও হেরে যায় তিতির, সবের মতোই। সেই "গুড ফর নাথিং"ই রয়ে যায়।







Wednesday, November 22, 2017

আমি ও সানগ্লাস

১।

" পইপই করে তোকে বলেছি, রোদের মধ্যে বেরোস যখন, সানগ্লাসটা পড়ে নিবি। এবার বোঝ! মাথা ব্যথা কী করে কমবে, আমি জানিনা। গ্লোনইন খেয়ে দেখ। " (মা জননীর পরম প্রতাপান্বিত চিৎকার)
" হ্যাঁ, পড়েছি তো। " ( মিনমিনে রিনরিনে গলায় অধমের উত্তর)
" সে তো এখন, আগে পড়লে এই মাথা ব্যথাটা হত না। এত বছর বয়স হয়ে গেলো, তবু নিজের ভালো নিজে বুঝতে শিখলো না। " ( অত্যন্ত বিরক্তি, "এর আর কিছু হল না" ভাব সহ মা জননী) 



২।

" মা আসছি। ক্যাব এসে গিয়েছে। " ছলছল চোখ, মায়ের ও মেয়ের, দুজনেরই। ক্যাবে ওঠার মুখে কিন্তু মেয়ের কক্ষনো ভুল হয় না সানগ্লাসটা পড়ে নিতে, সে রোদ হোক কি না হোক। সেটা যে তখন এক বিরাট পর্দা।




৩।

পণ্ডিচেরি প্ল্যান চেকলিস্টঃ

ফ্লোরাল প্রিন্টের ড্রেস :  ✓
বিচ স্যান্ডাল : ✓
সানস্ক্রিন লোশন : ✓
সানগ্লাস ( লেটেস্ট স্টাইলের) : ✓




৪।

তেল মাখা মাথা, কোন হেয়ারস্টাইলই যখন ভালো লাগছে না, মাথার পিছনে সব চুলগুলোকে টেনে এনে একটা দলা পাকিয়ে খোঁপা। চোখে বড় সানগ্লাস, ঠোঁটে হাল্কা লিপগ্লস। পারফেক্ট! এক্কেবারে নাল্লা ইড়কা!!!

Tuesday, November 21, 2017

গানের ওপারে

হেমন্তের বিকেল। পড়ন্ত সূর্যের ম্লান আলো এসে পড়েছে হিমানীর ফ্যাকাশে গালে। কাঠের জানলার পাল্লা ধরে বসে থাকে ও এই সময়ে, সারাদিনের মতোই। সামনের লেকের ওপর সূর্যাস্ত ওর খুব প্রিয়, আর একটু পরেই শুরু হয়ে যাবে আশেপাশের বাড়িগুলি থেকে পরিণত অপরিণত কণ্ঠে সরগমের রেওয়াজ। বড় ভালো লাগে হিমানীর। মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার দিনগুলি। সন্ধ্যেবেলা খেলার মাঠ থেকে ফিরেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসাতো মা, শিবানী আর ও, ওরা দুই বোন গলা খুলে গাইত গান। দুই বোনেরই অসামান্য গানের গলা। পাড়ার ক্লাবে, স্কুলে সমস্ত অনুষ্ঠানে ওরা দুজনে মাটিয়ে রাখতো ওদের কোকিলের কলতানে।

" বৌদি এসো। তোমায় রেডি করে দিই। দাদা আবার নইলে আমায় বকবে দেরি হলে।"

হিমানী কিছু বলে না, ঠায় তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে। পশ্চিমের আকাশ এখন হাল্কা বেগুনী, সার দিয়ে একে একে সব পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের বাসায়। আজকের মতো সমস্ত সংগ্রাম শেষ, আবার কাল ঊষার নতুন আলোয় শুরু হবে দিনযাপনের যুদ্ধ।

