গ্রিনিচ ভিলেজ। শহরের এই অঞ্চলটা ওয়াশিংটন স্কোয়ারের খানিক পশ্চিমে অবস্থিত। পথঘাট বেশ আঁকা বাঁকা। এই স্থানটি চিত্রশিল্পীদের খুবই প্রিয়। এখানকার পরিবেশ, আলো বাতাস, সবই বেশ প্রশস্ত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে ঘরভাড়া নিতান্তই কম। তাই সবদিক দিয়েই, এই গ্রিনিচ ভিলেজ যেন চিত্রশিল্পীদের স্বর্গ।
সু আর জন্সি, দুই বান্ধবী, দুজনেই শিল্পী। গ্রিনিচে এমনই এক তিনতলা বাড়ির সবচেয়ে ওপরতলায় ওরা থাকে। ওদের বন্ধুত্ব অবশ্য এই গ্রিনিচে এসেই। এমনিতে একজনের বাড়ি মেইনে, অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী। বসন্তের এক মনোরম দিনে এইট্থ স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় ওদের দুজনের পরিচয়। আর অল্পক্ষণেই দুজনেই দেখলো দুজনের পছন্দ অপছন্দ অনেকাংশেই মিলে যাচ্ছে। আর তাই ওরা বিশেষ দেরি না করে একসাথে এই বাড়িটিতে থাকা স্থির করলো।
গ্রিনিচ ভিলেজে দিন কেটে যায় আপনমনে। গ্রীষ্ম বর্ষা চলে গিয়ে আসে শীত। সাথে আনে এক নতুন অতিথিকে, নাম তার "নিউমোনিয়া"। এই অতিথি সারা শহরে তার হিমশীতল আঙুলের স্পর্শে একে একে বহু মানুষকে করছে কুপোকাত। শহরের ডাক্তাররা মোটেই খুশি নন একে নিয়ে। যদিও শহরের পূর্বদিকে এর অবাধ গতি, তবু পশ্চিমে, গ্রিনিচের দিকে এই নব্য অতিথি একটু ধীর লয়েই ঘুরছে বটে। অবশ্য তা হলেও, এই অতিথিকে মোটেই সাধুপুরুষ বলা চলে না। বলবোই বা কী করে? কোন ভদ্র ভালো মানুষ কখনও কোন যুবতীকে ব্যতিব্যস্ত করে? এই যে, এই আমাদের অতিথি, তার জ্বালাতনে আমাদের ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী জন্সি ব্যতিব্যস্ত। সে ঠিক নিজের দুষ্ট ঠাণ্ডা আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়েই দিলো মেয়েটিকে। বেচারি জন্সি। বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারে না। পারে না চলতে। সারাদিন শুয়ে থাকে খাটে, জানলার ধারে। আর চেয়ে দেখতে থাকে জানলার বাইরে। এক মনে।
এরই মধ্যে একদিন, জন্সির চিকিৎসক, বেশ চিন্তান্বিত হয়েই সু'কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, তোমার বন্ধুর ব্যাপারটা কী বলো তো? ওর কি বাঁচবার এতটুকুও ইচ্ছে নেই?" সু কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না। অনেক কষ্টে বলে, "কেন ডাক্তারবাবু? কী হয়েছে? জন্সির কতদিনের শখ, ইতালি যাবে। সেখানে গিয়ে বে অফ নেপলসের ছবি আঁকবে।" ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন, "উঁহু। দেখো, যে রুগী নিজেই বাঁচতে চায় না, আমি হাজার চেষ্টা করলেও তাকে বাঁচাতে পারবো না। বাঁচবার জন্য ইচ্ছেশক্তি রোগীর নিজের ভিতর থেকে আসতে হবে। বুঝলে? আর সেইটা কিন্তু আমি তোমার বন্ধুর মধ্যে এতটুকুও পাচ্ছি না। খুবই চিন্তার বিষয়।" সু অবাক হয়। কী হলো জন্সির, এরকম আচরণ কেন? কীসের কষ্ট ওর? তবে কি এটা কোন হৃদয়ঘটিত ব্যাপার? কই, ও তো কিছু জানে না। না না, এ হতেই পারে না। ডাক্তার বলেন, "দেখো, জন্সির শরীর অত্যন্ত দুর্বল। আমি আমার দিক থেকে সব রকম চেষ্টা তো করছিই। করবোও। কিন্তু রুগী যদি নিজেই তার বাঁচবার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে, তাহলে ডাক্তার হিসেবে আমার বিশেষ কিছু আর করার ক্ষমতা থাকে না। দেখো, ওর সাথে গল্প করো। কথা বলে দেখো, ওর কী সমস্যা। আগামীদিনের কথা বলো, নানান পরিকল্পনা করো। শোনো ও কী বলছে। ভবিষ্যতের কথা বললে যদি ও প্রাণশক্তি ফেরত পায়। দেখো।"
ডাক্তারের মুখে বান্ধবীর শরীরের এই অবস্থার কথা শুনে সু মনের দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে। পাশের ঘরে বসে নিভৃতে খানিক চোখের জল ফেলে। তারপর মনে পড়ে যায় নিজের দায়িত্ব। নাহ, বন্ধুকে বাঁচাতেই হবে। ওকে ভালো রাখতেই হবে। তাই চোখ মুছে হাসিমুখে, প্রিয় গান গুনগুন করতে করতে রঙ তুলি ক্যানভাস নিয়ে পৌঁছে যায় জন্সির ঘরে। গিয়ে দেখে সেই একই পরিচিত দৃশ্য। জানলার দিকে পাশ ফিরে চুপ করে শুয়ে আছে জন্সি। রোগে জীর্ণ ক্লান্ত জন্সি। ও ঘুমোচ্ছে, পাছে ওর গানের শব্দে ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয়, এই ভেবে সু গান থামিয়ে দেয়। তারপর আঁকা নিয়ে বসে।
কাজ করতে করতে সু'র কানে একটি মৃদু শব্দ আসতে থাকে। মিনমিনে রিনরিনে স্বরে যেন কোন কথা বলছে। ও আঁকা ফেলে উঠে যায় জন্সির খাটের পাশে। গিয়ে দেখে, বন্ধুটি জেগে শুয়ে আছে। আর আপন মনে বাইরে তাকিয়ে কী যেন গুনে চলেছে। এবং যে সংখ্যাগুলো বিরবির করছে, তার গুনতি উল্টো। বারো। খানিক থেমে আবারএগারো, দশ। মুহূর্তেই এরপর নয়, আট, সাত... শেষের সংখ্যাগুলো যেন হুড়মুড়িয়ে একের পর এক এসে গেলো।
সু অবাক হয়। জন্সি কী গুনছে? কীই বা আছে গোনার? কৌতূহলী সু জানলার বাইরে তাকায়। চোখে পড়ে পাশের বাড়ির ন্যাড়া দেওয়াল। সেই দেওয়ালের গা বেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লতানে গাছটিতেও শীতের স্পর্শ দৃশ্যমান। ইতিমধ্যেই শীতল হাওয়ায় পাতাঝরা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালের সাথে তাল মিলিয়ে সেও যেন ন্যাড়া হওয়ার জন্যই পথ চেয়ে আছে, অপেক্ষায়।
"কী হলো জন্সি?" সু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
জন্সি দুর্বল কন্ঠে উত্তর দেয়, "ছয়... ওই দেখো সু, তিনদিন আগেও ওখানে শয়ে শয়ে ছিলো। তখন গুনতে গুনতে আমার মাথা ব্যথা করতো সু। আর এখন দেখো, সব শেষ। প্রায় সব শেষ। ওই, ওই। ওই যে। আরো একটা। পাঁচ। ওই দেখো। আরো তাড়াতাড়ি যেন কমে যাচ্ছে এখন।"
বন্ধুর এই হাহাকার কিছুই বোধগম্য হয়না সু'র। অবাক হয়েই প্রশ্ন করে, "কী গুনছ জন্সি? কী? পাঁচটা কী?"
