"থাপ্পড়" সিনেমাটি দেখেছেন? আমার দেখা হয়নি। তবে ট্রেলার দেখেছি। পারলে দেখবেন। খুব প্রয়োজন। আপাতত তিনটি ঘটনা বলি যখন এই থাপ্পড়টা খুব জরুরি।
থাপ্পড়
সুচেতনা
(১)
বিতান, অভ্র, রঞ্জিত, সুকোমল সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে বন্ধু, যাকে একেবারে বলে "চাড্ডি বাডিজ"। একই স্কুলে লেখাপড়া করেছে। তবে বর্তমানে কলেজ আলাদা। বিতান ফোর্থ ইয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ব্যাঙ্গালোরের কলেজে, অভ্র কোনো এক আই আই টিতে এম এস সি ফার্স্ট ইয়ার, রঞ্জিত হলদিয়াতে মেডিকেল থার্ড ইয়ার আর সুকোমল মাস কম পড়ছে কলকাতাতেই। আপাতত হোলির ছুটিতে চার বন্ধু একসাথে। অনেকদিন পর। আড্ডা জমেছে শহরের এক বিখ্যাত শপিং মলের ফুড কোর্টে। এদিক সেদিক নানান গল্পই চলছে। তবে মাঝে মধ্যেই এক কমন টপিক বারবার উঠে আসছে। তাদের চারজনের জীবনেই কোনো বিশেষ বান্ধবীর অভাব।
বি: ধুর, ফোর্থ ইয়ার হয়ে গেল। গিটার গাঁজা কিছুই বাদ দিলাম না। প্লেসমেন্টেও চাকরি জুটে গেল। কিন্তু গার্ল ফ্রেন্ড? ধুর ধুর। আমার কপালে ওই আনন্দবাজার নাচছে।
র: শোন ভাই, ওসব মেয়ে ফেয়ে নেই লাইফে, অনেক শান্তিতে আছিস। বুঝেছিস?
সু: কেন বে? নিজে ব্যাটা সারাদিন এনাটমি ক্লাসে জমিয়ে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখছো সব, তোমার ভাই লাগে না। কিন্তু আমাদের তো লাগে। নাকি? কীরে অভ্র, চুপ করে কেন, বল? কাহাতক আর পোস্টার দেখে কাজ সারতে ভাল্লাগে বল তো?
অভ্র কোনো উত্তর দেয়না। চুপচাপ বসে শোনে ওদের কথা।
বি: সুকোমল ভাই একদম রাইট কথা বলেছিস। রঞ্জিত তো সারাদিন ওই ক্যাডাভার ঘাঁটে। ওর আর কী বল। রাত্রে ওতেই চলে যায়। আমাদের বাপু জীবনে ওই জন্যই শপিং মল লাগে। ওই দেখ, দেখ, দেখ। ওই যে। ওই যে ওই পিঙ্ক হট প্যান্ট পরা চিংকিটাকে দেখ। দেখেছিস? পুরো মাখন ভাই, মাখন।
সু: হ্যাঁ। উফ ঠিক যেন ভিটের ক্যাটরিনা। কী ঠ্যাংখান ভাই। আঃ।
র: তোরা চুপ করবি? তখন থেকে বাজে কথা বলেই যাচ্ছিস। লিমিট ক্রস করছিস কিন্তু।
বি: ওই যে বললাম, আমাদের কষ্টটা তুই আর কী বুঝবি বল। তুই রোজ ঘাঁটিস হিউম্যান ঠ্যাং। আর আমাদের কপালে জোটে ম্যাক্সিমাম ওই কে এফ সির ঠ্যাং। আর সাইডে একটু আধটু ওই চিংকি মামনিগুলো। তুই আর কী বুঝবি ভাই, প্রিভিলেজড মানুষ। কীরে অভ্র, বল?
অভ্র আর চুপ থাকতে পারে না। রাগে ওর কান লাল হয়ে গিয়েছে। ও উঠে দাঁড়িয়ে সুকোমল আর বিতানের গালে দুটো থাপ্পড় মারে, জোরে। "যেদিন তোরা ভালো মানুষ হবি, সেদিন আসবি কথা বলতে", এই বলে উঠে চলে যায় টেবিল ছেড়ে। বাকি তিন বন্ধু সাময়িক ভাবে বিহ্বল হয়ে গেলেও তারপর একে অপরের মুখ চাওয়াচাউই করতে থাকে। ওরা জানে না, অভ্র, যে কিছু মাস আগে অবধিও ওদেরই মতন ছিল, কয়েক সপ্তাহ হল বদলে গিয়েছে। বদলটা অবশ্য বাধ্য হয়েই। নিজের বোনের মলেস্টেশনের পর মানসিক রুগীতে পরিণত হওয়াটা স্বচক্ষে দেখে।
(২)
নয়নিকা আর দীপাঞ্জনের বিয়েটা দুই বছর পূর্ণ করেছে সদ্য। কাগজ দেখে সম্বন্ধ করেই বিয়ে। পাল্টি ঘর। সবাই জানে, বেশ আনন্দেই আছে ওরা। হ্যাঁ, এমনি সবই ঠিকঠাক। শুধু ওই মাঝে মাঝে দীপ অফিস থেকে ফেরে মদ খেয়ে। নেশায় চুর। আর তখন কাণ্ডজ্ঞান থাকে না কোনো। নয়নিকা কিছু বলতে গেলেই তখন জোটে অকথ্য ভাষায় গালাগালি। আর মার। এ ছাড়া অবশ্য মাঝে মাঝে নয়নিকার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে শারীরিক মিলনও ঘটে। নয়নিকার হাজার বারণ, কাকুতি মিনতি তখন হয়ে যায় "বাহানা"। সমস্ত "পৌরুষ" ঢেলে নিজের "অধিকার" ফলায় দীপ। নয়নিকা একেই নিজের ভাগ্য বলে মেনেই নিচ্ছিল। ঠিক যেমন ছোট থেকে শিখে এসেছে, মেয়েরা মানিয়ে নেয়। স্বামীই দেবতা। পুরুষ মানুষ। একটু আধটু ওরকম করতেই পারে। প্রায় যখন অভ্যেস করেই ফেলছিল ও, হঠাৎই স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপ থেকে পুনরায় যোগাযোগ হয় পারমিতার সাথে। পারো উকিল। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বিষয়ে একদিন একটা পোস্ট শেয়ার করার সূত্রেই ওর সাথে নয়নিকার আলাদা করে কথা হয়। নয়নিকা আস্তে আস্তে বুঝতে শেখে যে এগুলি ওর প্রাপ্য নয়। রুখে দাঁড়াতেই হবে ওকে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকুক কি না। আর তাই সেকেন্ড এনিভার্সারির দিন রাতেও যখন দীপাঞ্জন নেশা করে এসে মারতে যায় নয়নিকাকে, নয়নিকা উল্টে একটা পাল্টা থাপ্পড় মারে দীপের গালে।
ঘটনার আকস্মিকতায় দীপ থমকে যায়। নেশা তখন কেটে গেছে। অবাক সে। ওর এই নরম বউ ওকে মারতে পারলো? আঁতে ঘা লাগে ওর। পার্স আর একটা ছোট ব্যাগ গোছানোই ছিল। হাতে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যায় নয়নিকা বাড়ি থেকে। মুক্তির সন্ধানে।
(৩)
শর্মী আর ওর পাঁচ বছরের মেয়ে পুপাই এই কিছু মাস হলো এসে থাকছে নেস্ট হাউজিংয়ের তিনতলার এই ফ্ল্যাটে। ওদের ঘিরে পাড়া প্রতিবেশীর অপার কৌতূহল। কেন বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ স্থায়ীভাবে নেই, বাড়িতে কখন কে এলো গেল, সব ব্যাপারেই সকলের বড়ই জিজ্ঞাসা। অনেকে তো আবার কেন মিত্তিররা ওদের ফ্ল্যাট ভাড়া দিলো, এই নিয়েও নানান মতামত রেখেছেন।
শর্মীদের এই ফ্ল্যাটে আসার পর আজ প্রথম জেনারেল বডি মিটিং। এমনিতেই ওর ইচ্ছে ছিল এই সুবাদে বিল্ডিংয়ের সকলের সাথে আলাপ পরিচয় করবে, তা ছাড়া সিকিউরিটি, জলের ব্যবস্থা এসব নিয়েও জিজ্ঞাস্য ছিল কিছু। তাই শর্মী এসেছে মিটিংয়ে। কিন্তু এসে যে এমন কিছু ঘটবে, সেটা এই একবিংশ শতাব্দীর কলকাতাতে বসে ও আশা করেনি। কী হলো? শুনুন তাহলে।
মিস্টার দত্ত, হাউজিংয়ের সেক্রেটারি, প্রথমেই শর্মীর সাথে সকলের পরিচয় করালেন। তারপর পরবর্তী এজেন্ডাতে যেতে যাবেন, এমন সময় বাধ সাধলেন শর্মীর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের সিনিয়র মিসেস সিনহা। "আচ্ছা, শর্মী, তুমি একা থাকো কেন?" শর্মী একটু তাকালো, এইসব প্রশ্নে ও অভ্যস্ত। তাই হেসেই উত্তর দিলো, "না তো মাসিমা। আমি আমার মেয়ে পুপাইকে নিয়ে থাকি।" মিসেস সিনহাও দমবার পাত্রী নন। উনি বললেন, "না মানে তোমার হাজব্যান্ড? উনি কোথায়?" শর্মী মাথা ঠান্ডা রেখেই বললো, "নেই।" মিসেস সিনহা অবাক। বললেন, "নেই মানে? উনি কি মারা..." শর্মী ওকে থামিয়ে বললো, " না না। বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। আমরা ডিভোর্স নিয়েছি, তিন বছর হলো।" ব্যস। এইবার যেন মিসেস সিনহা লোপা বল পেয়েছেন, ঠুকে ওভার বাউন্ডারি। বললেন, "ও মা। সে কী, ডিভোর্স কেন, কী সমস্যা?" শর্মী ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো, "ওটা পার্সোনাল।" মিসেস সিনহা ছাড়বার পাত্রী নন। বললেন, "নিশ্চয়ই তোমার কোনো এফেয়ার টেফেয়ার..." ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই হঠাৎ কোণ থেকে এতক্ষণ বিরক্ত হয়ে চুপচাপ শুনে যাওয়া, ওরই পুত্রবধূ, স্বাগতা সিনহা বলে উঠলো, "মা, অন্তত ওর সেই সাহসটা আছে, একসাথে থাকা যাচ্ছিল না বলে বেরিয়ে এসেছে। অন্তত আমার চেয়ে ভালো আছে। প্রতিদিন আপনার ছেলের ওই লুচ্চামি, নোংরামি সহ্য করে আছি শুধুমাত্র সাহসের অভাবে। ও অন্তত নিজের মতো করে বাঁচছে। কে কী বলবে, তা পাত্তা দেয়নি। আর এফেয়ারের কথা বলছেন, আপনার ছেলেকে একবার ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন তো, আজকাল উনি কার সাথে এফেয়ার করছেন? মিস রুহি না মিসেস মিত্র?"
উপস্থিত সকলে চুপ। কারুর মুখে একটা কথা নেই। শব্দের থাপ্পড়টা ভালোই খেয়েছেন সিনিয়র মিসেস সিনহা।
No comments:
Post a Comment