" কী গো? এসো? কোন শাড়িটা পড়বে, বলো।"
রমার কথায় সম্বিৎ ফেরে হিমানীর। আস্তে আস্তে বিছানায় বসে আলমারিতে রাখা শাড়িগুলোর দিকে তাকায়। কত দামী দামী পোশাক, এক কালে রজতের সাথে পার্টিগুলোতে যেত যখন সেজেগুজে, এক্কেবারে রাজরানী লাগত। কত বছর পর আবার আজ একটা পার্টি হতে চলেছে বাড়িতে। চায়নি ও একদম, কিন্তু রজতকে বলতে পারল কই? বিয়ের পঁচিশ বছর উদযাপন করবে বলে নাছোড়বান্দা সে।

 বাঁ হাত দিয়ে পছন্দের হলুদ বেনারসিটা দেখায় রমাকে।
" ওই হলদে শাড়িটা? ঠিক তো? "
মাথা নাড়ে হিমানী।

রমা ওকে সাজাতে সাজাতে করে চলে রাজ্যের গল্প, টিভি সিরিয়াল থেকে শুরু করে হাউজিং কমপ্লেক্সের খুঁটিনাটি। গত দশ বছর ধরে ও আছে হিমানীর দেখাশোনা করার জন্য। একেবারে ছায়ার মত থেকে আগলে আগলে রাখে ওকে। যখন প্রথম আসে এ বাড়িতে নার্সের কাজ নিয়ে, তখন দেখত সারাদিন পুরনো ফটো এলবাম হাতে নিয়ে হিমানী পড়ে পড়ে কাঁদত, দুই চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে নেমে আসত অঝোর অশ্রুধারা। কিন্তু একটা শব্দ বের হত না। অমন লক্ষ্মীপ্রতিমার ন্যায় চেহারার মানুষটাকে কান্নাকাটি করতে দেখতে কোমলহৃদয়ের রমা ভেঙ্গে পড়ত।

এখন আর বৃষ্টি পড়েনা, চারিদিক শান্ত, স্তব্ধ। গাড়ির ভয়াবহ এক্সিডেন্ট আর তাতে  ছেলের অকালমৃত্যু নির্বাক করে দেয় হিমানীকে। বহু চেষ্টা করেও আর বাণী ফেরাতে পারেনি ওর কণ্ঠে কেউ। রজত নিজের অফিস, ব্যবসা সব মিলিয়ে অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে। বহির্বিশ্বের সাথে নিত্য কেজো সম্পর্কের ফলে আর সূক্ষ্ম অনুভূতি, দুঃখ কষ্টরা বুঝি কবেই বিদায় নিয়েছে, বুকের মাঝে একটা বিশাল ফাঁক সেও অনুভব করে, তবে হিমানীর মত না।

" কী সুন্দর লাগছে তোমায় দেখতে গো বৌদি। আহা, ঠিক যেন মা লক্ষ্মী। " রমার কথায় ম্লান হাসে ও।

" কই গো, এসো। লোকজন যে আসা শুরু করে দিয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার। চলো। "
রজতের এগিয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে হিমানী বেরোয় নিজের ঘর থেকে। আজ এতগুলো বছর পরে ও বাড়ির ছাদে এলো। সেই ছাদ, যেখান থেকে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত ওর প্রিয় শহরটিকে। ধোঁয়ায় ঢাকা রাতের আকাশে তারারা গরহাজির। কিন্তু ফেয়ারি লাইটস দিয়েছে কৃত্রিম সৌন্দর্য।  ম্যুজিক সিস্টেমে লো ভল্যুমে চলছে কিশোর রফি লতার রেট্রো। রঙিন পানীয় আর হরেকরকম সুখাদ্যের গন্ধে সন্ধ্যে জমজমাট।

আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সাথে সৌজন্যের হাসি হেসে কেটে গেল সারা সন্ধ্যেটা। রাত্রে রমার ছুটি করে দিয়ে রজত হিমানীকে নিয়ে গেলো নিজেদের বেডরুমে। ঘর অন্ধকার।
" দাঁড়াও, এক মিনিট। " এই বলে রজত চট করে একটা কাপড়ের ফালি এনে হিমানীর চোখ বেঁধে আস্তে আস্তে ঘে ঢুকল ওর হাত ধরে। হিমানী টের পেল ঘরের আলো জ্বলে উঠেছে। রজত ওর চোখ থেকে ফিতে খুলতেই,
" সারপ্রাইজ! দেখো তো? পছন্দ হল তো? "
ওর সামনে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো, ঠিক যেমনটা পঁচিশ বছর আগে হানিমুনে ইংরেজ আমলের চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে দেখে দুই চোখ চিকচিক করে উঠেছিল হিমানীর।

আজ আবার হিমানীর দুই চোখ ছলছল করছে। এত বছরে, এত ঝড়ঝাপটাতেও রজত ভোলেনি ওর এই ইচ্ছাটিকে। খুব সন্তর্পণে ও এসে বসল পিয়ানোতে। বাংলোতে বাজানো গানটাই আবার বাজিয়ে গাইল ও আজ, নাই বা শুনতে পাক ওর গলার স্বর আজ কেউ। হিমানীর আঙুলের ছোঁয়ায় তখন পিয়ানো থেকে যে সুরঝঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে, রজত যেন তাতেই ডুবে যাচ্ছে, আরো প্রেমে, আরো প্রেমে।






Monday, November 20, 2017

ব্যাকস্পেসঃ একটি কাল্পনিক কথোপকথন

ইভেন্টের সাথে সামঞ্জস্য আছে কি না, বুঝছিনা। থিম, যেটা নিয়ে লিখছি আর কি, সেটাও কিছুই নতুন না। এই ব্যাকস্পেসের আড়ালে জমে থাকে অনেক অনেক অজানা গল্প। অনেক কিছুই আমরা ভাবি, এমনটা হলে বা এমনটা বলতে পারলে, কী ভালোই না হতো। কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে মনে হয় রিওয়াইন্ড বাটনটা প্রেস করতে পারলে, অনেক কিছু অন্যরকম ভাবে করা যেত। তেমনই এক কাল্পনিক কথোপকথন তুলে ধরলাম। আপনি আমি সক্কলে কোন না কোন দিন এমন অবস্থায় পড়েছি বা পড়ব যেখানে " কেমন আছিস" এর উত্তরে লম্বা করে নিজের দুঃখের কথা লেখার চেয়ে এক বুক অভিমান নিয়ে "হ্যাঁ, ভালো" বলাটা অনেক বেশী সহজ। নীচের লেখাটিও কিছুটা ওই ধাঁচেরই।


ডিসক্লেমারঃ ইভেন্টের নামের সাথেই ম্যাচ করিয়ে, "সব চরিত্র কাল্পনিক। Any resemblance to any person living or dead is purely coincidental."


এক "ভালো" মেয়ের কথা



- ওই, আমার ওপর রাগ হয়েছে নাকি? কদিন এক্কেবারে কথা বলছিস না যে?

