রঙ রুট ১৫
সুচেতনা
V
মেঘ এখনো কাটেনি। দার্জিলিংয়ে থাকার মেয়াদ আজ সকালেই শেষ হলো। জাহ্নবীর কপালে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন, মেলেনি। মা বোধহয় ঠিকই বলেছে, সবার জন্য নয়। সাধনা করতে হয়। আর জাহ্নবীর সাধনা বুঝি যথেষ্ট হয়নি। আজ লেপচাজগৎ যাচ্ছে ওরা। সন্দীপের ওখানে ব্রেকফাস্টের পর রেজিস্টারে প্রয়োজনীয় সই সাবুদ মিটিয়ে রওনা দিয়েছে, অরিজিতের গাড়িতেই। দার্জিলিংয়ের আবহাওয়া ভালো না থাকায় টাইগার হিল ওরা যায়নি। মূলত পায়ে হেঁটেই যা ঘুরে বেরিয়েছে। তবে গতকাল একবার ঘুম আর বাতাসিয়া লুপ ঘুরে এসেছে।
লেপচাজগৎ মোটে এক ঘন্টার পথ। আড্ডার ছলে গাড়িতে উঠতে না উঠতেই প্রায় পৌঁছে যাওয়া। দুই ধারে সারি সারি পাইনের রাজি, সবুজ। টাটকা তাজা বাতাস। হ্যাপি হিল হোম স্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে বুক ভরে টাটকা বাতাসে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো জাহ্নবী। আহা, কী পরিষ্কার এই বাতাস। কোনো দূষণের জায়গাই নেই। শুভঙ্করকে ডেকে বললো, "কী অদ্ভুত সুন্দর না জায়গাটা? দেখো শুভ, কী শান্ত, নিস্তব্ধ। একটু কান পাতলেই কত রকমের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শোনো।" শুভ মাথা নেড়ে সায় দেয়। জাহ্নবীর সাথে যাবতীয় মান অভিমান পর্ব মিটে গিয়েছে ওর। দার্জিলিংয়েই। সেদিন অভি আর জাহ্নবী ম্যাল থেকে তারপর জলাপাহার রোডের দিকটা অবধি দেখে এসেছিল। শুভর দেখা মেলেনি। তবে ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে শুভ হাজির। ও নাকি কোনো এক ছোট্ট তিব্বতি দোকানে বসে কয়েক কাপ চা আর ম্যাগি সহ স্থানীয়দের সাথে এমনই কথা বলতে ব্যস্ত ছিল যে ম্যালে এসে ওদের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়নি। "বলো ভুলে গিয়েছিলে।" জাহ্নবীর অভিযোগ অবশ্য সরাসরি না করে উড়িয়েই দিয়েছিল। সন্ধ্যের বনফায়ার, বার্বিকিউ সব সময়ই একটা চোরা চাপা টেনশন, জাহ্নবী আর অভি ভালোই বুঝতে পারছিল। শেষমেশ ওরা আর নিজেদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।
রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে জাহ্নবী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মন খারাপ। মন অস্থির। এমন সময় দূরে অভির ঘর থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে আসছিল। নির্জন, নিরিবিলি। তাই মোটামুটি কথা বোঝাই যাচ্ছিল। শুভঙ্কর একটু মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে বসেছিল। আর মদ পেটে পড়তেই বীর বাঙালির মতোই কথার ফুলঝুরি শুরু।
"শুভ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস।"
"বাড়াবাড়ি? আমি করছি না তুই?"
"তুই।"
"সেই তো, সেই তো। সারা বিকেল জাহ্নবীর সাথে ম্যালে বসে সোহাগ কে করেছিল রে? আমি? না তুই?"
"আস্তে শুভ, আস্তে। নিরিবিলি। সবাই শুনতে পাবে।"
"শুনুক। লোকের জানা উচিত। ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে আসল অভিমন্যুকে।"
"আসল অভিমন্যুর কী হয়েছে?"
"এই যে যেই দেখলি, যেই বুঝলি, মেয়েটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে, ইউ হ্যাড টু কাম ইন বিটুইন আস। তুই এখনো বিশাখার সাথে তোর ঝামেলার জন্য আমায় দায়ী করিস। তোদের ব্রেক আপের দায় আমার নয় অভি। ফর গডস সেক। আন্ডারস্ট্যান্ড, বিশাখা ব্রোক আপ বিকজ অফ হার ওন রিজনস। আই হ্যাড নাথিং টু ডু দ্যেয়ার। প্লিজ তুই সেই গ্রাজটা আমার আর জাহ্নবীর মধ্যে এনে ফেলিস না। প্লিজ। বিন এ লং টাইম সিন্স আই গট দ্য কারেজ টু লাভ। জাহ্নবীকে আমি ভালোবাসি। ওকে আমি ভালো করে চিনতে চাই। ডোন্ট কাম ইন বিটুইন আস। প্লিজ অভি।"
জাহ্নবী স্তব্ধ হয়ে শুনে গিয়েছে কথাগুলো। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। টুঁ শব্দটি না করে দুই চোখ দিয়ে গরম নোনতা কান্না নেমে চলেছে। কাঁদতে কাঁদতে জাহ্নবী কখন জানি ধপ করে পড়ে গিয়েছে বারান্দায়। টাল রাখতে না পেরে। সেই সময়ে কাঠের টেবিলটা উল্টে পড়ে। তারই শব্দে চমকে বারান্দায় এসে ওকে এই অবস্থায় দেখে অভি আর শুভ। ছুটতে ছুটতে আসে ওরা দুজন। ওর ঘরের দরজা ভাগ্যিস ভ্যাজানো ছিল। জাহ্নবীকে সযত্নে, পরম মমতায় দুই হাতে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় শুভঙ্কর। অভি জলের ছিটে দেয়। সেই স্পর্শে জাহ্নবীর জ্ঞান ফিরলেও ডুকরে কেঁদে ওঠে আবার। শুভঙ্কর সারা রাত থেকে যায় ওই ঘরে। জাহ্নবীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে ও। চুলে বিলি কেটে দেয়। ওর কোলে মাথা কখন জানি জাহ্নবী নিশ্চিন্তে ঘুমের ঘোরে পৌঁছে যায়। শুভ তবু ওঠে না। কষ্ট হলেও, নড়ে না। পাছে জাহ্নবীর কষ্ট হয়। অভি খানিক চেয়ে থাকে ওদের দিকে। তারপর ফিরে যায় নিজের ঘরে। শুভটা আজ অনেকগুলো পুরোনো ক্ষত চাগাড় দিয়ে দিয়েছে। সারাতে হবে। প্রলেপ, সেই আদি অকৃত্রিম বৃদ্ধ, বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
(ক্রমশ)
No comments:
Post a Comment