দুপুরের খাবারটা বেশ ভালোই ছিল। যদিও
অন্যান্য ট্যুর পার্টিদের মেনুতে যেমন ভ্যারাইটি আইটেম লেখা থাকে , মানে ওই চাউমিন
চিলি চিকেন, (ও এখন তো আবার সৃজিত মুখুজ্জের সিনেমার জেরে, চিকেন চাউমিন চিলি ফিস বেশি
পপুলার) বা বিরিয়ানি মাংস ছিল না। তবে টায়ার্ড হয়ে এসে একটু গরম গরম ভাত ডাল কফির তরকারি
পাঁপড় ভাজা কাতলা মাছ চিকেন কারি আর পেঁপের চাটনি খেয়েও মনপ্রাণ তৃপ্ত হলো বইকি। রিন্টু
এর মধ্যেই এসে বলে দিয়েছে, চারটের দিকে সবাই মিলে বেরনো হবে, লঞ্চে চেপে। সবাই যেন
রেডি থাকি। আমরা খেয়ে উঠতে উঠতে প্রায় তিনটে বেজেই গিয়েছিল। ভাবলাম আধ ঘণ্টা একটু পিঠটান
করি। আমি ফোন বাবাজীকে চার্জে বসিয়ে একটু রেস্ট নেবো, এমনটা ভেবে ব্যাগ হাতড়াচ্ছি।
চারজার কই? ও মা, খেয়াল হলো, বাবা মা এবং আমি, তিনজনেই ভেবেছি যে অন্যজন নিয়েছে সেটি।
আর ব্যস, কেউ নিইনি। যদিও সাথে পাওয়ার ব্যাঙ্ক ছিল, তবুও। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেলো।
যাহ্, ফোনের চার্জ কখনো ৮০% এর নীচে নামলেই কেমন একটা ধুকপুকানি হয়। তবে যাই হোক,
এ যাত্রায় রক্ষা করলো কাকা। দখল নিলাম চারজারের। বাবা ঘুম দিলো। কাকা একটু ফোনে এর
তার খোঁজখবর করতে লাগলো। আমি শুলাম বটে, কিন্তু ওই শুয়ে শুয়ে ফেসবুক খুলবার বৃথা চেষ্টা।
নেটওয়ার্ক এতই খারাপ, কিছুই হলো না। বাইরে আওয়াজ পাচ্ছি, মা কোন একটা বাচ্চার সাথে
গল্প জুড়েছে। বেরিয়ে এসে দেখি, রিকো। আমাদেরই সহযাত্রী। ভারী মিষ্টি এই বাচ্চাটি। বছর
তিনেক বয়স, গোলগাল, হাসিখুশি, মিশুকে। রিসোর্টের সামনে ঢালাই করা রাস্তায় কুকুরের পায়ের
ছাপ রয়েছে কয়েকটা। ও সব্বাইকে ডেকে ডেকে দেখিয়ে বলছে, “এই দেখো, বাঘের পায়ের ছাপ।“
সরল শিশু মন। ওর সাথেই খানিক গল্প করতে করতে দেখি চারটে বেজে গেলো। একে একে সবাই যে
যার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। বিকেলের সাইট সিয়িং করার জন্য। আজ যেখানে যাবো, সেখানে
বাঘ টাঘ দেখার কোন গল্প নেই। শুধুই কিছু মাইগ্রেটরি পাখি দেখা। আর সূর্যাস্ত।
সুন্দরবনে পৌঁছনো ইস্তক দেখছি, কেমন
জানি কুয়াশার পাতলা একটা আস্তরন জেন লেপ্টে আছে। আকাশের মুখ ভার না হলেও, বিশেষ প্রসন্ন
নয়। যতক্ষণে আমরা স্বর্ণময়ীতে গিয়ে উঠলাম, সূর্য ঢেকে গিয়েছে মেঘের আড়ালে। এক্কেরে
বিফোর টাইম সূর্যাস্ত। মন খারাপ হলো আমাদের। তবুও আশায় আশায় রওনা দিলাম, যদি…। বোট
বা লঞ্চ, যাই বলি না কেন, সেখানে প্রতিবার চলার সময় আমাদের সারেঙ মশাই বলে দিয়েছিলেন,
দুইদিকের ব্যালেন্স যেন সব সময় বজায় থাকে। নইলে যে কোন সময়ে লঞ্চ উল্টে ভালোরকম বিপদের
সমূহ সম্ভাবনা। তাই লঞ্চ ডেকের দুদিকেই সমানভাবে চেয়ার যেমন পাতা, তেমন করেই আমাদের
বসার নির্দেশ ছিল। কোন জন্তু টন্তু দেখা গেলে উনি যে এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে সক্কলে
