রঙ রুট (১৭)
সুচেতনা
জাহ্নবী আর শুভঙ্কর ফিরে আসে প্রায় পাঁচটা নাগাদ। এসে দেখে অভি নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে রয়েছে। বেয়ারা জানালো, ও ঘুমোচ্ছে। ওকে যেন কেউ না ডাকে। বিরক্ত না করে। এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। শুভ আর জাহ্নবী একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যে যার নিজের ঘরে ফিরে গেল। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। দুজনেই ক্লান্ত। বেয়ারা জিজ্ঞেস করলো, চা পাঠাবে কি না। শুভ পাঠাতে বললো। জাহ্নবী বললো ও পরে খাবে। ঘরে ফিরে ও সুভদ্রাকে ফোন করলো। সারাদিন পর মেয়ের গলা শুনে মায়ের একটু স্বস্তি। জমিয়ে রোডোডেনড্রোন দেখার কথা বললো। সুভদ্রা বললেন, "যাক। তোর এই যে রঙের খেলা দেখতে আসার ইচ্ছে, তাহলে সেটি পূর্ণ হলো। বল?"
"হ্যাঁ মা। খুব ভালো লাগলো। জানো তো, আই হ্যাড গুড কম্পানি। শুভঙ্কর। প্রবাসী বাঙালি। বম্বেতে থাকে। এখানকার যে মালিক, অভিমন্যু, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরই গেস্ট হয়ে এসেছে। ওদের দুই বন্ধুতে ঝগড়া হয়েছে। মান অভিমান পর্ব চলছে। তাই অভি আমাদের সাথে যায়নি।"
"কী নাম বললি?"
"শুভঙ্কর। এই রে পদবীটা কখনো জিজ্ঞেস করিনি।"
"না না। অন্য ছেলেটি। কী নাম ওর?"
"অভিমন্যু। ও ওর বাবার পালিত পুত্র। ও ও সিঙ্গল পেরেন্টের ছেলে জানো। তাই আমার সাথে খুব ভালো আলাপ হয়েছে। মিলমিশ খুব ভালো। বেসিকালি আমরা তিনজন দারুণ বন্ধু। দাঁড়াও, তোমায় ছবি পাঠাই।"
সুভদ্রা খানিকক্ষণ কিছুই বলেন না।
জাহ্নবী আবার বলতে থাকে, "কী গো মা? দেখলে?ছবি পাঠালাম।"
সুভদ্রা উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। ওই লাল সোয়েটার ছেলেটি?"
"না। ওটা শুভ। অন্যজন অভি।"
"বাঃ। দুজনকেই কী ভালো দেখতে।"
"হ্যাঁ। শুনেছি ওর বাবা নাকি দারুণ হ্যান্ডসাম। সিঙ্গলও। কাল আসবেন। দেখা হবে। আলাপ করবো। শুভ তো ওর আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান। সারাক্ষণ আঙ্কেল এই করেছে, আঙ্কেল এই বলে, এই করতেই থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাপ রে, এত ভালোও কেউ হয় নাকি? আচ্ছা মা, একটা আইডিয়া এলো। এই আঙ্কেল তো সিঙ্গল। তোমার সাথে প্যাচ আপ করাবো নাকি? কী? বলো বলো।"
সুভদ্রা রেগে গিয়ে বলেন, "চুপ চুপ। যত ফাজলামি ইয়ার্কি, না? কোথায় নিজের বিয়ে করার বয়স হচ্ছে, তা না। এখন তিনি মায়ের বিয়ে দিয়ে হেডলাইন হবেন। হুহ।"
"কেন মা? অসুবিধে কী? আমি বড় হয়ে গিয়েছি। আমার নিজস্ব জগৎ আছে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। ব্যস। এবার ঝাড়া হাত পা। নিজেকে এটেনশন দাও।"
"তুই থামবি?"
"আহা আহা, রেগে যাও কেন?"
"তুই চুপ কর।"
"আচ্ছা বেশ। কাল আঙ্কেলের সাথে দেখা হোক। ছবি তুলে পাঠাবো তোমায়। দেখো পছন্দ হয় কি না। অবশ্য আমায়ও দেখতে হবে। এলিজিবল কি না। তোমার জন্য অবভিয়াসলি।"
সুভদ্রা আর কোনো কথা না বলে ফোনটা কেটে দেয়। অদ্ভুত লাগে জাহ্নবীর। ওর মা যে কেন এতটা ক্ষেপে গেল, বুঝতে পারেনা। এমন নয় যে মায়ের বিয়ে দেবে বলে ও আগে কথা তোলেনি। মা রেগে যাননি। বরং মজায় যোগ দিয়েছেন। কে জানে।
ফোনটা চার্জে বসিয়ে জাহ্নবী ঘরে তালা দিয়ে বেরোয়। চা তেষ্টা পেয়েছে। পাশের বাড়ি যেতে গিয়ে হৈচৈ খোসগল্পের শব্দ কানে আসে। একটু থমকে দাঁড়ায়। শুনতে পায় অভি আর শুভর গলা। অভির ঘর থেকে। দরজা বন্ধ। গতকালের পর থেকে ওদের দুজনের এই বন্ধ ঘরের আলাপ ভাবলেই ভয় লাগে। তবে এখন তো মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক। হাসির রোল ভেসে আসছে দমকে দমকে। জাহ্নবী ভাবলো, থাক। পুরোনো বন্ধু। নিজেদের ঝামেলা নিজেরাই মিটিয়ে নেবে। ও বরং এর মধ্যে আর ঢুকবে না। বেয়ারকে এক কাপ চা দিতে বলে সোফায় বসলো।
চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়েছে, এমন সময়ে কানে এলো গীটারের টুংটাং। শোনা গেল শুভর কণ্ঠে
"কিছুদিন মনে মনে
কিছুদিন মনে মনে শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে।
ইশারায় কইবি কথা গোঠে মাঠে..."
আঃ। এইটা তো মায়ের কাছে শেখা। প্রিয় গান। জাহ্নবী আর থামাতে পারলো না নিজেকে। দরজায় ঠ্যালা দিয়ে ঢুকে পড়ল ওদের আসরে।
বিছানার ওপরে দুজনে বসে। অভির হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটুতে অন্য হাত দিয়ে তাল দিচ্ছে। শুভ বিভোর হয়ে গান গাইছে। জাহ্নবী তার সাথে ধরে ফেলল গান।
"শ্যামকে যখন পড়বে মনে
চাইবি কালো মেঘের পানে..."
শুভ অবাক হয়ে গান থামিয়ে তাকালো। জাহ্নবী ইশারায় ওকে গেয়ে যেতে বললো। ব্যস। তারপর সারা সন্ধ্যে চললো একের পর এক গান। কখনো অভি, কখনো শুভ। জাহ্নবীও গেয়েছে। বনফায়ার বার্বিকিউ প্ল্যান সব মুলতুবি। বেয়ারা এসে মাঝে মাঝে হুইস্কি আর পকড়া দিয়ে যাচ্ছিল। উষ্ণ পানীয়ে গলা ভিজে গান আরো খোলতাই।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে রাত হয়ে আসে। ডিনারের তাড়া আসতে থাকে কিচেন থেকে। ওরা খেলে তবে বাবুর্চি বেয়ারা কাজ মিটিয়ে শুতে পারবে। জাহ্নবীরাও তাই দেরি করতে পারেনা আর। ডিনার টেবিলে গরম গরম ফ্রায়েড রাইস আর চিলি পনির। সাথে স্যালাড। আড্ডাও জমে ভালোই। জাহ্নবী খুব খুশি। অভি আর শুভর মনোমালিন্য যে কেটে গিয়েছে, এতেই আনন্দ। ও বলেও ফেলে সে কথা। শুনে দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠে বলে, "আরে, আমরা এরকমই। সেই চাড্ডি আমলের বন্ধু। ঝগড়া ভাব, লোগেই থাকে। We fight like crazy and make up easier!"
"হলেই ভালো", জানায় জাহ্নবী।
খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে এবার ওরা নিজেদের ঘরে ফেরার উদ্যোগ করে। সারাদিনের পরিশ্রমে দুজনেরই চোখে ঘুম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো শুভ। মেঘ একটু কাটবো কাটবো করছে। তারাও দেখা যাচ্ছে অল্প। শুভঙ্কর বললো, "দেখছো আকাশটা? মনে হয় রাত্রে ক্লিয়ার হতে পারে। আর তাহলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা।
জাহ্নবী মাথা নেড়ে বলে, "দেখা যাক। আমার সাধনার ফল কী দাঁড়ায়..."
(ক্রমশ)
বি: দ্র: আপনাদের থেকে সাড়া পেয়েছি ত্রাণ তহবিলের জন্য। অপেক্ষায় আছি আরো স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ার। আপনারা বার্তাটি ছড়িয়ে দিন পরিচিত মহলে। এমার্জেন্সী ফান্ডে টাকাটা দ্রুত পৌঁছে যাওয়া খুব খুব দরকার এখন। বিস্তারিত জানতে আমার সকালের পোস্টটি দেখুন।
No comments:
Post a Comment