Friday, March 27, 2020



রঙ রুট (১৬)
সুচেতনা

লেপচাজগতের হোমস্টেটা আরো সুন্দর। একদম জঙ্গলের মধ্যে। দুটো একতলা কাঠের বাংলো পাশাপাশি। একটাতে অভি থাকে ওর বাবার সাথে। সেখানেই কিচেন, ডাইনিং রুম আর ছোট অফিস। অফিসঘরেই থাকে বাবুর্চি আর বেয়ারা। পাশের বাড়িতে তিনটে ঘর। সেখানেই দুটোতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে জাহ্নবী আর শুভর। অভি থাকবে নিজের বাড়িতেই। ওর বাবা কাল সকালে এসে পৌঁছবেন গৌহাটি থেকে। আজ এখন ব্রেকফাস্ট সেরে ওদের রোডোডেনড্রোন দেখতে যাওয়ার কথা। অভি ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছিল, এমন সময়ে শুভ ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, "অভি, আমরা তাহলে কখন বেরোচ্ছি? লাঞ্চের আগে না পরে?" অভি একবার তাকালো শুভর দিকে। তারপর জাহ্নবীর দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে শুভর দিকে ফিরে বললো, "আমি যাব না। তোরা দুজনে বরং যা। সাথে যদি অরিজিৎকে লাগে, ও যাবে। তোরা একাও যেতে পারিস। সোজা রাস্তা। কোনো অসুবিধে হবে না। ইন ফ্যাক্ট, সুবিধেই হবে। তোরা প্রাইভেসি পাবি।" এই বলে অভি বেরিয়ে গেল, গটগট করে।
জাহ্নবী বিহ্বল। শুভর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, "ব্যাপারটা কী হলো?" শুভ ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বললো, "চাপ নিয়ো না। অভিটা ওরকম। চিরকাল। হি উইল বি ফাইন।" জাহ্নবী বুঝে ওঠেনা এদের ব্যাপার। শুভ আর অভি, দুজনেই দুজনের সম্পর্কে ঠিক এক কথা বলে। আসলে ওরা দুজন দুজনের ভীষণ ভালো বন্ধু। তাই হয়তো এই মান অভিমান, এবং তার পরে যে সব ঠিক হয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা।