দেখতে পাই, এমনটাই বলে আশ্বস্ত করলেন। আমাদের তখন মনে একটাই চিন্তা। আর যাই হোক না
কেন, বাঘ যেন মিস না করি।
এইসব করতে করতে আমাদের লঞ্চ চলতে লাগল।
সেই একই চওড়া নদী। নদীর নাম জানি কি, ঠিক খেয়াল পড়ছে না। আসলে ওঁরাও খুব একটা সেই বিষয়ে
বলেননি। আমাদের ভরসা ছিল গুগল ম্যাপ। নদীর দেখি বিভিন্ন চ্যানেল। খাঁড়ির মতো এদিক ওদিক
জলের ধারা ঢুকে যাচ্ছে। জোয়ারের সময় তাতে জল ভরে যায়। পাড়ের গাছপালাগুলো অনেকটাই ডুবেও
থাকে। আমরা যখন গিয়েছি, তখন ভাটার সময়। তাই পাড়ে দেখলাম ভীষণ কাদা। দুপাশ থেকে গাছেরা
নুয়ে পড়ছে জলে। প্রায় আধ ঘন্টা, কি আর একটু বেশি চলার পর দেখি একটা জায়গায় অনেকগুলো
লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভাবলাম, কী ব্যাপার? কী দেখছে ওঁরা? বাঘ দেখা গেলো নাকি? মাথার
মধ্যে তো শুধু ওই একটাই চিন্তা। বাঘ মামার দর্শন কি পাবো? নাহ। সে গুঁড়ে বালি ঢেলে
জানলাম, এই জায়গার নাম “জটিরামপুর”। এখানেই আমরা পাখী দেখবো। ওই কাদা কাদা নদীর পাড়ে
তাকিয়ে রইলাম সবাই হাঁ করে। কই? কোন পাখীর দেখা নেই। জানতে পারলাম, পাখিদের আসা এখন
অনেক কমে গেছে। কে জানে? ওরাও হয়তো একই জায়গায় আর প্রত্যেক বছর না এসে বিভিন্ন জায়গায়
জায়গায় ট্যুর করছে। সত্যিই তো, কাঁহাতক আর একই জায়গায় প্রতি বছর ঘুরতে আসা হালো লাগে?
তাই না? যাই হোক, ওই দু তিনটে সাদা বক (পরে অবশ্য দেখে জেনেছি, ওদেরও কিছু গাল ভরা
নাম আছে বই কি) আর একটা দুটো মাছরাঙা। এই ছিলো দেখার ঝুলিতে। মিনিট পনেরো ওখানে অপেক্ষা
করে এবার ফেরার পালা। সূর্যাস্ত দেখা হবে না। মেঘের আড়ালে সূর্যদেব। তাই একদম রিসোর্টে
ফেরা। জন্তু জানোয়ার কিছু তেমন দেখি ছাই না দেখি, লঞ্চে চেপে এই জলভ্রমণ, তাও দু পাশে
ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, এই অভিজ্ঞতাটা কিন্তু বেশ লাগছিল।
ফিরলাম ওই আধ ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের
জার্নির পর। রিন্টু বলল, আজ কালচারাল প্রোগ্রাম আছে। স্থানীয় কোন দল এসে নাচ গান পরিবেশন
করবে। সেই দেখতে দেখতেই চা-পকোড়া সহযোগে সন্ধ্যেটা ভালোই কাটল। ওঁদের স্থানীয় গানে
প্রতি লাইনে যেন সুন্দরবনের জীবনযাত্রার কথা, সুখ দুঃখের গল্প, প্রাত্যহিক লড়াইয়ের
গল্প ফুটে উঠছিল। আমরাও দর্শকাসন থেকে একবার গিয়ে নাচের তালে পা মেলালাম। ছবি টবিও
উঠলো। এইসব শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা। সক্কলেই আমরা ভীষণ ক্লান্ত। নটার দিকে ডিনার
পরিবেশন করলো। ভাত রুটি ডাল তরকারি পাঁঠার মাংস আর চাটনি। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম। পরেরদিন
সকাল সকাল বেড টি দেবে। আর সাথে দেবে গরম জল। সেই যে, জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমার সংলাপের
মতো, “রানিং হট ওয়াটার”। কাল সারাদিনের লম্বা জার্নি। ভালো করে একটা এইবারে ঘুম দরকার।
No comments:
Post a Comment