Wednesday, May 2, 2018

প্রাত্যহিকী

পার্ট থ্রি পরীক্ষা শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ হল। ভাইয়ের এখন জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স বাকি, তাই এক্ষুনি বেড়াতে যাওয়াও হচ্ছেনা কোথাও। মা সারাক্ষণ ভাইয়ের পিছনে টিকটিক করে যাচ্ছে। বাবার অফিসে এখন ভগবান জানে কেন এত কাজের চাপ। বাড়িতে যে কতটুকু সময় থাকে, কে জানে। বন্ধুরা সব এদিক ওদিক ঘুরতে চলে গিয়েছে। অখণ্ড অবসর, অথচ আমি কাঠ বেকার। আমি শাল্মলী, বয়স এই গত মাসে একুশ পূর্ণ হল। বেথুন কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে বি এস সি পড়লাম। গান গাইতে ভীষণ ভালবাসি। নাচও ভালোই পারি। আঁকাটা তেমনভাবে আসেনা, তবে কাজ চালিয়ে দিতে পারি। বন্ধুদের হাতে মেহেন্দি করতে হলে আমিই হলাম সেই ""go-to person"। খুচখাচ লেখালিখিও যে করিনা, তা বলব না। সে লেখা কেমন হয় আসলে, সত্যি বলতে কী, আমি নিজে জানিনা। নিজের লেখা তো নিজের ভালো লাগেই, সন্তানসম। এত কিছু পারি, করি অন্য সময়ে, বা সময়ের অভাবে করতে পারিনা। অথচ এখন এই এত্ত সময়, এদিকে আমার কিচ্ছু করতে ভালোই লাগছেনা। পরীক্ষার আগে স্ট্যাট মেকের ফরমুলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথায় গিজগিজ করতো লেখালিখির প্লট, গানবাজনার আসরের পরিকল্পনা। অথচ এখন ডায়েরিটা নিয়ে বসি, একটা আঁচড়ও কাটতে পারিনা। কী মুস্কিল যে হল।

কিছু লিখতে বসলেই খালি ওর বলা কথাগুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে। ন্যাকা ন্যাকা প্রেমে মাখোমাখো কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। অথচ সেটাও পারিনা। একবার চেষ্টা করেছিলাম আজ সকালে, তাও হলো না। যে কটা লাইন লিখলাম, কেউ যদি প্লেজিয়ারিস্ম সফটওয়ারে ফেলে, বুঝবে পুরো আমাদের whatsapp চ্যাটটা কপি পেস্ট করেছি। লোকে বলে মানুষ প্রেমে পড়লে নাকি ক্রিয়েটিভ হয়ে যায়। কই, আমি তো কিছুই করতে পারছিনা। কোন নান্দনিকতা নেই, কোন সৃষ্টি নেই, সৃজনশীলতা কবেই টাটা বাই বাই করে যেন চলে গিয়েছে। রসায়ন নিয়ে পড়েও জীবনে রসের অভাব। এদিকে প্রেমটাও ঠিক জমিয়ে করতে পারছি কই? সর্বক্ষণ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে চলছি। কী যে করি, কী যে করি। কেমন অসংলগ্ন লাগছে সবকিছু। ভুলভাল লিখে যাচ্ছি ডায়েরি খুলে এই যে।
এইসব সময়ে একটাই নিরাময়। আমার প্রাণের আরাম, মনের শান্তি। আমার গীতবিতান।


মা ভাইকে নিয়ে টিউটোরিয়ালে গিয়েছে। ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। আমি কোনোমতে টেবিলে চাপা দিয়ে রাখা ভাত মাছের ঝোল খেয়ে সেই যে দেড়টা নাগাদ গীতবিতানটা খুলে বসেছি...তিন ঘণ্টা হয়ে গেল। একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছি, মনের আনন্দে। ইউটিউবে তানপুরাটা ল্যুপে ফেলে রেখেছি।

"বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে।
কোথা হতে এলে তুমি হৃদিমাঝারে॥"

"খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি, আমার মনের ভিতরে
কত রাত তাই তো জেগেছি, বলবো কী তোরে।"

"কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিবো হৃদয় খুলিয়া।"

আহা, কী বাণী। প্রতিটা যেন একদম মনের কথাগুলো আমার হয়ে বলে দিচ্ছে, আমার হৃদয়ের একান্ত গভীর গহ্বর থেকে নিঃসৃত করছে বাসনার গান, শব্দরাজি মেলেছে অসীম আকাশে রঙিন পাখনা। আহা, কী সুখ। কী আনন্দ।

আমি যখন গান গাই, চোখ বুজে থাকি। একটা গান শেষ করে চোখ মেলেছি, দেখি সামনে মা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আমার দিকে।
"কী রে, থামলি কেন? গা না। কতদিন পর শুনছি বলতো? ভালো লাগছে খুব। গেয়ে যা।"
"আর ভাই? ও ডিস্টার্বড হবে তো। কখন এলে, ডাকতে হয় তো।"
" না না, ও একটু রেস্ট নেবে এখন। অসুবিধে নেই। ভাগ্যিস চাবিটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। নইলে এমন স্বতঃস্ফূর্ত গান কি শুনতে পেতাম না কি?"
" কী যে বলো না মা!"
" ঢং করিস না। উফ।"

কিছু কিছু দিন এমন হয় না, যাই করি, খুব ভালো লাগে? সব কিছুতেই মানে পাই? আজকের দিনটাও ঠিক তেমনই হল। সন্ধ্যে জুড়ে বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশের ওপর সঞ্চয়িতা রেখে কাটিয়ে দিলাম বেশ অনেকটা সময়। রাত্রে অনেকদিন পর দেখলাম, লিখতে বসে শব্দ খুঁজে পাচ্ছি। নাহ, সেই ন্যাকা ন্যাকা বোকা বোকা প্রেম না। বরং অনেক পরিণত সম্পর্কের কথা।

 ঠাকুর আছেন, এই বিশ্বাসটুকুই তো সম্বল।

No comments:

Post a Comment