রঙ রুট (৯)
সুচেতনা
গাড়ি চলছে। অরিজিৎ সিংয়ের গানও সমান তালে চলছে। বেশিরভাগ গানই বড্ড দুঃখের। এবং বিরহের। শুভঙ্করের সেইসব পছন্দ হচ্ছে না। ওরা যখন শিলিগুড়ি ঢুকছে, শুভঙ্কর বললো, "বস, খিদে পেয়েছে খুব। ভালো দেখে কোনো ধাবায় থামিয়ো তো। গরমাগরম আলুর পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে। সাথে চাই ধূমায়িত এক কাপ চা। ক্লাসিক দার্জিলিং টি। আর হ্যাঁ তারপর মুড সেরা হয়ে যাবে। তখন প্লিজ গাড়িতে অন্য গান দিয়ো। কিছু আনন্দের গান। বা ডান্স মিক্স। এইসব বিরহ টিরহ অনেক হলো। আর না। ভাই, তুমি এই এইটুকু ছেলে, এখনই কীসের এত বিরহ বলো তো? আর এই যে এই ম্যাডাম। উনি মুখে বলছেন না বটে, তবে আমি জানি। ওঁরও মোটেই পছন্দ হচ্ছে না গানটা।" এতক্ষণ অবধি ঠিকই চলছিল সব। জাহ্নবী শুনে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিল। খিদে তো ওরও পেয়েছে। এবং কে জানে কেন, এই যাত্রাপথে ধবার ধারে খেতে গেলে আলু বা পনির পরোটা পেলে একেবারে দিলখুশ হয়ে যায়। তবে গানের ব্যাপারে যেই ওর নাম এসে গেল, ব্যস। রেরে করে উঠলো ও। বললো, "এ কী, না না। আমার মোটেই অপছন্দ না। অরিজিৎ সিংকে খুবই ভালো লাগে। মস্ত মগন গানটা শুনেছেন? ওইটা আমার অল টাইম ফেভারিট।" শুভঙ্কর হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বললো, "ধুর ধুর। দাঁড়ান, খেয়ে আসি। দেখবেন, আমার কাছে একটা সেরা প্লেলিস্ট আছে। ওইটা চালাবো। তখন বলবেন। বন্ধুমহলে আমার মিউজিকের টেস্ট বেশ সুখ্যাত ও বিখ্যাত।" এরপর আর কথা বাড়ানোর মানে হয় না। ওরা ধাবা দেখে গাড়ি থেকে নামে।
খাওয়াটা ছিল জম্পেশ। পুরু মাখন মাখানো পরোটা। সাথে চা। অবশ্য দার্জিলিং চা বোধহয় না। ছিল দুধ চা। খেতে খেতে শুভঙ্কর অনেক গল্প বলতে লাগল। ওর বেড়ানোর নেশার কথা, বিভিন্ন বয়সে বন্ধুদের সাথে নানান দুষ্টুমি, স্কুল কলেজের মজার মজার সব কীর্তি। একেকটা শুনতে শুনতে তো জাহ্নবী প্রায় হেসে কুটিপাটি যাওয়ার জোগাড়। সত্যিই, শুভঙ্কর ভারী মজার মজার কথা বলে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে ওরা গাড়িতে ফেরে। শুভঙ্কর জাহ্নবীকে বলে, "আমি বন্ধুমহলে বাচাল বলে পরিচিত। দেখছি ব্যাপারটা ইউনিভার্সাল। আপনিও গোটা সময়টা চুপ করে আমার বকবকের অত্যাচার শুনে গেলেন। নিজের কথা কিছুই বললেন না।" জাহ্নবী হেসে উত্তর দিলো, "বাবাঃ, বন্ধুমহলে আপনি তো খুবই বিখ্যাত দেখছি। গানের টেস্ট, বাচাল, কত ব্যাপারে আপনার খ্যাতি!" শুভঙ্কর বললো, "চাটুন চাটুন। এই চাট খেতেও আমি বিখ্যাত। তা বন্ধুত্ব যখন, এক তরফ থেকে সব গল্প করলে ব্যাপারটা কেমন ইনকমপ্লিট হয় না? তাই আর কী। আপনার সম্পর্কে কিছুই তো বললেন না।" জাহ্নবী বললো, "ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন, এ কার পাল্লায় পড়লাম? ডাকাত নয় তো?" শুভঙ্কর ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, "আই বেগ টু ডিফার। এমন সুন্দরী ও সফিস্টিকেটেড ডাকাত, আমাদের দেশে অসম্ভব।" কথাটা শুনে জাহ্নবী হো হো করে হেসে উত্তর দিলো, "এবার কি শুনবো যে বন্ধুমহলে আপনার ফ্লার্টিং স্কিলসও বিখ্যাত?" শুভঙ্করও হাসি না চেপেই বললো, "দিন দিন। প্যাঁক দিন। আমি শুধু আপনার কথা শুনতে চাইছিলাম। আপনি মানুষটা কেমন, কেমন সব অভিজ্ঞতা আপনার।" জাহ্নবী জবাব দিলো, "আমি খুব বোরিং ও সাধারণ একটি মেয়ে। দিল্লীতে থাকি, মায়ের সাথে। চাকরি করি। গান শুনি। বই পড়ি। সিনেমা কম দেখি। ব্যস। এর চেয়ে বেশি আর কিচ্ছু নেই। আমার লাইফে কোনো ইন্টারেস্টিং বা হ্যাপেনিং ঘটনাই নেই।" শুভঙ্কর বলে, "তাই বুঝি? তা বেশ তো। লেটস মেক দিস ট্রিপ হ্যাপেনিং!" জাহ্নবী হাসে। জানলার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। খানিকটা যাওয়ার পর মুখ না ফিরিয়েই বলে, "শুভ, তুমি যে বলছিলে তোমার গানের স্টক ভালো। কই? আমরা শুনবো না?"
শুভঙ্কর জাহ্নবীর দিকে ফিরে তাকায়। অদ্ভুত এক হাসি। যুদ্ধজয়ের? কে জানে। উত্তরে কিছু না বলে নিজের ব্যাগ থেকে পেনড্রাইভ বের করে। অরিজিৎকে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, সেকেন্ড ফোল্ডারটা চালাও বস। ম্যাডাম পরীক্ষা নেবে বলছে।"
গাড়ি এগিয়ে চলে। স্টিরিও প্লেয়ারে বাজতে থাকে "মুসাফির হু ইয়ারো। না ঘর হ্যায়, না ঠিকানা।" জাহ্নবীর পছন্দ হয়েছে গান। বেশ পছন্দ। মাথা নেড়ে তাল দিতে থাকে গানে।
(ক্রমশ)
No comments:
Post a Comment