Wednesday, February 12, 2020
আলিঙ্গন
(১)
ফেব্রুয়ারির কলকাতা। ঠান্ডাটা এখনো যাবো যাবো করেও যায়নি। জলসা পার্টির জন্য সবচেয়ে যথাযথ সময়। রুমিদের ছাদের গানের আসর তাই জমে গিয়েছে। রুমির দাদা ও তার বন্ধুরা, রুমি ও তার বন্ধুরা, সব্বাই হাজির। গান গল্প আর কাবাব সহকারে শীতের রাত জমে যায়, প্রতি বছর। এতক্ষণ রুমিদের "ব্যান্ড"এর গান হলো। বেশিরভাগই হালফিলের বলিউড আর হলিউড। এখন টুকরো বিরতি। বিরতির অবসরেই পিকলু রুমিকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে গেল ছাদের একটা নিরিবিলি কোণে। পিকলু, রুমির দাদা সুবুর বেস্ট ফ্রেন্ড। আবার কলেজ হোস্টেলের একদা রুমমেটও। এখন একই অফিসে চাকরিও করে। রুমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় পিকলুর দিকে। পিকলু বলে, "গানের গলা তোর এত ভালো। এত স্পষ্ট বাংলা ইংরেজি হিন্দি উচ্চারণ। এদিকে গেয়ে বেড়াস যত হাবিজাবি গান। কেন রে?" রুমি পাল্টা প্রশ্ন করে, "কেন, ভালো হয়নি?" পিকলু জবাব দেয়, "তা না। কিন্তু নিজের গুণকে মর্যাদা দিতে পারিস না এইভাবে।" রুমি কিছু বলে না। হাতের কফি কাপটা নামিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে দেয়ালে হেলান দিয়ে। রাতের কলকাতার ঝিকমিক আলো। মায়াবী। টের পায়, পাশে পিকলুও দাঁড়িয়ে আছে। তবে পিকলুর দৃষ্টি ওরই দিকে স্থির। ওর দিকে না ফিরেই রুমি বলে, "কিছু বলবে?" পিকলু চুপ থাকে। তারপর প্রায় মিনিট দুই পর রুমিকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই বন্ধনে রয়েছে অনেকটা আশ্বাস। ভরসা। ভালোবাসা। গাঢ় কণ্ঠে বলে, "পাগলী, ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি তো যাচ্ছি এই মোটে দু বছরের জন্য। ফিরে তো আসবই। ফিরতে তো আমাকে হবেই। আমার এই পাগলীটা রয়ে গেলো যে এখানে।"
নাঃ। রুমি উত্তরে কিচ্ছু বলতে পারে না। শুধু আরো খানিকক্ষণ পিকলুর শরীরের ওমটুকু শুষে নেয়। তারপর কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় স্টেজের দিকে। গিটার হাতে উঠে গাইতে থাকে, মঞ্চে প্রথমবার, রেট্রো গান। রুমির এ যাবৎ সেরা উপস্থাপনা।
"Paas aiye ki ham nahin
Ayenge baar baar
Bahen gale mein daal ke
Ham ro le zaar-zaar
Ankhoon se phir ye
Pyaar ki barsaat ho na ho
Shayad phir is janam mein
Mulakat ho na ho"
(২)
সারা রাত বীভৎস কেটেছে ওদের। ওদের, মানে, রুমি আর পিকলুর। সাত মাসের মেয়ে পুপুলের সারা রাত জ্বর আর তার জেরে বেচারি একটুও ঘুমোতেই পারেনি। কান্নাকাটি করেই চলেছে। নতুন বাবা মাও তাই দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি এক মুহূর্তও। ভোরের দিকে তাও পুপুল শান্ত হয়ে একটু ঘুমোলে, রুমি ল্যাপটপ খুলে নিজের কাজ নিয়ে বসতে পেরেছে। ইন্টারন্যাশনাল অফিসে আজ ওর খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন, বড়সড় ক্লায়েন্টের জন্য। এটায় ভালো করে ওকে আজ কাজ দেখাতেই হবে। কেরিয়ারের উন্নতি অনেকটাই নির্ভর করে আছে আজকের প্রেজেন্টেশনের ওপর। তার ওপর আবার ছয় মাস ম্যাটারনিটি লীভের পর এটাই বড় মঞ্চ, নিজেকে আবার লাইমলাইটে অ্যানার জন্য। সব মিলিয়ে রুমির জন্য আজকের এই দিন একেবারে "ডু অর ডাই"। এমনই দিনে মেয়ের জন্য সারা রাত জেগে থাকতে হলো। মাঝে মধ্যে যে ও কাজের চেষ্টা করছিল না, তা নয়। পিকলু বরং ওকে বারবার বলছিলও, ওই সামলে নেবে। রুমি যেন কাজে মন দেয়। কিন্তু পুপুল যে এতদিন মায়ের সান্নিধ্যেই অভ্যস্ত। পিকলু সবে দশদিন হলো অফিসের কাজ থেকে বাড়ি ফিরেছে। তাই এখনও মেয়ের সাথে তেমন করে সখ্যতা গজিয়ে ওঠেনি।
আটটার দিকে রুমি ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে পড়লো অফিসের জন্য তৈরি হতে। পিকলুও অন্য ঘরে নিজের অফিসের জন্য তৈরি হতে গিয়েছে। দুজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়বে কাজে। দুজনের অফিস দুই প্রান্তে। দুটো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবে দুজন। পুপুল থাকবে ন্যানির কাছে। আজ এর মধ্যেই মেয়ের ন্যানি এসে গিয়েছে। ওকে ওষুধপত্র ঠিকমতো বুঝিয়ে দিয়েছে রুমি। কিছুটা নিশ্চিন্ত। তবুও, মায়ের মন, মেয়েকে ফেলে যেতে মন কেমন করছিল। বেরোতে গিয়ে বারবার ব্যাগ ফেলে এলাম, চাবি ফেলে এলাম, এরকম নানান ছুতো করে পুপুলের কাছে ফিরে যাচ্ছিল রুমি। পিকলু খেয়াল করেছে সেটা। চতুর্থবার যখন রুমি "এই যাহ্, জল খেয়ে এলাম না" বলে আবার ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকতে এগোচ্ছে, পিকলু ওকে দু হাত দিয়ে থামিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে বলল, " শোন, এত প্যানিক করিস না তো। শি উইল বি ফাইন। অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। তুই প্রেজেন্টেশনে কন্সেন্ট্রেট কর। পুপুলের কাছে তো সীতা রইলোই।" রুমি ধরা গলায় উত্তর দেয়, "মেয়েটাকে জ্বরের মধ্যে ফেলে রেখে যেতে খুব গিলটি ফিলিং হচ্ছে রে।" পিকলু শক্ত করে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে বলে, "সে তো বুঝছি। কিন্তু শোন, তোকে আজ যে অফিস জেতেই হবে। নইলে কিন্তু বড় হয়ে তোর মেয়ে যদি শোনে যে অর কথা ভেবে তুই এমন চান্স মিস করছিস, শি উইল নেভার ফরগিভ ইউ। কাজেই বলি কী? আমি না হয় আজ ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়ে নিই। তুই নিশ্চিন্তে অফিস যা। ওকে?" রুমি শান্ত হয়ে আকড়ে থাকে পিকলুকে। মুহূর্ত থমকে যায়। এইগুলোই তো প্রাপ্তি, এইটুকুই তো চাওয়া-পাওয়া।
পরিস্থিতিগুলো পাল্টে যায়। কিন্তু পাত্র পাত্রী আর আলিঙ্গন, আর তার সাথে লেগে থাকা ভরসাগুলো এক রয়ে যায়। ফোর এভার।
"Hum ko mili hai aaj
Ye ghadiya naseeb se
Je bhar ke dekh leejiye
Hamako kareeb se"
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment