প্রাক-কথা
গত অগস্ট থেকে নভেম্বরের শেষ অবধি ভয়ানক
রকমের ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছি। পি এইচ ডি
থিসিসের কাজকর্ম নিয়ে একেবারে যাকে বলে, ল্যাজে গোবরে অবস্থা। তা যাই হোক, ডিসেম্বরের শুরতে
বাড়ি ফিরলাম। কলকাতা। ভিতরের যাযাবর পোকাটি ভালোমতন নাড়া দিয়ে উঠলো। এদিকে বাড়িতে রাজমিস্ত্রির
কাজ হচ্ছে। মেরামত, রঙ, এইসব। কাজেই, বাবা মা বলেই দিলেন, তাঁরা এই মুহূর্তে কোন বড়
বা মাঝারি ট্রিপেও যেতে পারবেন না। এদিকে আমার মাথায় বেরানোর ভূত চেপেই গিয়েছে। যেতে
তো হবেই। কাঁহাতক আর রোজ সন্ধ্যেয় বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে চা কফি স্ন্যাক্স খেয়ে কাটানো
যায়? হ্যাঁ, বাড়ির বাইরে যাচ্ছি বটে, অথচ বেড়ানো তো হচ্ছে না। তিন বান্ধবী মিলে ঠিক
করলাম, ঘরের কাছে ডায়মন্ড হারবার, সেখানেই একটা ডে ট্রিপ সেরে ফেলি। সেইমতো হোয়াটসঅ্যাপ
গ্রুপ পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেলো। কিন্তু নাহ, বুকিং মিলল না। বুকিং মিলল না টাকিতেও। অগত্যা,
দিন পরিবর্তন। এদিকে সেটি কিনা মস্ত কঠিন প্রশ্ন। প্রায় দেশের নিয়ম নীতি বানানোর মতোই
কঠিন ব্যাপার। তিনজনের সুবিধে মতো একটা তারিখ ঠিক করা। অনেক কষ্ট করেও সেই তারিখ আর
জুটলো না। অগত্যা, সেই আবার কফি খেতে যাওয়া। বেড়ানোর আশা এদিকে ছাড়তেও পারছি না। কী
করা যায়? কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায়, এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের একটা মেন্টালি
বানানো লিস্টের শরণাপন্ন হলাম। লিস্টের প্রথমেই বেনারস। মাসিকে বললাম, চলো যাই। মাসি
কোন সময় নষ্ট না করেই বারণ করে দিলো। দেশের যা অবস্থা, দুই মহিলা মিলে ইউ পি যাওয়া
নাকি মোটেই সেফ না। নেক্সট ইন লিস্ট, দারজিলিং। এদিকে তখন এইসব সি এ এ, এন আর সি নিয়ে
মারমার কাটকাট অবস্থা। ট্রেন প্লেন নাজেহাল অবস্থা। অগত্যা, সেই গুড়েও বালি। তাহলে? তাহলে আর কী? ঠিক এই সময়ে,
এক্কেরে রক্ষাকর্তার ন্যায় এসে হাজির হলো ফেসবুক। এমনিই একদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে
করতে স্পন্সরড অ্যাডে এলো, সুন্দরবন ভ্রমণের কথা। একটু খোঁজখবর নিলাম। ইতিমধ্যে
রোজ বেরিয়ে বেরিয়ে এমন অবস্থা, যে বাবা মায়ের কাছে তখন “ভ্যাকেশন”এর কথা বলার ঠিক
সাহস নেই। ভরসা তাহলে মাত্র একজন। দায়িত্ব দিলাম কাকার কাছে। চুপিচুপি
হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে দিলাম সমস্ত লিঙ্ক। বললাম, সুন্দরবন যাবে? আমি জানতাম,
কাকা হ্যাঁ বলবেই। কাকারও যে পায়ের তলায় সর্ষে। একা মানুষ। তার ওপর আবার সদ্য
রিটায়ার করছে। কাজেই উত্তরটা যে হ্যাঁ হবেই, সেই বিষয়ে সন্দেহ ছিল না কোন। বললাম,
একটাই শর্ত। প্ল্যানটা যে গোটাটাই আমার মাস্টারমাইন্ড, সেইটা বাবা মা কে জানানো
যাবে না। কাকা বলা বাহুল্য, রাজি। বিকেলের মধ্যেই মায়ের মোবাইলে মেসেজ ঢুকল তার।
‘সুন্দরবন যাবে?’ মা আমায় ডেকে দেখালো, বললও, যাবি? আমি যেন কত সারপ্রাইজড, সেরকম
ভান টান করে মোটামুটি ঝটপট হ্যাঁ বলে দিলাম। ব্যস, আর কী? বাবাকে রাজি করানো গেলো
খুব সহজেই। ওই একটু আমি হম্বি তম্বি, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল টেল করলাম, ব্যস। তারপর
এই অপারেটর ওই অপারেটর এইসব করতে করতে অবশেষে দ্য টেলিগ্রাফে এক রবিবারের বিজ্ঞাপন
দেখে ইকো ট্যুরিজমকে ঠিক করা হলো। সায়েন্স সিটির সামনে থেকে ওদের বাস ছাড়বে।
ওখানেই পিক-আপ, ওখানেই ড্রপ। কলকাতা টু কলকাতা পার হেড ৪৫০০ টাকা প্লাস জি এস টি।
সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার মতো পড়লো জনপ্রতি। ঝটপট সময় নষ্ট না করে অনলাইনে টাকা
ট্রান্সফার করে আমাদের চারজনের জন্য ২৩, ২৪, ২৫ তারিখের ট্রিপ বুক করা হয়ে গেলো।
এবার শুধুই অপেক্ষা। কবে ২৩শে জানুয়ারি আসবে, কবে বেরবো। জোর কদমে চলল পরিকল্পনা,
আলোচনা। কী কী জামাকাপড় নেওয়া হবে, ঠান্ডা কেমন। জুতোই বা কী নেবো? (হ্যাঁ, জুতো
নিয়ে তো আমার বিশেষ ইয়ে আছে, তাই আর কী) বাড়ি থেকে ওই সক্কাল সক্কাল সায়েন্স সিটি
অবধি ক্যাব পাবো কি না। নানান প্রশ্ন। যাই হোক। সবকিছু উত্তর টুত্তর পেয়ে টেয়ে
আমরা অবশেষে ২৩শের সকাল পেলাম। কাকা ইতিমধ্যেই আগের রাত্রে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে,
যাতে একসাথেই চারজনে যেতে পারি।
মালপত্র রেডি। রেডি আমরাও। ওলা বুক
হয়ে গিয়েছে। গাড়িও প্রায় এসেই গেলো। এইবার ঠাকুর ঠাকুর করে বেরিয়ে পড়লেই যাত্রা
শুরু।
No comments:
Post a Comment