Monday, March 23, 2020



রঙ রুট (১০)
সুচেতনা

অরিজিতের মিউজিক প্লেয়ারে হঠাৎ শুরু হয় কিশোর কুমারের উদাত্ত কণ্ঠে "রুক যানা নহি, তু কভি হারকে..."। জাহ্নবী এতক্ষণ টুকটাক নিজের মনে গুনগুন করলেও এইবারে বেশ গলা ছেড়েই গানটি ধরলো। জানলার বাইরে দিয়ে উত্তরবঙ্গের ছোট ছোট গ্রাম নগর পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়িতে। রাস্তার ধারে ছোট ছোট দোকান। কত মানুষ। যে যার পসরা নিয়ে, কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আকাশ একটু মেঘলা। বৃষ্টি, এখনো হয়নি। গান গাইতে গাইতে জাহ্নবী টের পায়, শুভঙ্কর মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। স্মিত হাসি ছুঁড়ে দেয় ও, শুভঙ্করের দিকে। অরিজিতেরও বেশ পছন্দ হয়েছে জাহ্নবী দিদির গান। গান শেষ হতেই ও তাই "আরে দিদি, আপনি তো দুর্দান্ত গান করেন! খুব খুব ভালো হয়েছে।" বলে স্টিয়ারিংয়ে হাত চাপড়ে দেয়। শুভঙ্কর এক মুখ মুগ্ধতা নিয়ে জাহ্নবীর দিকে ফিরে বলে, "জাহ্নবী, এক্সিলেন্ট। তুমি তো দেখি নাইটিঙ্গেল।" জাহ্নবী আবার এইসব স্পটলাইট, লাইমলাইটে কোনোটাই পছন্দ করেনা। অস্বস্তি হয়। এখনও হতে শুরু করলো। ইশ, গোটা রাস্তাটা ও দিব্যি চুপচাপ নিজের মতোই গান গাইতে গাইতে আসছিল। কেন যে হঠাৎ বেখেয়ালে গলা ছেড়ে ফেললো।
শুভঙ্কর পাশ থেকে সমানে ওকে অনুরোধ করে চলেছে আরো একটা গান শোনানোর জন্য। অরিজিৎও সেই আবদারে সায় দিয়েই চলেছে। ছেলেটা এমনই বিচ্ছু, বলে কি না, "দিদি আপনি যদি আরো একটা গান ধরেন, তাহলে আপনাকে একটা ফার্স্ট ক্লাস ভিউ পয়েন্ট নিয়ে গিয়ে একদম ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং লিকার চা খাওয়াবো।" জাহ্নবী ইতস্তত করে। চা খাওয়ার টোপটা বেশ ভালো মতোই লোভনীয় ওর কাছে। বিশেষ করে এখন। গাড়ি এখন একটু উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। আর মেঘ করার দরুণ, হালকা শিরশিরানি রয়েছে হাওয়ায়। পাতলা সোয়েটশার্ট মোকাবিলা করছে বটে এখনো, তবু, এক কাপ চা পেলে মন্দ হয়না। সাথে আবার বলছে ভালো ভিউ পয়েন্ট। হুম। এইটুকু চেষ্টা করাই যায়।
জাহ্নবী আরো কিছুক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে। তারপর গানটা ধরেই ফেলে। "আমি কোন পথে যে চলি, কোন কথা যে বলি..."। গান শেষ হতেই শুভঙ্কর হাততালিতে মাতিয়ে দেয়। জাহ্নবী সলজ্জ হাসি হাসে। গালদুটি রক্তিম। কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা ভালোলাগায় আর কিছুটা গানের উঁচু স্কেলের জন্য।
অরিজিৎ কথা রেখেছে। ঘুম শহরে পৌঁছে ওদের নিয়ে গিয়েছে একটা ছোট্ট ক্যাফেতে। ক্যাফের জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু আজ মেঘ করে আছে। তাই দর্শন, হলো না। কিন্তু চা পান বেশ আনন্দ সহকারেই হলো। লালচে সোনালী লিকার চা। সাথে ফ্রেশলি বেকড কুকিজ। আহা। কুকিজগুলি এতই সুস্বাদু, মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। দু চোখ বুজে আসে ভালোলাগায়। শুভঙ্কর নিজের প্লেটেরগুলো শেষ করেছে। এবার হাত বাড়িয়েছে জাহ্নবীর প্লেটে। জাহ্নবী দেখেও দেখলো না। চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে জানলার বাইরে, ক্যাফে সংলগ্ন ঝোপে ফুটে থাকা গোলাপী বেগুনী জংলা ফুলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললো, "জানো শুভ, তখন ওই গানটা কেন হঠাৎ জোরে গাইলাম? আসলে ওই গানটা ছোটবেলা থেকে এতবার শুনেছি, এত বেশিবার শুনেছি, গেয়েছি.... আমায় তো আমার মা একলা হাতে মানুষ করেছে, তাই সব সময় এই গানটির কথা বলতো। কিভাবে হিম্মত রাখতে হবে কঠিন সময়ে। ভয় না পেতে। গানটা আমার জীবনের এন্থেম। তাই ঐটা শুনেই কেমন জানি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। গেয়ে ফেললাম।"
শুভঙ্কর আলতো করে জাহ্নবীর হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখে বলে, "ভাগ্যিস!"

(ক্রমশ)

বি: দ্র: দয়া করে আজ জনতা কারফিউকে মেনে চলুন। আর কারফিউ শেষ হলেই দুম করে সবাই মিলে কোথাও জমায়েত হবেন না। বারবার সরকার থেকে যা যা নিয়ম বলছেন, মেনে চলুন। প্লিজ। ভারতবর্ষের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে করোনা মহামারী রূপে এলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, তছনছ হয়ে যাবে। তাই প্লিজ, দায়িত্বশীল নাগরিক হোন। নিজে সচেতন হোন। অন্যকেও সচেতন করুন। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। কয়েকটা দিন, দাঁতে দাঁত চিপে থাকুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ধৈর্য রাখুন। সহায়তা করুন। নিয়ম মানুন। বুদ্ধি খরচ করুন। দয়া করে।

No comments:

Post a Comment