Saturday, February 1, 2020
Sunderban 4
দ্বিতীয় দিন
সক্কাল সক্কাল ওই ছটা সোয়া ছটার দিকে বেড টি আর সাথে বিস্কিট দিয়ে আমাদের ঘরে ঘরে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলো। তারপর সাথে সাথেই শুরু হলো গরম জল দেওয়া। ওই বালতি করে করে দিয়ে যাচ্ছিল হোটেলের ছেলেরাই। একটা সেন্ট্রাল জাউগায় বিশাল হাঁড়িতে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে জল ফুটছিলো। জানিনা সেই জলের সোর্স কী, পাশেই বয়ে চলা নালা না কি? জলের রঙ কিন্তু বেশ ঘোলাটে। যাই হোক, কীই বা করা। যা পাচ্ছি, তাই দিয়েই কাজ চালাই। খুব যে ইলাবোরেট করে স্নান করবো, সেই উপায় নেই। কারণ ঠান্ডা মন্দ না। যাই হোক, সাতটার মধ্যে সকলে তৈরি হয়ে নিলাম বটে। তাও ওই বোট ছাড়তে ছাড়তে সেই আটটাই বেজে গেলো কারণ ওই এক দুজনের লেট লতিফ আচরণ।
আজকে অনেকগুলো জায়গায় যাওয়ার কথা, বেশ লম্বা জার্নি। আর কপালে যদি বাঘ দেখা যায়, তো সে আজকেই হবে। আমাদের দয়াপুর আইল্যান্ডের থেকে বলা যায় প্রায় ওই মিনিট দশেকের জার্নিতেই (লঞ্চে অবশ্যই) পৌঁছে যাওয়া যায় সজনেখালি। সজনেখালি হলো সুন্দরবন অঞ্চলের মূল দ্বীপ বা সেন্টার। সরকারি কাজকর্ম, ট্যুর গাইড ইত্যাদি সব এখান থেকেই পাওয়া যায়। আমাদের লঞ্চ সজনেখালির ঘাটে দাঁড়ালো, তবে আমরা নামলাম না। বরং সরকার স্বীকৃত একজন ট্যুর গাইড আমাদের লঞ্চে উঠলেন। নামটা ঠিক খেয়াল পড়ছে না। ধরে নিলাম, মাধব বাবু। উনি উঠেই আমাদের সুন্দরবনে স্বাগত জানালেন। নিজের পরিচয় দিলেন। এবং জানালেন যে আমরা যতক্ষণ এই রিজার্ভ ফরেস্টের ভিতর দিয়ে চলবো, ততক্ষণ গাইডের সাথে থাকাটা বাধ্যতামূলক। উনিই প্রতিপদে আমাদের সাথে থাকবেন। জঙ্গলের নিয়মকানুন সমস্ত কিছু বলবেন। জানাবেন এখানকার মানুষজনের কথা।
সুন্দরবন অঞ্চলের টোটাল এরিয়া কত, তার কত শতাংশ ভারতে (একজ্যাক্ট সংখ্যা মনে নেই) আর কতটা বাংলাদেশে (ওখানেই বেশি এরিয়া ভারতের তুলনায়) সমস্ত বিষয়ে জানালেন। এও জানালেন যে এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ইউনেস্কো স্বীকৃত হেরিটেজ সাইট। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৈশিষ্ট্য আমরা ছোটবেলায় স্কুলের বইতে পড়েছি। এই লম্বা মোটা কান্ড, ওপর দিকে পাতার “ক্যানোপি”। শিকড় বেশ শক্তপোক্ত, মাটি আঁকড়ে থাকে। হতেই হবে, নইলে প্রতিনিয়ত এই যে নদীর পাড় ভাঙছে, তার থেকে বাঁচবে কী করে? ইয়া লম্বা লম্বা সে শিকড়, এক্কেবারে পাড় অবধি এসে পৌঁছে গিয়েছে। আন্তরজাল সৃষ্টি করে প্রায়। আবার কিছু কিছু গাছে শ্বাসমূল থাকে, যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি, “নিউম্যাটোফোর”। এই নিউম্যাটোফোরের বৈশিষ্ট্য এদিন সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও লঞ্চ থেকে আমি বুঝিনি, তবে ভালো করে পরেরদিন দেখেছিলাম। কাজেই সেই নিয়ে কথা পরে হবে। ছবি অবশ্য আগেই আপনাদের দেখিয়েছি।
আমাদের প্রথম ডেস্টিনেশন, সুধন্যখালি। পৌঁছে গেলাম অল্পক্ষণেই। সুধন্যখালিতে দেখার বলতে ওয়াচ টাওয়ার। লঞ্চ ঘাটে এসে ভিড়লো। আমাদের নামার আগে মাধব বাবু বলে দিলেন, সকলে যেন ওনার সাথে সাথেই থাকি, হারিয়ে যেন না যাই। আমরা এক ঘাটে নামবো, উঠবো অন্য ঘাট থেকে। তাই এই সাবধানতা। কাদা পিচ্ছিল ঘাটে আমরা সবাই নামলাম এক এক করে। বড় করে গেট, লেখা সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ার। ভিতরে ঢুকেই একটা অফিস মতো। রিন্টু সেখানে গিয়ে পারমিটের ব্যবস্থা করলো। তারপর আমরা সবাই চলতে লাগলাম। অল্প কিছুটা জায়গা জুড়ে ওই সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানীয় গাছ, যেমন গরান, গেঁয়ো, হেতাল, সুন্দরী আলাদা করে রাখা, জালের আড়ালে। এ ছাড়াও আরো বিভিন্ন গাছপালা রয়েছে। চেনা অচেনা। সেইসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে। তিনতলা উঁচু। সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। খোলা জায়গা বেশ অনেকখানি দেখা যায় ওখান থেকে। কাদা মাটি মতো খোলা জায়গা। আসলে জন্তুর দেখা পাওয়া যায় বলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু রাস্তা করে দেওয়া, যাতে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়। যদিও জাল দিয়ে রাখা (বাঘের জন্য), তবুও, জানা কথা, এখানে বাঘ আসে না। দেখতে পেলে ম্যাক্সিমাম ওই হরিণ। তা, তাই বা মন্দ কী? আই আই টিতে থাকাকালীন হরিণের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছি, নিজের হাতে ওদের খাইয়েছি। সে আলাদা অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই জঙ্গলের পরিবেশে ওদের দেখাও কম আনন্দের নয়। তাই ওই হরিণ দেখতে পাবো ভেবেই একটু মনে উৎসাহ। আর তারই মধ্যে রব উঠলো। ওই তো হরীন। ওই যে, আরে ওই তো। সোওওওজা তাকালেই, ওই যে, কাদার মধ্যে মিশে গেছে রঙ। দলের একটি ছেলে আমার ক্যামেরার জ্যুম লেন্স তাক করে সেটিকেই বেশ দূরবীন বানিয়ে দেখে টেখে আমায় দেখতে দিলো বটে। তবে পোড়া কপাল, কিছুই বুঝলাম না। শুধু ওই ওয়াচ টাওয়ারের ব্যাকড্রপে ছবি তুল্লাম গোটাকয়েক। নীচে নেমে এলাম। সেখানে দেখি সিমেন্টের বসার জায়গা পাতা,কাকা বসে জিরোচ্ছে। পাশেই জাল দেওয়া। জালে বেশ কয়েকটা বাঁদর হুটোপুটি করছে। শুনলাম, ওখান থেকে হরিণ ভালো দেখা যাচ্ছে। লেখাপড়ায় যতটা মনোনিবেশ করলে আজ আমি নোবেল পেয়ে যেতাম, তার চেয়েও বেশি মন দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। অবশেষে, হ্যাঁ অবশেষে, দেখা মিলল। হরিণের। স্পটেড ডিয়ার। তিন চারজন ছিলো। রোদ পোহাচ্ছিল। ওদের দেখার জন্য আমাদের হুড়োহুড়ি দেখে ওরাও বোধহয় আমোদ পেয়ে দুবার উঠে একটু হাঁটা চলা করলো। তাতে আমাদেরই লাভ হলো। একটা মুভমেন্ট দেখতে পেয়ে সঠিক লোকেশনটা অনেকেই বুঝলাম। তারপর ক্যামেরার লেন্স তাক করেই খচাৎ। বেশি খচাত দেখতে দেখতে পাশের বাঁদরগুলো খিচখিচ শুরু করে দিতেই দে ছুট। ইতিমধ্যেই রিন্টু আর মাধব বাবুও আমাদের তাড়া দিতে এসে গিয়েছেন। সদলবলে সব ভালো ছেলেপুলের মতো আমরা অন্য ঘাটে বাঁধা লঞ্চে এসে উঠে পড়লাম।
লঞ্চ চলতে লাগলো। লুচি ছোলার ডাল আর ডিম সিদ্ধ প্লাস্টিকের প্লেটে সাজিয়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট দেওয়া হলো। লঞ্চে আপাতত দুলুনি নেই। কাজেই খেতে অসুবিধে নেই। এরপরের গন্তব্য, পঞ্চমুখ। অনেকটা রাস্তা। প্রায় দেড় ঘন্টা তো বটেই। গোটা রাস্তা মাধব বাবু নানান গল্প নিয়ে চললেন আমাদের সাথে। যাত্রাপথটিও বেশ ইনটারেস্টিং।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment