Saturday, January 11, 2020

এক মুঠো রোদ

রোদটা একদম ভালো করে উঠছেইনা কদিন ধরে। কাপড়জামা যে কীভাবে শুকোবে, কিচ্ছু ভেবে পায়না চন্দ্রিমা। ধুর, এরকম করে কদিন যে চলবে? এগুলো না শুকোলে লাগেজে কী প্যাক করবে? ভেবে পায় না ও। এই তো আজ গেলো তেরো, আগামী সতেরোয় তো ওর বেরোনো। এখনও গুচ্ছের টুকটাক কেনাকাটি, প্যাকিং সব বাকি। অবশ্য আদৌ কি চন্দ্রিমার ট্রিপটা সম্ভব হবে? সব কিছুই হঠাৎ করে এমন এলোমেলো হয়ে গেলো...  এক মাসের জন্য চন্দ্রিমার প্রাগে যাওয়ার কথা। একটা উইন্টার স্কুল অ্যাটেন্ড করতে। কলেজে পড়ানোর চাকরিটা পাওয়ার পর এই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। প্রথম যেদিন আমন্ত্রণপত্র হাতে আসে, বা বলা ভালো ইমেলে আসে, খুশীতে বেশ একটা ছোটখাটো নাচ নেচে ফেলেছিল ও। সেই মাস্টার্স পড়ার সময় থেকে যেই প্রেস্টিজিয়াস উইন্টার কোর্সে যাওয়ার জন্য চন্দ্রিমা মুখিয়ে থাকতো, যেখানে সিলেকশন পর্ব নিয়েই রীতিমতো সাড়া পড়ে যেতো, আজ সেখানে লেকচার দেওয়ার সুযোগ এসেছে। চন্দ্রিমার দুর্দান্ত আনন্দ হওয়ার কথা। হচ্ছিলোও। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর জীবনে নেমে এলো গভীর ঝঞ্ঝা।

সীতাংশু সেদিন অফিস থেকে ফিরে দিব্যি খোশ মেজাজেই তো ছিল। অফিসে একটা ভালো ডিল ক্র্যাক করেছে, সেই খুশীতে সেলিব্রেশন করবে বলে দুজনে ঝটপট তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরলো লং ড্রাইভে। উদ্দেশ্য, হাইওয়ে ধরে অনেকটা দূর যাওয়া, তারপর ওদের প্রিয় পাঞ্জাবি ধাবায় রুটি পনীর চিকেন কাবাব আর লস্যি সহ জমিয়ে ডিনার করা। সেদিন খাওয়াদাওয়াটা হয়েওছিল বেশ ভালো। ফেরার পথে দুজনেই গাড়ির স্টিরিওতে পুরনোদিনের গান চালিয়ে গল্প করতে করতে ফিরছিল। সীতাংশুই চালাচ্ছিল গাড়ি। অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। শুনশান রাস্তা। শুধু মাঝে মাঝে কিছু মালবাহী ট্রাক যাচ্ছে পাশ দিয়ে, উল্টো দিক দিয়ে। চন্দ্রিমার আসন্ন প্রাগ সফরের শেষে সীতাংশু ওখানে পৌঁছে যাবে, তারপর দুজনে মিলে সপ্তাহখানেক ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরবে। এমনটাই প্ল্যান চলছিল। এমন সময় কোথা থেকে যে কী হয়ে গেলো। উল্টোদিক থেকে আসা একটা ব্রেক ফেল করা লড়ি, তার চোখ ধাঁধানো হেডলাইট, সীতাংশুর ভয়ে ফ্যাকাশে হওয়া মুখ, প্রাণপণে স্টিয়ারিং উইল ঘুরিয়ে দেওয়া, একটা বিশাল ঝাঁকুনি।

চন্দ্রিমার জ্ঞান ফিরেছিল একদিনের মধ্যেই। চোট বেশি পায়নি ও, ভাগ্য ভালো। একটা ছোট ফ্র্যাকচার আর কপালে কেটে যাওয়া। কিন্তু সীতাংশুর চোট বেশ গুরুতর। দুদিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরলেও, ডাক্তাররা খুব একটা সুবিধের কথা বলছেন না। অপারেশন হয়তো করতে হতে পারে। নিজে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও চন্দ্রিমা প্রত্যেকদিন সকাল বিকেল সীতাংশুর কাছেই থেকেছে, ওর যত্ন আত্তি করেছে। সীতাংশু যদিও ওকে বারবার কলেজ কামাই না করতে বলেছে, তবুও। চন্দ্রিমা ওকে ছেড়ে যাবেই না। সীতাংশুর শারীরিক অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছেনা। ডাক্তাররা এইবারে যেন বেশ চিন্তিত। ইতিমধ্যে একটা মেডিকেল বোর্ড বসেছে, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তাই নিয়ে আলোচনা করতে। একেই এইরকম বিচ্ছিরি আবহাওয়া। সারাদিন এই অকালের বৃষ্টি। তার উপর সীতাংশুকে নিয়ে টেনশন। ভালো লাগেনা কিচ্ছু চন্দ্রিমার। মনমরা মেয়েটাকে দেখে সীতাংশুরও ভারী কষ্ট লাগে। কোথায় এখন ওদের প্রাগ ভ্রমণ নিয়ে মুখিয়ে থাকার কথা, তা না। তবুও, এরই মাঝেই সীতাংশুরই জোর করায়, চন্দ্রিমা রোজ হাসপাতালে বসেই ল্যাপটপে নিজের প্রেজেন্টেশন বানাচ্ছে। যদি ঈশ্বরের কৃপায় সীতাংশুর উন্নতি হয় স্বাস্থ্যে, যদি চন্দ্রিমা যেতে পারে।

