১।
"মা,ঝটপট ভাতটা বেড়ে দাও প্লীজ। দেরি হয়ে যাবে নইলে।"
"দিয়ে রেখেছি। ফ্যান চালানো আছে। ঠাণ্ডা করতে। তুই আয়।"
"আসছি মা, দুলটা পরে নিই।"
"বেশী সাজগোজ করতে যাস না। প্র্যাকটিস টিচিং করতে যাচ্ছিস, এখনো স্টুডেন্ট তুই। বেশী সাজলে লোকের চোখ টাটাবে।"
"টাটালে টাটাবে। আমার ইচ্ছে হলে সাজবো, লোকের দেখার হলে দেখবে, না হলে দেখবেনা। মন্তব্য করলে করবে। শালীনতা বজায় রেখে চললে উভয়পক্ষ, কোন তো অসুবিধে হওয়ার কথা না।"
"ওরে এটা তোর লরেটো না মা, এটা সরকারী স্কুল।"
"তাতে কী? শাড়িই তো পরছি। সাথে একটু কাজল। টিপও পরিনি।"
"বাবা রে বাবা। আমার ঘাট হয়েছে। আর বলবনা। যা ইচ্ছে কর। পারসোনাল এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলছিলাম। শোনার হলে শুনবি, না হলে না।"
"একজ্যাক্টলি মা। এইটাই বলতে চেয়েছি। প্রত্যেকের স্বাধীনতা আছে। অন্যকে আঘাত না দিয়ে যতক্ষণ নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করতে পারব, ততক্ষণ কারুর কিছু বলাকওয়ায় আমার অন্তত যায় আসে না। (সুর করে) আমি শুচি আসন টেনে টেনে বেড়াবো না বিধান মেনে!!! বুঝলে হে মা?"
"সবেতেই রবি ঠাকুর কপচাস না তো। ছাড় এবার। খেতে বস।"
"আহ, ঠিক আছে। বাংলা সাহিত্যের স্টুডেন্ট, রবিবাবু ছাড়া কেইই বা আছে আমাদের? যাক গে। বুঝলে, আজ শুক্তোটা যা জম্পেশ হয়েছে। মানদাদিকে বলো।"
বছর বাইশের টুকটুকি আর ওর মায়ের সংসার। ওর বাবা মারা যান যখন ওর বয়স মোটে চার। বাবাকে নিয়ে কোন স্মৃতিই নেই টুকটুকির। মায়ের আদরে আর শাসনেই সে আজ বড় হয়েছে। সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা মায়ের আদর্শে বেড়ে ওঠা টুকটুকি আজ বি এ পাস করে বি এড পড়ছে। প্র্যাকটিস টিচিং করতে আজ যাচ্ছে একটি আধা সরকারী স্কুলে, একটু মফঃস্বলের দিকে। সিনিয়রদের থেক শুনেছে যে এখানে নাকি সক্কলে ভীষণভাবে প্রাচীনপন্থী, স্যারেরা ধুতি শার্ট আর ম্যাডামরা শাড়ি ছাড়া পরেন না। ও শহুরে মেয়ে, শাড়িতে খানিক অনভ্যস্ত, ভালো করে রুল্বুক দেখেছে। কোথাও ড্রেসকোড নিয়ে কিছু লেখা নেই। ঠিক করেছে আজ প্রথম দিন বলে শাড়ি পরবে, পরেরদিন থেকে সালওয়ার কামিজ। যে যা বলে, বলুক। খেয়ে উঠে পাঁচ মিনিট বসে তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে টুকটুকি বেরোল স্কুলের উদ্দেশ্যে। ট্রেন আর টোটো চেপে প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা।
২।
"আসুন সুরঙ্গমা। স্কুলে চিনে আসতে কোন অসুবিধে হয়নি তো?"
"একটুও না। ষ্টেশনের বাইরে টোটো স্ট্যান্ডে স্কুলের অনেক ছাত্রদের দেখতে পেলাম। ওদের সাথেই চলে এলাম।"
"বেশ। টা ওরা জ্বালায়নি তো?"
"ওমা, না না। জ্বালাতন করবে কেন?"
"না, তেমন রেপুটেশন কি না।"
"আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ম্যানেজ করে নেবো। আপনি বরং আমায় ক্লাস বুঝিয়ে দিন।"
"হ্যাঁ, আসুন।"
হেডমাস্টারবাবুর অফিসের পিয়ন হালদারদার সাথে টুকটুকি ওরফে সুরঙ্গমা সেন এলো স্টাফ্রুমে। সেখানে জানলার ধারে একটা খালি চেয়ার টেবিল রাখা, সেখানেই বসবে আগামী পঁচিশ দিন। দশটা নাগাদ প্রথম ক্লাস। ক্লাস ইলেভেন। বাংলার শিক্ষক, অপূর্ববাবুর সাথে ক্লাসে এলো সুরঙ্গমা। দোতলার একটা বিরাট ঘর। আগেকারদিনের বাড়ি, খুব উঁচু সিলিঙ, সিলিঙ থেকে লম্বা লম্বা ডাণ্ডার ফ্যান ঝুলছে চারটে। চেয়ার টেবিল পুরনো আমলের, ঘরে টিউবলাইটের আলো জ্বলছে। জনা তিরিশেক ষোলো-আঠারোর ছেলেপিলে বসে আছে। এই বয়সের ছেলে, ক্লাস ফাঁকা থাকলে তো কেউ শান্ত হয়ে থাকেনা, তাই প্রথম ক্লাসে ঢুকে মাছের বাজারই মনে হচ্ছিল টুকটুকির। অপূর্ববাবুর "ক্লাস, চুপ কর তোরা"তে সব শান্ত হল।
"ইনি সুরঙ্গমা। তোদের নতুন ম্যাডাম। আগামী কয়েক সপ্তাহ তোদের ক্লাস নেবেন। আমি ক্লাসের পিছনে বসে থাকব। একটুও জ্বালাতন করবিনা। সহযোগিতা কাম্য।"
গোটা ক্লাস চুপ। হাঁ করে সবাই তাকিয়ে ওঁদের নতুন দিদিমণির দিকে। টুকটুকি একটু অস্বস্তিবোধ করল বটে, কিন্তু তারপর যেই শুরু করল চর্যাপদ পড়ানো, ওর যেন সব দ্বিধা কেটে গেলো। ছাত্রছাত্রীরাও মুগ্ধ হয়ে ওর পড়ানো শুনতে লাগল। দেখতে দেখতে কখন যে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাস শেষ হয়ে গেলো, কেউই যেন টের পায়নি। অপূর্ববাবু স্টাফ্রুমে এসে ওর খুব প্রশংসা করলেন। এরপর দুই পিরিয়ড অফ, তারপরে ক্লাস এইটের একটা ক্লাস নিতে হবে। ব্যস, ছুটি। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মাকে একবার জানানোর জন্য বারান্দার কাছে গেলো। ধুর, সমানে বিজি আসছে। কে জানে এই বেলা এগারোটার সময় কার সাথে আবার গল্প জুড়েছে মা। ক্লাস নেই নাকি আজ? মিনিট দশেক চেষ্টা করেও যখন ফোনে পেল না, তখন আবার স্টাফরুমে ফিরবার উপক্রম করল টুকটুকি। ইংরেজির ছন্দাদি ওকে দেখে হাসলেন আর তারপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। "শুনলাম অপূর্বদার কাছে, তুমি খুব ভালো পড়িয়েছ। কাকে ফোন করে বলছ? বয়ফ্রেন্ডকে?" চোখ টিপে হাল্কা হাসলেন। টুকটুকির গেলো রাগ ধরে। কে রে বাবা, চেনা নেই জানা নেই এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন কেন? অদ্ভুত তো। "না, মা কে।" এই বলে ও ফিরল স্টাফরুম। পাশ দিয়ে তখন ইলেভেনের ছেলেগুলো যাচ্ছিল, কী লজ্জা। নিশ্চয়ই ওরা শুনলো।
ক্লাস এইটের ক্লাসটিও বেশ ভালোই হল। আবার আসব ফিরে পড়াতে হল, পরাতে গিয়ে জীবনানন্দের মৃত্যু চেতনা নিয়ে বোঝাতে গিয়ে বারবার নিজের স্কুল জীবনের কথা মনে হচ্ছিল সুরঙ্গমার। শাশ্বতী আনটি কী সুন্দর করে বোঝাতেন, মাথার মধ্যে যেন আজও গেঁথে আছে সব। ও কি কোনদিনও অমন ভালো শিক্ষিকা হতে পারবে? বিরাট চ্যালেঞ্জ।
৩।
"ম্যাডাম, অনেকদিন পরে একটা ভালো ক্লাস উপভোগ করলাম।" স্টেশন প্ল্যাটফর্মে বসে ফোন নিয়ে খুটখুট করছিল টুকটুকি। ট্রেন আসতে ঘন্টাখানেক বাকি। একটুর জন্য একটা মিস করেছে। এই লাইনে প্রতি ঘণ্টায় একটা করে ট্রেন। হঠাৎ এই কথায় একটু চমকে মুখ তুলে দেখল, ওর ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র, সুবীর। ও যখন পড়ায়, প্রতিদিন সুবীর ফার্স্ট বেঞ্চে বসে। হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে পড়া গিলে নেয়। একটু অস্বস্তি হয় বই কি, সারাক্ষণ ওরকম তাকিয়ে থাকায়। তবে ছেলেটির হাব ভাব ব্যবহার মন্দ না। লেখাপড়াতেও ঝোঁক আছে। সিনিয়রদের থেকে বয়েজ স্কুল সম্বন্ধে যেমন একেকটা বিভীষিকার কাহিনী শুনেছিল, মোহনপুর বয়েজ স্কুলে অন্তত তেমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি টুকটুকিকে এই এক সপ্তাহে।
"তাই বুঝি? কেন অপূর্ববাবু কেমন পড়ান? ওনার ক্লাস ভালো লাগেনা?"
"হ্যাঁ, উনি সিলেবাসটা খুব ভালো কাভার করেন। ওনার জন্যই তো মাধ্যমিকে লেটার এসছে আমাদের কতজনের, বাংলায়। কিন্তু উনি আপনার মতো না।"
"আমার মতো না বলতে?"
"আপনি কী সুন্দর গভীরভাবে ভাবেন, ভাবান। চর্যাপদ পড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথে চলে গেলেন।"
"সেটা ভালো নাকি? অত টপিক থেকে সরে গেলে সিলেবাস শেষ হবে কেমন করে?"
"ঠিক হবে ম্যাম। কিন্তু এইভাবে পড়লে জিনিসটা অনেক বেশী ভাল বুঝছি, মনের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে।"
"তাহলে ভালো। আমি তো ভাবছিলাম এরকম করে পড়ালে আমি কুড়িদিনে সিলেবাস শেষ করতে পারব না। আজ অপূর্ববাবু বললেন, চারদিন হয়ে গেল, এখনো চর্যাপদে আটকে কেন। এরপর বৈষ্ণব পদাবলীতে ঢোকো"
"ম্যাম, আপনি কুড়িদিন পর চলে যাবেন?"
"হ্যাঁ, আমি তো প্র্যাকটিস টিচিং করতে এসেছি।"
"ও। আসলে এই কদিনে আপনার ফ্যান হয়ে গিয়েছি।"
"মন দিয়ে লেখাপড়া করো। লাইব্রেরী থেকে বই তুলে পড়ো। রিসোর্সের তো অভাব নেই।"
"হ্যাঁ।"
"তুমি কোথায় থাকো? ট্রেন কখন?"
"আমার বাড়ি হাঁটা পথ ম্যাডাম। ক্লাসের পর ভাবলাম আপনার সাথে গিয়ে কথা বলি। দেখলাম আপনি ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছেন। তাই সাইকেল চেপে এলাম।"
"আচ্ছা।"
"চা খাবেন ম্যাডাম?"
"হ্যাঁ। খাওয়া যায়। এমনিও আমার ট্রেন আসতে দেরি আছে। চলো।"
৪।
ট্রেনের জানলার ধারে সিটে বসে সুবীরের সাথে গল্পগাছার কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল। ছেলেটার সাথে কথা বলে খুব প্রমিতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। প্রমিত ওর সাথে আই সির টিউশনে বাংলা পড়ত, সেন্ট লরেন্সের স্টুডেন্ট। খুব ভাব ছিল ওদের মধ্যে তখন। নানান বিষয়ে অসীম কৌতূহল, অপরিসীম জ্ঞান। কথা বলতে গেলে কোনদিনও টপিকের কমতি হত না। সুবীরও মনে হয় তেমনই। হয়তো ওও তারপর প্রমিতের মতই টুয়েলভের পর ইঞ্জিনিয়ারিঙে চলে যাবে। এইসব সাহিত্য থেকে শত হস্ত দূরে। ছেলেটা এখন প্রায় রোজই ওর সাথে ষ্টেশনে আসে। টিফিনের সময়টা ওর সাথে গল্প করে আবার ক্লাসে ফেরত যায়। বেশ ভালো লাগে ওর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে। আজকাল আবার গল্পের বিষয় শুধুই সাহিত্য না। নানান সময়েই জীবনদর্শন, দৈনন্দিন ঘটনা, গান, ইত্যাদি নিয়েও জমাটি আড্ডা হয়। দু সপ্তাহেই বেশ একটা আলাদা রকমের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে ওদের দুজনের। অসম বন্ধুত্ব বলা যায় না। কতই বা বয়সের ব্যবধান? বছর ছয় সাতের? সুবীরের মধ্যে বেশ একটা পরিণত ভাব আছে, যার ফলে বয়সের এইটুকু ফারাকটাও মনে পড়ে না। ওদের এই গল্প করাটা খানিকটা যেন অভ্যেসেই দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মাঝে দুদিন সুবীর স্কুলে আসেনি, বড্ড
ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল টুকটুকির। রবিবারও কেমন আনচান আনচান ভাবে কাটল। টুকটুকি ঠিক কোন নাম দিতে পারেনা এই বন্ধুত্বের, এই সম্পর্কের। হয়তো সব সম্পর্কের নামকরণ প্রয়োজন নেই, অযথা জটিলতা এসে পড়ে।
৫।
আজ শেষবারের মতো ক্লাস নিলো সুরঙ্গমা। এখন ষ্টেশনে পাশাপাশি বসে টুকটুকি আর সুবীর। দুজনেই চুপচাপ। কোন কথা হচ্ছেনা। ক্লাসে আজ ছেলেরা ছোট্ট করে সুরঙ্গমা ম্যাডামকে ফেয়ারওয়েল দিয়েছে। বিভিন্নজন নানান গান আবৃত্তি করেছে। ক্লাস যখন শেষ হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি, তখন বন্ধুদের ধাক্কাধাক্কিতে বাধ্য হয়ে সুবীর এলো সামনে। তারপর ওর ভরাট গলায় ধরল, "আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্কভাগী।" মুগ্ধ হয়ে গোটা ক্লাস ওর গান শুনলো। এত দরদ, এত অপূর্ব অভিব্যক্তি। সুরঙ্গমার দু চোখ চিকচিক করে উঠেছিল।
ট্রেন ঢুকছে ষ্টেশনে। টুকটুকি নিজের হাতটা ছাড়াল সুবীরের হাত থেকে।
"ভালো থাকিস। অনেক বড় হ" বলে এগিয়ে যাচ্ছিল দরজার দিকে, এমন সময়ে পিছন থেকে শুনল, "প্লীজ পরের ট্রেনটায় যাও। আরো কিছুক্ষণ বসি?"
" এলো আঁধার ঘিরে
পাখি এলো নীড়ে
তরী এলো তীরে
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো
ওগো দুঃখ জাগানিয়া... "
https://soundcloud.com/suchetana-gupta-620409473/ami-tomar-preme-hobo-shobar-kolonkobhagi-short
No comments:
Post a Comment