Friday, January 31, 2020

Sunderban 3


দুপুরের খাবারটা বেশ ভালোই ছিল। যদিও অন্যান্য ট্যুর পার্টিদের মেনুতে যেমন ভ্যারাইটি আইটেম লেখা থাকে , মানে ওই চাউমিন চিলি চিকেন, (ও এখন তো আবার সৃজিত মুখুজ্জের সিনেমার জেরে, চিকেন চাউমিন চিলি ফিস বেশি পপুলার) বা বিরিয়ানি মাংস ছিল না। তবে টায়ার্ড হয়ে এসে একটু গরম গরম ভাত ডাল কফির তরকারি পাঁপড় ভাজা কাতলা মাছ চিকেন কারি আর পেঁপের চাটনি খেয়েও মনপ্রাণ তৃপ্ত হলো বইকি। রিন্টু এর মধ্যেই এসে বলে দিয়েছে, চারটের দিকে সবাই মিলে বেরনো হবে, লঞ্চে চেপে। সবাই যেন রেডি থাকি। আমরা খেয়ে উঠতে উঠতে প্রায় তিনটে বেজেই গিয়েছিল। ভাবলাম আধ ঘণ্টা একটু পিঠটান করি। আমি ফোন বাবাজীকে চার্জে বসিয়ে একটু রেস্ট নেবো, এমনটা ভেবে ব্যাগ হাতড়াচ্ছি। চারজার কই? ও মা, খেয়াল হলো, বাবা মা এবং আমি, তিনজনেই ভেবেছি যে অন্যজন নিয়েছে সেটি। আর ব্যস, কেউ নিইনি। যদিও সাথে পাওয়ার ব্যাঙ্ক ছিল, তবুও। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেলো। যাহ্‌, ফোনের চার্জ কখনো ৮০% এর নীচে নামলেই কেমন একটা ধুকপুকানি হয়। তবে যাই হোক, এ যাত্রায় রক্ষা করলো কাকা। দখল নিলাম চারজারের। বাবা ঘুম দিলো। কাকা একটু ফোনে এর তার খোঁজখবর করতে লাগলো। আমি শুলাম বটে, কিন্তু ওই শুয়ে শুয়ে ফেসবুক খুলবার বৃথা চেষ্টা। নেটওয়ার্ক এতই খারাপ, কিছুই হলো না। বাইরে আওয়াজ পাচ্ছি, মা কোন একটা বাচ্চার সাথে গল্প জুড়েছে। বেরিয়ে এসে দেখি, রিকো। আমাদেরই সহযাত্রী। ভারী মিষ্টি এই বাচ্চাটি। বছর তিনেক বয়স, গোলগাল, হাসিখুশি, মিশুকে। রিসোর্টের সামনে ঢালাই করা রাস্তায় কুকুরের পায়ের ছাপ রয়েছে কয়েকটা। ও সব্বাইকে ডেকে ডেকে দেখিয়ে বলছে, “এই দেখো, বাঘের পায়ের ছাপ।“ সরল শিশু মন। ওর সাথেই খানিক গল্প করতে করতে দেখি চারটে বেজে গেলো। একে একে সবাই যে যার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। বিকেলের সাইট সিয়িং করার জন্য। আজ যেখানে যাবো, সেখানে বাঘ টাঘ দেখার কোন গল্প নেই। শুধুই কিছু মাইগ্রেটরি পাখি দেখা। আর সূর্যাস্ত।
সুন্দরবনে পৌঁছনো ইস্তক দেখছি, কেমন জানি কুয়াশার পাতলা একটা আস্তরন জেন লেপ্টে আছে। আকাশের মুখ ভার না হলেও, বিশেষ প্রসন্ন নয়। যতক্ষণে আমরা স্বর্ণময়ীতে গিয়ে উঠলাম, সূর্য ঢেকে গিয়েছে মেঘের আড়ালে। এক্কেরে বিফোর টাইম সূর্যাস্ত। মন খারাপ হলো আমাদের। তবুও আশায় আশায় রওনা দিলাম, যদি…। বোট বা লঞ্চ, যাই বলি না কেন, সেখানে প্রতিবার চলার সময় আমাদের সারেঙ মশাই বলে দিয়েছিলেন, দুইদিকের ব্যালেন্স যেন সব সময় বজায় থাকে। নইলে যে কোন সময়ে লঞ্চ উল্টে ভালোরকম বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। তাই লঞ্চ ডেকের দুদিকেই সমানভাবে চেয়ার যেমন পাতা, তেমন করেই আমাদের বসার নির্দেশ ছিল। কোন জন্তু টন্তু দেখা গেলে উনি যে এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে সক্কলে দেখতে পাই, এমনটাই বলে আশ্বস্ত করলেন। আমাদের তখন মনে একটাই চিন্তা। আর যাই হোক না কেন, বাঘ যেন মিস না করি।
এইসব করতে করতে আমাদের লঞ্চ চলতে লাগল। সেই একই চওড়া নদী। নদীর নাম জানি কি, ঠিক খেয়াল পড়ছে না। আসলে ওঁরাও খুব একটা সেই বিষয়ে বলেননি। আমাদের ভরসা ছিল গুগল ম্যাপ। নদীর দেখি বিভিন্ন চ্যানেল। খাঁড়ির মতো এদিক ওদিক জলের ধারা ঢুকে যাচ্ছে। জোয়ারের সময় তাতে জল ভরে যায়। পাড়ের গাছপালাগুলো অনেকটাই ডুবেও থাকে। আমরা যখন গিয়েছি, তখন ভাটার সময়। তাই পাড়ে দেখলাম ভীষণ কাদা। দুপাশ থেকে গাছেরা নুয়ে পড়ছে জলে। প্রায় আধ ঘন্টা, কি আর একটু বেশি চলার পর দেখি একটা জায়গায় অনেকগুলো লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভাবলাম, কী ব্যাপার? কী দেখছে ওঁরা? বাঘ দেখা গেলো নাকি? মাথার মধ্যে তো শুধু ওই একটাই চিন্তা। বাঘ মামার দর্শন কি পাবো? নাহ। সে গুঁড়ে বালি ঢেলে জানলাম, এই জায়গার নাম “জটিরামপুর”। এখানেই আমরা পাখী দেখবো। ওই কাদা কাদা নদীর পাড়ে তাকিয়ে রইলাম সবাই হাঁ করে। কই? কোন পাখীর দেখা নেই। জানতে পারলাম, পাখিদের আসা এখন অনেক কমে গেছে। কে জানে? ওরাও হয়তো একই জায়গায় আর প্রত্যেক বছর না এসে বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় ট্যুর করছে। সত্যিই তো, কাঁহাতক আর একই জায়গায় প্রতি বছর ঘুরতে আসা হালো লাগে? তাই না? যাই হোক, ওই দু তিনটে সাদা বক (পরে অবশ্য দেখে জেনেছি, ওদেরও কিছু গাল ভরা নাম আছে বই কি) আর একটা দুটো মাছরাঙা। এই ছিলো দেখার ঝুলিতে। মিনিট পনেরো ওখানে অপেক্ষা করে এবার ফেরার পালা। সূর্যাস্ত দেখা হবে না। মেঘের আড়ালে সূর্যদেব। তাই একদম রিসোর্টে ফেরা। জন্তু জানোয়ার কিছু তেমন দেখি ছাই না দেখি, লঞ্চে চেপে এই জলভ্রমণ, তাও দু পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, এই অভিজ্ঞতাটা কিন্তু বেশ লাগছিল।
ফিরলাম ওই আধ ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নির পর। রিন্টু বলল, আজ কালচারাল প্রোগ্রাম আছে। স্থানীয় কোন দল এসে নাচ গান পরিবেশন করবে। সেই দেখতে দেখতেই চা-পকোড়া সহযোগে সন্ধ্যেটা ভালোই কাটল। ওঁদের স্থানীয় গানে প্রতি লাইনে যেন সুন্দরবনের জীবনযাত্রার কথা, সুখ দুঃখের গল্প, প্রাত্যহিক লড়াইয়ের গল্প ফুটে উঠছিল। আমরাও দর্শকাসন থেকে একবার গিয়ে নাচের তালে পা মেলালাম। ছবি টবিও উঠলো। এইসব শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা। সক্কলেই আমরা ভীষণ ক্লান্ত। নটার দিকে ডিনার পরিবেশন করলো। ভাত রুটি ডাল তরকারি পাঁঠার মাংস আর চাটনি। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম। পরেরদিন সকাল সকাল বেড টি দেবে। আর সাথে দেবে গরম জল। সেই যে, জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমার সংলাপের মতো, “রানিং হট ওয়াটার”। কাল সারাদিনের লম্বা জার্নি। ভালো করে একটা এইবারে ঘুম দরকার।  

Wednesday, January 29, 2020

Saraswati Pujo

প্রতিদিনের মতোই আজও সকাল আটটায় ঘুম ভাঙে ওর। রেডিওতে প্রিয় মর্নিং শোতে আরজের কথায় খেয়াল পড়ে, আজ যে বসন্ত পঞ্চমী। মনে পড়ে যায় স্কুল কলেজের কথা। হইহই করে প্রিয় হলুদ রঙা শাড়ি পরে "বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে"দেবীর আরাধনা। তারপর কোনোরকমে প্রসাদ খেয়ে টো টো করে বন্ধুরা মিলে বিভিন্ন স্কুলে, গানের স্কুলে যাওয়া।
ও একবার ভাবে, অফিসে কি তাহলে গত খাদি মেলা থেকে কেনা হলুদ প্রিন্টেড সিল্কটা পরবে? ধুর। নতুন অফিস। কলিগদের সাথে ভাব জমেনি এখনো। একা একা শাড়ি পরে গিয়ে লোক হাসাবে? দরকার নেই। হাল্কা মাথা নেড়ে নিয়মমাফিক কুর্তি আর জিন্সে সাজিয়ে নেয় নিজেকে। তবে হ্যাঁ, মায়ের কথা শুনে কুর্তিটা হলুদ হয় বটে।

বাস স্টপে চোখে পড়ে শ্যাম্পু করা এক ঢাল খোলা চুল বা খোঁপার দল। রঙ বেরঙের শাড়ি। পাশে হলুদ লাল কমলা পাঞ্জাবিরা। আর তাদের মান অভিমান হাসি খুনসুটি।
বাসটা থামে স্কুলের স্টপেজে। সিগনালে। চোখে পড়ে, সেই দলে দলে মায়ের শাড়িতে হঠাৎ বড় হওয়া ক্লাস নাইন আর ইলেভেনের দিদিদের ভিড়। আর একটু কোণে, পেট্রোল পাম্পের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়ানো পাশের বয়েজ স্কুলের মুগ্ধদৃষ্টিগুলি।
সবই স্মৃতি। সিগনাল লাল থেকে সবুজ হয়। শৈশবকে ফেলে রেখে ও এগিয়ে চলে বর্তমানে। মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় রয়ে যায় স্মৃতির মণিকোঠায়।

Sunderbans 2


প্রথম দিন

যাক গে, হইহই করতে করতে (পড়ুন, ক্যাবের পর ক্যাব ক্যান্সেল করছে, পাশ থেকে মা জননী চিৎকার করছেন, কেন আমরা রেডি হয়েও বসে বসে ভ্যারান্ডা ভেজেছি এতক্ষণ, কেন এতক্ষণেও ক্যাব বুক করা শুরু করিনি, ইত্যাদি) শেষমেশ ক্যাবটি এলেন। আমরাও গুটিগুটি পায়ে ডিকিতে অল্প যা লাগেজ ছিল, তুলে দিয়ে গাড়ির ভিতর বসে পড়লাম। (ইতিমধ্যে আমার খান দুইয়েক সেলফি তোলা হয়ে গিয়েছে, ফেসবুকের জন্য।) ট্যুর ম্যানেজার রিন্টুর ফোন ঢুকেছে এর মধ্যেই, কাকার মোবাইলে। আমরা কতক্ষণে পৌঁছচ্ছি, জানতে চেয়ে। বাস নাকি অলরেডি পৌঁছে গিয়েছে। বেশিরভাগ লোকজনও পৌঁছে গিয়েছেন। বাবাহ, বাঙালির এমন সময়জ্ঞান ভালো, জেনে অবাক। যেহেতু বাসের সিট নির্দিষ্ট ছিল না, আগে এসে আগে বসো গোছের ভাব, ধরেই নিলাম, পিছনের সিটই আমাদের কপালে নাচছে। এবং হলোও তাই। শেষের ঠিক আগের রোতে টু-সিটারে আমি আর মা, আর থ্রিসিটারে বাবা আর কাকা এবং আমাদের অল্প লাগেজ বসলো। বাসের ছাড়ার কথা ছিল (কাগজ অনুযায়ী) সাড়ে সাতটায়। ছাড়ল ঠিক ৮:২৯ এ। আহা। এক ঘন্টাও তো লেট করেনি। বাঙালি স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী, ঠিকই আছে।

বাস ছাড়তে ছাড়তেই দেখি “আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি এখনও হয়নি”। কে আসবে বলে, কে জানে?   সায়েন্স সিটি থেকেই বাঁ দিকে ঘুরে গেলো বাস। চলতে লাগলো কলকাতা লেদার কমপ্লেক্সের রাস্তাঘাট দিয়ে। টুকটাক ঝিল, একটু কম উন্নত বাড়িঘর এইসব নিয়েই যাত্রাপথ। রাস্তার ধারের দোকানগুলির সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কী নাম জায়গাগুলির। চেনা নাম বলতে, দেখলাম ওই একমাত্র ভাঙ্গর। আমার এক পিসি ওখানের কলেজে পড়ান। তাই নামটা জানি। ঝিল পুকুর ভাঙা রাস্তা সাইকেল অটো ভ্যান মানুষজন ছাগল গরু কুকুর বিড়াল সব দেখেত দেখতে বাস চলতে লাগলো। ইতিমধ্যেই বাস ছাড়তেই হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সুগার অ্যান্ড স্পাইসের বাক্সে ব্রেকফাস্ট। একটা ভেজ বার্গার, একটা পনীর প্যাটি, একটা কাপ কেক আর একটা শুকনো মিষ্টি। হাঙরের মতো খিদে পেয়ে গিয়েছিল বাস জার্নির সৌজন্যে। তাই কেক বাদে বাকিগুলি খেয়েই নিলাম। বাস রাস্তা মোটামুটি স্ম্যুদ, তাই ঝাঁকুনি খুব একটা খাইনি, পিছনের সিটে বসেও। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, বাসটা খুব একটা পছন্দ হয়নি। জানলার কাঁচ ভালো বন্ধ হচ্ছিলো না। এদিকে যা কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল... ভলভো লেখা থাকলেও এ অরডিনারিই বাস। মোটেই ভলভো নয়।  যাই হোক, মাঝে কোন এক জায়গায় পনেরো মিনিটের চা খাওয়ার ব্রেক দিয়ে টিয়ে বাস পৌঁছল গদখালি। তখন প্রায় বারোটা বাজে। মাঝে বাসন্তী নামের জায়গার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম যখন, বাসের লোকজন জোক ক্র্যাক করলো। ভীরু নামের কেউ বোধহয় ওঁদের দলে ছিলেন, তাই তাকে বাসন্তী নিয়ে খ্যাপানো হলো। যাক গে। গদখালি থেকে আমাদের লঞ্চের জার্নি শুরু হবে। ঘন্টা দেড়-দুইয়ের ব্যাপার। বাসের পারকিং থেকে লঞ্চঘাট ওই হাঁটাপথে মিনিত তিনেক মতো। গদখালি জায়গাটি অত্যন্ত ভিড়-হট্টগোলের। একগাদা টাটা ম্যাজিক, অটো দাঁড়িয়ে লোক তুলছে, নামাচ্ছে। ক্যানিং, সোনাখালি এইসব জায়গার প্যাসেঞ্জার। সেই ভিড়, কাদা পিচ্ছিল রাস্তা পেরিয়ে লঞ্চঘাটে এলাম। সামনে এই এত বড় আমাদের লঞ্চ দাঁড়িয়ে। নাম তার ‘স্বর্ণময়ী”। আমরা সব মিলিয়ে ছিলাম ৪৫ জন, আর সাথে রিন্টু। সব্বাই মিলে একে একে গিয়ে উঠলাম লঞ্চে। সিঁড়ির কাছটা বেশ ভালোমতন পিচ্ছিল ছিল, তাই একটু ভয় করছিল বটে, তবে আমাদের হাত ধরেই প্রায় লঞ্চে উঠিয়ে দিলেন লঞ্চকর্মীরা। কোন অসুবিধে হয়নি। লঞ্চের নীচের তলায় (একবারও ঢুকিনি, ঢোকা উচিত ছিল) ওঁরা আমাদের সবার লাগেজ নিয়ে রেখে দিলেন। আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম। ডেক বরাবর সারি দিয়ে দিয়ে চেয়ার পেতে রাখা। আমরা চারজনে, বাকিদের সাথেই ওই চেয়ারে যে যার মতো বসে পড়লাম। আমি নিয়েছিলাম ধারের চেয়ার। লঞ্চ ছেড়ে দিলো অল্পক্ষণেই। দেড় ঘন্টা মতো চলবে। এ এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা আমার জন্য। আগেও কেরলের ব্যাকওয়াটারে ঘুরেছি, বেরিয়েছি এমন লঞ্চে। বিভিন্ন জায়গায় রিভার বা সি-ক্র্যুজও করেছি। কিন্তু এরকম দুই ধারে জঙ্গল, এত চওড়া নদী, এর মধ্যে দিয়ে এই প্রথম। বেশ লাগছিল। হাল্কা দুলুনি পর্যন্ত ছিলো না। বেশ ধীরস্থির জার্নি।
এর মধ্যেই ট্যুরের লোক এসে চা আর বিস্কিট দিয়ে গেলেন। দু পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল দেখতে দেখতে আমরা চললাম। মেঘলা ভাব ছিলো, তাই কনকনে স্যাঁতস্যাঁতে দুইই বোধ করছিলাম। ভালো করে টুপি চাদর জড়িয়ে বসলাম। আমার কাকা বসে ভিডিও তোলা শুরু করে দিলো। আমিও ক্যামেরা বের করে টুকটাক ছবি তুলছি। বাবা ঝিমোচ্ছে। মা সহযাত্রীদের সাথে এর মধ্যেই বন্ধুত্ব পাতিয়ে গপ্প জুড়ে ফেলেছে। কেউ কেউ নদিয়া জেলা থেকে এসেছেন, দশজন একসাথে। ওঁদের লিডার জিনি, তিনি কিছুদিন আগে ঘুরে গিয়েছেন, তাই মোটামুটি সমস্তটাই জানেন। তিনিই আমাদের বলছিলেন, কতক্ষণ লাগবে। কাল কোথায় যাবো। আজ কোথায় যাব। আদৌ বাঘ দেখতে পাবো কি না। এইসব।  এই করতে করতে দয়াপুরে পউছলাম, প্রায় দুটো নাগাদ। দয়াপুর হলো ওই অঞ্চলের সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত লোকালয়। এখানেই অনেক রিসোর্ট রয়েছে। আমাদের সুন্দরবন ভিউ পয়েন্ট রিসোর্টটিও এখানেই। লঞ্চকে ঘাটে বেঁধে দিলো। আমরা একে একে নামলাম। মালপত্র সাথে নিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে কয়েক পা হেঁটেই আমাদের রিসোর্ট। ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। বেশ সবুজ। জলাশয়ও রয়েছে। দোতলা বাড়ি। চেক-ইন রেজিস্টারে সই করে ঘরে গেলাম। পাশাপাশি দুটো ঘর আমাদের, একতলায়। ১০৫ আর ১০৬। একটু ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে বেরোতে হবে।

Monday, January 27, 2020

Sunderbans 1


প্রাক-কথা

গত অগস্ট থেকে নভেম্বরের শেষ অবধি ভয়ানক রকমের ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছি পি এইচ ডি থিসিসের কাজকর্ম নিয়ে একেবারে যাকে বলে, ল্যাজে গোবরে অবস্থা। তা যাই হোক, ডিসেম্বরের শুরতে বাড়ি ফিরলাম। কলকাতা। ভিতরের যাযাবর পোকাটি ভালোমতন নাড়া দিয়ে উঠলো। এদিকে বাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ হচ্ছে। মেরামত, রঙ, এইসব। কাজেই, বাবা মা বলেই দিলেন, তাঁরা এই মুহূর্তে কোন বড় বা মাঝারি ট্রিপেও যেতে পারবেন না। এদিকে আমার মাথায় বেরানোর ভূত চেপেই গিয়েছে। যেতে তো হবেই। কাঁহাতক আর রোজ সন্ধ্যেয় বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে চা কফি স্ন্যাক্স খেয়ে কাটানো যায়? হ্যাঁ, বাড়ির বাইরে যাচ্ছি বটে, অথচ বেড়ানো তো হচ্ছে না। তিন বান্ধবী মিলে ঠিক করলাম, ঘরের কাছে ডায়মন্ড হারবার, সেখানেই একটা ডে ট্রিপ সেরে ফেলি। সেইমতো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেলো। কিন্তু নাহ, বুকিং মিলল না। বুকিং মিলল না টাকিতেও। অগত্যা, দিন পরিবর্তন। এদিকে সেটি কিনা মস্ত কঠিন প্রশ্ন। প্রায় দেশের নিয়ম নীতি বানানোর মতোই কঠিন ব্যাপার। তিনজনের সুবিধে মতো একটা তারিখ ঠিক করা। অনেক কষ্ট করেও সেই তারিখ আর জুটলো না। অগত্যা, সেই আবার কফি খেতে যাওয়া। বেড়ানোর আশা এদিকে ছাড়তেও পারছি না। কী করা যায়? কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায়, এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের একটা মেন্টালি বানানো লিস্টের শরণাপন্ন হলাম। লিস্টের প্রথমেই বেনারস। মাসিকে বললাম, চলো যাই। মাসি কোন সময় নষ্ট না করেই বারণ করে দিলো। দেশের যা অবস্থা, দুই মহিলা মিলে ইউ পি যাওয়া নাকি মোটেই সেফ না। নেক্সট ইন লিস্ট, দারজিলিং। এদিকে তখন এইসব সি এ এ, এন আর সি নিয়ে মারমার কাটকাট অবস্থা। ট্রেন প্লেন নাজেহাল অবস্থা। অগত্যা, সেই গুড়েও বালি। তাহলে? তাহলে আর কী? ঠিক এই সময়ে, এক্কেরে রক্ষাকর্তার ন্যায় এসে হাজির হলো ফেসবুক। এমনিই একদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে স্পন্সরড অ্যাডে এলো, সুন্দরবন ভ্রমণের কথা। একটু খোঁজখবর নিলাম। ইতিমধ্যে রোজ বেরিয়ে বেরিয়ে এমন অবস্থা, যে বাবা মায়ের কাছে তখন “ভ্যাকেশন”এর কথা বলার ঠিক সাহস নেই। ভরসা তাহলে মাত্র একজন। দায়িত্ব দিলাম কাকার কাছে। চুপিচুপি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে দিলাম সমস্ত লিঙ্ক। বললাম, সুন্দরবন যাবে? আমি জানতাম, কাকা হ্যাঁ বলবেই। কাকারও যে পায়ের তলায় সর্ষে। একা মানুষ। তার ওপর আবার সদ্য রিটায়ার করছে। কাজেই উত্তরটা যে হ্যাঁ হবেই, সেই বিষয়ে সন্দেহ ছিল না কোন। বললাম, একটাই শর্ত। প্ল্যানটা যে গোটাটাই আমার মাস্টারমাইন্ড, সেইটা বাবা মা কে জানানো যাবে না। কাকা বলা বাহুল্য, রাজি। বিকেলের মধ্যেই মায়ের মোবাইলে মেসেজ ঢুকল তার। ‘সুন্দরবন যাবে?’ মা আমায় ডেকে দেখালো, বললও, যাবি? আমি যেন কত সারপ্রাইজড, সেরকম ভান টান করে মোটামুটি ঝটপট হ্যাঁ বলে দিলাম। ব্যস, আর কী? বাবাকে রাজি করানো গেলো খুব সহজেই। ওই একটু আমি হম্বি তম্বি, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল টেল করলাম, ব্যস। তারপর এই অপারেটর ওই অপারেটর এইসব করতে করতে অবশেষে দ্য টেলিগ্রাফে এক রবিবারের বিজ্ঞাপন দেখে ইকো ট্যুরিজমকে ঠিক করা হলো। সায়েন্স সিটির সামনে থেকে ওদের বাস ছাড়বে। ওখানেই পিক-আপ, ওখানেই ড্রপ। কলকাতা টু কলকাতা পার হেড ৪৫০০ টাকা প্লাস জি এস টি। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার মতো পড়লো জনপ্রতি। ঝটপট সময় নষ্ট না করে অনলাইনে টাকা ট্রান্সফার করে আমাদের চারজনের জন্য ২৩, ২৪, ২৫ তারিখের ট্রিপ বুক করা হয়ে গেলো। এবার শুধুই অপেক্ষা। কবে ২৩শে জানুয়ারি আসবে, কবে বেরবো। জোর কদমে চলল পরিকল্পনা, আলোচনা। কী কী জামাকাপড় নেওয়া হবে, ঠান্ডা কেমন। জুতোই বা কী নেবো? (হ্যাঁ, জুতো নিয়ে তো আমার বিশেষ ইয়ে আছে, তাই আর কী) বাড়ি থেকে ওই সক্কাল সক্কাল সায়েন্স সিটি অবধি ক্যাব পাবো কি না। নানান প্রশ্ন। যাই হোক। সবকিছু উত্তর টুত্তর পেয়ে টেয়ে আমরা অবশেষে ২৩শের সকাল পেলাম। কাকা ইতিমধ্যেই আগের রাত্রে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে, যাতে একসাথেই চারজনে যেতে পারি।
মালপত্র রেডি। রেডি আমরাও। ওলা বুক হয়ে গিয়েছে। গাড়িও প্রায় এসেই গেলো। এইবার ঠাকুর ঠাকুর করে বেরিয়ে পড়লেই যাত্রা শুরু।

Saturday, January 18, 2020

মেট্রো সিটি

(এক তরফা ফোনের সংলাপ)

মিসেস সেনঃ নমস্কার, আমি আজকের আনন্দবাজার পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করছিলাম।

মিসেস সেনঃ হ্যাঁ, আমি মিসেস শ্রুতি সেন। মেয়ের মা। মানে...

মিসেস সেনঃ হ্যাঁ। বলছি। আমার মেয়ের নাম রোহিণী সেন। বর্তমানে আই আই টি মাদ্রাসে পি এইচ ডি করে। আপাতত কিছুদিন ছুটি কাটাতে এসেছে কলকাতা।

মিসেস সেনঃ বায়োটেক
ঃ (দীর্ঘ)
মিসেস সেনঃ আচ্ছা। ঠিক আছে। পাঠাবো। একটু জিজ্ঞাস্য ছিল।

মিসেস সেনঃ বলছি, আপনার ছেলের ডিটেলস...
ঃ (নাতিদীর্ঘ)
মিসেস সেনঃ আপনাদের বাড়িটা কোথায়?

মিসেস সেনঃ ও আচ্ছা। ব্যারাকপুর। বেশ। তা ছেলে কোথায় পড়ায়?

ঃ ও, আই আই টি? তা কোনটি?

মিসেস সেনঃ ও (একটু থমকে/ ভেবলে গিয়ে)। আচ্ছা। বেশ।

মিসেস সেনঃ হ্যাঁ বলুন।

মিসেস সেনঃ ম্যাট্রিমনি৪২০ অ্যাট ইয়াহু... হুম।

মিসেস সেনঃ ও, ম্যাট্রিমনিতে এন ওয়াই না?

মিসেস সেনঃ আচ্ছা। এম এ টি আর আই এম ও ডাবল এন আই ই। আচ্ছা, এইটা এরকম বানান কেন?

মিসেস সেনঃ ও আচ্ছা। আমি ভাবলাম হয়তো আইডি খুঁজে পান নি। ঠিক আছে। আমি মেয়েকে বলে সব পাঠাচ্ছি।

মিসেস সেনঃ হ্যাঁ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। বুঝি। তাড়াতাড়ি পাঠাচ্ছি।

ঃ হ্যাঁ, অনেক ধন্যবাদ। রাখছি তাহলে?

মিসেস সেনঃ নমস্কার।


(ফোন রাখার শব্দ)

(পাশ থেকে ভদ্রলোক, মানে মিস্টার সেন, খবরের কাগজটি ভাঁজ করে রেখে আগ্রহভরে তাকালেন স্ত্রীর দিকে)
মিসেস সেনঃ বাবুউউউ, এই বাবুউউউ
(দূর থেকে) রোহিণীঃ কীইইইইই?
মিসেস সেনঃ এদিকে শোন
রোহিণীঃ কী হয়েছে বলো না।
মিসেস সেনঃ আঃ, এখানে ডাকছি তো। শুনে যা।
রোহিণীঃ উফ। আসছি।

