Sunday, March 29, 2020

রঙ রুট (১৯)
সুচেতনা

অনেক রাত করে শুলেও, জাহ্নবীর ঘুম ঠিক সাড়ে ছটার মধ্যে ভেঙে গেল। ততক্ষণে অবশ্য সূর্যোদয় হয়ে গিয়েছে। পর্দার আড়ালে দুধ সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা রাজকীয়ভাবে বিদ্যমান। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। শুভকে দেখতে পেলো একটু দূরে, রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে। অভির দেখা নেই। জাহ্নবী এগিয়ে গেলো শুভর দিকে। "সুপ্রভাত", বললো ও।
শুভ হাসিমুখে ওকেও অভিবাদন জানালো। তারপর বলল, "তাহলে, কাল রাত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হলো?"
জাহ্নবী কপট রাগতস্বরে বললো, "আপনাদের দুই বন্ধুর পেটের ভিতরে কথা আর থাকে না। সত্যি।"
"কী করব, বেস্ট ফ্রেন্ডস।"
"আমার জানো আজ অবধি কখনো খুব ভালো বন্ধু হয়নি। কোনো বন্ধুত্বই খুব গভীরে যায়নি। তোমাদের দুজনের এই বন্ধুত্ব ভারী ভালো লাগে আমার। মনে হয়, আমারও  যদি এমন বন্ধু হতো।"
"রইলাম তো। শুভ অভি জাহ্নবী। ত্রিমূর্তি। এই বন্ধুত্ব কোনো অবস্থাতেই ভাঙবে না। দেখো। কথা দিলাম।"
জাহ্নবী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে, "এই স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন অঙ্গীকার নিলে। এই প্রমিস কিন্তু কোনো অংশেই অগ্নিসাক্ষীর কম নয়। খেয়াল রেখো..."

ওদের কথার মধ্যেই দূর রাস্তা থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। এত সকাল সকাল এদিকে কে এলো?
"আঙ্কেল বোধহয়।" শুভ বলে।
অল্প সময়ের মধ্যেই একটা সিলভার রঙের বোলেরো গাড়ি এসে থামে। ভিতর থেকে নেমে আসেন বছর পঞ্চান্নর এক সুপুরুষ ব্যক্তি। লম্বা, দীর্ঘদেহী ঋজু চেহারা। কাঁচা পাকা চুল। পুরু মোটা গোঁফ। সেই গোঁফের আড়াল থেকেই বেরিয়ে আসে এক চওড়া হাসি। শুভ ওঁকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম সেরে ফেলে। ভদ্রলোক শুভকে জড়িয়ে ধরে বলেন, "ইয়ং ম্যান। এ কী, গলে মিলো। ইয়ে সব প্রণাম শনাম কিউ?"
"কেমন আছো আঙ্কেল? অনেক দিন পর দেখা হলো।"
"বেটা, খুব ভালো আছি। তুমি বলো। কাম ওয়াম সব ঠিক?"
"হ্যাঁ আঙ্কেল।" তারপর হঠাৎই শুভর মনে পড়লো জাহ্নবীর কথা। জাহ্নবী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের। শুভ ওকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বললো, "আঙ্কেল, মিট হার। শি ইজ জাহ্নবী। দিল্লীতে থাকে। চাকরি করে। জাহ্নবী, দিস ইজ অর্জুন আঙ্কেল। অভির বাবা।"
জাহ্নবী ভদ্রলোককে প্রণাম করেন। উনি ব্যস্ত হয়ে জাহ্নবীকে বাধা দিতে যান। "আরে আরে, করো কী? বেটিরা বাড়ির লক্ষ্মী। তারা কখনো আমাদের পায়ে হাত দেয়না। বুঝলে মা? এসো, ভিতরে চলো। শুভ, চলো। অভি আমায় বলেছে ওর কথা। আমি জানি। চলো বাকি গল্প চা খেতে খেতে।"
ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে পড়েছে। সে আঙ্কেলের মালপত্র নিয়ে এগিয়ে যায়। ভদ্রলোক ওকে ডেকে বলেন, "ছোটবাবুকে ডেকে দাও। আর আমাদের জন্য চা পাঠাও।"

"তারপর, বলো। দার্জিলিং কেমন লাগলো তোমাদের?"
জাহ্নবী উত্তর দিলো, "ভালো। খুবই ভালো। তবে ওয়েদার ভালো ছিলো না। তাই একটু কম এনজয় করেছি। টাইগার হিল যাওয়া হয়নি।"
"হুম। দার্জিলংএর ওয়েদার নিয়ে একটা ব্যাপার আছে। ভেরি আনপ্রেডিক্টেবল।"
"আঙ্কেল আপনার ট্রিপ কেমন হলো?"
"ভালো রে শুভ। খুব ভালো। ওখানে একটা কাজেই গিয়েছিলাম। সেটা সেরে এলাম।"
"আরেকটা হোটেল কিনলে?"
"হ্যাঁ রে। ওই গৌহাটির আউটস্কার্টে। ওটাকে একটা ইকো রিসোর্টে কনভার্ট করতে হবে। এরকমই ইচ্ছে।"
"গ্রেট। ঐটা রেডি হয়ে গেলে নেক্সট টাইম চলে এসো। জাহ্নবী, তুমিও এসো। ইনভাইট করে রাখলাম।"
"হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। মাকে নিয়ে আসবো। মার খুব কামাখ্যা যাওয়ার ইচ্ছে। অনেক দিনের।"
"খুব ভালো। শিয়র। উই উইল বি গুড হোস্টস। কী বলিস অভি?" ইতিমধ্যে অভি এসে গিয়েছে ওদের মধ্যে। ঘুম ঘুম চেহারা এখনো।
"বাবা, শোনো না। তুমি কি টায়ার্ড নাকি আমাদের সাথে বেরোবে?"
"কোথায় যাবি?"
"ভাবছিলাম গাড়ি নিয়ে তিনচুলে ঘুরে আসবো।"
"আমি ড্রাইভ করতে পারবো না। তোরা কেউ করলে আমি রাজি।"
"আমি চালাবো আঙ্কেল?" জাহ্নবী প্রশ্ন করে।
"তুমি হিল ড্রাইভিং জানো?" আঙ্কেল একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
"হ্যাঁ! এই তো, লাস্ট ইয়ার সামারে মাকে নিয়ে আমি শিমলা থেকে ঘুরে এলাম। নিজেই ড্রাইভ করে।"
"গ্রেট, গ্রেট ইয়ং লেডি। খুব ভালো লাগে এইসব বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো কী সুন্দর স্মার্ট। আমাদের ছোটবেলায় এরকম ছিলই না। ফ্রি মিক্সিং ও ছিল না। থিংজ হ্যাভ চেঞ্জড।"
অভি এইবারে একটু বাবার পিছনে লাগতে গেল। বললো, "তা ফ্রি মিক্সিং থাকলে কী হতো? কাউকে পছন্দ ছিল নাকি?"
আঙ্কেল হাহা করে গলা ছেড়ে হেসে বললেন, "সে তো ছিল। তবে দ্যাট লেডি ওয়াজ অলসো ভেরি মডার্ন। ভেরি স্মার্ট। একদম এই জাহ্নবীর মতো। ইন ফ্যাক্ট জাহ্নবী সো রিমাইন্ডস মি অফ হার।"
"আচ্ছা? তাই? বেশ বেশ। আমার কাজ তাহলে একটু ইজিই হলো।" জাহ্নবী মুচকি হেসে বলে। ওর অঙ্কেলকে খুব পছন্দ হয়েছে। মায়েরও যদি হয়...
"কী ব্যাপার?" কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞেস করেন আঙ্কেল। জাহ্নবী ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে, "এখন না। পরে ঠিক সময় হলে।"
"এই আজকালের বাচ্চাগুলো না..." এই বলতে বলতে আঙ্কেল নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান। স্নান সেরে তৈরি হতে হবে।