- না না, তোর ওপর রাগ হবে কেন? আমি কে? কী রাইট আছে আমার বল তোর ওপর রাগ করার? তুই কি না এখন সেলিব্রিটি, তোর নামে গোটা মিডল স্কুল ফ্ল্যাট, ফ্যান ক্লাব হয়ে গেলো তোর। সেখানে আমি কে না কে কোন হরিদাস পাল যে তোর ওপর রাগ করব? স্বরলিপিতে যখন তোর এগেন্সটে বিলুরা এত নোংরামি করল, তখন না হয় আমি একটু তোকে সাপোর্ট দিয়েছি। তা দেবো না কেন, তুই কি না আমার এত্ত ভালো বন্ধু। তার মানে তো এই না যে তোর ওপর আমার রাগ করার অধিকার হবে, তাই না? স্বরলিপি ছেড়ে বৈতালিকে এলি, শুরুতে তোকে ব্যান্ডে চান্সই দিলো না। তাতে কী? আমরা একসাথে তারপরে গান গাইলাম, সেই সুবাদে তুই আবার সোলো গাইলি। তখন এত্ত লোকে তোর ওই গান শুনে ফ্ল্যাট হয়ে গেলো। তারপর স্কুল ফেস্টে তোর ওই পারফরমেন্সটা রে, যার জন্য আমি এত গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে পাবলিসিটি করলাম, ওটায় যে অসামান্য সাড়া পেলি, ওই চিয়ারিং করা তো আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল, তাই না? আমি কি না তোর সেই কবেকার বন্ধু, বন্ধুর জন্য এইটুকু করতে পারিনা? করবোই তো, আমি না ভালো মেয়ে? বাবা, এখন তুই কত বড় মাপের সিঙ্গার সংরাইটার বল,কীসব আবার শুকনো খেজুরগুড় হাম্বা গাম্বা লেভেলের গান লিখিস, আমার এইটুকু মাথায় ঢোকেই না। মাঝে মাঝে তো দেখি আবার অনু মলিকের মত ওইসব আরবি পার্সি সব গানের সুর থেকেও অনুপ্রেরণা পাস। সেদিনের তোর ওই গানটারে, ওই যে রে, ল্যাভেন্ডার নিয়ে যে গানটা সেদিন রিলিজ করলি, তার সুরটা তো ভীষণভাবে আমার এক চাইনিজ পিয়ানিস্টের একটা পিসের কথা মনে করাল। তারপরে দেখলাম তোর ভিডিওতে ভর্তি ভর্তি লাইক আর লাভ, কমেন্ট আর শেয়ার। কে জানে, এতজন যখন প্রশংসা করল, এত স্তাবক, সকলে কত বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই খুব মৌলিক হয়েছিল। আমার নেহাত কাঁচা মাথা। এসব বুঝিনি তাই, এপ্রিশিয়েট করতেই পারিনি উল্টে ভাবলাম কিনা তুই টুকলি করেছিস। যাই হোক, সরি রে। না না। এরকম ভাবা আমার ভুল হয়েছে। তোর ওপর রাগ করাটাও ভুল হয়ে গিয়েছিল। এক্সট্রিমলি সরি রে। প্লীজ তোর ফ্যানক্লাবে আমায় স্থান দে, অন্তত পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে? ইয়ে দোস্তি হাম কভি না তোড়েঙ্গে। প্লীজ প্লীজ? জানি খুব ট্যালামার্কা শোনাচ্ছি, কিন্তু কি করব, আমি যে এরকমই, প্যালা হাঁদা গঙ্গারাম। তোর মত চৌকশ থোড়িই। আর রাগ করব না। এবার থেকে সারাক্ষণ তোর স্তুতি গাইবো, তোর ভালোটুকুই দেখবো। পদে পদে আমায় যখন অবহেলা করিস, সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করব। আমি কি না ভালো ভদ্র মেয়ে। আমার কি আর ঝগড়া আসে বল?



(অনেকগুলো ব্যাকস্পেস টেপার শব্দ)

- ধুর, না রে। একটু ব্যস্ত ছিলাম রে। অনেকগুলো পেন্ডিং এসাইনমেন্ট ছিল, ওই নিয়ে...

- তাই বল। ইয়ুটিউবে একটা নতুন গান পোস্ট করেছি এবার। শুনে বলিস কেমন লাগল। আর একটু প্রোমোট করে দিস, পিপলস চয়েসের প্রাইজটা টার্গেট করেছি।

- হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ভালো তো হবেই, তুই করেছিস কি না!

- হুম। প্রোমোট করতে ভুলিস না।
- চল বাই।
- বাই।







Tuesday, November 14, 2017

স্নেহ

- হ্যালো?
- মিতু কী করছিস বাবু?
- সকাল সকাল কী করব বলো? এই তো ক্যাম্পে বসে আছি।
- এখনো কোন পেশেন্ট আসেনি?
- এসছে তো, ওই তিন চার জন।
- কতক্ষণ চলবে?
- বিকেল পাঁচটা অবধি।
- সবে এগারোটা বাজে। বলছি ব্রেকফাস্ট করেছিস?
- না, সময় হয়নি।
- সে কী? কতবার বলব ব্রেকফাস্ট স্কিপ করবি না?
- উফ মা, সময় পাইনি বলছি তো।
- সময় পাইনিটা কোন কথা হল? শরীর খারাপ হয় জানিস?
- মা পাঁচ বছর ধরে কষ্ট করে ডাক্তারিটা না আমি পাস করেছি মা, তুমি না। তাই প্লীজ আমার ব্যাপারটা আমায় বুঝতে দাও।
- ধুর বাবা, ভালো লাগেনা। তোকে কিছু বলতে গেলেই এমনভাবে রিএক্ট করিস আমার ভীষণ খারাপ লাগে।
- বলতে আসোই বা কেনো বলো তো? কাজের সময় ফোন করে জ্ঞান দিতে এলে আমি কিভাবে উত্তর দেবো?
- ছাড়। আমি রাখছি।
- হ্যাঁ রাখো।


মনটা তেতো হয়ে গেলো মিতু, অর্থাৎ ডঃ মিতালি দাসশর্মার। একেই কাল রাত্তির থেকে  হবু বর সুপ্রিয়র সাথে এক প্রস্থ ঝগড়া চলছে। মিতু ওর ফাইনাল ইয়ার থেকে একটি এন জি ওর সাথে যুক্ত। দুই মাস অন্তর অন্তর ও তাদের সাথে আসে সাঁওতাল পরগণার এই ছোট গ্রামে। স্থানীয় মানুষজনের চিকিৎসার জন্য।  বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় থেকেই সুপ্রিয় জানে এই ব্যাপারটা, শুরুতে এই নিয়ে কোনরকম মনোমালিন্য হয়নি। কিন্তু ইদানীং মিতু দেখছে, বিয়ে যত এগিয় আসছে, সুপ্রিয়র যেন দুই চোখের বিষ হয়ে উঠছে মিতুর এই ক্যাম্প। কাল রাত্রে অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটির পর দুজনেই পরেরদিন কাজ আছে এই অজুহাতে ঝগড়া স্থগিত রেখেছে, তাই মুড অফ। এর মধ্যে মায়ের ফোন আসায় বেচারির উপর চোটপাট করে দিল। কিই বা করে মিতু, এই নিয়ে সকাল থেকে দুবার ফোন, পাঁচবার মেসেজ হয়ে গিয়েছে মায়ের সাথে, তারপরেও বার বার ফোন এলে বিরক্ত হবে না? এক কথা শুনতে ভালো লাগে? ও নিজেও জানে, ব্রেকফাস্ট মিস করা খারাপ। কিন্তু মুড ভালো নেই। ইচ্ছে করছেনা। জোর করে খাবে নাকি? মা যেন কিচ্ছু বুঝতে চায় না। ধুর, পেশেন্টও আসছেনা কোন।
নিজের মেকশিফট চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাইরেটা দেখল মিতু। আশেপাশে তেমন লোকজন নেই ক্যাম্পের ওরা কয়েকজন ছাড়া। রাঙ্গারও দেখা নেই।

