শনি আর রবি, এই দুদিন বাড়ির সবার আলাদাই আনন্দ। সারা সপ্তাহ অফিসের ঘানি টানার পর পরপর দুদিন শুধুই আরাম আর আলস্য। এই দুটোদিন বাকি পাঁচদিনের মত সকাল ছটার অ্যালার্মে ঘুম না ভাঙলেও চলে। নাকে মুখে কিছু একটা গুঁজে শেয়ার ক্যাবে চেপে অফিস পৌঁছাও, তারপর সারাদিন কীবোর্ডের দিকে তাকিয়ে লাইনের পর লাইন হয় কোড লেখো, নয় ভুল সংশোধন করো। তারপর আবার সন্ধ্যে হলে সেই অ্যাপ ক্যাবের সার্জ। সব মিলিয়ে সোম থেকে শুক্র, একটুও শান্তি নেই, নেই অবসর। তবে হ্যাঁ, স্নিগ্ধার অবশ্য যাহাই শনি তাহাই সোম। বরং শনি রবি বাড়তি কাজই বটে। এই যেমন, দুধওয়ালা ঠিক সেই ছটাতেই দুধ দিয়ে যাবে, সাড়ে সাতটাতে ময়লা নেওয়ার গাড়ি এসে উইস্ল বাজিয়ে যাবে। তারপর আটটার মধ্যে নিরুদি আসবে বাসন মাজতে। না এলে তো আরোই চিত্তির। শুক্রবার, উইকেন্ড শুরু, একটু বেশীমাত্রাতেই রান্না খাওয়া হয়েছে। সিঙ্ক্ ভর্তি এঁটো বাসন। সব মাজতে হবে। স্বামী ইন্দ্রজিৎ আর কন্যা পুপ্লুর ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সাড়ে নটা, এর মধ্যেই তাই মুখরোচক নাস্তাও তৈরি করতে হবে। নইলে তো আবার পুপ্লুর বাক্যবাণ ধাঁ করে এসে বিঁধবে। "সারাদিনই তো বাড়ি বসে থাকো। এত কুকারি শোজ্ দেখতে থাকো। এদিকে রান্নার সময় সেই একঘেয়ে রান্না। দুটোদিন একটু আয়েস করে খাবো দাব, তাতেও যদি সেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বাটার টোস্ট নয় একঘেয়ে লুচি আলুর চচ্চড়ি পাই, ভালো লাগে বলো? উঁহু। জাস্ট ভাল্লাগেনা। একটু ইউনিক্ কিছু তো করতে পারো।" পাশ থেকে ইন্দ্রও সায় দেবে, "হ্যাঁ স্নিগ্ধা, রোজ তো অফিসে টিফিনে পাউরুটি আটা রুটি নয় রবারের সোলের মত ঠাণ্ডা লুচি চিবোই। একটু অন্যরকম কিছু করো প্লিজ?" অগত্যা, সব্জি চিকেন ডিম ময়দা সব নিয়ে তোড়জোড়, রাজকীয় ব্রেকফাস্ট বানাও। পুপ্লু আর ইন্দ্রর সারা সপ্তাহের ছাড়া জামাকাপড় মেশিনে দাও, এরই মধ্যে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন। বলাই বাহুল্য, সেখানেও চাই "ভেরিয়েশন'। নইলে একগাদা টাকার শ্রাদ্ধ করে জোম্যাটো। মাগ্যিগণ্ডার বাজার। হিসেব করে চলতে হয়। সবদিক সামলাও। কাজের লোকের মাইনে, সংসারের খরচ, দেওয়া থোওয়া। সব হিসেব তো ম্যাডাম স্নিগ্ধাকেই করতে হয়। বাড়ির লোক তো মাসের শুরুতে থোক টাকা ধরিয়েই খালাস। জামাকাপড় কাচা চলাকালীনই দুপুর আর রাতের রান্নার ব্যবস্থাটাও করে ফেলতে হয়। শনি রোব্বার মানেই হয় বাড়িতে গেস্ট, নয় নিজেরা কারুর বাড়ি যাওয়া। বা শপিং মলে ঘুরে বেরানো। নইলে সিনেমা থিয়েটার। বয়স যে হচ্ছে, তা স্নিগ্ধা আজকাল ভালোই টের পায়। আগে এত কাজ দিব্যি সামলে নিত, আজকাল অল্পেই হাঁপ ধরছে। হাঁটুর ব্যথাও জানান দিচ্ছে মাঝে মধ্যেই। পঁয়তাল্লিশেই শরীর ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে। নিয়মিত আজকাল বাড়িতে ব্যায়াম করছে বটে, পুষ্টিকর খাওয়া দাওয়াও করছে। কেউ দেখবে না, খোঁজ নেবে না। নিজেরটা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। নিজের যত্ন নিজেকেই করতে হবে। যানে স্নিগ্ধা। বোধহয় এবার পরিশ্রমটা একটু একটু করে কমাতে হবে। চাকরিরত হলে চিন্তা ছিল না। ষাটের পরই রিটায়ারমেন্ট। কিন্তু এই চাকরিতেতো আবার সেই বালাইও নেই। কায়দা করে "ডেজিগ্নেশন" দেওয়া আছে বটে, "হোম মিনিস্টার" নাকি "হোম ম্যানেজার"। হাসি পায় স্নিগ্ধার মাঝে মাঝে। এইসব যত গাল ভরা নাম। সবই "গিমিক"। কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক লাভের জন্য আর কিছু ওই সমাজের জন্য। বেশ এরকম নাম ধাম দিয়ে বিনে পয়সায় কাজ করইয়ে নেওয়া যায়। ওই বছরে কিছু বিশেষ বিশেষ দিনে, যেমন উইমেন্স্ ডে, মাদার্স্ ডে, এইসব দিনে যা একটু আধটু উদযাপন হবে। ব্যস। তারপর সারা বছর সেই যে কে সেই। নাহ, উইকেন্ড মোটেই ভালো লাগেনা স্নিগ্ধার।
চাই না বাপু এই দুদিনের উদযাপন, চাই না এই "গিমিক"। তার চেয়ে শুধু আর বাকি সদস্যদের মত প্রাপ্য সম্মান, কাজের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য অবসর দাও, এতেই হবে। এইটুকুই তো চায় স্নিগ্ধা, স্নিগ্ধারা। পাবে না ওরা?
No comments:
Post a Comment