শুভ্র রোহিণী আর ওদের মেয়ে মেখলার ছোট্ট সংসার। এই শহরে এসেছে ওরা গত মাসে, শুভ্রর চাক্রিসূত্রে। শুভ্র চাকরি করে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে, রোহিণী লেখালিখি নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করে। মেখলার বয়স আট। আর পাঁচটা এই বয়সী বাচ্চার মতই সরল নিষ্পাপ হাসিখুশি। হাউজিং কমপ্লেক্সের বাকি বাচ্চাদের সাথে বিকেলবেলা খেলতে নিয়ে যায় ওর আয়া মাসি, কমলি। ধরাধরি, ছুটোছুটি, দৌড়ঝাঁপ করে খেলেধুলে প্রতিদিন যখন বাড়ি ফেরে পার্ক থেকে, কলকল করে মায়ের কাছে গল্প করে। কোন বন্ধু কী বলল, কটা খেলায় জিতল, কার সাথে আড়ি আর কার সাথে ভাব হলো, এই সব নিয়েই ওর ছোট্ট জগত। রোহিণীও এইসব শুনতে শুনতে পৌঁছে যেত নিজের ছোটবেলায়। তখন ওদের পাড়া কালচার ছিল। সমস্ত কচিকাঁচার দল, একটু বড়দের তত্ত্বাবধানে খেলত, পড়ত। বেশ একটা সাবেকি যৌথ পরিবার গোছের ব্যাপার ছিল। শুধু যে ভালোটুকুই ছিল, তা না। অনেক মনোমালিন্য, মন কষাকষিও লেগেই থাকত। তবুও সবের মধ্যে একটা মিলমিশ ব্যাপার ছিল। একই সাথে শীতকালে পিকনিক থেকে শুরু করে রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যাপালন, বিজয়া দশমী লেগেই থাকত।
এই কমপ্লেক্সে প্রত্যেকেই ব্যস্ত। তেমনভাবে পাশের ফ্ল্যাটের মানুষজনের সাথেও একে অপরের ভাব নেই, কথাবার্তা নেই। লিফটে দেখা হলেও সকলেরই মাথা নিচু, হাতে মুঠোফোন। তবুও এই বাচ্চাগুলোর সূত্রে অল্পবিস্তর যোগাযোগ হয়। এর তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মায়েদের নেমন্তন্ন হয়, সেই সুবাদে রোহিণী চেনে জনা দশেককে।
মেখলা থ্যালাসেমিয়ার রুগী। যার ফলে ওর জীবনযাপন আর পাঁচটা বাচ্চার মতো পুরোপুরি এক না। বছরে আট নয়বার রক্ত নিতে হয়। খুব বেশী দৌড়ঝাঁপ করতে পারেনা। খাবার খাওয়ায়ও কিছু রেস্ট্রিকশন মেনে চলতে হয়। যখন প্রথম মেখলার অসুখটা ধরা পড়েছিল, রোহিণী আর শুভ্র ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। তারপর নানান কাউন্সেলিং করে এখন ওরা অনেকটাই স্বাভাবিক। অন্তত চেষ্টা করে একটা স্বাভাবিক জীবনযাপনের। মেখলাকে সব সময় বুঝিয়ে শুনিয়ে আগলে আগলে রাখাটাই ওদের জীবনের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। এই কমপ্লেক্সের বাচ্চাগুলো এতটাই ছোট, ওরা এখনই এই রোগের কথা বুঝবেনা। ওদের শুধুই এক কথা, "why is Mekhla not coming to play today", বা "Why Mekhla cannot run much" ইত্যাদি। মায়েরা জানে, তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে মেখলার শরীরটা ভালো নেই। ওর বন্ধুরাও ওকে ভালোবাসে বলে যত্ন নেয় ওর, একটা রীতিমতো সাপোর্ট গ্রুপের মতো কাজ করে মেখাল্র বন্ধুরা ও তাদের মায়েরা।
একদিন সন্ধ্যেবেলা মেখলা খেলে ফিরল ফ্ল্যাটে। রোহিণী লক্ষ্য করল মেয়ে চুপচাপ, তেমনভাবে কথা বলছেনা। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে উত্তর পেলো না। ভাবল, বাবা ট্যুরে গিয়েছে, হয়তো সেই জন্য মন খারাপ। ঘাঁটল না রোহিণী মেখলাকে। মনমরা হয়েই একটু হোমওয়ারক করল রোজের মতো। ওই একটু আঁকিবুঁকি কাটা খাতায়। আর কিছু রঙ করা। পরেরদিন রোহিণী দেখল মেখলার তাও মন খারাপ কমেনি। কিছুতেই খেলতে গেলো না। ওকে নিয়ে মন ভালো করতে কাছের মলে গেল, আইসক্রিম খাওয়ালো। যে মেয়ে আইসক্রিমের বায়না করে অন্যান্য সময়ে অতিষ্ঠ করে ছাড়ে, সে মেয়ে আজ যেন দোকানে গিয়েও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম নেবে জিজ্ঞেস করায় স্বভাববিরুদ্ধ "তোমার যা ইচ্ছে" বলে একটা কোণে দাঁড়িয়ে থাকল। রোহিণী একটু অবাক হল। কিছু গণ্ডগোল নাকি? দিনকাল ভালো না। যাক, শুভ্র ফিরছে রাত্রে, নিশ্চয়ই মেয়ের মন ভালো হয়ে যাবে ঠিক, এই ভেবে সরিয়ে দিল কুচিন্তা।
শুভ্র ফিরল রাত করে, মেখলা ততক্ষণে নিজের টেডি আঁকড়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রোহিণী একবার জানালো মেয়ের কথা বাবাকে। "আরে ও এমনি কোন বন্ধুর সাথে দেখো ঝগড়া হয়েছে হয়তো, বা কোন গেমে হেরেছে। তাই মুড অফ। তুমি চিন্তা করো না।" এই বলে শুভ্র অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। জীবন নিত্যনইমিত্তিকভাবে চলতে লাগল। শুধু পরপর চারদিন হয়ে গেলো, মেখলা কিছুতেই খেলতে যেতে চায়না নীচে। রোহিণী একদিন কাজ ফেলে নিজে ওর সাথে নামবে বলতেও মেয়ে কিছুতেই রাজি হল না। উল্টে জোরাজুরিতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। কী হয়েছে, কেন খেলবে না বারবার জিজ্ঞেস করাতেও কোন উত্তর নেই। শুধুই কান্না। এবারে কিন্তু রোহিণী বেশ চিন্তিত হল। শুভ্রকে মেসেজ করে ব্যাপারটা জানালোও। শুভ্র ফিরল মেয়ের জন্য খেলানাপাতি কিনে, তাতেও মেয়ের কান্নাকাটি থামেনা। মেয়ে বাবার বেশী ন্যাওটা। তাই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করে বাবা অবশেষে জানলেন আসল কারণ। কিছুদিন আগে খেলতে গিয়ে কমপ্লেক্সে নতুন মুখ রুনিদাদা নাকি ওকে নিয়ে খুব মস্করা করেছে, কেন মেখলা বেশী দৌড়তে পারেনা, ইচ্ছে করে ওর খেলার সময় বলগুলো দূরে দূরে ছুঁড়ছিল, ও হাঁপিয়ে যাওয়ায় ওকে আর খেলায় নেবেনা বলেছিল। রুনি বাকিদের চেয়ে একটু বড়। সাথে রয়েছে বেশ মজার মজার নানান খেলনা। বাকি বাচ্চারাও স্বভাবতই তাই মেখলাকে ছেড়ে রুনির সাথেই ছিল। এতে মেখলা মনমরা হয়ে গিয়েছে। আর তাই কিছুতেই খেলতে যাবেনা। বলতে বলতে ওইটুকুনি মেয়ের দুই গাল বেয়ে বড় বড় কান্না গড়িয়ে পড়ছিল। রোহিণী নিজেকে সামলাতে না পেরে অঝোরে কান্না শুরু করল। একেই মেয়ের অসুস্থতার জন্য নিজেকে ভীষণভাবে দায়ী মনে করে, আর প্রতি পদে তাই মেয়েকে ভুগতে দেখলে বা কষ্ট পেতে দেখলে সাংঘাতিক অনুশোচনায় ভোগে। সেই সব দিক দিয়ে শুভ্র অনেকটাই শক্ত। কষ্ট খারাপ লাগা সবই আছে ওর, কিন্তু প্রকাশটা খুব কম। আজ মেয়ে আর বউকে এমনভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে ভারি আনচান করছিল ওর মন। কীভাবে কী সামলাবে ভাবতে গিয়ে দিশেহারা। চুপচাপ দুজনকে বুকে টেনে বসে রইলো খানিকক্ষণ। পরম শান্তি একে অপরের ওমে।
তারপর বলল, "জানিস মেখলা মা, আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন একবার দোল পূর্ণিমার দিন ভোরবেলা পাশের বাড়ির আম গাছ থেকে মুকুল পাড়তে পাঁচিলে উঠেছিলাম। বন্ধুদের কাছে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম, ধরা না পড়ে এক ঝুরি মুকুল আনবো। তা হল কী, আমার এমনই কপাল খারাপ, আগের রাত্রে শিশির পড়ে পাঁচিল পুরো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ছিল। ওই পিছল পাঁচিল থেকে আমি পা ফস্কে পড়লাম একদম নীচে। হাত ভাঙল। ছয় সপ্তাহ ওই অসহ্য ব্যথা আর প্লাস্টারের কষ্ট। খেলতে যেতে পারি না। একেই এইসব করেছি বলে বাবা মায়ের থেকে বকুনি খেলাম। তারপর আমার সেই বন্ধুরাও দেখি আর আমার খোঁজ নিত না। এক দুজন শুরুর দিকে এসে দেখে যেত। তারপর ওদের আসাও বন্ধ হয়ে গেল। খুব কষ্ট হত। হাতের প্লাস্টার কাটার পর যেদিন খেলতে গেলাম মাঠে, দেখলাম সব্বাই তখন নতুন নতুন বন্ধু পেয়ে খেলায় মত্ত। আমায় তেমন ভাবে পাত্তাই দিলো না কেউ। বাড়ি এলাম মন খারাপ করে। তখন জানিস তোর ঠাম্মা কী বলেছিল আমায়? বলেছিল যে এইটাই পৃথিবীর নিয়ম। কারুর জন্যই কোন কিছু আটকে থাকেনা। জীবনে চলার পথে বিভিন্ন মানুষের আসা যাওয়া চলতে থাকে। কারুর ওপর কখনো নির্ভর হবি না। নিজের মতো করে নিজেরটুকু দিয়ে থাকবি, বাঁচবার রসদ পাবি। জানি, এখন হয়তো অনেক কিছুই বুঝছিস না, কিন্তু আরেকটু বড় হ, তখন বুঝবি। জীবনের সমস্ত যুদ্ধ জয় করার শক্তি আমাদের অন্তরে আছে, কারুর ওপর যেন কক্ষনো নিজের সুখকে নির্ভর করবিনা। কারুর কাছে ঋণী হবিনা। নিজের মতো করে নিজের ক্ষমতায় মাথা উঁচু করে চলবি। দেখবি তাহলে আর এরকম এর তার ব্যবহারে কষ্ট পাবিনা।"
"এত ভারি ভারি কথা মেখু বুঝবে নাকি? তুমিও না! এর চেয়ে মাম্মা, তোকে একটা গান শোনাই। মন্ত্রের মতো করে গানটা শুনবি, গাইবি, বুঝবার চেষ্টা করবি। দেখবি, সব সময় মনে বল পাবি।"
"কী গান মাম্মা?"
" আমি গাই, তুই শোন। তারপর আমি এক লাইন গাইবো, তুই শুনে শুনে গাইবি। ঠিক আছে?"
"ওকে মাম্মা। ফাঙ্কশানের মতো গান শিখব?"
"হুম, এই ফাঙ্কশানটা হবে অনেক বড় স্টেজে। জীবনে।"
রোহিণী সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠল,
"তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে।
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে, তারি আদেশ পেলেছ।
তুমি আঁধার বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠো, তুমি ছোট হয়ে নও গো ছোট,
জগতে যেথায় যত আলো সবায়, আপন ক'রে ফেলেছ।।"
এই গানটি মেখলার আগামী দিনগুলিতে, ওর নানান বাধা বিপত্তিভরা জীবনের পথে সান্ত্বনার পরশ নিয়ে আসুক, প্রতি পলে, এইটুকুই সদিচ্ছে রইল রোহিণী আর শুভ্রর।
No comments:
Post a Comment