Saturday, February 8, 2020

বইমেলা, উৎসর্গ, ইত্যাদি

শহরে বইমেলা চলছে। কিন্তু ঋজুর এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলে কথা। হুট হাট তো আর উইকডেগুলোয় বেরিয়ে পড়া যায় না। গত উইকেন্ডটা কেটেছে মেলবোর্নে, কনফারেন্সে। হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে, আগামী এক দু মাসের মধ্যেই মেলবোর্ন চলে যাবে ঋজু, আপাতত বেশ কিছু বছরের জন্য। কলকাতার পাট চুকিয়ে। আর তাই কলকাতা বইমেলায় আর ফেরা হয়তো হবেনা। সেই জন্যই এই উইকেন্ডে যে কোনোভাবেই হোক, ঋজুকে বইমেলায় যেতেই হবে। অন্তত একবার। হ্যাঁ, ঋজু বইয়ের পোকা বলাই যায়। সেই স্কুলবেলা থেকেই লেখাপড়া কাজের বইপত্রের সাথে সাথে গল্পের বই সব সময় ব্যাগে থাকেই থাকে। এখনও প্রতিদিন রাত্তিরে শোয়ার আগে অন্তত তিরিশ চল্লিশ পাতা না পড়লে ঘুম হয়না ওর। এমন নয় যে বইমেলা ছাড়া কেনা হয়না। কিন্তু তাও, কলকাতা বইমেলার সাথে একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়া কাজ করে ঋজুর। বাবার হাত ধরে ময়দানের বইমেলা হয়ে প্রেমিকাদের সাথে মিলনমেলা প্রাঙ্গন। ঋজু চায় বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা নিজের দুই সন্তানের মধ্যেও সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে। আর তাই আজ বইমেলা যেতেই হবে তাতান ও তিতিরকে নিয়ে। 

ঝটপট এগারোটার মধ্যে ব্রাঞ্চ সেরে ওলা চেপে ছেলে মেয়েকে নিয়ে মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে যায় ঋজু। বারোটা বাজতে দশ মিনিট। গেটের বাইরে লম্বা লাইন। এখনো যে বইপ্রেমী মানুষের এত ভিড়, দেখেও ভালো লাগে ঋজুর। একটা সময় যখন কলেজে পড়তো, বইমেলার লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে কত সময় কাটাতো। সেকেন্ড আর থার্ড ইয়ারে তো নিজেদের ম্যাগাজিনও বের করেছিল। কত কাঠখড় পুড়িয়ে। পালা করে নিজেদের টেবিলে বসে থাকতো ঋজু মল্লিকা শামসুর অনিতা মালঞ্চ আর শালুক। শালুক। নামটা মনে করলেই এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে যায় ঋজুর। যেমন মিষ্টি নাম, তেমনি মিষ্টি স্বভাবের ছিল মেয়েটি। প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। কলকাতায় এসেছিল মেধার জোরে। ওদের সাথে আলাপ এই লেখালিখি ম্যাগাজিনের সূত্রেই। বাংলা বিভাগের রত্ন ছিল শালুক। 

মেলা খুলতেই ঋজু ছেলে মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলে প্রিয় সব স্টলে। খুঁজে খুঁজে ছোটবেলার প্রিয় বইগুলি কিনে দেয় তাতান তিতিরকে। ওরাও রঙ বেরঙের এইসব বই পেয়ে খুশি। কমিক্সই বেশি কিনেছে ঋজু ওদের জন্য। অন্তত আকর্ষক ছবির সূত্র ধরে অন্তত বইয়ের অভ্যেসটা শুরু হোক ওদের। তারপর না হয় অন্য বই কিনবে। এরকমই ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এসে পৌঁছলো ও লিটিল ম্যাগাজিনের টেবিলগুলিতে। পসরা সাজিয়ে সেখানে বসে আছেন অনেকেই। ক্রেতার ভিড় একটু কম। ঋজু ঠিক করলো সময় নিয়ে প্রতিটি টেবিলে যাবে, উল্টে পাল্টে দেখবে বই। পছন্দ হলে কিনবে। এগোতে থাকে ও। বই হাতে নেয়। অনুভব করার চেষ্টা করে একেকটি বইয়ের পিছনে এতগুলো মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমকে। কন্টেন্ট পছন্দ হলে কিনে ফেলে। ইতিমধ্যেই বইয়ের প্যাকেটে দুই হাত ভরে গিয়েছে ঋজুর। ছেলেমেয়েদের হাতেও কিছু প্যাকেট। তবু, এই ভার বয়ায় আনন্দ অপরিসীম। ঘুরতে ঘুরতে একটা টেবিলে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে একটু থমকে দাঁড়ায় ঋজু। "আমাদের সেইদিন"। লেখিকা শালুক গোস্বামী। আরে, এ যে ওদের শালুক। বইয়ের পিছনে লেখক পরিচিতি পড়ে ঋজু। শালুক এখন লন্ডনে বাংলা পড়ায়। পেশা অধ্যাপনা হলেও নেশা সাহিত্য। বাঃ, ওদের মধ্যে তাহলে একমাত্র শালুকই কথা রাখলো। নিজের বই বের করতে পারলো। মন ভালো হয় ঋজুর। এইবারে সামনের পাতা খোলে। উৎসর্গ পড়ে স্তম্ভিত হয়।
লেখা আছে "ঋজুদাকে। জানি, তুমি ঠিক একদিন এই বই পড়বেই। আমার মন বলছে। তুমি বলতে, 'শালুক, বই বের করতেই হবে তোকে। তোর মধ্যে লেখাটা আছে।' আমি হাসতাম। বলতাম, 'কে পড়বে আমার লেখা?' তুমি বলতে 'আর কেউ পড়ুক না পড়ুক, আমি পড়বই।' আমি বলতাম, 'সে তো তুমি পাণ্ডুলিপি পড়বেই। তুমিই আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি পড়বে। কী, পড়বে তো?' তুমি হাসতে। হ্যাঁ না বলতে না কিছু। আমি পাগলী। ধরেই নিতাম, মৌনতা মানেই সম্মতি। কিন্তু বুঝিনি যে শালুক ফুল ফোটে কেবল পুকুরে। নদী পাহাড় জঙ্গলে তার স্থান নেই। ঋজুদা, জানো তো, আমি এখন থাকি একটা ব্যস্ত শহরে। ভিড়। লোক। ট্র্যাফিক। হট্টগোল। আমার অনেক স্টুডেন্ট। অনেক পরিচিত। বন্ধুবান্ধব। কিন্তু তবুও, কোথায় যেন বড্ড একা। দেখো না, একদিন তোমার এই শালুকফুলকে যদি একটু সময় দাও? দেবে? আমি অপেক্ষায় থাকবো। আমি জানি, তুমি এই লেখা পড়বেই পড়বে। কী করে জানলাম? ওই যে, আমাদের প্রিয়গান, 'তেরা মুঝসে হ্যায় পেহলে কা নাতা কই...' কোনো এক জন্মে আমরা নিশ্চয়ই এক ছিলাম বা হবো। দেখো... এইবারে না। এই জন্মে অন্তত এই উৎসর্গটা স্বীকার করো। ভালো লাগবে আমার। 
ভালো থেকো ঋজুদা।"

ঋজু কোনো কথা বলতে পারে না। দু চোখের কোণে জল চিকচিক করে। কোনোমতে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে বইটা ব্যাগে ভরে হনহন করে এগিয়ে যায় মেলার গেটের দিকে। তাতান তিতির অবাক। নানান কথা জিজ্ঞেস করে, আবদার করে আরেকটু ঘুরতে। ঋজু কিছু বলে না। এগিয়ে চলে। ওর যে আজ তাড়া আছে। খুব তাড়া। এ বই ওকে পড়তেই হবে। এক্ষুণি। 

No comments:

Post a Comment