(রোহিণীর প্রবেশ)
রোহিণীঃ বলো?
মিসেস সেন: কী করছিলি রে?
রোহিণী: আরে সামনেই দিগন্তর আনুয়াল ফাংশান না? তা তাতে একটা শ্রুতিনাটক নামাতে হবে। সেইটার স্ক্রিপ্ট নিয়েই ভাবছিলাম। বিকেলে তো আবার বেরোনো আছে। তাই এখন সেরে ফেলবো ভাবছিলাম যতটা পারি।
মিসেস সেন: বিকেলে কোথায় যাবি আবার?
রোহিণী: সাউথ সিটি। পরে বলছি।
মিসেস সেন: ও। তা কী নিয়ে লিখবি?
রোহিণী: জানি না। মাথায় আসছে না কিছু। ওই জন্যই তো চুপচাপ বসে ভাবছিলাম। তার মধ্যে তুমি এমন হাঁকডাক শুরু করে দিলে। তা বলো, কী হয়েছে?
মিসেস সেনঃ বলছি শোন না, তোর অ্যাটলাসটা এখনও আছে?
রোহিণীঃ অ্যাটলাস? কী করবে?
মিসেস সেনঃ আঃ, যা জিজ্ঞেস করছি, সেইটা বলবি তো।
রোহিণীঃ খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। কেন বলোতো?
মিসেস সেনঃ দরকার আছে। একটু দেখ না রে।
রোহিণীঃ কী দরকার বলো? এখন যাবতীয় যা ইনফরমেশন চাই, সবই ইজিলি গুগলে পেয়ে যাবো। বরং ইট ইস মোর কনভিনিএন্ট।
মিসেস সেনঃ তা ঠিক। তা শোন না, বলছি যে, ইন্ডিয়াতে মেট্রো সিটিজ কোনগুলো?
রোহিণীঃ দাঁড়াও, নেট দেখে বলি। আপাতত যা মনে হচ্ছে, দিল্লী বম্বে কলকাতা ম্যাড্রাস ব্যাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ। পুণে কি? বা আর কোন? এক মিনিট। লেট মি চেক।
 (মোবাইলে খানিক খুটখাট)
রোহিণীঃ  হুম, যা বলেছি, ঠিক। সাথে অ্যাড পুণে অ্যান্ড আহমেদাবাদ।
মিসেস সেনঃ আচ্ছা, এঁর মধ্যে আই আই টি কোনগুলোতে আছে?
রোহিণী (একটু অবাক হয়েই)ঃ দিল্লী বম্বে মাড্রাস হায়দ্রাবাদ। গান্ধীনগরেও আছে। কিন্তু অটাকে কি আহমেদাবাদ হিসেবে ধরবে? না ধরাই উচিত।
মিসেস সেনঃ হুম। আচ্ছা, এদের সমস্ত ফ্যাকাল্টিদের লিস্ট কোথায় পাবো?
রোহিণীঃ নেটে। কিন্তু ওয়াট ইস দিস মা? কী হয়েছে?
মিসেস সেনঃ সম্বন্ধ।
রোহিণীঃ মা তুমি আবার শুরু করেছ?
মিসেস সেনঃ সে কী, আবার শুরু করেছ আবার কী কথা? তোর বিয়ে দিতে হবে না?
রোহিণীঃ উফ বাবা। তুমি প্লিজ বলো মা কে। কতবার বলেছি তো। এখন এই বিয়ে বিয়ে বিয়ে না করতে। আমি মরছি রিসার্চের জ্বালায়। এদিকে তুমি পিছনে পড়ে আছো। জানো পেপারটা কবে থেকে আন্ডার রিভিউ পড়ে আছে। ওটা যতক্ষণ না হচ্ছে, আমি থিসিস সাবমিট করতে পারবো না। ওই নিয়ে টেনশনে মরে যাচ্ছি। এদিকে তুমি ওই ফাটা রেকর্ডের মতো এক গান গেয়েই চলেছো। ডিসগাস্টিং।
মিস্টার সেনঃ আরে বাবু, শোন না। শুনেই তো দেখ।
রোহিণীঃ বাবা তুমিও এর মধ্যে?
মিস্টার সেনঃ আরে না রে বাবা। আমি এঁর মধ্যে নেই। কিন্তু এতক্ষণ তোর মায়ের এক তরফা যা কনভারসেশন শুনলাম রে। উফ, আই অ্যাম সো কিউরিয়াস, শুনেই নিই। তুইও চুপচাপ বসে শোনই না।
রোহিণী (খুব বিরক্ত হয়ে)ঃ ওকে। তুমি বলছো বলে। বাট লেট মি মেক ওয়ান থিং ভেরি ক্লিয়ার। আই ডোন্ট ওয়ান্ট আ রিপিট অফ দিস বিয়ে বিয়ে ননসেন্স এনিমোর নাউ। এটাই লাস্ট শুনছি। এর পরে ফারদার এই নিয়ে আলোচনা শুনলে আমি বাড়ি আসা বন্ধ করে দেবো।
মিসেস সেন (করুণ স্বরে): দেখলে তুমি? দেখলে মেয়ের কান্ডকারখানা?
মিস্টার সেন: আহা, অত অধৈর্য্য হও কেন। পরের কথা পরে দেখা যাবে। যাক গে, তুমি বলো দেখি।
মিসেস সেন: হুম। তা আজকের আনন্দবাজারে একটা ভালো সম্বন্ধ দেখলাম বুঝলে। পাত্র এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ঘোষ। বয়স চৌত্রিশ।
মিস্টার সেন: এই রে। তুমি এদের ফোন করলে শ্রুতি?
মিসেস সেন: এদের মানে? কী সমস্যা?
মিস্টার সেন: না মানে জ্বলজ্যান্ত এরকম রেড ফ্ল্যাগ দেখেও তুমি ফোন করতে পারলে?
(পাশ থেকে রোহিণীর খ্যাকখ্যাকে হাসির শব্দ।)
রোহিণী: বাবা, মা বোঝেনি।
মিস্টার সেন: থাক। আর বুঝতে হবে না।
মিসেস সেন: বলো না রে বাবা।
মিস্টার সেন: একটা চৌত্রিশ বছর বয়সী ছেলের সাথে তুমি বাবুর বিয়ের চেষ্টা করছো কী করে।
মিসেস সেন: তা তোমার মেয়েরও তো বয়স ঊনত্রিশ। সে কথা মাথায় আছে? খুকি খুকি সেজে ঘুরলেই হলো?
রোহিণী: আই অবজেক্ট। বয়স নিয়ে আমায় খোঁটা দেবে না। এখনও টিন্ডারে যত ম্যাচ আসে, সব কিন্তু বয়সে ছোট। সো...
মিসেস সেন: ওই নিয়েই থাক। শোনো, সম্বন্ধ করে বিয়ে করলে ওই পাঁচ ছয় বছরের এজ গ্যাপটা নরমাল।
রোহিণী: আরে ধুর। কিছুই বুঝছো না। লিভ ইট।
মিস্টার সেন: হ্যাঁ সেই। রেড ফ্ল্যাগ, চৌত্রিশ। কিছুই যখন বোঝোনি, ফাইন। ঐতিহাসিক ভুল আবার হবে। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। যাক গে। কন্টিনিউ।
মিসেস সেন: হ্যাঁ, তা যা বলছিলাম। তো সেই নম্বরে ফোন করলাম। পাত্রের মা রিসিভ করেছিলেন। বললেন ছেলে আই আই টি তে পড়ায়। কিন্তু কোন আই আই টি, সেটা জিজ্ঞেস করলাম। বলেননি। বললেন, কোন এক মেট্রো সিটিতে। ঠিক সময়ময়ত জানিয়ে দেবেন।
রোহিণী: এ আবার কি অদ্ভুত ব্যাপার। কোন আই আই টি বলতে এত লজ্জা কীসের? আদৌ আই আই টি তো মা? নাকি আই টি আই? নির্ঘাত তাই। বসে বসে সব আই আই টির ওয়েব সাইট চেক করবে নাকি?
মিসেস সেন: হয়তো।
রোহিণী: পাগল নাকি। আর তুমি নিশ্চয়ই বলেছো আমি আই আই টি এমে আছি?
মিস্টার সেন: হ্যাঁ, বলে তো ছে। ইভেন ডিপার্টমেন্ট ও বলেছে।
মিসেস সেন: জিজ্ঞেস করলো তোর ডিটেল। তাই বলেছি।
রোহিণী: এ কে রে ভাই। আমার ডিটেল জেনে নেবে। এদিকে নিজেদের বেসিক জিনিসই বলবে না। লোকেশন। দ্যাট ইস সো ইম্পরট্যান্ট। নাম কী লোকটার? দেখে হচ্ছে স্যাম্পল টা কে।
মিসেস সেন: নাম বলেনি।
রোহিণী: এক মিনিট এক মিনিট। নাম বলেনি মানে?
মিসেস সেন: হ্যাঁ মানে সারনেম জানি। ঘোষ। ব্যারাকপুরে বাড়ি। ব্যস। ইমেল আই ডি দিয়েছে। বলেছে তোর সিভি আর ছবি পাঠাতে। ওঁদের ছেলের পছন্দ হলে যোগাযোগ করে নেবেন।
রোহিণী: মগের মুলুক পেয়েছে নাকি? এহ? ইয়ার্কি? নাম বলবে না। লোকেশন জানাবে না। এদিকে আমাদের সব ডিটেল জেনে নেবে। আবার সিভি ছবি সব চাই।
মিসেস সেন: আরে রাগ করছিস কেন? নিশ্চয়ই পরে জানা যাবে।
মিস্টার সেন: আর শোন রে। ইমেল আইডি খানা যা এক পিস।
রোহিণী: নিশ্চয়ই ফালতু কিছু হবে। ইনস্টিটিউট আইডি নিশ্চয়ই দেয়নি।
মিসেস সেন: আমি তোকে ইমেল এড্রেসটা দেব বাবু। তুই লক্ষ্মী মেয়ের মতো সিভি আর ছবি পাঠিয়ে দিস।
রোহিণী: ফার্স্ট অফ অল, সিভি ছবি চায় কোন সাহসে যখন নিজেদের বেসিক ইনফো দিতে রাজি নয়? তুমি কী করে শিয়র হচ্ছ যে এটা কোনো পারভার্টের নম্বর নয়? হয়তো আমার ডিটেলস, ছবি সব নিয়ে মিসইউজ করবে। বিসাইডস, হু আসকস ফর সিভি? চাকরি দিচ্ছে নাকি? উইয়ার্ড।
মিসেস সেন: হয় রে বাবা। সিভি চায়। আমি শুনেছি।
রোহিণী: চায় আমিও জানি। মৃন্ময়ীর কাছে শুনেছি। ওর বোনের জন্য বানিয়েছিল। বাট ওরা তেলুগু। বাঙালিদের মধ্যে শুনিনি কখনো।
মিসেস সেন: আরে বাবা। হয়। আমি তোকে বলছি শোন না। এই যে, ম্যাট্রিমনি৪২০@ইয়াহু.কো। ম্যাট্রিমনি স্পেলিংটা আলাদা। দেখে নিস।
মিস্টার সেন: নিউমেরলজি। সব নিউমেরলজি। সায়েন্সের প্রফেসর ছেলে, এদিকে দেখো। সুপার্সটিশনের আখড়া।
রোহিণী: বাবা দেখো, এড্রেসে নম্বরটা আবার ৪২০। ভাবতে পারছো?
মিস্টার সেন (হাসতে হাসতে): চৌত্রিশ, ৪২০... তাও তোর মা রেড ফ্ল্যাগ দেখছে না রে বাবু।
রোহিণী: সেই।
মিসেস সেন: এরকম করে তোরা বাপ মেয়েতে মিলে আমায় শেষ করে দিলি। একটা রিক্যুয়েস্ট করলাম। সেটাও রাখলি না।
রোহিণী: মা প্লিজ। তুমি আমায় আর একবারও বলবে না এদের মেল করতে। যদি বলো, আমি করবো। কিন্তু এট ইয়োর ওন রিস্ক। কারণ মেলে আমি যে কী না কী লিখে দেবো, তার গ্যারান্টি কিন্তু আমি নিচ্ছি না। বুঝেছো? যতসব ফালতু ব্যাপার।
মিসেস সেন: তুই সব ব্যাপারে ওরকম করিস কেন রে? এইটুকু এডজাস্ট করতে হয়। আমরা মেয়ের বাড়ি। তাছাড়া ওরা তো বলেছে, পরে বলবে।
রোহিণী: পরে বলবে মানে? ওয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট? এখন বললে কী প্রব্লেম? গুগল সার্চ করলে কী ভয়ানক কিছু বেরোবে? তা সেটা তো পরে জানলেও আমরা জানবো। অদ্ভুত।
মিসেস সেন: ওরকম রেগে যাস না। মেয়ের বাড়ি। সম্বন্ধ করে বিয়ে। এগুলো হয়।
রোহিণী: চেঞ্জ ইয়োর থট। হয়তো আগে হতো। এখনো হয়। ভুল হয়। মেন্টালিটি পাল্টাও।
মিস্টার সেন: হ্যাঁ শ্রুতি, এটা কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি।
মিসেস সেন: আমি আর কী বলি। তোমরাই যখন সব সময় ঠিক, আমি সব সময় ভুল। আমারই দোষ।
মিস্টার সেন: এই ক্ষেত্রে, হ্যাঁ।
রোহিণী: মা প্লিজ স্টপ মেকিং মি ফিল লাইক ইয়োর বার্ডেন। যা ইচ্ছে যার তার উইমসেস এন্ড ফ্যান্সিসের দায় নিয়ো না। প্লিজ মা।
মিস্টার সেন: তুমি বরং যাও গিয়ে একটু শোও। রেস্ট নাও। সারাদিন খাটুনি যায়। রেস্ট নাও। দরকার।
রোহিণী: আমি যাই লেখালিখির চেষ্টা করি। কিছু না পেলে এই পুরোটাই স্ক্রিপ্ট করে দেবো। লোকে অন্তত হাসবে এরকম অদ্ভুত সব দাবি দেখে।
মিস্টার সেন: বিকেলে তোর কোথায় বেরোনো রে?
রোহিণী: ওই যে বললাম, সাউথ সিটি।
মিস্টার সেন: কার সাথে?
রোহিণী: সৌকর্য।
মিস্টার সেন: সে আবার কে?
রোহিণী: ওই হিউম্যানিটিজের সুদেষ্ণা আছে না? ওর ক্লাসমেট ছিল জে ইউ তে। ওই সুদেষ্ণার জন্য কিছু পাঠাবে বলেছে। আমি কালেক্ট করে নেব। কফিও খাবো। শুনেছি ছেলেটা সত্যজিৎ টু স্মরণজিৎ সবেতেই কম্ফোর্টেবল। তাই আশা করছি, আড্ডাটা জমবে ভালো।
মিস্টার সেন: যা। ঘুরে আয়। দেখিস বাবা, হিস্ট্রি জিওগ্রাফি সবদিকটা দেখেশুনে নিস।
রোহিণী: বাবা, তুমি না... (হাসি)

