Wednesday, May 16, 2018

না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা

"না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা"

প্রিয়

অনেকদিন পর চিঠি লিখতে বসেছি। হয়তো আমার চিঠিটা পড়তে বসে তুই খুব অবাক হবি। আসলে আমার কাছে অনেক কিছু ছিল, সেগুলির আর সত্যিই কোন প্রয়োজন নেই, বা বলতে পারিস, মূল্য নেই আমার কাছে। তোর কাছে সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু থাকতে পারে, তাই পাঠাচ্ছি। মনে কর, এই চিঠিটা যেন সেগুলিরই একটা কাভার লেটার।

এই এত্ত এত্ত জিনিস, একটা বাক্সে আঁটানো খুব মুস্কিল হয়েছিল জানিস, তাও কোনোমতে করেছি। দেখ ফিতেটা কাট, সাবধানে, কাঁচি ব্যবহার কর। মনে নেই, সেই সেবার তোর জন্মদিনের উপহারের ফিতে কাটতে গিয়ে হাত কেটে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়েছিলি? ব্যথা পেয়েও শিখিস না, সত্যি! হুম, কাঁচিটা নে, ফিতে কাট। হ্যাঁ। একটা সেলোফিনে মোড়া দুটো বাসের টিকিট দেখেছিস? ২৩৪ রুটের, চার টাকার। স্টেডিয়াম থেকে থানা। এটা কিন্তু আমাদের প্রথম একসাথে যাওয়ার দিনের না । এটা হল সেই মেঘলা দিনেরটা। আমরা দুজন ক্লাস শেষ করে বাস স্ট্যান্ড অবধি হেঁটে এলাম। সেদিন কেন জানিনা, বারবার খালি আমাদের দুজনের হাত একে অপরের স্পর্শ পাচ্ছিল। তুই চলে যাওয়ার পর, আমি অনেকক্ষণ বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ভিজলাম। মায়ের কাছে খুব বকা খেয়েছিলাম জানিস, খাবো নাই বা কেন? আমার তো খুব ঠাণ্ডা লাগার ধাত। সেইবারে জ্বর এসছিলও। তবে কপালের উষ্ণতার মধ্যে যেন বারবার তোর হাতের স্পর্শ অনুভব করছিলাম।

জ্বর প্রসঙ্গে মনে পড়ল। মনে আছে সেই একবার শীতের ছুটিতে আমরা সবাই দেখা করলাম - তুই আমি পিউ দীপু... আমার সেদিনও জ্বর ছিল (ফেসবুকের ছবিগুলোতে কী বাজে লাগছিল আমায়!), তুই সেটা শুনে ক্যালপলের পাতা এনে দিয়েছিলি। এক্সপাইরি ডেট পেরিয়ে গেলেও এই পাতাটা আমি চার বছর ধরে জমিয়ে রেখেছিলাম। ওটাও খুঁজে দেখিস, বাক্সে পেয়ে যাবি।

প্রথম স্টাইপেন্ড পেয়ে তোকে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম মনে আছে রেড প্যান্ডাতে? সেই যে সেই রুফটপ রেস্টুরেন্টটা, জ্যোমাটোতে দারুণ রেটিং ছিল। তখন আমরা অফিশিয়ালি কাপল না হলেও দুজনের প্রতি একটু একটু আকর্ষণটা বুঝতে শিখেছি। সেই বিলটা না এখনো আছে। ওটাও পেয়ে যাবি এই নীল খামে। নীল খামটা পন্ডিচেরি থেকে কিনেছিলাম। তুই ততদিনে ইন্টার্নশিপ করতে শিকাগো চলে গিয়েছিস। প্রতিদিন তোর নামে একটা করে চিঠি লিখতাম। এই নীল খামে ভরতাম। কিন্তু পাঠানো হয়ে ওঠেনি। সব জমিয়ে রেখেছি। ওগুলো কিন্তু খুঁজিস না এই বাক্সে। সেগুলি একান্তই আমার আপন।

ততদিনে তুই নিজের জগত পেয়ে গিয়েছিস। সেই জগতে আমার স্থান আছে কি না, সেই ব্যাপারে তুই তখনও দ্বিধায় (আচ্ছা এখন কি তুই সেই দ্বিধা কাটিয়েছিস?)। তোকে জিজ্ঞেস করলাম, স্কাইপে তোর মুখ চোখ দেখেই বুঝলাম প্রশ্নপত্র ভীষণ কঠিন সাজিয়ে ফেলেছি। তোর সিলেবাসের বাইরে। তুই বাড়তি সময় চাইলি। দিলাম। ওই সময়টা রোজ চিঠিগুলি লিখতাম। ভেবেছিলাম তুই ফিরলে একসাথে সব কটা দেবো। তারপর যখন ফিরলি, দেখলাম তুই তখনও বড্ড ইমোশনালি আনস্টেবল। বুঝলাম এইভাবে চলবে না।

খুব কষ্ট হয়েছিল। তবুও নিজেকে তোর থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলাম। বলে না, out of sight, out of mind - হলো উল্টো। "Tis distance that leads to enchantment"। রাতের পর রাত কাঁদতাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর রাত্রে একটু কখন কে জানে দুই চোখের পাতা এক হতো বটে। রোবটের মতো সারাদিন কাজেকর্মে ভুলে থাকতাম। রাত হলেই আবার সেই এক চক্র শুরু। এই করতে করতে হঠাৎ একদিন সকালবেলা বুঝলাম যে ব্যথাটা একটু কমেছে। আর তারপর সেই প্রকোপটা একটু একটু করে আরো কমছে। কমতে কমতে এখন শূন্যে এসে ঠেকেছে।

আবার ব্যথাটা যদি ভুল করে চাগাড় দিয়ে ওঠে, সেই ভয়ে ভাবলাম তোর আমার সব স্মৃতিচিহ্নগুলো ফেরত দিয়ে দিই তোকে। আমার দিদিমার থেকে ছোট থেকে এই সঞ্চয়ের অভ্যেস পাঠিয়েছি। কিচ্ছু ফেলিনা। তাই এই চার বছরের অনেক অনেক স্মৃতি রয়ে গিয়েছে - উপহারের বই, দুল, কাজল থেকে শুরু করে প্রতিটা রেস্টুরেন্টের বিল, পস মেশিনের স্লিপ, কত্ত কিছু। এই পার্থিব জিনিসগুলি বাক্সবন্দী করে দিলাম। মুহূর্তগুলো, ভালোলাগা, ভালোবাসা - এগুলি কীভাবে ফেরত দিই বল তো? জানা নেই। জানাস, তাও ফেরত দিয়ে দেবো। অনেকটা হয়তো এই কন্ট্রোল জেডের মতো।

তোর সাথে কাটানো সময়গুলো বড় ভালো কেটেছে। চাই না আর তিক্ততা বাড়াতে। তাই মনে হল, এই ভালো। তুই থাক নিজের মতো। আর প্রশ্নপত্র নিয়ে ভাবতে হবেনা। পরীক্ষা বাতিল। অপ্রয়োজনীয়। ভালো থাকিস। সুখে থাকিস। আর আমাদের প্রিয় গানটার কথাই ধার করে বলি,

" দুঃখ তোমার কেড়ে নিতে চায় যত...

সুখের দিনে নাই বা পেলে পাশে, খবর দিয়ো হঠাৎ কান্না পেলে।"

ইতি

তোমার "কী জানি কী"


https://www.youtube.com/watch?v=Jc4DyACFVqY

No comments:

Post a Comment