Thursday, April 26, 2018

আমি ও সেই মেয়েটি

আমার হোস্টেলে একটি মেয়ে আছে। আমার উইঙেই থাকে। কিন্তু পিজি হোস্টেল, সবার সাথে সবার তেমন আলাপ নেই। তাছাড়া মেয়েটি সদ্য এসছে এই উইঙে। ওর নাম জানিনা। কোথাকার মেয়ে, কোন ডিপার্টমেন্ট, কী কোর্স, কিচ্ছুটি জানিনা। শুধু জানি, মেয়েটি অপয়া। না মানে, মেয়েটাকে অপয়া বলছিনা, কিন্তু ওর মুখটা দেখলেই কেন জানিনা মনে হয়, দিন খারাপ যাবে। সকাল সকাল স্নান সেরে জামাকাপড় শুকোতে দিতে যাই ওর ঘরের সামনে দিয়ে। জোর করে তখন নিজের চোখদুটোকে ওর ঘরের দিকে না ফেরানর চেষ্টা করতে থাকি। আমার কপাল ভালো হলে ওর জানলা বন্ধ থাকে। আর ভুল করেও যদি ওর মুখোমুখি হয়ে যাই, তো সারাদিন তটস্থ থাকি। এই বুঝি কারুর সাথে অকারণে ঝগড়া হবে বা কারুর কাছে বকা খাবো। নিদেনপক্ষে সাইকেলের চাকায় অন্তত পাঙ্কচার হবে। কাপড় মেলতে গিয়ে ওর মেলা ম্যাক্সি ঝুলছে দেখলেও গা ঘিনঘিন করে ওঠে। এতটাই অসহ্য লাগে ওকে। কোন মানুষকে যে বিনা কারণে এত অপছন্দ করতে পারি, সেটা এই মেয়েটিকে না দেখলে জানতে পারতাম না। এমনিতে আমি বাইরের রূপ নিয়ে তেমনভাবে গা করিনা। কিন্তু এই মেয়েটি কালো, মাথার চুল অনেক কম, টেনে চুল বেঁধে রাখে যখন, মাথার তেলো দেখা যায়। অনেক সময় দেখেছি সাজগোজ করেছে। কিন্তু তাও কেমন হাসি পায় ওকে দেখলে তখন, যেন কাক হয়ে ময়ূর সাজতে গিয়েছে। মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে, ঘর পাল্টে নেবো হোস্টেলের। যতই ঝঞ্ঝাট হোক না কেন।
কাল সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম বাইরে। ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে আমাদের বাস সার্ভিস বন্ধ। আমি একা হেঁটে ফিরছিলাম। একদম নির্জন রাস্তা। লোকজন নেই। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি আলোর বেগে পাশ দিয়ে হুশ করে চলে যাচ্ছিল। চারিদিকে এত রকম ঘটনা পড়ি, একটু একটু ভয় করছিলো বটে। তার ওপর বেরোনোর আগে মেয়েটিকে দেখেছিলাম। না জানি, কী অঘটন না ঘটে আজ, এইসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত পা চালিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে একটা বাইকে দুটো চ্যাংড়া ছেলে এসে আমার ওড়না ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিলো। দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বলছিল, মুখ দিয়ে ভক করে সস্তা মদের গন্ধ। ভাষা না বুঝলেও, আমার যে চরম বিপদ, তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে কুলকুল করে ঘামছিলামও। কী করবো, কোথায় যাব, কার সাহায্য পাবো, ভাবছি আর সাথে ঈশ্বরকে স্মরণ করছি। এমন সময়ে হঠাৎ দেখি উল্টোদিক থেকে স্কুটি চালিয়ে আসছে কেউ। হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে আমার চোখ, আরোহীকে দেখতে পারছিনা। শুধু শুনতে পাচ্ছি, তামিল ভাষায় কোন মেয়ের গলা। সে চিৎকার করছে, স্কুটি থেকে নেমে ক্যারাটের পাঞ্চ মারছে। আমি ততক্ষণে প্রায় বেহুঁশ। আবছা দেখতে পেলাম ছেলেদুটো বাইকে উঠে দে চম্পট। এক জোড়া পরম মায়াময় দুই চোখ আমার দিকে তাকিয়ে, সযত্নে আমায় উঠিয়ে পাশের এক বেঞ্চে বসাচ্ছে। অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বুঝলাম, এ যে সেই মুখ, সেই অপয়া মুখটি।

 

বই দিবস উপলক্ষ্যে

আজ বিশ্ব বই দিবস। সেই উপলক্ষ্যে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলো।
প্রিয় বইয়ের কথা বলতে গেলে কেমন একটা ঘেঁটে যায় সবকিছু। শুরু করেছিলাম বই পড়া ইংরেজি দিয়ে। এনিড ব্লাইটন তখন তাঁর লেখনশৈলী দিয়ে মুগ্ধ করছেন আমায়। ফেমাস ফাইভ, নডি, ফাইভ ফাইন্ড আউটার্স, হার্ডি বয়েজ, ন্যান্সি ড্রিউ এরা তখন আমার স্বপ্নের চরিত্র।
আরেকটু বড় হতে মনে আছে মা ঠাকুমা বাবার সাথে পাড়ার জাগরণী পাঠাগার যেতাম। পছন্দের বই নিয়ে পড়তাম। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ার জন্য তখনও ইংরেজি বইয়ের ওপর বেশি আকর্ষণ ছিল। তবে মায়ের শাসনের ফলে তখন ধীরে ধীরে বাংলা বইয়ে ঝোঁক এলো। মতি নন্দী রূপক সাহা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমরেশ মজুমদার এদের হাত ধরে শিশু সাহিত্যে প্রবেশ। পূজা বার্ষিকী আনন্দমেলা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। ছুটিতে দিদিমার বাড়ি গেলে গোগ্রাসে গিলতাম শরৎ রচনাবলী। সাথে আবার সমান তালে পড়তাম ঠাকুমার ঝুলি। আরেকটু বড় হলাম। যা পড়া বারণ, তার ওপর আকর্ষণ বাড়তে থাকল। মা বাবা অফিস চলে গেলে লাইব্রেরির থেকে তাদের আনা তথাকথিত বড়দের বই, পূজাবার্ষিকী আনন্দবাজার পত্রিকা দেশ বর্তমান আনন্দলোক পড়তাম লুকিয়ে, খাটের তলায় ঢুকে গিয়ে, ঠাকুমার নজর এড়িয়ে। ওই প্রথম আমার "পেকে যাওয়া"!!
মাঝে একটা সময় বই পড়ায় ভাটা এসেছিল। লেখাপড়ার চাপে। তবুও খুচখাচ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায় চলতোই। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ভালো রেজাল্ট করলে উপহারে নিতাম বই। এখনো বই উপহার পেতে ও দিতে খুব ভালোবাসি।
এখন বই পড়ি যতটা সম্ভব। ইংরেজি বেশি। কারণ চেন্নাইয়ে বসে বাংলা বই পাওয়া দুষ্কর। হোস্টেলে রাখার জায়গা অভাব, তাই বেশির ভাগ বই কিন্ডলে পড়ি। কী করি? একটি অনলাইন লাইব্রেরির মেম্বারশিপ নিয়েছি আবার। এছাড়া ফেসবুকে বিভিন্ন স্বাদের নানা লেখা পড়ি। পড়ার হ্যাবিটটা ধরে রাখতে হবে। ইদানিং পড়া একটু কম হচ্ছে, লেখাও তাই কম আসছে। কটাদিন একটু ব্রেক নিচ্ছি তাই।
আপনাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা। প্রচুর প্রচুর বই পড়ুন। পড়ান। লিখুন।
সাথে থাকুন সাম্পানের।


Wednesday, April 11, 2018

নব আনন্দে জাগো

১।



শীত গ্রীষ্ম বর্ষা। সোম থেকে শুক্র সুনন্দার এক রুটিন। ভোরবেলা অ্যালার্ম বাজার আগেই উঠে পড়া, কোনোমতে হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে দৌড়। আর তারপর ছেলের আর স্বামীর টিফিন, ওদের সকলের ব্রেকফাস্ট বানানো, ওরা বেরিয়ে গেলে রান্নাবান্না সারা। এই করতে করতেই কখন যে দুপুর হয়ে যায়, তখন একটু টুকটাক বই পড়ে বা এঁকে, খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে বা টিভি চালিয়ে অল্পক্ষণের জন্য দুই চোখের পাতা এক হয়ে যাওয়া। আবার বিকেল হতে আবার সবাই বাড়ি ফিরলে তাদের খিদমত খাটা।
আজ প্রথম ব্যাঘাত ঘটবে আঠারো বছরের এই সাজানো রুটিনে। এত বছরের টুকিটাকি আঁকিবুকির একজিবিশন ওর। শিল্পী সুনন্দার আত্মপ্রকাশ ঘটবে নতুন করে।




২।



ছোট থেকেই আর পাঁচটা মেয়ের মতোই গোলাপী রঙ ভীষণ প্রিয় ওর। মা অফিস চলে গেলে গরমের ছুটিগুলো কাটত ড্রেসিং টেবিলের সামনে মায়ের লিপস্টিক, টিপ, কাজল নিয়ে খেলা। মায়ের শাড়ি পরে মায়ের মতো সাজতে যে কী ভালো লাগতো পিয়ালের। আরো ভালো লাগত খেলনাবাটি নিয়ে রান্না রান্না খেলা। 
কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে  সেদিনের পিয়াল আজ শুরু করতে চলেছে একটা নতুন জীবন, নাম নিয়ে, "পিয়ালী"। 




৩।

"ম্যাম, আমিও নাটকে অংশগ্রহণ করতে চাই।" অডিশনে সাড়া ফেলে দেওয়া  সাত বছরের কৃষ্ণার আবদারে না করতে পারলেন না নামজাদা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের  ড্রামার শিক্ষিকা মলয়জা সেন। এই প্রথম, এত বছর পর, "স্নো ওয়াইট অ্যান্ড সেভেন ডোয়ারফ" নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করল কৃষ্ণবর্ণা কেরলকন্যা। 



৪।


পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান পাড়ার ক্লাবে। আবৃত্তির প্রতিযোগিতা চলছে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো কেউ "বীরপুরুষ", কেউ "প্রশ্ন", কেউ বা "পূজারিণী" বলে একের পর এক হাততালি কুড়িয়ে নিচ্ছে। এমন সময় স্টেজে উঠলো আট বছরের রুদ্র। সচরাচর মুখচোরা ছেলেটি চিরকাল তোতলা বলে এর তার থেকে টিটকিরি খেয়ে অভ্যস্ত। এই প্রথম হাততালি কুড়িয়ে প্রতিযোগিতায় প্রথম পাঁচে এলো - নতুন বছরে মায়ের সদা জুগিয়ে যাওয়া সাহস যে ওকে দিয়েছিল এক নতুন আত্মবুশ্বাস।  




৫। 


নীতিবাগীশ মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে রঞ্জা। ছোট থেকেই বাবার আদর্শে মানুষ হয়েছে সে। আর তাই কিছুতেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় গার্ড দেওয়ার সময়ে পরীক্ষার্থীদের "সুবিধে" করতে রাজি হয়নি। ফলে পরীক্ষার শেষ দিনে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ করেই সেই সব "ছাত্রছাত্রী" ও তাদের বাড়ির লোকেদের হাতে নিগৃহীত হয় সে। 
আজ মাসখানেক পর আবার রঞ্জা স্কুল যাচ্ছে। আজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। আবার ফিরবে ও পরিদর্শকের ভূমিকায়। 






৬।

অভীকের সাথে ব্রেকাপের পর কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ। এ কদিন তিথি ঘরের বাইরেই যায়নি। রুমমেটরা হাজার চেষ্টা করেও ওকে কলেজে পাঠাতে পারেনি। কিন্তু নাহ, অনেক হল কান্নাকাটি, দোষারোপ। এ ওকে ঠকালো না ও একে, এসবের চুলচেরা হিসেব নিকেশ তো হল। দিনের পর দিন এইভাবে মন খারাপ করে থাকলে আর তিথির চল্বেনা। 
মায়ের পাঠানো শাড়িটা পরে খোঁপাটা ঠিক করছে তিথি। এখনো কত সাজগোজ বাকি। এক সপ্তাহ পর আজ ও বেরোবে। পয়লা বৈশাখের শুভদিনে। শুরু করবে জীবনটা নতুন করে। 



 

Saturday, April 7, 2018

আর পাঁচটা গল্পের মতো

মঞ্জরী কমপ্লক্সে প্রতি বছরের মতই এখন হইহই করে চলছে রিহার্সাল। আসন্ন পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে যে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, তার জন্য গত দেড় মাস ধরে চলছে বিরাট কর্মযজ্ঞ। এ ব্লকের মৌসুমি দির তত্ত্বাবধানে চলছে গানের দলের প্র্যাকটিস, সি ব্লকের সুমনা কাকীমার দায়িত্বে নাটক। রুমকি ঝুমকি কচিকাঁচাদের নাচ তোলাতে ব্যস্ত। শনি রবিবার সকাল বিকেল তো রিহার্সাল চলছেই, এ ছাড়াও এখন অনুষ্ঠান আসন্ন বলে উইকডেজেও সন্ধ্যায় দু ঘণ্টা প্র্যাকটিস চলছে।

বিকেল হতেই আজ এ বাড়ি, কাল ও বাড়ি থেকে "আমরা সবাই রাজা", "বজ্র মাণিক দিয়ে গাঁথা", "রিমঝিম ঘন ঘন রে"র সাথে সাথে ঘুঙুরের মিষ্টি শব্দ।

মৌসুমিদিদের টানা লম্বা বারান্দায় মেয়ের দল সারি দিয়ে বসে গীতবিতান খুলে গান গায়। অরিন্দমদার হাতের গুণে তবলায় দাদরা কাহারবার বোলেরা খেলা করে। পিয়ালের হারমোনিয়ামের সাথে শ্রুতিবক্স থেকে তানপুরার সাবেকি ধ্বনি, আলাদা মাধুর্য আনে পরিবেশে।

নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে সাহায্য করছে উপমন্যু। ও ডাক্তারি পড়ে মেডিকেল কলেজে। অসম্ভব সুন্দর সরোদ বাজায়। নাটকের একেকটা দৃশ্যে এমন সুন্দর সুরমূর্ছনা এত অনায়াসে তুলছে ও, উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ। সুমনা কাকিমার মেয়ে মধুশ্রীর নাটকে ছোট্ট রোল, এক মালিনীর। হাতে গোণা তিনটে দৃশ্য। সামনেই কলেজের পরীক্ষা ওর, তাই অমন দাপুটে অভিনেত্রীর এবারে এত কম অভিনয়। কথামতো নিজের দৃশ্যে অভিনয়ের পর খাতা কলম নিয়ে কঠিন কঠিন ইকুয়েশন সল্ভ করার কথা ওর। স্টোক্স লয়ের সাথে সাথে কখন যে দুই তরুণ হৃদয়ের লাবডুবের সূক্ষ্ম অনুরণন হয়েছিল, কেউ টের পায়নি।

অনুষ্ঠানের দিন সমগ্র নাচ গান নাটক ভীষণ ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। সাদা শাড়ি, অঙ্গে জুঁই ফুলের গয়না, ডানাকাটা পরী ছাড়া কিছু কম লাগছিল না মধুশ্রীকে। বাসন্তী রঙা পাঞ্জাবীতে সৌম্য শান্ত রূপে উপমন্যুর সৌন্দর্যয়ও ঠিকরে বেরোচ্ছিল। সেদিন রাত্রে দুজনে নদীর ধারে অনেকক্ষণ বসে সুখ দুঃখের কথা বলেছিল। তারপর একে ওপরের মধ্যে বিনিময় হল কত প্রতিশ্রুতি।

আর তারপর প্রায় বেশীরভাগ গল্পের মতই ওদের গল্পেও এলো একই পরিণতি। দূরত্ব বাড়ে, যোগাযোগ নিভে যায়।
আজ জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে হঠাৎই দুজনের দেখা হয় নার্সিং হোমে, রুগীর স্ত্রী ও ডাক্তারের ভূমিকায়।
"কেমন আছ? চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
" ঈশ্বর আর তুমি ভরসা"

আর এইভাবেই পরিণতি পায় আরেকটি অসম্পূর্ণ কাহিনী।

Thursday, April 5, 2018

মনোরথ

১।

"যে জন আছেন মাঝখানে"

গ্রীষ্মের শান্ত দুপুর। বাইরে শুনশান, শুধু একটা বিশ্রী কাক সমানে ডেকে চলেছে, একটানা, একঘেয়ে। স্বাতী বসে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে, এক দৃষ্টিতে ঠায় তাকিয়ে আয়নায় লেগে থাকা একটা লাল টিপের দিকে। ধুলো পড়া, রঙ ফিকে হওয়া, কিন্তু আঠা এখনো গাঢ়।
প্রতি রাতে বিছানায় শুয়ে যখন পাঁচ মাস পুরনো স্বামীর সোহাগের অপেক্ষায় থাকে ও, দেওয়ালে টাঙ্গানো স্বামীর স্বর্গীয়া স্ত্রীর ছবিতে ওই একই টিপ বড্ড জ্বলজ্বল করে।




২।

"ওরা এ মন কেমন বোঝেনা"

এমেরিকায় সুচাকুরে, কুলীন ব্রাহ্মণ, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, বয়স তিরিশ।  রূপুর জন্য একদম পালটিঘর। তাই বাড়ির বড়দের কাছে ওর না টিকলো না। এক ফাল্গুনী সন্ধ্যায় চার হাত এক হয়ে ওরা চলে গেল সুদূর বিদেশে। সংসার করে সুখে শান্তিতে থাকতে।
বিয়েতে পাওয়া কিছু উপহার আর নিত্যনৈমিত্তিক দরকারি জিনিসে ঠাসা সুইটকেসটা আজ বড্ড ভারি। এক কোণে সযত্নে ওতে চলেছে কিছু সুগন্ধী কাগজ, যার প্রতিটি আঁচড়ে মাখা দুটি প্রেমময় হৃদয়ের কিছু অপূর্ণ স্বপ্নরাজি।




৩।

"বেলাশেষে" 

পৌষ সংক্রান্তির আগে গোটা বাড়ি তকতকে পরিষ্কার করাটা মীরার বহু বছরের অভ্যেস। এবারে নাতি নাতনি নিয়ে ছেলেমেয়েরা আসছে বিলেত থেকে, তাই আগেভাগেই এইসব করে রাখছেন। বহু কাজ বাকি। আলমারিটা গোছাতে গিয়ে একটা কোণা থেকে বেরিয়ে এলো একটি আধ খোলা ছাইরঙা উলের গোলা আর তাতে গাঁথা দুটি আট নম্বরের কাঁটা। প্রতি শীতে স্বামীর জন্য বুনতেন, সেই বছরও শুরু করেছিলেন। আদ্ধেকটা বোনার পর আর দরকার লাগেনি।
উলের গোলাটা গোছাতে গোছাতে মীরা ভাবলেন, বাড়ি খালি হলে আবার বসবেন বোনা নিয়ে, চৌকিদার ছেলেটি এই শীতেও একখানা পাতলা সোয়েটার পরে ঘোরে।




 

Wednesday, April 4, 2018

রোজনামচা

ডঃ রয়, একবার এদিকে আসবেন? একটা ক্রিটিকাল পেশেন্ট আছে। একটু এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দরকার ছিল।

সুলগ্নাদি, কাল তোমার সময় হবে একবার? একটা ছোট্ট ইন্টারভ্যু লাগত।

মিসেস রয়, পৃথ্বী রেজাল্ট ভালোই করেছে। শুধু একটু দেখবেন যেন ক্লাসে কথা কম বলে। বড্ড টকেটিভ।

সুলু, উইকেন্ডে ফ্রি আছিস? চল সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাই। মীনাক্ষী কলকাতায় এসছে, এই ফাঁকে ব্যাচ মিনি রি-ইউনিয়ন হয়ে যাবে।

বৌদি, আমি কিন্তু কাল পরশু আসব না।

বৌমা, তোমার বাপিকে একবার দেখো তো, বলছে হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে। কোন ওষুধ দেবে কি?

মাম্মাম, এই দেখো, আমি আজ হ্যান্ড্রাইটিং ক্লাসে তিনটে স্মাইল পেয়েছি।

শোনো, ভিয়েনাতে কনফারেন্সটাতে ডেকেছে। সপরিবারে। হ্যাঁ বলে দিচ্ছি কিন্তু।

বাবু, কবে আসবি? ভাইয়ার মেয়ের গিফটটা কিনতে নিয়ে যাবি না?



আর তারপর, সারাদিনের হাজার ব্যস্ততা মিটলে, একটু প্রাণের আরাম।

সুলগ্নাদি, এই ছবিটা দুর্দান্ত তুলেছো। একটু টিপস দেবে?
সুলগ্না, তোমার ছবিটা অসাধারণ। আমাদের ম্যাগাজিনের কাভার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি?
সুলগ্না আগামী মাসে একটা ফটোওয়াক অরগানাইজ করবো। তুমি ট্রেনিং দিতে পারবে?  

