Monday, March 30, 2020

রঙ রুট (২০)

VI

বেরিয়ে ফেরার প্রায় মাসখানেক পর, জাহ্নবী তিনটি ইমেল পাঠিয়েছিল। শুভঙ্কর, অভি আর আঙ্কেলকে।

প্রিয় শুভ
জানি তুমি হয়তো আমার ব্যবহার ও আচরণে খুব অবাক হয়েছ। ফিরে এসে অবধি আমি তোমার কোন ফোনের উত্তর দিইনি, মেসেজ পড়ে রেখে দিয়েছি। জবাব পাঠাইনি। রাগ করেছ নিশ্চয়ই? করারই কথা। আসলে বাড়ি ফেরার পর থেকে একটা অদ্ভুত বাজে রকমের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি এ কদিন। না না চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। মাও ভালো আছে। শুধু কিছু ব্যাপার ঘটে গিয়েছে, যা আমায় মানসিকভাবে বিহ্বল করে তুলেছিল। তবে এখন সব শান্ত। আমি ভালো আছি। তবে সেসব কথা তোমায় ফোনে বা ইমেলে জানাবো না। দেখা করে সামনাসামনি বলবো।
তুমি কি এর মধ্যে দিল্লী আসবে? এসো না। তাহলে দেখা করবো। তুমি আমাদের বাড়িতেই থেকো। মায়ের খুব ইচ্ছে তোমার সাথে আলাপ করার। ভালো লাগবে তুমি এলে। মন খুলে কথা বলবো তোমার সাথে। প্রমিস। এসো কিন্তু।
জানিয়ো কবে আসবে।
ইতি
জাহ্নবী



প্রিয় অভি
দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে যে একটা আস্ত ভাই পেয়ে যাবো, ভাবতেই পারিনি। বন্ধু তো পেয়েইছি, সাথে পেয়ে গেলাম একটা ভাই। আজ থেকে, আমায় দিদি বলে ডাকবি। ঠিক আছে? কী? সব ঘেঁটে যাচ্ছে? কিচ্ছু বুঝছিস না তো? তাহলে সোজাসাপ্টা বলি। আমার বাবা হলো তোড় বাবা। মিস্টার অর্জুন রাঠোড়। কাজেই, আমরা ভাই বোন।
অবাক হচ্ছিস? কী করে এসব কী বলছি? ওই যে সেদিন আঙ্কেল বলছিলেন না? ছোট বয়সে কাউকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল? আর আমায় দেখে বারবার তার কথা মনে হচ্ছিলো... হবেই তো, কারণ সে যে আমার মা। সত্যি বলছি, আমিও দিল্লী ফেরার আগে অবধি জানতেই পারিনি। আমি এমনই গাধা, অর্জুন আঙ্কেলের নাম শোনার পরেও মাথায় স্ট্রাইক করেনি কিছু। শেষ রাত্রে মাকে আমাদের ছবি পাঠাতে মা চিনতে পারে তার এতগুলো বছর আগের ফেলে আসা কাছের মানুষটিকে। যাকে নানান কারণে সেই সময়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আমি দিল্লী ফেরার পর মা আমায় বলে সে কথা। তবে কারণ, এখনও জানি না। এইটুকু জানি, দুজনের মান অভিমান বোধহয় এখনও রয়েছে। বলছি, একটা কমপ্লিট পরিবার চাই তো তোর? তাহলে আমায় সাহায্য করিস। মা আর আঙ্কেলের ভাব করাতেই হবে। আমি ক্রমশ তোকে সব জানাবো। তোর সাহায্য নেব। ঠিক আছে?
আর ওদের মিলমিশ না হলেও, আমরা কিন্তু ভাই বোন হয়ে গেলাম। আগাম নেমন্তন্ন করে দিলাম রাখীর দিন। দিল্লী। চলে আসবি। ঠিক আছে?
ইতি
তোর দিদি


শেষ চিঠিটা লিখতে যে জাহ্নবীকে কতবার ব্যাকস্পেস প্রেস করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তবু, শেষমেশ এই দাঁড়িয়েছে।

প্রিয় অর্জুন আঙ্কেল
আশা করি ভালো আছেন। প্রথমেই জানাই, আমি খুবই দুঃখিত একদিন আপনাকে মেল করিনি বলে। আসলে বাড়ি ফিরে এসে একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে চলছিলাম। খুলেই বলি তবে।
আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে, দার্জিলিং শহরে আপনার আলাপ হয়েছিল একটি বাঙালি পরিবারের সাথে। মনে আছে? দাদা বৌদি আর ওদের ছোট বোন। মেয়েটি তখন সবে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছে।  আপনার সাথে দেখা হতো প্রায় প্রতিদিন, ম্যালে। সকাল সন্ধ্যে। খুব জমাটি আলাপ আড্ডা চলত। তারপর একদিন সবাই মিলে বেড়াতে গেলেন লোকাল সাইটসিয়িং করতে। দিব্যি চলছিল। এর মধ্যে একদিন ঠিক হলো সবাই মিলে গাড়ি করে ধারেকাছে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু দিনের দিন দাদা বৌদি যেতে পারলেন না। বৌদির তখন হঠাৎ ধুম জ্বর। বোনটিকে নিয়ে আপনি গেলেন ঘুরতে। ততদিনে অবশ্য দুই পক্ষেরই মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তারপর আর কী, ক্ষণিকের অসাবধানতা। দুদিন পর ওরা ফিরে এলো। মেয়েটি এক মাস পর বুঝলো, ও আপনার সন্তানের মা হতে চলেছে। বাড়িতে জানানোর প্রশ্নই নেই। ভয়ানক রক্ষণশীল পরিবার। মেরেই ফেলতো হয়তো। আপনার সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু আপনি তখন দিশেহারা হয়ে যান। আশ্বস্ত করতে পারেন না। মেয়েটির আবার প্রবল আত্মসম্মান। একবার না শুনে আর চেষ্টা করেনি। সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছিলোই। পেয়েও গেলো ভাগ্য ভালো। পোস্টিং দেরাদুন। চলে গেলো। আর সেখানেই কিছু মাস পর, আমার জন্ম।
আমার মা কোনদিনও আপনার সাথে, আপনার পরিবার বা মায়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। কেন? হয়তো অভিমান। একা হাতে আমায় বড় করেছে। আমি মানুষ হয়েছি। মা আর আমার এখন দুজনের সুখের সংসার।
আপনাকে লেপচাজগতে খুব ভালো লেগেছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম (না চিনেই) যে আপনার সাথে মাকে ভালো মানাবে। সেই জন্যই মাকে জানাই সে কথা। ছবিও পাঠাই। মা আপনার ছবি দেখেই চিনতে পারে। তবে আমায় বারবার বারণ করে আপনাকে জানাতে। এই প্রথম আমি মায়ের কথা রাখছি না। আপনাকে লুকিয়ে চিঠি লিখছি। সবটা জানালাম আপনাকে। এদিকে মান অভিমান চুড়ান্ত পর্যায়ে আছে। বল এইবার আপনার কোর্টে। আপনি এবার যা ভালো বোঝেন।
ভালো থাকবেন। আঙ্কেল হিসেবেই শ্রদ্ধা করে যাবো চিরদিন।
ইতি
জাহ্নবী


তিনটে ইমেল পাঠিয়ে দিয়ে জাহ্নবী খানিক নিশ্চিন্ত। অনেক হাল্কা লাগছে। মাকে এখন এইসব কিচ্ছু বলা যাবে না বটে। দেখাই যাক, জীবন কী রেখেছে ওদের জন্য। কিছু হোক না হোক, একটা বন্ধু আর একটা ভাই তো পেলো। পিতৃপরিচয় জানলো, স্নেহ... সেও কপালে থাকলে জুটেই যাবে। অত আর ভাববে না। ডক্টর আস্থানা বলেছেন, "লিভ লাইফ ওয়ান ডে অ্যাট আ টাইম।" সত্যিই, সেই ভালো।


(শেষ)

No comments:

Post a Comment