প্রতিবার ও যখন ক্যাম্পে আসে, রাঙ্গা আর ওর ছেলে বিশু এসে ওর সাথে দেখা করে যায়। পুলের পাশেই ওদের ঘর। গত বর্ষায় কোন বিষাক্ত পোকার কামড় খেয়ে বিশুর অবস্থা যায় যায় প্রায়। রাঙ্গা কাঁদতে কাঁদতে প্রায় হাতে পায়ে ধরে ক্যাম্প থেকে মিতুকে নিয়ে যায় ওদের ঘরে। প্রাথমিক চিকিৎসা করে তারপর এম্ব্যুলেন্স করে সদর হাসপাতালে গিয়ে বিশুর চিকিৎসা চলে দুদিন। পুরোপুরি যতক্ষণ ও সুস্থ না হয়, মিতু ওখানেই ছিল। তারপর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বিশুকে আর রাঙ্গাকে ওদের ঘরে পৌঁছে ওর ছুটি হয়েছিল। সেই থেকে রাঙ্গা আর বিশু প্রতিবার এসে ওদের ডাক্তার দিদির সাথে দেখা করে যায় ক্যাম্প বসলেই। বড় ভালো লাগে এই গ্রামের মানুষগুলোকে মিতুর, কী সরল, কী ভালো। শহুরে আধুনিকতা যতদিন না ওদের ছুঁতে পারে, ততদিনই ওদের মঙ্গল। নইলে তো সেই সব একেকটা স্বার্থপর জীব হবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই মিতু দেখল দূরে হলুদ শাড়ী পরে রাঙ্গা। সাথে হাত ধরে দৌড়তে দৌড়তে আসছে বিশু।
- ও দিদি, কেমন আছো?
- ভালো রাঙ্গা। তুমি?  এই বিশু কেমন আছিস?
- ভালো পিসি।
- তোমাদের আজ দেরি হল? আমি ভাবছিলাম এখনো আসলে না কেন?
- আজ বিশুর ইস্কুলে ডেকেছিল। ওখান হতে এলাম।
- কেন রে বিশু? লেখাপড়া করছিস না নাকি?
- না পিসি। আমি ফার্স্ট হয়েছি ক্লাসে। তাই মা কে ডেকে বলল।
- বাহ! খুব ভালো। দাঁড়া, তোকে কী দিই?
- কিচ্ছু দিয়োনি দিদি। ছেলেটা খুব বদমাশ হচ্ছে।
- কেন রাঙ্গা?
- কোন কথা শোনেনা। সকাল থেকে জানো খায়নি কিচ্ছু। না খেয়ে ইস্কুলে পালায়, খেলবে বলে। তুমি ওকে একটু বকে দাও না দিদি।

মনে পড়ে গেল মায়ের কথা। মায়েদের চিন্তা বোধহয় স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে এক থাকে। সাঁওতাল পল্লীর অশিক্ষিত রাঙ্গা হোক কী দক্ষিণ কলকাতার নামী কলেজের প্রিন্সিপাল মলয়া, নিজের সন্তানের সুস্বাস্থ্য ছাড়া মায়েদের জীবনে বোধহয় আর কিচ্ছু বড় না। হঠাৎই তাই সকাল বেলা মায়ের ওপর চোটপাট করার জন্য একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল মিতুর। চেম্বার থেকে নিজের হাতব্যাগটা এনে, সেখান থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে বিশুকে দিতে দিতে বলল, " এই বিশু পাগল, আমি যেন পরেরবার এসে মায়ের কাছে তোর নামে কোন নালিশ না শুনি। ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া করবি। মা কে জ্বালাতন করলেই শহরে নিয়ে যাব। বুঝবি ঠ্যালা তখন! "

শহরের নামেই বিশুর গায়ে জ্বর আসে, আর তাই এইবারে যে মোক্ষম ডোজটা পড়েছে, বুঝল মিতু। " যা বাড়ি গিয়ে স্নান করে শিগগিরি খা কিছু। রাঙ্গা নিয়ে যাও ওকে। ভালো থেকো। "
" দিদি তুমিও ভালো থেকো। আবার এসো।"

মিতুর চোখের সামনে দিয়ে মায়ের হাতে বিস্কুটের প্যাকেটটা দিয়ে, মুখে একটা পুরে, তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে চলল আট বছরের বিশু, এক হাতে মায়ের হাত শক্ত করে জাপ্টে ধরে; এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর তো দুটো হয় না। এই বোধও হয়তো দেশ কাল সবকিছুর বাধা ছাড়িয়ে যায় এসে যায় মানব মনে। চোখের কোণের জল রুমালে মুছে মিতু চলল ফোন বের করতে। মা কে একটা সরি বলতেই হবে, এখুনি।