কাঁপা কাঁপা স্বরে জন্সি বলে, "পাতা। ওই যে, সামনের গাছটা দেখছো, ওই যে। ওই গাছের পাতাগুলো ঝরতে ঝরতে এখন মোটে পাঁচে এসে ঠেকেছে। যেদিন শেষ পাতাটি ঝরে যাবে সু, সেদিনই, সেদিনই জেনো, আমিও মরে যাবো। ডাক্তার বলেনি তোমায়?"
সু'র ভিতরটা দুঃখে কেঁপে ওঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে পরম মমতাভরে জন্সির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, "ওসব যত বাজে কথা। ওরকম হয় নাকি জন্সি? তুমি ভুল জানো। তাছাড়া তুমি ওই গাছটাকে কত ভালোবাসো বলো তো? ওর সাথে তোমার আয়ু মোটেই জড়িত না। হতেই পারে না। তাছাড়া, সবচেয়ে বড় কথা। এই তো, একটু আগেই আমার ডাক্তারের সাথে কথা হলো। উনি বলেছেন। তোমার শরীর এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। উন্নতি হচ্ছে স্বাস্থ্যের। দেখো, দুর্বলতা তো এখনো রয়েছে। সেটা কাটালেই ব্যস, তুমি পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে। নাও, এখন কিছু খাও দেখি। চাঙ্গা হতে হবে তো? তুমি খেয়ে নাও। তুমি খেয়ে নিলে আমি কাজ নিয়ে বসবো। আঁকা বাকি বেশ কিছু। দেখি, আঁকাগুলো বিক্রি করে তোমার জন্য কী কিনতে পারি।"
জন্সি অবুঝ বালিকার মতো উত্তর দেয়, "না সু। আমি কিচ্ছু খাবো না। আমার জন্য তোমায় কিছু কিনতেও হবে না। দেখো, ওই যে। আরো একটা পাতা ঝরে গেলো। আমি জানি। পরপর সব পাতা ঝরে যাবে। আজ রাতের মধ্যেই সব পাতা ঝরে গাছটা একদম ন্যাড়া হয়ে যাবে। আর কী, সব শেষ। আমিও চলে যাবো। আমারও আয়ু ফুরাবে।"
বন্ধুর এমন ব্যবহারে সু বিহ্বল হয়। কী বলবে ও? কীভাবে শান্ত করবে জন্সিকে? শেষ চেষ্টা করে। কাতরস্বরে বলে, "জন্সি, তুমি এখন একটু শুয়ে থাকো। চোখ বন্ধ করে থাকো। আর বাইরে তাকিয়ো না। দেখো, আমায় আজ রাতের মধ্যে এই কাজটা শেষ করতেই হবে। আলো লাগবে। তাই আর জানলাটা বন্ধ করতে পারছি না। কিন্তু তুমি বাইরে তাকিয়ো না। জন্সি, দোহাই তোমার, একটু ঘুমাও।"
জন্সি জিজ্ঞেস করে, "পাশের ঘরে গিয়ে কাজ করা যায় না?"
সু মাথা নাড়ে। বলে, "না জন্সি। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। আমি চাই না তুমি ওই পাতাগুলোর দিকে তাকাও।"
রোগে ক্লিষ্ট জন্সি অবোধ শিশুর মতোই অবুঝ। বলে, "ঠিক আছে। আমি চোখ বন্ধ করে থাকছি। কিন্তু তুমি কথা দাও। কাজ শেষ করেই আমায় বলবে। আমি বাইরে তাকিয়ে থাকতে চাই। দেখতে চাই পাতাগুলো কীভাবে ঝরে পড়ে। আমার প্রাণও যে ওর সাথে জড়িয়ে আছে। ওই যে, ওই শেষ পাতাটার সাথেই দুলে দুলে পরম আনন্দে আমিও চলে যেতে চাই।"
"জন্সি, তুমি কথা বলো না। দোহাই। আমি আমার আঁকাটা শেষ করি। আজকের মধ্যে এটা করতেই হবে। আঁকায় একটি পুরুষ চরিত্র থাকবে। দেখি, তাকে মিস্টার বারম্যানের মতোই দেখতে আঁকবো। ওঁকে ডেকে আনি। আমি এই যাবো আর এই আসবো। তুমি কথা দাও, জন্সি, নড়াচড়া করবে না এর মধ্যে। কথা দাও ঘুমোবে?"
বারম্যান ওদেরই বিল্ডিঙে থাকেন, ষাটোর্দ্ধ চিত্রশিল্পী। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ওপর উনি ছবি আঁকছেন। মনে সাধ, একদিন কোন দুর্দান্ত ছবি এঁকে বিশ্ববিখ্যাত হবেন। অবশ্য তাঁর আঁকার বিশেষ কদর শিল্পমহলে নেই। টাকার জন্য তাই মাঝেমাঝেই অন্য শিল্পীদের হয়ে মডেলের কাজও করে দেন। যা রোজগার, বেশিরভাগই উড়িয়ে দেন মদের নেশায়। তবুও এত কিছুর মধ্যেও সু আর জন্সির খোঁজখবর নেওয়া, ওদের সাহায্য করাটাকে নিজের পরম কর্তব্য বলেই মনে করেন বারম্যান।
বারম্যানের ঘরে পৌঁছে সু দেখলো, ঘর অন্ধকার। উনি চুপ করে বসে আছেন। ঘরভর্তি মদের গন্ধ। নির্ঘাত নেশা করে আছেন। সু এরই মধ্যে মনের দুঃখে জন্সির অসুখ, দেওয়ালের ধারের শুকনো গাছটার ঝরাপাতা, তার সাথে জন্সির নিজের আয়ুকে জুড়ে নেওয়ার কথা সব বলে ভেঙে পড়ে, "আমি আর পারছি না। কোনদিক যে সামলাই? আঁকাটাও শেষ করতে হবে। আপনি আসবেন মিস্টার বারম্যান? আমার মডেল হয়ে যান দয়া করে।" সব শুনে মিস্টার বারম্যান রাগে ফেটে পড়লেন। চেঁচিয়ে বললেন, "এমন অলুক্ষুণে কথা কে বলে? কে ঢোকাচ্ছে এইসব আবোল তাবোল কথা জন্সির মাথায়? মেয়েটা মরতে বসেছে আর তুমি আমায় বলছো বসে বসে এখন মডেল সেজে বসে থাকতে? যাবো না আমি। এ হয় না।" সু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, "দোহাই মিস্টার বারম্যান। এরকম বলবেন না। জন্সি দুর্বল। এই দুর্বল চিত্তে ওর মাথায় যত উদ্ভত খেয়াল হচ্ছে। এরই মধ্যে আপনিও সাহায্য না করলে আমি তবে কোথায় যাই?"
মিস্টার বারম্যান এবার শান্ত হয়ে বললেন, "দেখো সু। আমি আসছি। আমি কোথায় বললাম আমি যাবো না। শুধু জন্সি বেচারির জন্য মন কেমন করছে। ওইটুকু একটা মেয়ে, এমন অসুখে ভুগবে কেন? এখানে থাকাই উচিত না তোমাদের। আমাদের। দেখো, আমি একদিন একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু ছবি আঁকবোই। বিখ্যাত হবোই। অনেক খ্যাতি হবে। হবে যশ। আর সেদিন তোমাদের নিয়ে আমি এই বাজে জায়গা থেকে চলে যাবো। অনেক দূরে। দেখো। নাও চলো দেখি, আঁকার জোগাড় করো। আমি আসছি।"
এরপর আর কোন কথা হয় না। দুজনে চুপচাপ নেমে আসে নীচে। জন্সির ঘরে। জন্সি তখন রোগক্লিষ্ট ঘুমে আচ্ছন্ন। পর্দা সরিয়ে জানলা ভেজিয়ে পাশের ঘরে আসে সু আর মিস্টার বারম্যান। সেই ঘরের জানলা দিয়ে দুজনে একবার বাইরে তাকায়। প্রবল ঝড় বইছে, সাথে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝে নরম বরফকুচি ঝরে পড়ছে। পাতাঝরা লতানে গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখে দুজনে, একদৃষ্টে। কোন কথা বেরোয়না ওদের মুখ দিয়ে। তারপর চুপচাপ জায়গায় ফিরে আঁকা শুরু করে সু। প্রায় সারা রাত জেগে কাজটা শেষ করেছে ও। ভোরের দিকে ঘন্টাখানেকের জন্য একটু ঘুমিয়েও পড়েছিল সু। এইবার উঠে পাশের ঘরে যায়, ধীরপায়ে। দেখে, জন্সি জেগে শুয়ে আছে। ব্যাকুল দৃষ্টিতে জানলার পর্দার দিকে চেয়ে। সু'কে দেখে বলে, "পর্দাটা সরিয়ে দাও। আমি দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই আমার গাছটাকে। দেখি, পাতাগুলো কেমন আছে।"
সু আস্তে আস্তে জানলা থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেয়। চোখ যায় ন্যাড়া দেওয়ালের গায়ে লতানে গাছটার দিকে। সারা রাত ঝড় বৃষ্টি চলেছে। তবুও, শেষ একটা পাতা এখনও টিকে আছে। শুকনো খয়েরি ডালের ভিতর থেকে। একটা সবুজ পাতা। ধারগুলো অবশ্য ইতিমধ্যেই হলুদ হতে শুরু করেছে। তবুও, একা লড়ে যাচ্ছে, প্রবলভাবে। একটা শেষ সবুজ পাতা। জন্সি দেখে অবাক হয়, বলে, "সারা রাত যা বৃষ্টি হলো, হাওয়া দিলো, আমি ভেবেছিলাম বুঝি... না। আজ আর পারবে না ও। আজ ও ঝরে পড়বেই। আর সাথে আমিও। দেখো সু।" সু ভেবে পায় না কী বলবে এর উত্তরে। যে কিনা নিজেই বাঁচবার শেষ ইচ্ছেটুকু বিসর্জন দিয়েছে, চলে যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছে, তাকে কীই বা বলে আটকানো যায়? সু অপারগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে বন্ধুকে। অপলকে। ইচ্ছে করে বন্ধুত্বের দোহাই দেবে। কিন্তু জানে, তাতেও কাজ হবে না। যে জীবন থেকে সব মোহ ক্রমশ সরিয়ে ফেলছে, সেখানে বন্ধুত্বের দোহাই বা টিকবে কেন?
দিন কেটে যায়। রাত্রে আবার ঝড় ওঠে। বৃষ্টি। ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। তারই মধ্যে ওরা দেখতে পায়, সেই শেষ সবুজ পাতাটা এখনও টিকে আছে। লড়ছে, প্রবল বিক্রমে, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। একা। বীরদর্পে।
পরদিন সকালে আবার জন্সির আব্দারে জানলার পর্দা সরে যায় ঘরের। দুই বন্ধু দেখে অবাক হয়ে, সেই গতকালের শেষ সবুজ পাতাটা এখনও টিকে গেছে। খানিকক্ষণ সেদিকে দেখে এরপর সু চলে যায় রান্না করতে। জন্সির জন্য পথ্য রান্না করবে ও। জন্সি খানিক তাকিয়ে থাকে বাইরে, তারপর বন্ধুকে বলে, "সু, আমি অনেক ভাবলাম। এই যে পাতাটা টিকে গেলো, কেন জানো? কারণ ও কিছু বলতে চায় আমায়। আমায় বোঝাতে চায় যে এত সহজে হার মানলে চলবে না। আমায় লড়াই করতে হবে। আমি এ কদিন বড় ভুল করেছি, আর এমন করবো না। আমায় বাঁচতে হবে। নতুন উদ্যম নিয়ে। আগে দেখি, একটু আমায় আয়নাটা এনে দাও দেখি। একবার দেখি এ কদিনে কী অবস্থা হয়ে আছে আমার চেহারার।"
সু ওকে খাইয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। জন্সি বসে থাকে বিছানার ধারে। কিছুক্ষণ পরে সুর দিকে তাকিয়ে বলে, "জানো সু, আমি একদিন ঠিক ইতালি যাবো। দেখো। বে অফ নেপলসের ছবি আমি আঁকবোই।" বন্ধুর কথা শুনে সু খুশী হয়। এই তো, এই তো ও আগামীর কথা ভাবছে। এই তো, ফিরছে। ওর জীবনীশক্তি ফিরছে। তাহলে হয়তো এ যাত্রায় বাঁচাতে পারলো বন্ধুকে।
বিকেলের দিকে ডাক্তার আসেন রুগীকে পরীক্ষা করতে। জন্সিকে দেখে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে উনি আজ বেশ সন্তুষ্ট। সুকে বলেন, "তোমার বন্ধুর শারীরিক উন্নতি হয়েছে দেখছি। যত্ন ভালোই করেছো। চালিয়ে যাও। খাওয়া দাওয়া, বিশ্রাম আর যত্ন। এই তিনটিই মূল ওষুধ ওর। ভালো হয়ে যাবে ও। খুব শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি এখন যাই, ওদিকে ডাক পড়েছে। নতুন রুগী। বারম্যান নাম। মাইকের বয়স হয়েছে। মনে তো হচ্ছে নিউমোনিয়া। ওঁকে সারানো কঠিন। দেখি হাসপাতালে নিয়ে যাই যাতে যতটা কম কষ্ট পায় আর কী।"
পরের দিন আবার ডাক্তার ফিরে আসেন। জন্সির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন। তারপর খুশি হয়ে সু'কে বলেন, "তুমি বড় ভালো সেবা করেছো রুগীর। ও এখন অনেক ভালো আছে। চিন্তার আর কোন কারণ নেই। ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করিয়ো। ব্যস। তাহলেই সব ঠিক। "
বেলার দিকে জন্সির কাছে এসে বসে সু। ওকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে বলে, "জন্সি, একটা খবর দেওয়ার ছিল।" জন্সি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় বন্ধুর দিকে। সু বলতে থাকে, "মিস্টার বারম্যান। মিস্টার বারম্যান আর নেই। আজকেই মৃত্যু হয়েছে ওঁর। হাসপাতালে। তবে একটাই ভালো কথা। উনি বেশি ভোগেননি। বেশি কষ্ট পাননি। দুদিনের কষ্ট। প্রথম দিন কেউ একজন ওঁকে নিজের ঘরে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে ডাক্তার ডেকে দেন। ওঁর জামাকাপড় জুতো সব ভিজে। হিমশীতল। কে জানে কী করে? তারপর একটু এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে অবশ্য নজরে আসে একটা আলো। বাইরে নিয়ে যাওয়ার আলো। হয়তো কোথাও বেরিয়েছিলেন। আর পাওয়া যায় কিছু আঁকার সরঞ্জাম। একটু হলুদ রঙ, একটু সবুজ রঙ তখনও লেগে আছে প্যালেটে।"
জন্সি থামিয়ে দেয় বন্ধুকে। বলে, "দেখো সু। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখো। ওই গাছের শেষ পাতাটি দেখছো? দেখেছো কেমন এত ঝড় বৃষ্টিতেও ওটা অটুট আছে। এতটুকু নড়ে পর্যন্ত নি। এবার বুঝছি কেনো। ওই তো, ওই যে, ওইটাই সেদিন রাত্রে মিস্টার বারম্যান এঁকে গিয়েছেন। এতদিনে ওঁর মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। দেখেছো কেমন অদ্ভুত সুন্দর ওই সৃষ্টিটি? এটাই মিস্টার বারম্যানের এঁকে যাওয়া শ্রেষ্ঠ শিল্প। ওঁর গুণের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ওই শেষ সবুজ পাতাটা। শিল্পী মহলে দেখো, অমর হয়ে থাকবে। ওঁর শেষ শিল্প।"
No comments:
Post a Comment