(বাবা মেয়ে হেসে প্রস্থান করে। মা গজগজ করতে থাকে।)

Wednesday, January 15, 2020

পিঠে পুলির চিঠি

"শ্রীচরণকমলেসু মা
আশা করি আপনি ভালো আছেন। শীতের প্রকোপে আপনার পায়ের ব্যথাটা বিশেষ বাড়েনি তো? কবিরাজি তেল দিয়ে মালিশটা পারুলদিকে দিয়ে নিয়মিত করবেন কিন্তু। উপকার পাচ্ছিলেন বলেছিলেন। আমরা সকলেই ভালো আছি। বাবলু এবং বাবলুর বাবা সোল্লাসে বিদেশী শীতকালের আনন্দ উপভোগ করছে। আমি অবশ্য সারাদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকি, তাই কিঞ্চিৎ মনমরা। তবে আজ আপনার ছেলে এমন কাজ করেছে যে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। 
আমার গত পরশু থেকে ঠান্ডা লেগে অবস্থা একটু কাহিল। সর্দি কাশি তো ছিলই। তার সাথে গতকাল রাতে ভালোমতো মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল। অবশ্য সেই মাথা ব্যথার অন্য কারণও আছে। ভীষণ বাড়ির কথা, আপনাদের সকলের কথা, আমার মা আর দিদিমার কথা মনে পড়ছিল। যেই খেয়াল পড়েছে যে আজ পৌষ সংক্রান্তি, অথচ এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কোত্থাও কেউ নেই যে একটু ভালোবেসে নতুন গুড় দিয়ে পাটিসাপটা করে দেবে, দুধপুলি তুলে ধরবে মুখের সামনে। আসলে পৌষ সংক্রান্তির দিন তো নিয়ম করে পিঠে পুলি খেয়েই বড় হয়েছি। আপনিও তো গত বছর আমার পছন্দের গোকুল পিঠে আর পাটিসাপটা বানিয়েছিলেন। আমার মনে আছে। খুব ভালো খেতে হয়েছিল। সেই স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। একটু গুড় কিনে রেখে দেবেন ফ্রিজে। আমরা আবার যখন দেশে যাবো, আমায় রেঁধে খাওয়াবেন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। পিঠে পুলির কথা ভেবে ভেবে ভীষণ মন খারাপ। একেই এখন কোনো খাবারের স্বাদ পাচ্ছি না। তার ওপর এই মন কেমন। কান্নাকাটি করেছি সারাদিন, খুব। আর তাই মাথায় বড্ড যন্ত্রণা। ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলাম। 
আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে দেরিতে। রান্নাঘর থেকে টুকটাক খুটখাট শব্দ পাচ্ছিলাম। মিক্সি চালানোর শব্দও আসছিল কানে। আর কানে আসছিল ছ্যাঁক ছোঁক। ভাবলাম বুঝি বাবা আর ছেলেতে মিলে ব্রেকফাস্টের অমলেট বানাচ্ছে। কোনো কায়দার স্টাফিং দিয়ে। ধীরেসুস্থে উঠলাম বিছানা ছেড়ে। মাথার ব্যথাটা কম। এক কাপ কড়া কফি খেলেই পুরোটা সেরে যাবে। একটু ফ্রেশ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতেই ব্যস। নাকে ঝাপটা এলো। নতুন গুড়। ক্ষীর। চাল গুঁড়ো। আহা। কোনো ভুল নেই। এই গন্ধ যে পাটিসাপটার। এ গন্ধ চিনতে আমি কখনো ভুল করবোই না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এই সময় এই সুগন্ধ। মাথাটা কি একেবারেই গিয়েছে আমার? ওষুধের প্রভাব? ভুল ভাবছি? ভুল বুঝছি? দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পৌঁছে গেলাম সোজা রান্নাঘরে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে। 
এ কী। কী সারপ্রাইজ! বাবলু এবং তার বাবা, দুজনে ইতিমধ্যেই গোটা দশেক পাটিসাপটা ভেজে ফেলেছে। আরো অনেকটাই গোলা আর পুর রয়েছে। আমার সাধের রান্নাঘর এলোমেলো, লন্ডভন্ড। দুজনের চুলে গালে হাতে ময়দার ছড়াছড়ি। কিন্তু না। উঁহু। আজকে ওরা কেউ বকুনি খায়নি আমার কাছে। সামনে ওই গরম পাটিসাপটা। আর কি অন্যদিকে চোখ যায়? পাটিসাপটার ওপর নতুন গুড় ছড়িয়ে যা ভালো খেতে হয়েছিল, কী বলি আর? একদম আপনার হাতের রান্না যেন। আপনার ছেলে বললো, ছোট থেকে আপনাকে আর ওর ঠাকুমাকে রাঁধতে দেখে দেখেই শিখেছে। আর বাকিটা, পাড়াতুতো মাসীমাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছে। 
আপনি আজ এখানে থাকলে ছেলে ও নাতির কৃতিত্বে খুব খুশি হতেন। গর্ব হতো আপনার। 
আজ দিনটা বড্ড ভালো কাটলো। আপনার পুত্র ও পৌত্রের কৃপায়। আপনাকে তাই ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ জানাই, এমন ভালো সন্তান পালন করেছেন বলে। আর হ্যাঁ, একটা ঢিপ করে প্রণাম। সংক্রান্তির দিনে। ভালো থাকবেন। আপনার রান্না পিঠে পুলিটা কিন্তু তোলা রইলো। গিয়েই খাবো। 
ইতি
আপনার স্নেহধন্যা
সুরঙ্গমা। 

১৫ই জানুয়ারি, ১৯৯৫
রিভারডেল, ফিলাডেলফিয়া।"


চিঠিটা পড়া শেষ করে বাবলু ওরফে পৃথ্বীজিতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো অন্তর্লীনা। পৃথ্বীজিতের চোখে মুখে লেগে আছে একটা দুষ্টু মিষ্টি হাসি। ক্যাসারোল থেকে একটা পাটিসাপটা বের করে অন্তর্লীনার মুখে পুরে দিতে দিতে বললো, "কয়েকদিন আগে ঠাম্মার আলমারিটা পরিষ্কার করছিলাম। ওখানেই একটা বাক্সে এই চিঠিটা পেলাম। যখন আমরা ইউ এসে ছিলাম। সেই সময়কার চিঠি। মায়ের হাতে লেখা। ঠাম্মার কাছে যত্ন করে রাখা ছিল। আমিও পড়ে টরে ইন্সপায়ার্ড হয়ে গেলাম। আমার শেহজাদী ছুটি পায়নি। বাড়ি যেতে পারছে না। পিজির অখাদ্য কুখাদ্য হজম করতে বাধ্য হচ্ছে দিন কে দিন। নাহয় আমিই ফিল্ডে নামি। দেখ, অনুপ্রেরণা পেয়ে রাঁধলাম কেমন। ইগার্লি ওয়েটিং ফর ইয়োর কমপ্লিমেন্ট ম্যাডাম।" অন্তর্লীনা এক কামড় মুখে দেয়। আহা। নরম। গরম। টাটকা নলেন গুড়ের স্বাদ। মন চলে যায় দিদিমার রান্নাঘরে। টিনের ছাদের ছোট্ট রান্নাঘরটা। যেটাকে ওরা ভাইবোনেরা সব ম্যাজিক রুম বলেই জানতো। কারণ ওখানে গেলেই ম্যাজিকের মতো দিদিমা ঠিক ওদের মন বুঝে পছন্দের খাবার তৈরি করে দিতো। শীতের ছুটিতে সেই ম্যাজিক রুম নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করতো। আহা। আজ এত বছর পরে আবার সেই স্বাদ ফিরে পেলো ও। পৃথ্বীজিতের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো, "আজ তোর ঠাম্মা আর আমার দিদিমা, দুজনেই খুব প্রাউড হতো জানিস, তোকে দেখলে। আই এম শিয়র, ওরা দেখছেই। আদরের নাতি নাতনিগুলোর এই পিঠে উৎসব। থ্যাংক ইউটা বড্ড পলকা জানিস তো এইসব ক্ষেত্রে। তাও বলবো, রেঁধে বেড়ে খাওয়াস চিরকাল। আমি যা ল্যাধখোড়।" পৃথ্বীজিত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, "কোনোদিনও যদি অথেন্টিক সংলাপ কিছু বলতি রে। ব্যোমকেশের এই সিজনটা আমারও দেখা হয়ে গিয়েছে রে। থ্যাংক ইউ এর ডায়লগটা যে ঝাঁপা, জানি কিন্তু।" অন্তর্লীনা মুচকি হেসে বলে, "তাহলে আর কী। বাকিটাও অনুসরণ কর। আমি বরং খাওয়ায় মন দিই। কী বলিস?"

Saturday, January 11, 2020

এক মুঠো রোদ

রোদটা একদম ভালো করে উঠছেইনা কদিন ধরে। কাপড়জামা যে কীভাবে শুকোবে, কিচ্ছু ভেবে পায়না চন্দ্রিমা। ধুর, এরকম করে কদিন যে চলবে? এগুলো না শুকোলে লাগেজে কী প্যাক করবে? ভেবে পায় না ও। এই তো আজ গেলো তেরো, আগামী সতেরোয় তো ওর বেরোনো। এখনও গুচ্ছের টুকটাক কেনাকাটি, প্যাকিং সব বাকি। অবশ্য আদৌ কি চন্দ্রিমার ট্রিপটা সম্ভব হবে? সব কিছুই হঠাৎ করে এমন এলোমেলো হয়ে গেলো...  এক মাসের জন্য চন্দ্রিমার প্রাগে যাওয়ার কথা। একটা উইন্টার স্কুল অ্যাটেন্ড করতে। কলেজে পড়ানোর চাকরিটা পাওয়ার পর এই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। প্রথম যেদিন আমন্ত্রণপত্র হাতে আসে, বা বলা ভালো ইমেলে আসে, খুশীতে বেশ একটা ছোটখাটো নাচ নেচে ফেলেছিল ও। সেই মাস্টার্স পড়ার সময় থেকে যেই প্রেস্টিজিয়াস উইন্টার কোর্সে যাওয়ার জন্য চন্দ্রিমা মুখিয়ে থাকতো, যেখানে সিলেকশন পর্ব নিয়েই রীতিমতো সাড়া পড়ে যেতো, আজ সেখানে লেকচার দেওয়ার সুযোগ এসেছে। চন্দ্রিমার দুর্দান্ত আনন্দ হওয়ার কথা। হচ্ছিলোও। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর জীবনে নেমে এলো গভীর ঝঞ্ঝা।

সীতাংশু সেদিন অফিস থেকে ফিরে দিব্যি খোশ মেজাজেই তো ছিল। অফিসে একটা ভালো ডিল ক্র্যাক করেছে, সেই খুশীতে সেলিব্রেশন করবে বলে দুজনে ঝটপট তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরলো লং ড্রাইভে। উদ্দেশ্য, হাইওয়ে ধরে অনেকটা দূর যাওয়া, তারপর ওদের প্রিয় পাঞ্জাবি ধাবায় রুটি পনীর চিকেন কাবাব আর লস্যি সহ জমিয়ে ডিনার করা। সেদিন খাওয়াদাওয়াটা হয়েওছিল বেশ ভালো। ফেরার পথে দুজনেই গাড়ির স্টিরিওতে পুরনোদিনের গান চালিয়ে গল্প করতে করতে ফিরছিল। সীতাংশুই চালাচ্ছিল গাড়ি। অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। শুনশান রাস্তা। শুধু মাঝে মাঝে কিছু মালবাহী ট্রাক যাচ্ছে পাশ দিয়ে, উল্টো দিক দিয়ে। চন্দ্রিমার আসন্ন প্রাগ সফরের শেষে সীতাংশু ওখানে পৌঁছে যাবে, তারপর দুজনে মিলে সপ্তাহখানেক ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরবে। এমনটাই প্ল্যান চলছিল। এমন সময় কোথা থেকে যে কী হয়ে গেলো। উল্টোদিক থেকে আসা একটা ব্রেক ফেল করা লড়ি, তার চোখ ধাঁধানো হেডলাইট, সীতাংশুর ভয়ে ফ্যাকাশে হওয়া মুখ, প্রাণপণে স্টিয়ারিং উইল ঘুরিয়ে দেওয়া, একটা বিশাল ঝাঁকুনি।

চন্দ্রিমার জ্ঞান ফিরেছিল একদিনের মধ্যেই। চোট বেশি পায়নি ও, ভাগ্য ভালো। একটা ছোট ফ্র্যাকচার আর কপালে কেটে যাওয়া। কিন্তু সীতাংশুর চোট বেশ গুরুতর। দুদিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরলেও, ডাক্তাররা খুব একটা সুবিধের কথা বলছেন না। অপারেশন হয়তো করতে হতে পারে। নিজে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও চন্দ্রিমা প্রত্যেকদিন সকাল বিকেল সীতাংশুর কাছেই থেকেছে, ওর যত্ন আত্তি করেছে। সীতাংশু যদিও ওকে বারবার কলেজ কামাই না করতে বলেছে, তবুও। চন্দ্রিমা ওকে ছেড়ে যাবেই না। সীতাংশুর শারীরিক অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছেনা। ডাক্তাররা এইবারে যেন বেশ চিন্তিত। ইতিমধ্যে একটা মেডিকেল বোর্ড বসেছে, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তাই নিয়ে আলোচনা করতে। একেই এইরকম বিচ্ছিরি আবহাওয়া। সারাদিন এই অকালের বৃষ্টি। তার উপর সীতাংশুকে নিয়ে টেনশন। ভালো লাগেনা কিচ্ছু চন্দ্রিমার। মনমরা মেয়েটাকে দেখে সীতাংশুরও ভারী কষ্ট লাগে। কোথায় এখন ওদের প্রাগ ভ্রমণ নিয়ে মুখিয়ে থাকার কথা, তা না। তবুও, এরই মাঝেই সীতাংশুরই জোর করায়, চন্দ্রিমা রোজ হাসপাতালে বসেই ল্যাপটপে নিজের প্রেজেন্টেশন বানাচ্ছে। যদি ঈশ্বরের কৃপায় সীতাংশুর উন্নতি হয় স্বাস্থ্যে, যদি চন্দ্রিমা যেতে পারে।

ডাক্তাররা আর রিস্ক নিতে রাজী নন। এতদিন হয়ে গেল, মাথার ক্লটটা ঠিকমতো মিলিয়ে যাচ্ছেনা। এইবারে সার্জারি করতেই হবে। সীতাংশু চাইছিল না। বারবার বলছিল, "দেখো, সামনের সপ্তাহেই তোমার যাওয়া। এর মধ্যে আর এইসব অপারেশনের ঝক্কি নিয়ো না। ওষুধ খেয়ে তো কমছে। একটু ধৈর্য্য ধরি। কমে যাবে। তুমি বরং ঘুরে এসো। ডোন্ট মিস দ্য চান্স চন্দ্রিমা।" চন্দ্রিমা এইসব কথা শুনে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে থাকে। বলে, "তুমি কি আমায় এরকম ভাবো বলো? তোমার শরীর আগে না আমার লেকচার? উঁহু। কক্ষনো না। তোমার সার্জারি হবেই। ডাক্তার যখন বলেছেন, হতেই হবে। ওঁরা তোমার চেয়ে বেশি বোঝেন। প্লিজ। আর না করো না।" সীতাংশু অনেক তর্ক বিতর্কের পর শেষমেশ রাজি হয় একটা শর্তে। সার্জারিটা যেন চন্দ্রিমার যাওয়ার দিন চারেক আগেই হয়ে যায়। আর সবকিছু ঠিকঠাক চললে, চন্দ্রিমা যেন প্রাগ যাওয়া বাতিল না করে।

গতকাল অপারেশনটা হলো। ডাক্তার তো বলেছেন, সাকসেসফুল। চব্বিশ ঘন্টা না কাটলে অবশ্য কিছু বলা যাবে না। আজ পনেরো। পরশুর টিকিট। হাসপাতালে সীতাংশুর সাথে দেখা করতে চন্দ্রিমা বের হয়। আজ অনেকদিন পর আকাশের মেঘ কেটেছে। রোদ উঠেছে। সীতাংশুর সার্জারিটা ভালোয় ভালোয় মিটেছে, চন্দ্রিমা অনেকটা নিশ্চিন্ত। কাল রাতে সীতাংশুর জ্ঞান ফেরেনি, তাই কথা হয়নি। আজ দেখা হবে। কথা হবে। বড্ড স্পেশাল। তাই বিশেষ করে সীতাংশুর পছন্দসই গোলাপী শাড়ি পরেছে। চোখে টেনেছে আই লাইনারের ছোঁয়া। ঠোঁটে লিপস্টিক। একদম টিপটপ সাজ। সীতাংশুর কেবিনের সামনে পৌঁছে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় চন্দ্রিমা। হালকা টোকা দিয়ে ঘরে ঢোকে। সীতাংশু উঠে বসেছে, নার্সকে ভর দিয়ে। আরেকজন নার্স ওকে ব্রেকফাস্ট খাওয়াচ্ছে। মাথার কাছের জানলা দিয়ে সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে বিছানায়। সীতাংশু সেই রোদের আদরে মাখামাখি। চন্দ্রিমাকে দেখে থমকে গেল খানিক। তারপর আস্তে আস্তে বললো, "প্রেজেন্টেশন রেডি? লাগেজ প্যাক? এই যাত্রায় তোমার যাওয়াটা তাহলে হচ্ছেই। আমাদের ইউরোপ ভ্রমণটা নাহয় মুলতুবি থাক। কিন্তু হবেই। কথা দিলাম। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুরে এসো। বিশ্বজয় করো। আমি তো রইলাম।" চন্দ্রিমা কিচ্ছু বলতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সীতাংশুর দিকে। শুধু টের পায় দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল। আনন্দের। ছুটে গিয়ে সীতাংশুর কাঁধে লুটিয়ে পড়ে। সীতাংশু হালকা করে "আঃ" বলে দু হাত দিয়ে জাপ্টে ধরে চন্দ্রিমাকে। ভালোবাসার, ভরসার আলিঙ্গনে।

Wednesday, January 8, 2020

je kawta din.. reprise version Anupam Roy

"যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে, যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে, আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে ছিলে.. আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে ছিলে। যেটুকু রোদ ছিল লুকনো মেঘ বুনেছিলাম তোমার শালে ভালোবাসা, আমার আঙ্গুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে ছিলে.. আমার আঙ্গুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে ছিলে। চিন্তার অনুপ্রবেশ রেজার ব্লেডের ধারে বিন্দু বিন্দু মেশে সিন্ধু স্রোতে বাড়ে, মাঠের প্রান্তে যে লোক একলা বাঁশির সুরে সকাল বিকেল ডাকে এমনি ভবঘুরে, স্থানীয় সংবাদে তাই কেউই শিরোনামে নেই। যেভাবে নিঃশব্দে ফেলেছে পা রূপকের সাহায্যে আরও দূরে চলে গেলে। আমার অলস জোছনাতে তুমি লেগেছিলে.. আমার অলস জোছনাতে তুমি লেগেছিলে। যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে, আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে ছিলে.. আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে ছিলে। আমার আঙ্গুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে ছিলে.. আমার আঙ্গুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে ছিলে।"