"শ্রীচরণকমলেসু মা
আশা করি আপনি ভালো আছেন। শীতের প্রকোপে আপনার পায়ের ব্যথাটা বিশেষ বাড়েনি তো? কবিরাজি তেল দিয়ে মালিশটা পারুলদিকে দিয়ে নিয়মিত করবেন কিন্তু। উপকার পাচ্ছিলেন বলেছিলেন। আমরা সকলেই ভালো আছি। বাবলু এবং বাবলুর বাবা সোল্লাসে বিদেশী শীতকালের আনন্দ উপভোগ করছে। আমি অবশ্য সারাদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকি, তাই কিঞ্চিৎ মনমরা। তবে আজ আপনার ছেলে এমন কাজ করেছে যে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি।
আমার গত পরশু থেকে ঠান্ডা লেগে অবস্থা একটু কাহিল। সর্দি কাশি তো ছিলই। তার সাথে গতকাল রাতে ভালোমতো মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল। অবশ্য সেই মাথা ব্যথার অন্য কারণও আছে। ভীষণ বাড়ির কথা, আপনাদের সকলের কথা, আমার মা আর দিদিমার কথা মনে পড়ছিল। যেই খেয়াল পড়েছে যে আজ পৌষ সংক্রান্তি, অথচ এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কোত্থাও কেউ নেই যে একটু ভালোবেসে নতুন গুড় দিয়ে পাটিসাপটা করে দেবে, দুধপুলি তুলে ধরবে মুখের সামনে। আসলে পৌষ সংক্রান্তির দিন তো নিয়ম করে পিঠে পুলি খেয়েই বড় হয়েছি। আপনিও তো গত বছর আমার পছন্দের গোকুল পিঠে আর পাটিসাপটা বানিয়েছিলেন। আমার মনে আছে। খুব ভালো খেতে হয়েছিল। সেই স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। একটু গুড় কিনে রেখে দেবেন ফ্রিজে। আমরা আবার যখন দেশে যাবো, আমায় রেঁধে খাওয়াবেন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। পিঠে পুলির কথা ভেবে ভেবে ভীষণ মন খারাপ। একেই এখন কোনো খাবারের স্বাদ পাচ্ছি না। তার ওপর এই মন কেমন। কান্নাকাটি করেছি সারাদিন, খুব। আর তাই মাথায় বড্ড যন্ত্রণা। ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলাম।
আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে দেরিতে। রান্নাঘর থেকে টুকটাক খুটখাট শব্দ পাচ্ছিলাম। মিক্সি চালানোর শব্দও আসছিল কানে। আর কানে আসছিল ছ্যাঁক ছোঁক। ভাবলাম বুঝি বাবা আর ছেলেতে মিলে ব্রেকফাস্টের অমলেট বানাচ্ছে। কোনো কায়দার স্টাফিং দিয়ে। ধীরেসুস্থে উঠলাম বিছানা ছেড়ে। মাথার ব্যথাটা কম। এক কাপ কড়া কফি খেলেই পুরোটা সেরে যাবে। একটু ফ্রেশ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতেই ব্যস। নাকে ঝাপটা এলো। নতুন গুড়। ক্ষীর। চাল গুঁড়ো। আহা। কোনো ভুল নেই। এই গন্ধ যে পাটিসাপটার। এ গন্ধ চিনতে আমি কখনো ভুল করবোই না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এই সময় এই সুগন্ধ। মাথাটা কি একেবারেই গিয়েছে আমার? ওষুধের প্রভাব? ভুল ভাবছি? ভুল বুঝছি? দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পৌঁছে গেলাম সোজা রান্নাঘরে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে।