Thursday, November 9, 2017

সোনার ছেলে

মাদ্রাস নিয়ে লিখছি, সেখানে বলব যাদের কথা, তাদেরই একজনের কথা আজ বলি আলাদা করে। ওর জীবনটা হয়তো অনেকের সাথেই মিলে যাবে, আবার নাও মিলতে পারে, কিন্তু আমি যতজনকে চিনেছি আজ অবধি, এইরকম অধ্যাবসায় বোধহয় কারুর দেখিনি।
সকাল থেকে রাত অবধি সাঙ্ঘাতিকভাবে লেখাপড়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। অনেক সময় রাতের পর রাত জেগেও কাজ করে। শরীর খারাপ হয়ে যাবে, একটু বিরতি নে বললেও কথা শোনেনা; কারুর সাথে নিজের রিসার্চের কাজের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে দুই চোখ চকচক করে ওঠে।  কোন কিছু করবে ভাবলে এক অদম্য জেদের সাথে শেষ দেখেই ছাড়ে। আমরা যখন ওকে বলি যে এত অমানুষিক পরিশ্রম করছিস কেন, তার উত্তর পাই, আমাকে অনেকটা বড় হতে হবে। জীবনে দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। তোমরা বুঝবে না।
সত্যিই তাই। ওর জীবনের স্ট্রাগলের কথা যতদিন জানিনি, ততদিন ভাবতে পারতাম না, ওর এত খাটুনির পিছনের আসল উদ্দেশ্যটা কী। আসলে যখন ছোট থেকে বড় হয়েছে ও, দুই চোখে ছিল এক স্বপ্ন, সে স্বপ্ন একদিন অনেক বড় হবে, দূর হবে জীবনের বাধা।
মেদিনীপুর শহরের এক বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের ছেলে ও। বড় হয়েছে দারিদ্র্য ও অভাবের মধ্যে। তবে কখনোই তা মুছে ফেলতে পারেনি ওর দুই চোখের এই স্বপ্নকে। বরং প্রতি মুহূর্তে ওকে এই অভাব অনটনের সংসার মনে করিয়ে দিতো যে আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের থেকে ওকে যে অনেক বেশী খাটতে হবে। স্কুলে পড়াকালীন আই আই টি জয়েন্টের কথা জানত না, তাই স্টেট জয়েন্ট ছাড়া অন্য কোন পরীক্ষায় বসেনি। এবং সেখানেও অসম্ভব ভালো র‍্যাঙ্ক করে যাদবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙে চান্স পায়। অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতা না থাকায় ট্যুশন করে নিজের খরচ চালাত। বছর দেড়েক চাকরি করে টাকা জমিয়ে এখন ও আই আই টিতে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিঙে রিসার্চ করছে। ও আমাদের সকলের গর্ব।  যেখানেই যায় নিজের কাজ প্রেসেন্ট করতে, প্রথম স্থান পেয়ে আসে। ও আমাদের সোনার ছেলে। সমস্ত ফ্যাকাল্টিদের, সিনিয়রদের আর জুনিয়রদের ও প্রিয়পাত্র।
আমার খুব গর্ব হয় ওকে চিনি বলে। ওর থেকে প্রতি মুহূর্তে শিখি যে অদম্য ইচ্ছা আর সাহস থাকলে, কঠিন অধ্যাবসায়ের মারফত কীভাবে মানুষ তার স্বপ্ন সফল করতে পারে। যেভাবে ওর কেরিয়ার এখনও অবধি চলছে, আমি হলফ করে বলতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে ও একাডেমিক ফিল্ডে খুব নাম করবে।

শুধু লেখাপড়াতেই ওর গুণ সীমিত না। ভীষণ ভাবে ভালো মনের একটা মানুষ, কোনরকম বিপদে আপদে এগিয়ে যায়। যথাসাধ্য সাহায্যও করে। এছাড়া বড় ভালো ছবি আঁকে, গান গায়, লেখালিখি করে। গিটার বাজায়। এই প্রসঙ্গে বলি, ওকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে চিনি। গিটার বাজাতো আমি গান গাইলে, তখন ওকে গানের কর্ড দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু এই কবছরে নিজের চেষ্টায় গিটারটাকে ভালোমতোই রপ্ত করে ফেলেছে, নিজে নিজে সুর বানায়, বাজায়।

গর্ব হয় প্রতি মুহূর্তে আমার ওর জন্য। ও আমার সবচেয়ে প্রিয় ভাই, চন্দন বোস। 


Thursday, November 2, 2017

নাম তো সুনা হোগা

পুজোর ছুটির পর স্কুল খুলেছে আজ প্রায় এক মাস পরে। এইট বির ক্লাসরুমে আজ এক নতুন মুখ। লাস্ট বেঞ্চের একটা কোণে চুপ করে বসে আছে ছেলেটা। মিষ্টি দেখতে, চোখে চশমা না থাকলে অনেকটা রাহুলের মতো দেখতে। আরে রাহুল, কুচ কুচ হোতা হ্যায়? সেই রাহুল।  ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাস টিচার মহুয়া মিস রোল কলের সময় ছেলেটির সাথে সারা ক্লাসের পরিচয় করিয়েছিলেন বটে, কিন্তু রূপসা তখন চকপিস আনতে অফিসে গিয়েছিল, তাই নামটা জানা হয়নি। রূপসার তো কী বিশাল ক্রাশ এস আর কের উপর। প্রথম তিন পিরিয়ড ধরে ক্লাস চলাকালীন তাই বারবার চোখ গেছে ছেলেটির দিকে। বেশ একটা অগোছালো ভাব চেহারার মধ্যে, শার্টের কলারটা একদিকে উঠে আছে, টাইটাও ল্যুজ। নেহাত হেডস্যার এখনো এইদিকে আসেননি, নইলে ঠিক প্রথমদিনেই ছেলেটা পানিশমেন্ট পেত। রূপসা ঠিক করল, টিফিন ব্রেকের সময় একবার গিয়ে আলাপ করবে আর তখন ওকে স্কুলের আদবকায়দা নিয়ে বলবে। এই সবে সরখেল স্যার ম্যাথস ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। টাইম এন্ড ডিস্টেন্সের কিছু বাঁশ বাঁশ অঙ্ক করতে করতে আজ সারা ক্লাস বিদ্ধ্বস্ত, সবাই প্রায় যে যার মত চুপচাপ টিফিন বক্স বের করছে। নতুন ছেলেটি ছাড়া আর কেউই তেমন সপ্রতিভ নেই আর। ছেলেটিই বরং প্রত্যেকটা অঙ্ক স্যারের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে করে যাচ্ছিল। রূপসা ভাবল, এই সুযোগ। অঙ্ক বোঝাও হবে, সাথে সাথে আলাপটাও ঝালিয়ে আসবে। নইলে ওর মতো গুডি গুডি মেয়ে হঠাৎ যেচে যেচে নতুন ছেলের সাথে আলাপ করতে যাচ্ছে, ইমেজের সাথে যায়না। বন্ধুরাও আওয়াজ দেবে।
"হাই, আমি রূপসা। লাস্ট যে অঙ্কটা স্যার আদ্ধেক হিন্টস দিয়ে চলে গেলেন না, ডু ইয়ু মাইন্ড এক্সপ্লেইনিং ইট টু মি?"
" শিয়োর! এই দেখো, এইখানে রিলেটিভ ভেলোসিটি ধর এক্স, প্ল্যাটফর্মের লেন্থ তো বলেই দিয়েছে ... "

মিনিট দশেক ধরে অঙ্কটা ভালো করে বুঝেটুঝে বহুবার থ্যাঙ্ক ইউ বলে রূপসা এবার নিজের ডেস্কের দিকে যেতে গেলো। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে এত কাণ্ডের মধ্যে, ওর নামটাই তো জানা হয়নি।
" হ্যাঁরে। তোর নাম কী রে? সেটাই তো জানলাম না। "
উত্তর এলো, " রাহুল, নাম তো সুনা হোগা! "
ঠোঁটের কোণের এক কুচি হাসিটা...