ডাক্তাররা আর রিস্ক নিতে রাজী নন। এতদিন হয়ে গেল, মাথার ক্লটটা ঠিকমতো মিলিয়ে যাচ্ছেনা। এইবারে সার্জারি করতেই হবে। সীতাংশু চাইছিল না। বারবার বলছিল, "দেখো, সামনের সপ্তাহেই তোমার যাওয়া। এর মধ্যে আর এইসব অপারেশনের ঝক্কি নিয়ো না। ওষুধ খেয়ে তো কমছে। একটু ধৈর্য্য ধরি। কমে যাবে। তুমি বরং ঘুরে এসো। ডোন্ট মিস দ্য চান্স চন্দ্রিমা।" চন্দ্রিমা এইসব কথা শুনে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে থাকে। বলে, "তুমি কি আমায় এরকম ভাবো বলো? তোমার শরীর আগে না আমার লেকচার? উঁহু। কক্ষনো না। তোমার সার্জারি হবেই। ডাক্তার যখন বলেছেন, হতেই হবে। ওঁরা তোমার চেয়ে বেশি বোঝেন। প্লিজ। আর না করো না।" সীতাংশু অনেক তর্ক বিতর্কের পর শেষমেশ রাজি হয় একটা শর্তে। সার্জারিটা যেন চন্দ্রিমার যাওয়ার দিন চারেক আগেই হয়ে যায়। আর সবকিছু ঠিকঠাক চললে, চন্দ্রিমা যেন প্রাগ যাওয়া বাতিল না করে।

গতকাল অপারেশনটা হলো। ডাক্তার তো বলেছেন, সাকসেসফুল। চব্বিশ ঘন্টা না কাটলে অবশ্য কিছু বলা যাবে না। আজ পনেরো। পরশুর টিকিট। হাসপাতালে সীতাংশুর সাথে দেখা করতে চন্দ্রিমা বের হয়। আজ অনেকদিন পর আকাশের মেঘ কেটেছে। রোদ উঠেছে। সীতাংশুর সার্জারিটা ভালোয় ভালোয় মিটেছে, চন্দ্রিমা অনেকটা নিশ্চিন্ত। কাল রাতে সীতাংশুর জ্ঞান ফেরেনি, তাই কথা হয়নি। আজ দেখা হবে। কথা হবে। বড্ড স্পেশাল। তাই বিশেষ করে সীতাংশুর পছন্দসই গোলাপী শাড়ি পরেছে। চোখে টেনেছে আই লাইনারের ছোঁয়া। ঠোঁটে লিপস্টিক। একদম টিপটপ সাজ। সীতাংশুর কেবিনের সামনে পৌঁছে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় চন্দ্রিমা। হালকা টোকা দিয়ে ঘরে ঢোকে। সীতাংশু উঠে বসেছে, নার্সকে ভর দিয়ে। আরেকজন নার্স ওকে ব্রেকফাস্ট খাওয়াচ্ছে। মাথার কাছের জানলা দিয়ে সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে বিছানায়। সীতাংশু সেই রোদের আদরে মাখামাখি। চন্দ্রিমাকে দেখে থমকে গেল খানিক। তারপর আস্তে আস্তে বললো, "প্রেজেন্টেশন রেডি? লাগেজ প্যাক? এই যাত্রায় তোমার যাওয়াটা তাহলে হচ্ছেই। আমাদের ইউরোপ ভ্রমণটা নাহয় মুলতুবি থাক। কিন্তু হবেই। কথা দিলাম। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুরে এসো। বিশ্বজয় করো। আমি তো রইলাম।" চন্দ্রিমা কিচ্ছু বলতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সীতাংশুর দিকে। শুধু টের পায় দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল। আনন্দের। ছুটে গিয়ে সীতাংশুর কাঁধে লুটিয়ে পড়ে। সীতাংশু হালকা করে "আঃ" বলে দু হাত দিয়ে জাপ্টে ধরে চন্দ্রিমাকে। ভালোবাসার, ভরসার আলিঙ্গনে।

No comments:

Post a Comment