Friday, February 7, 2020

রোজ ডে

লাঞ্চের পর একটু কাজ থেকে বিরতি নেয় পাল্কি। এই সময়টাতে একটু টুকটাক সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ঘুরে আসে। বেশিরভাগ দিনই এইসময়ে ও বিভিন্ন গ্রুপে যে লেখালিখির চর্চা হয়, সেইসব পড়ে। তারপর আবার ফিরে আসে কাজের মধ্যে। আজকেও তার ব্যতিক্রম নেই। আজ সর্বত্রই অবশ্য লেখালিখিতে ভালোবাসার গল্প, প্রেমের উচ্ছ্বাস। ডেস্ক ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে খেয়াল পড়লো, ও, আজ তো সাত। ভালোবাসার সপ্তাহ শুরু। আপনমনেই হাল্কা হাসি হাসে পাল্কি। মনে পড়ে যায় ফেলে আসা একটা রোজ-ডের কথা।

তখন সবে ফার্স্ট ইয়ার। অদিতের সাথে আলাপ হয়ে গিয়েছে। এমনই এক রোজ-ডে'তে, এইট বি'তে অটোর লাইনে দুজনে দাঁড়িয়ে। ওরা তখন মেট্রো স্টেশন অবধি একসাথে যায়। তারপর পাল্কি ঢুকে যায় পাতালে, অদিত এগিয়ে যায় ওর কলেজ বাসের দিকে। সারাদিনে এইটুকুই ওদের দেখা। সেদিন রাস্তার ধারের ফুলের দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়। ছেলে মেয়েরা ভিড় করে কিনছে সেই লাল গোলাপ। দুজনেই হাল্কা হাসে এইসব দেখে। অদিত তো আবার আগ বাড়িয়ে বলে, "ভালোবাসার নামে কেমন কমারশিয়ালাইজ করে ফেললো সব কিছু, দেখ? ইমোশনও নাকি বিক্রি হচ্ছে!" অদিত এরকমই। নানান বিষয়ে ওর দৃঢ় মতামত। বিভিন্ন বই পড়ে। আলাপ আলোচনা করে। ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র হয়েও যে কীভাবে এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে জ্ঞান, পাল্কি মুগ্ধ হয়েই অদিতের কথা শোনে। ইচ্ছে থাকলেও, ব্যাগের ভিতরে রাখা সদ্য কেনা লাল গোলাপটা পাল্কি দিতে পারে না অদিতকে। সারাদিন কলেজে, আর তারপর সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পথেও পাল্কির চোখে পড়ে কপোত কপোতীদের ওপর। কী সুন্দর সব গোলাপ দিয়েছে একে অপরকে। সেজেগুজে গল্প খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। ওর মনে কষ্ট হয়, খুব। ব্যাগ থেকে গোলাপটা বের করে পাড়ায় ঢোকার আগে বড় ডাস্টবিনটাতে ফেলে দেয় গোলাপটা।  নিজেকে স্তোক দেয়, সবাই তো এক রকম হয় না। অদিতের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আর পাঁচজনের মতো হয়তো না, তবু পাল্কি জানে, অদিত ওকে ভালোবাসে, খুব। কিন্তু ওই যে, মন মানে না।  অনেকক্ষণ নিজেকে আটকে রাখলেও, ঠিক বারোটা বাজার একটু আগে, দিন ফুরানোর আগের মুহূর্তে ছোট্ট একটা এস এম এস করে অদিতকে। "হ্যাপি রোজ ডে। আমি জানি তুই এইসব মানিস না। কিন্তু... আমারও তোকে আজ গোলাপ দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। তাই কিনে রেখেছিলাম। দিতে সাহস পাইনি। কিন্তু উইশটা করে দিলাম..."  
পাল্কি অদিতের থেকে যে কোনরকম সাড়া পাবে, ভাবেনি। তাই পরেরদিন সকালে উঠে এস এম এস দেখে একটু অবাকই হয়েছিল। তাতে লেখা, "থ্যাঙ্ক ইউ।" এর যে কী মানে করবে ও, বোঝেনি। শুধু মনের ভিতরে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো, হয়তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে কিছু স্পেশাল আয়োজন করবে অদিত। উঁহু, করেনি। উল্টে কথায় কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে ওর কাছে সব দিনই সমান। আর এইভাবে অনুভূতি নিয়ে ব্যবসা, মোটেই সমরথন করেনা ও। 
সেদিন রাত্রে কেঁদেছিল পাল্কি। অনেকক্ষণ। বালিশে মাথা গুঁজে শরীর কেঁপে উঠেছিল ওর কান্নায়। নাইট ল্যাম্পের নীলাভ আলো, ঝমঝমে বৃষ্টি আর একটা রাতজাগা পাখী ছিলো তার সাক্ষী। তারপর পরেরদিন সকালে আবার নিজেকে সামলে নেয়। ওই যে,  হৃদয় ভারসাস মস্তিষ্কের লড়াইয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো পাল্কির মস্তিষ্ক জিতে যায়। আবারও। 

ফেসবুকের সংসারে এদিক ওদিক করতে গিয়েই অদিতের প্রোফাইলে পৌঁছে থমকে দাঁড়ায় পাল্কি। অদিত এখন বিবাহিত। বিদেশে কর্মরত। ঘোরতর সংসারী। যদিও নিজে এখনও তেমন ভাবে ওই পাব্লিক ডিস্প্লে অফ অ্যাফেকশন করেনা স্ত্রীর প্রতি, কিন্তু মেয়েটি খুব পোস্ট করে। প্রেমে মাখোমাখো ক্যাপশন সহ দুজনের হাসিখুশি মুহূর্তের ছবি। এ দেশ ও দেশ ঘুরে বেড়ানো, নানান কন্সার্ট, সিনেমার চেক-ইন। আজও যেমন মেয়েটি দিয়েছে। অদিতকে ডেডিকেট করেছে এক তোড়া লাল গোলাপে মোড়া ভালোবাসা। উপচে পড়ছে সেখানে শুভেচ্ছাবার্তা। অদিতও স্পষ্টতই গদগদ। প্রেম-ভালোবাসায় সংসারী অদিত।

সেই অতগুলো বছর আগের এইট বি বাস স্ট্যান্ডের ফেলে আসা অদিত হারিয়ে গিয়েছে কোথায় কে জানে। পাল্কি এদিক ওদিক খোঁজে। দেখতে পায় না অদিতকে। হয়তো সবাই এগিয়ে যায়। কিন্তু পাল্কি পারেনি। ও আজও পড়ে রয়েছে সেই একই জায়গায়। ব্যাগ হাতড়ালে আজও হয়তো খুঁজে পাবে সেই না দেওয়া লাল গোলাপটা। 
জানলার বাইরে চোখ মেলে পাল্কি। মেঘ করেছে। খুব। যে কোন মুহূর্তে বুঝি আকাশ ভেঙ্গে নামবে বৃষ্টি।  আজও। বা হয়তো মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠবে...

No comments:

Post a Comment