প্রথম দিন
যাক গে, হইহই করতে করতে (পড়ুন, ক্যাবের
পর ক্যাব ক্যান্সেল করছে, পাশ থেকে মা জননী চিৎকার করছেন, কেন আমরা রেডি হয়েও বসে বসে
ভ্যারান্ডা ভেজেছি এতক্ষণ, কেন এতক্ষণেও ক্যাব বুক করা শুরু করিনি, ইত্যাদি) শেষমেশ
ক্যাবটি এলেন। আমরাও গুটিগুটি পায়ে ডিকিতে অল্প যা লাগেজ ছিল, তুলে দিয়ে গাড়ির ভিতর
বসে পড়লাম। (ইতিমধ্যে আমার খান দুইয়েক সেলফি তোলা হয়ে গিয়েছে, ফেসবুকের জন্য।) ট্যুর
ম্যানেজার রিন্টুর ফোন ঢুকেছে এর মধ্যেই, কাকার মোবাইলে। আমরা কতক্ষণে পৌঁছচ্ছি, জানতে
চেয়ে। বাস নাকি অলরেডি পৌঁছে গিয়েছে। বেশিরভাগ লোকজনও পৌঁছে গিয়েছেন। বাবাহ, বাঙালির
এমন সময়জ্ঞান ভালো, জেনে অবাক। যেহেতু বাসের সিট নির্দিষ্ট ছিল না, আগে এসে আগে বসো
গোছের ভাব, ধরেই নিলাম, পিছনের সিটই আমাদের কপালে নাচছে। এবং হলোও তাই। শেষের ঠিক আগের
রোতে টু-সিটারে আমি আর মা, আর থ্রিসিটারে বাবা আর কাকা এবং আমাদের অল্প লাগেজ বসলো।
বাসের ছাড়ার কথা ছিল (কাগজ অনুযায়ী) সাড়ে সাতটায়। ছাড়ল ঠিক ৮:২৯ এ। আহা। এক ঘন্টাও
তো লেট করেনি। বাঙালি স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী, ঠিকই আছে।
বাস ছাড়তে ছাড়তেই দেখি “আকাশ মেঘলা,
বৃষ্টি এখনও হয়নি”। কে আসবে বলে, কে জানে? সায়েন্স
সিটি থেকেই বাঁ দিকে ঘুরে গেলো বাস। চলতে লাগলো কলকাতা লেদার কমপ্লেক্সের রাস্তাঘাট
দিয়ে। টুকটাক ঝিল, একটু কম উন্নত বাড়িঘর এইসব নিয়েই যাত্রাপথ। রাস্তার ধারের দোকানগুলির
সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কী নাম জায়গাগুলির। চেনা নাম বলতে, দেখলাম ওই একমাত্র
ভাঙ্গর। আমার এক পিসি ওখানের কলেজে পড়ান। তাই নামটা জানি। ঝিল পুকুর ভাঙা রাস্তা সাইকেল
অটো ভ্যান মানুষজন ছাগল গরু কুকুর বিড়াল সব দেখেত দেখতে বাস চলতে লাগলো। ইতিমধ্যেই
বাস ছাড়তেই হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সুগার অ্যান্ড স্পাইসের বাক্সে ব্রেকফাস্ট। একটা ভেজ
বার্গার, একটা পনীর প্যাটি, একটা কাপ কেক আর একটা শুকনো মিষ্টি। হাঙরের মতো খিদে পেয়ে
গিয়েছিল বাস জার্নির সৌজন্যে। তাই কেক বাদে বাকিগুলি খেয়েই নিলাম। বাস রাস্তা মোটামুটি স্ম্যুদ, তাই
ঝাঁকুনি খুব একটা খাইনি, পিছনের সিটে বসেও। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, বাসটা খুব একটা
পছন্দ হয়নি। জানলার কাঁচ ভালো বন্ধ হচ্ছিলো না। এদিকে যা কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল...
ভলভো লেখা থাকলেও এ অরডিনারিই বাস। মোটেই ভলভো নয়। যাই হোক, মাঝে কোন এক জায়গায় পনেরো মিনিটের চা
খাওয়ার ব্রেক দিয়ে টিয়ে বাস পৌঁছল গদখালি। তখন প্রায় বারোটা বাজে। মাঝে বাসন্তী
নামের জায়গার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম যখন, বাসের লোকজন জোক ক্র্যাক করলো। ভীরু নামের
কেউ বোধহয় ওঁদের দলে ছিলেন, তাই তাকে বাসন্তী নিয়ে খ্যাপানো হলো। যাক গে। গদখালি
থেকে আমাদের লঞ্চের জার্নি শুরু হবে। ঘন্টা দেড়-দুইয়ের ব্যাপার। বাসের পারকিং থেকে
লঞ্চঘাট ওই হাঁটাপথে মিনিত তিনেক মতো। গদখালি জায়গাটি অত্যন্ত ভিড়-হট্টগোলের।
একগাদা টাটা ম্যাজিক, অটো দাঁড়িয়ে লোক তুলছে, নামাচ্ছে। ক্যানিং, সোনাখালি এইসব
জায়গার প্যাসেঞ্জার। সেই ভিড়, কাদা পিচ্ছিল রাস্তা পেরিয়ে লঞ্চঘাটে এলাম। সামনে এই
এত বড় আমাদের লঞ্চ দাঁড়িয়ে। নাম তার ‘স্বর্ণময়ী”। আমরা সব মিলিয়ে ছিলাম ৪৫ জন, আর
সাথে রিন্টু। সব্বাই মিলে একে একে গিয়ে উঠলাম লঞ্চে। সিঁড়ির কাছটা বেশ ভালোমতন
পিচ্ছিল ছিল, তাই একটু ভয় করছিল বটে, তবে আমাদের হাত ধরেই প্রায় লঞ্চে উঠিয়ে দিলেন
লঞ্চকর্মীরা। কোন অসুবিধে হয়নি। লঞ্চের নীচের তলায় (একবারও ঢুকিনি, ঢোকা উচিত ছিল)
ওঁরা আমাদের সবার লাগেজ নিয়ে রেখে দিলেন। আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম। ডেক
বরাবর সারি দিয়ে দিয়ে চেয়ার পেতে রাখা। আমরা চারজনে, বাকিদের সাথেই ওই চেয়ারে যে
যার মতো বসে পড়লাম। আমি নিয়েছিলাম ধারের চেয়ার। লঞ্চ ছেড়ে দিলো অল্পক্ষণেই। দেড়
ঘন্টা মতো চলবে। এ এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা আমার জন্য। আগেও কেরলের ব্যাকওয়াটারে
ঘুরেছি, বেরিয়েছি এমন লঞ্চে। বিভিন্ন জায়গায় রিভার বা সি-ক্র্যুজও করেছি। কিন্তু
এরকম দুই ধারে জঙ্গল, এত চওড়া নদী, এর মধ্যে দিয়ে এই প্রথম। বেশ লাগছিল। হাল্কা
দুলুনি পর্যন্ত ছিলো না। বেশ ধীরস্থির জার্নি।
এর মধ্যেই ট্যুরের লোক এসে চা আর
বিস্কিট দিয়ে গেলেন। দু পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল দেখতে দেখতে আমরা চললাম। মেঘলা ভাব
ছিলো, তাই কনকনে স্যাঁতস্যাঁতে দুইই বোধ করছিলাম। ভালো করে টুপি চাদর জড়িয়ে বসলাম।
আমার কাকা বসে ভিডিও তোলা শুরু করে দিলো। আমিও ক্যামেরা বের করে টুকটাক ছবি তুলছি।
বাবা ঝিমোচ্ছে। মা সহযাত্রীদের সাথে এর মধ্যেই বন্ধুত্ব পাতিয়ে গপ্প জুড়ে ফেলেছে। কেউ
কেউ নদিয়া জেলা থেকে এসেছেন, দশজন একসাথে। ওঁদের লিডার জিনি, তিনি কিছুদিন আগে
ঘুরে গিয়েছেন, তাই মোটামুটি সমস্তটাই জানেন। তিনিই আমাদের বলছিলেন, কতক্ষণ লাগবে।
কাল কোথায় যাবো। আজ কোথায় যাব। আদৌ বাঘ দেখতে পাবো কি না। এইসব। এই করতে করতে দয়াপুরে পউছলাম, প্রায় দুটো নাগাদ।
দয়াপুর হলো ওই অঞ্চলের সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত লোকালয়। এখানেই অনেক রিসোর্ট রয়েছে।
আমাদের সুন্দরবন ভিউ পয়েন্ট রিসোর্টটিও এখানেই। লঞ্চকে ঘাটে বেঁধে দিলো। আমরা একে
একে নামলাম। মালপত্র সাথে নিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে কয়েক পা হেঁটেই আমাদের
রিসোর্ট। ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। বেশ সবুজ। জলাশয়ও রয়েছে। দোতলা বাড়ি। চেক-ইন
রেজিস্টারে সই করে ঘরে গেলাম। পাশাপাশি দুটো ঘর আমাদের, একতলায়। ১০৫ আর ১০৬। একটু
ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে বেরোতে হবে।
No comments:
Post a Comment