এ কী। কী সারপ্রাইজ! বাবলু এবং তার বাবা, দুজনে ইতিমধ্যেই গোটা দশেক পাটিসাপটা ভেজে ফেলেছে। আরো অনেকটাই গোলা আর পুর রয়েছে। আমার সাধের রান্নাঘর এলোমেলো, লন্ডভন্ড। দুজনের চুলে গালে হাতে ময়দার ছড়াছড়ি। কিন্তু না। উঁহু। আজকে ওরা কেউ বকুনি খায়নি আমার কাছে। সামনে ওই গরম পাটিসাপটা। আর কি অন্যদিকে চোখ যায়? পাটিসাপটার ওপর নতুন গুড় ছড়িয়ে যা ভালো খেতে হয়েছিল, কী বলি আর? একদম আপনার হাতের রান্না যেন। আপনার ছেলে বললো, ছোট থেকে আপনাকে আর ওর ঠাকুমাকে রাঁধতে দেখে দেখেই শিখেছে। আর বাকিটা, পাড়াতুতো মাসীমাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছে।
আপনি আজ এখানে থাকলে ছেলে ও নাতির কৃতিত্বে খুব খুশি হতেন। গর্ব হতো আপনার।
আজ দিনটা বড্ড ভালো কাটলো। আপনার পুত্র ও পৌত্রের কৃপায়। আপনাকে তাই ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ জানাই, এমন ভালো সন্তান পালন করেছেন বলে। আর হ্যাঁ, একটা ঢিপ করে প্রণাম। সংক্রান্তির দিনে। ভালো থাকবেন। আপনার রান্না পিঠে পুলিটা কিন্তু তোলা রইলো। গিয়েই খাবো।
ইতি
আপনার স্নেহধন্যা
সুরঙ্গমা।
১৫ই জানুয়ারি, ১৯৯৫
রিভারডেল, ফিলাডেলফিয়া।"
চিঠিটা পড়া শেষ করে বাবলু ওরফে পৃথ্বীজিতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো অন্তর্লীনা। পৃথ্বীজিতের চোখে মুখে লেগে আছে একটা দুষ্টু মিষ্টি হাসি। ক্যাসারোল থেকে একটা পাটিসাপটা বের করে অন্তর্লীনার মুখে পুরে দিতে দিতে বললো, "কয়েকদিন আগে ঠাম্মার আলমারিটা পরিষ্কার করছিলাম। ওখানেই একটা বাক্সে এই চিঠিটা পেলাম। যখন আমরা ইউ এসে ছিলাম। সেই সময়কার চিঠি। মায়ের হাতে লেখা। ঠাম্মার কাছে যত্ন করে রাখা ছিল। আমিও পড়ে টরে ইন্সপায়ার্ড হয়ে গেলাম। আমার শেহজাদী ছুটি পায়নি। বাড়ি যেতে পারছে না। পিজির অখাদ্য কুখাদ্য হজম করতে বাধ্য হচ্ছে দিন কে দিন। নাহয় আমিই ফিল্ডে নামি। দেখ, অনুপ্রেরণা পেয়ে রাঁধলাম কেমন। ইগার্লি ওয়েটিং ফর ইয়োর কমপ্লিমেন্ট ম্যাডাম।" অন্তর্লীনা এক কামড় মুখে দেয়। আহা। নরম। গরম। টাটকা নলেন গুড়ের স্বাদ। মন চলে যায় দিদিমার রান্নাঘরে। টিনের ছাদের ছোট্ট রান্নাঘরটা। যেটাকে ওরা ভাইবোনেরা সব ম্যাজিক রুম বলেই জানতো। কারণ ওখানে গেলেই ম্যাজিকের মতো দিদিমা ঠিক ওদের মন বুঝে পছন্দের খাবার তৈরি করে দিতো। শীতের ছুটিতে সেই ম্যাজিক রুম নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করতো। আহা। আজ এত বছর পরে আবার সেই স্বাদ ফিরে পেলো ও। পৃথ্বীজিতের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো, "আজ তোর ঠাম্মা আর আমার দিদিমা, দুজনেই খুব প্রাউড হতো জানিস, তোকে দেখলে। আই এম শিয়র, ওরা দেখছেই। আদরের নাতি নাতনিগুলোর এই পিঠে উৎসব। থ্যাংক ইউটা বড্ড পলকা জানিস তো এইসব ক্ষেত্রে। তাও বলবো, রেঁধে বেড়ে খাওয়াস চিরকাল। আমি যা ল্যাধখোড়।" পৃথ্বীজিত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, "কোনোদিনও যদি অথেন্টিক সংলাপ কিছু বলতি রে। ব্যোমকেশের এই সিজনটা আমারও দেখা হয়ে গিয়েছে রে। থ্যাংক ইউ এর ডায়লগটা যে ঝাঁপা, জানি কিন্তু।" অন্তর্লীনা মুচকি হেসে বলে, "তাহলে আর কী। বাকিটাও অনুসরণ কর। আমি বরং খাওয়ায় মন দিই। কী বলিস?"
No comments:
Post a Comment