Tuesday, April 3, 2018

অণুগল্প। বিষয়ঃ বৃষ্টি

১ নাইট আনলিমিটেড

ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক রাত এগারোটা, শহরের বুকে আকাশ ভেঙ্গে নামলো হঠাৎ বৃষ্টি। গোটা বাড়ি নিশ্চুপ, নিঃঝুম, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধুমাত্র দোতলার বারান্দার এক কোণে তখন সবে শুরু -  সারারাত  টুপটাপ টিপটিপ আর তোর আমার জমে থাকা এক পাহাড় গল্প।



২। কালবৈশাখী

এই নিয়ে ছয় মাস হয়ে গেল শুভদীপের চাকরিটা নেই। ই এম আই আর ক্রেডিট কার্ডের বিলের চোখ রাঙানিতে বাড়ির পরিবেশ থমথমে, তটস্থ। এরই মধ্যে এক বৈশাখী বিকেলের ডাকে সুনয়নার সরকারী চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা আসায় এক লহমায় যেন গুমোট কেটে নামল স্বস্তির বৃষ্টি।


৩। বৃষ্টি, এ কী অনাসৃষ্টি

"আর কত সহ্য করতে হবে বল তো তোর জন্য আমাকে বাবু? একটু শান্তি দিবি না?" পি টি এম শেষে স্কুল থেকে ফেরার পথে মায়ের বকুনি খেয়ে বর্ষার কালো মেঘের মতোই মুখ ভার হয়েছিল বছর বারোর সমবুদ্ধর।
"বাড়ি চল, হচ্ছে তোর আজ। তাড়াতাড়ি পা চালা। বৃষ্টি আসছে।"
এ যে কী ভয়াবহ বৃষ্টি এসে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চলেছে ওর জীবন, বনানীর বুঝতে লেগেছিল শুধু একটা দৃশ্য - ছোট এক জোড়া পা, ঝুলন্ত।


৪। প্রাক্তন

সুপ্রতীকের ফোনে জানতে পারলাম বিকাশের অ্যাকসিডেন্টের কথা, অবস্থা ক্রিটিকাল। কোনোমতে উবার ডেকে ছুটলাম নার্সিং হোম। ও তখন ওটিতে। চলছে জীবন মরণ লড়াই। আর ওটির বাইরে ওর পুরো পরিবার। ওর স্ত্রী রঞ্জনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে, ওকে সামলানোর চেষ্টা করছে বিকাশের দাদা বৌদি। আমার বুকের ভিতর তখন প্রবল ঝড় উঠেছে, কী হয়, কী হয়, উথালপাতাল। ধীর পায়ে বেরিয়ে ওখান থেকে গেলাম বাইরে সংকটমোচনের মন্দিরে। ওইটুকু পথ যেতে ভিজলাম বটে, কিন্তু ওটা বুঝি দরকার ছিল। নইলে আমার মত "প্রাক্তন"কে কাঁদতে দেখলে, লোকে কী বলবে?


৫। কাগজের ছোটবেলা

"এই যে, তুই এই লাল কাগজটা নে। ভাইকে নীলটা দে। এবার আমি ঠিক যেমন যেমন করে ভাঁজ করছি, তেমন করে দেখে দেখে কর।"
"এই তো, খুব সুন্দর হয়েছে। এইবার এতে ফুল দিয়ে সাজাতে হবে। যা তিতলি, টবে নয়নতারা ফুটেছে। নিয়ে আয়।"
"চল, এবার আমরা এগুলোকে ভাসিয়ে দেবো নীচে গিয়ে। আয়।"
ছেলেমেয়েদুটোকে কাগজের নৌকো বানাতে শেখাতে গিয়ে কখন যে সুরমা পৌঁছে গিয়েছিল ছোটবেলার মামারবাড়ির গ্রামে, খেয়াল নেই।  ওদের "চল মাম্মাম, শিগগির চলো" ডাকে সম্বিৎ ফেরে ওর।

দিন বদলায়। কুশীলবরা পালটে যায়। কিন্তু বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই বিস্ময়ভরে ভাসিয়ে দিয়ে যায় স্বপ্নভরা তরী, উজান গাঙ্গে।