সম্পর্কের মূর্ছনা
সুচেতনা
রুকু যে গ্র্যান্ড পিয়ানোটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরে, ব্যাপারটা এড়ায়নি শাম্বর চোখে। কিন্তু ওই এইসব দেখার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করা এই মুহূর্তে সম্ভব না ওর। রুকু আর শাম্ব, সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি। মধুচন্দ্রিমায় এসেছে উত্তরবঙ্গের এক চা বাগানে। ম্যানেজার্স কোয়ার্টারকেই এখন সাজিয়ে গুছিয়ে বেশ হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, চড়া দামে। শাম্ব রুকুর মতো নবদম্পতিরা বেশ এখানে এসে নিরিবিলিতে সুন্দর পরিবেশে কটা দিন খুব আনন্দে কাটিয়ে ফিরে যায় নাগরিক সভ্যতায়।
প্রথম দিন এখানে এসেই রাজকীয় ব্যবস্থাপনা দেখে রুকুর চোখে মুখে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক খেলে যাচ্ছিল। শাম্ব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল স্ত্রীর এই খুশী। রুকু আর শাম্ব সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। শাম্বদের বাড়ি থেকে মোটে কয়েকটা বাড়ি পরেই রুকুর মামাবাড়ি। রুকু স্কুলবেলায় মা বাবা দুজনকেই হারানোর ফলে ঠাকুমা দাদুর কাছে মানুষ। তবে পুজোর ছুটি গ্রীষ্মের ছুটিতে মামাবাড়িতেই থাকতো। আর সেই সূত্রেই দুজনের আলাপ। বন্ধুত্ব। এবং বেশ খানিকটা বড় হওয়ার পর বোঝা যে একে অপরকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব। আর তারপরই দুজনের বিয়ে।
শাম্ব আর রুকু দুজনেই চাকরি করে। শাম্ব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। আর রুকু সরকারী কলেজে। বৌভাতের সকালে যখন ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান হয়, শাম্ব তখন বড়দের শিখিয়ে দেওয়া কথার সাথে নিজে থেকে যোগ করে বলে, "আজ থেকে তোর সমস্ত শখ আহ্লাদ পূরণের দায়িত্ব আমার।" রুকু ঘাড় কাত করে হেসেছিল। আসলে শাম্ব জানে, রুকুর ছোটবেলাটা সাদামাটা না হলেও, অসাধারণ ছিল না। ওর অনেক শখ আহ্লাদই আলমারির কোণায় কোণায় ধুলোয় চাপা পড়ে রয়েছে। ওর ইচ্ছে, একে একে ওর সব ইচ্ছেপূরণ ওই করবে। সাধ্য মতো।
রুকুর গানের গলা অসম্ভব ভালো। মিশনারি স্কুলে পিয়ানো বাজিয়ে গান শিখেছে। রীতিমতো স্টেজেও অনুষ্ঠান করেছে। কিন্তু পিয়ানো কেনার সামর্থ্য কখনো হয়ে ওঠেনি ওর। আর তাই এই ম্যানেজার্স কোয়ার্টারে এসে পিয়ানোটার প্রতি ছিল রুকুর আলাদা আকর্ষণ। প্রথমদিন থেকেই ওটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ও। ওদের থাকার তিনদিন, দুবেলা পিয়ানোতে বেশ খানিকটা সময় কাটাতো ওরা। রুকু বাজাতো, গান গাইতো। শাম্ব মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতো সাদা কালো কীয়ের ওপর দিয়ে রুকুর আঙুলের নৃত্য। আর শুনতো ওর মধুর কণ্ঠে গান। আজকেই শেষ এই ট্যুর। কাল সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়া। বাগডোগরা থেকে দুপুরের ফ্লাইটে বাড়ি ফেরা, পরিচিত ছন্দে। আর কাল থেকে এই পিয়ানোটার কাছে বসা হবে না। রুকু যেন আজ একটু বেশিই আঁকড়ে ছিল গ্র্যান্ড পিয়ানোটাকে। আর নিজের অক্ষমতা ভেবে ভেবে মরমে মরে যাচ্ছিল শাম্ব। কিছু একটা করতেই হবে ওকে।
পরেরদিন যথাসময়ে প্লেন ধরে কলকাতা পৌঁছলো ওরা। প্রিপেড ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি। ট্যাক্সিতে এক দুবার কাউকে ফোনে বাড়ির নির্দেশ দিচ্ছিল শাম্ব। রুকুর কানে ইয়ারফোন। ও খেয়াল করেনি। বাড়ি ফিরে শাম্ব ঢুকে পড়ল বাথরুমে। ফ্রেশ হতে। রুকুও পোশাক বদলাবে বলে আলমারি খুলছে, এমন সময় ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা বেজে ওঠে। কে এলো, একটু অবাক হয়। দরজা খুলে দেখে একজন ফুড ডেলিভারি এজেন্ট। হাসিমুখে বলে, "আপনি মিসেস রুক্মিণী তো? আপনার জন্য ডেলিভারি আছে।" রুকু অবাক। ও বলে, "কিন্তু, কিন্তু আমি তো কিছু অর্ডার করিনি।" আর তখনই পাশ থেকে শুনতে পায় শাম্বর কন্ঠ। "আমি অর্ডার করেছি। নিয়ে নাও।" "থ্যাংক ইউ ভাই" বলে ছেলেটিকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢোকে শাম্ব। রুকু টেবিলে কেকের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাক। শাম্ব বলে, "খুলেই দেখ।" রুকু সেলোটেপ কাটে বাক্সের। ঢাকনা খুলে দেখে একটা চকোলেট কেক। ম্যানেজার্স কোয়ার্টারের পিয়ানোটার আদলে। শাম্বর দিকে তাকায়, বিহ্বল হয়ে। শাম্ব গাঢ় স্বরে বলে, "হ্যাপি চকোলেট ডে রুকু। আপাতত ওটা দিয়ে কাজ চালা। আই প্রমিস, টেন্ট এনিভার্সারিতে আসলটা তোকে দেবই।" রুকুর দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে খুশির অশ্রু। শাম্বরও মন তৃপ্তিতে ভরপুর। এইসব ব্যবস্থা করা চারটি খানি কথা ছিল না। সব যে ভালোয় ভালোয় মিটেছে, এইটাই প্রাপ্তি।
No comments:
Post a Comment