পথেই লাঞ্চ করে নেবে, এই মর্মে ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওরা চারজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দেড় ঘন্টার যাত্রাপথ গানে গল্পে দুর্দান্ত জমাটি হয়েছিল। তিনচুলে গিয়েও খুবই ভালো সময় কেটেছে। অসাধারণ সেই ভিউপয়েন্ট। সবুজালি। বরফ ঢাকা পাহাড়। গরম স্যুপ। মোমো। ছবির পর ছবি। সেলফি। হইহই করে সারাদিন যে কীভাবে কেটে গেল, টেরই পায়না ওর। তারপর ফেরার পালা। এমনিও খুব দেরি করলে চলবে না। কাল জাহ্নবীর ফেরার ফ্লাইট। ওকেও এসে লাগেজের ফাইনাল প্যাকিং করতে হবে। ফেরার পথে গাড়ি চালালো শুভ। পাঁচটার মধ্যে ওরা এসে পৌঁছল কটেজে।
জাহ্নবী ঘরে ফিরে মাকে ফোন করে গল্প করলো সারাদিনের। ফিরিস্তি দিলো। তারপর কথাটা কিন্তু কিন্তু করে পেড়েই ফেললো। বললো, "মা, আঙ্কেলকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। হি ইজ এ গ্রেট জেন্টিলম্যান। তোমারও ওঁকে খুব ভালো লাগবে। দেখো। দাঁড়াও ছবি পাঠাই।"
এই বলে জাহ্নবী সুভদ্রাকে ওর আর আঙ্কেলের একটা সেলফি পাঠায়। খুব প্রিয় এই ছবিটা। দুজনের চোখে মুখে হাসি।
মাকে ছবি পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সুভদ্রার ফোনের। তবে কোনো ফোন আসে না। তাহলে হয়তো সিগনালের প্রব্লেম, জাহ্নবী ভাবে। ও ফোন করার চেষ্টা করে। লাইন লাগে না। ও ফিরে যায় লিভিং রুমে। গল্পের আসর বসেছে সেখানে। আঙ্কেল রসিয়ে রসিয়ে শুভ আর অভির ছোটবেলার নানান মজার কীর্তি বলে যাচ্ছেন। কথায় কথায় নিজের বিভিন্ন দেশভ্রমণের গল্পও বলেন। কত দেশ ঘুরেছেন আঙ্কেল। শখে। ব্লগ লিখতেন এক সময়। আঙ্কেল কথা বলেন ভারী ভালো। মুগ্ধ হয়েই শুনতে থাকে ওরা।
ডিনারের পর জাহ্নবী রুমে ফিরে আসে। মোবাইলে এখনো টাওয়ার নেই। তাই ফোন বা মেসেজ কোনো নোটিফিকেশনই নেই।
জাহ্নবীর মনটা একটু কেমন কেমন করে। এসেছিল এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থায়। এখন যেন এখানে এসে অভি আর শুভর মতো এমন ভালো বন্ধু পেলো। বেড়ানো হলো ভালোই। তারপর শেষ পাতে আঙ্কেলের মতো মানুষের সাথে পরিচয়। পিতৃহীন জীবনে আঙ্কেল যেন কিছুটা হলেও সেইখানে স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। জাহ্নবী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এদের সকলের সাথে যোগাযোগটা বজায় ও রাখবেই। হয়তো একটু একটু করে হলেও, এইভাবেই ও একটা সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে। অনেকটা কৃতজ্ঞতা ও মন ভালো করা অনুভূতি নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোল। রঙের সন্ধানে এলেও, এই রুটটা কোনোভাবেই, "wrong" বোধহয় হয়নি ওর।

পরেরদিন সকালে শুভ, অভি আর আঙ্কেল তিনজনে মিলে ওকে বাগডোগরা অবধি পৌঁছে দিয়ে এলো। মাঝে সিগনাল পাওয়ায় মেসেজ ঢুকলো। মায়ের মেসেজ। গতকাল রাতে পাঠানো। এইটুকুই। "তুই কোনো কথা বলবি না আর এই নিয়ে। আই ওয়ার্ন ইউ। বাড়ি আয় সাবধানে। আমি এয়ারপোর্ট যাবো।" মায়ের এই মেসেজে অবাক হয় জাহ্নবী। ও তো মায়ের সাথে একটু মজাই করছিল। অবশ্যই মায়ের অনুমতি না নিয়ে ও কিছুই করতো না। তাও, কে জানে। গাড়িতে অবশিষ্ট সময়টা আর এই নিয়ে মাথা ঘামায়নি জাহ্নবী। সবার সাথে আড্ডা দিয়েই কাটানোটা বেশি দরকারি মনে করল। মায়ের সাথে সামনাসামনি কথা বললেই সব সমস্যা ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। ও নিশ্চিত। কিন্তু এই তিনজনকে খুব শিগগিরই তো আর একসাথে পাবে না।
দুটো নাগাদ ওরা পৌঁছে গেল। এয়ারপোর্টের কাছে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ওরা একসাথে লাঞ্চ সারলো। আঙ্কেল কিছুতেই টাকা দিতে দিলেন না। জাহ্নবীর ফেয়ারওয়েল লাঞ্চ।
এত স্নেহ, এত ভালোবাসা। সত্যিই, জাহ্নবী অভিভূত। এক বুক ভালোবাসা, আবার দেখা হওয়ার ও যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাহ্নবী ঢুকে যায় এয়ারপোর্ট টার্মিনালে।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

বি: দ্র: রিলিফ ফান্ডে টাকা দিলেন? বই নিলেন? আরো পাঁচজনকে জানালেন সেটার কথা?

No comments:

Post a Comment