কিচেন থেকে স্যান্ডউইচ, কফি আর স্যালাড প্যাক করে দেয় বাবুর্চি। শুভ আর জাহ্নবী সেই ফুড হ্যাম্পার সাথে নিয়ে এগিয়ে চলে রঙের উদ্দেশ্যে। রঙ রুটে। সবুজ পাইনের জঙ্গল। টাটকা বাতাস। বুক ভরা নিঃশ্বাস। হালকা মেঘ। রোদের তেজও কম। পথে চলতে বেশ আরাম। জাহ্নবীর গলায় ঝুলছে ওর ভারী ক্যামেরাটা। চলতে চলতে মাঝে মাঝে এদিক ওদিকের ছবি তুলে চলছে। টের পাচ্ছে গুনগুন করে গান করতে করতে শুভর মোবাইলের লেন্স মাঝে মাঝেই ওর দিকে তাক হচ্ছে। মৃদু প্রতিবাদ করায় শুভ সুন্দর যুক্তি দিয়ে বলে দিলো, "তুমি তো সারাক্ষণ অন্যদের ছবি তুলছো। তোমার ছবিও তো কাউকে তুলতে হবে। মাকে পাঠাবে না নাকি?" এরপরে আর কিছু বলার থাকে না জাহ্নবীর। মোক্ষম জায়গায় শুভ মোচড়টা দিয়েছে।
এইবার ক্রমশ হাঁটার পথের দুই দিকের দৃশ্য বদলাতে থাকে। ঘন সবুজের মাঝে মাঝে কয়েক ঝলক লাল। থোকা হয়ে ফুটে আছে রোডোডেনড্রোন। আরো খানিকটা হাঁটতে থাকে ওরা। পথ একটু চড়াই। অল্প হাঁপ ধরছেও বটে। একটু বসলে হয়। জাহ্নবী সে কথা বলে শুভঙ্করকে। শুভ হাতের কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখে বলে, "আড়াইটে বাজতে যায়। বরং এর একটু এগিয়ে ঐখানে যাই। ফাঁকা ফাঁকা আছে। বসে লাঞ্চ সেরে আবার ফিরি। নইলে অন্ধকার হয়ে যাবে। এইসব জায়গায় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। এই জঙ্গলে আবার লেপার্ড টেপার্ড আছে কি না কে জানে।" জাহ্নবী শুভর কথায় সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে চলে। মিনিট দশেক পর ওরা পৌঁছয় একটা খোলা জায়গায়। একটু সমতল গোছের। দুধারে গাছের সংখ্যা কম। চারিদিকে রোডোডেনড্রোন গাছের সারি। হ্যাম্পার থেকে খাবার বের করে ওরা খেতে থাকে। চলতে থাকে গল্প।
জাহ্নবী হঠাৎ সামনের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, "আচ্ছা শুভ, কাল রাতে অভিমন্যুকে তুমি কী বেশ একটা গ্রাজ নিয়ে বলছিলে, সেটা কী?"
শুভ খাওয়া থামিয়ে জাহ্নবীর মুখের দিকে তাকায়। জাহ্নবী নিষ্পলক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকে, যেমন ছিল। শুভর উত্তরের অপেক্ষায়। শুভ একটু ইতস্তত করে বলে, "ও বেশ পুরোনো কাসুন্দি। না ঘাটলেই ভালো। দরকার কী?"
"দরকার আছে শুভ। বলো।"
"ওয়েল, শুনতে যদি চাওই তো শোনো। নাথিং এক্সট্রা অর্ডিনারি। আমরা কলেজে দুজনেই বিশাখাকে ভালোবাসতাম। আমি আগে। তারপর অভি। ইন ফ্যাক্ট, বিশাখা আমায় ডিচ করে। তারপর অভি সিনে আসে। ন্যাচারালি আই ওয়াজ শকড। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমারই এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঘুরছে। ওই সময়ে আমাদের খুব ঝামেলা হয়। কথা বন্ধ হয়েছিল অনেক মাস। খুবই অকওর্ড সিচ্যূএশন। তারপর ইয়ারের শেষের দিকে বিশাখা অভিকেও ডিচ করে। অভি অনেকদিন অবধি ভেবে এসেছে এর জন্য আমি দায়ী। আংকেল, মানে ওর বাবা, সব জেনে শুনে আমাদের দুজনকে একসাথে বসিয়ে অনেক বোঝান। উই মেড পিস। অর সো আই থট। এখন দেখছি, উই ডিড নট। কাল আঙ্কেল আসবেন। মে বি উই উইল নিড হিম টু পুট সাম সেন্স ইন্টু আস।"
জাহ্নবী আলতো করে চেপে ধরে শুভর হাত। ওর কাঁধে মাথা দিয়ে বলে, "দেখো, ইট উইল বি ইজি। অভিও রিপেন্ট করছে কালকের ঝগড়া। আই কুড সি ইট ইন হিজ আইজ। আর তুমিও যথেষ্ট আগ্রহী টু সর্ট থিংজ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমার দিকে থেকে একটা কথা বলতে পারি, তুমি আর অভি, দুজনেই আমার খুব ভালো বন্ধু। আশা করি সেটা বজায় থাকবে।"
পড়ন্ত দুপুরের সোনালী আলো এসে পড়ে ওদের মুখে। খানিকক্ষণ শান্ত হয়ে বসে উপভোগ করে নিস্তব্ধতা। তারপর ফিরতে হবে, নইলে অন্ধকার, এই চিন্তায় হাঁটা লাগায়।

(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment