Friday, November 23, 2018

সিরিয়ালঃ সিরিয়াসলি নেবেন না (লাস্ট)

#সিরিয়ালঃসিরিয়াসলি_নেবেন_না

ইয়ে মানে ইচ্ছে ছিল বেশ জমাটি একটা কমপ্লিকেটেড স্ক্রিপ্ট লিখব। খানিকটা এরকমঃ

সুপর্ণা শ্রীপর্ণার মধ্যে ঝামেলা টামেলা হবে কে রণিতকে নিজের জামাই বানাবে বলে। এই সব করতে গিয়ে শ্রীপর্ণা আবার আদিত্যর সাথে এক্সট্রা মারিটাল করবে।

রণিতের "দিভ্যা" এদিকে হঠাৎ কী করে অসুস্থ হবে। (সে বাই দি ওয়ে রণিতের বাগদত্তা) আই সি ইউ তে থাকবে। হসপিটালে। সেই হসপিটালের রিসেপশনিস্ট আবার ওই দ্বিতীয় পর্বের "অনামিকা" (আচ্ছা বেশ, ওর নামই না হয় অনামিকা হোক)। অনামিকা দেখবে রণিত দিভ্যাকে কত ভালোবাসে। সেবা যত্ন করে (আই সি ইউ তে পেশেন্ট পার্টি এমন ২৪ ঘণ্টা থাকে কি? কে জানে?)। মুগ্ধ হয়ে যাবে। রণিতকে সাপোর্ট করতে যাবে ইমোশনালি। সেই করতে গিয়ে এখন রণিতের প্রেমে হাবুডুবু খাবে।

প্রচুর যোগা খিচুরি। (অত লেখার ধৈর্য নেই। সত্যি বলছি।)

তারপর হঠাৎ "দশ বছর পর, মেগা এপিসোড"।

সেখানে দেখা যাবে

১। বুবাইয়ের সাথে রণিতের সেই আই সি ইউ বান্ধবী দিভ্যার বিয়ে হয়ে আছে। ওদের যমজ বাচ্চা আছে দুটো।

২। বিট্টুর সাথে সেই ডেলিভারি বয়ের এনগেজমেন্ট হচ্ছে। সে ছোকরা এখন আমাজনে টেকনিকাল স্পেশালিষ্ট। পড়ার খরচ চালাতে ডেলিভারির কাজ করত।

৩। বুবাইয়ের লিভিং পার্টনার অনামিকা।

৪। আদিত্য আর সুপর্ণা একসাথেই থাকে।  সপ্তাহে পাঁচদিন। উইকেন্ড কাটাতে অবশ্য শ্রীপর্ণা ওদের জয়েন করে। ওর মেয়ে মুন্নি (নাকি মুনিয়া, কী নাম ছিল জানি?) আসলে জানা যাবে আদিত্যর মেয়ে। তাই শ্রীপর্ণা মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য বাপকে দায়িত্ব নিতে বলবে।

এরা সবাই ফ্যামিলি ভেকেশনে মালয়শিয়া এসেছে (এয়ার এশিয়ায় সস্তায় টিকিট পেয়েছিল, কী করবে) । একটা রিসোর্টে একসাথে খানা পিনা চলছে।

ম্যানেজার আসবে কিছু জিজ্ঞেস করতে আদিত্যকে। সুপুরুষ, স্মার্ট, ইয়োং।

তার কথা থামিয়ে আদিত্য ওকে বলবে, "ইয়ং ম্যান, আর ইউ ম্যারিড?"
সে অবাক হয়ে বলবে, "নো স্যর।"
আদিত্যঃ বেশ। তুমি তাহলে আমার জামাই হবে। সি দ্যাট প্রিটি লেডি ইন পিঙ্ক? (মুন্নির দিকে পয়েন্ট করবে। মুন্নি কেন কে জানে পুলের ধারে পিঙ্ক লেহেঙ্গা পরে বসে আছে।) ম্যারি হার।

শ্রীপর্ণা আনন্দে ঢলে পড়বে আদিত্যর গায়ে। সুপর্ণাকে দেখা যাবে চেক-আউট করছে পাশের টেবিলে একটা সল্ট অ্যান্ড পেপার হেয়ার, দারুণ দেখতে, মাঝ বয়সী ভদ্রলোকের দিকে।

And they all lived happily ever after...(শিগগিরই টিভির পর্দায় অন্য কোন সিরিয়ালে আবার এদের সাথে দেখা হবে।)

সিরিয়াল সিরিয়াসলি নেবেন না ৩

৩।

কলিং বেল শুনে বিট্টু দৌড়ে গেল দরজা খুলতে।
"কে এলো রে? গেস্ট লিস্ট থেকে তো আর কারুর বাকি নেই আসার?" একটু অবাক হয়েই ইনিয়ে বিনিয়ে সুপর্ণা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো। রাত্তির দশটা বাজে। ড্রয়িং রুমের ঘড়িতে বেশ একটা অ্যান্টিক গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ক্যামেরা ফোকাস করবে, ঢং ঢং করে আওয়াজ হবে।
"নির্ঘাত ক্যাটারিং এর ছেলেটা। দাঁড়াও না, ফোন করলে রিসিভ করবে না, বড্ড বেশি বাড় বেড়েছে এদের। আমায় চটিয়ে পার পেয়ে যাওয়া সহজ না। ওর ব্যবসা বন্ধ করে দেবো আমি। Just wait and watch... (বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে পজ দিতে দিতে এরই মধ্যে পঞ্চাশ বার আঁচল ঠিক করতে করতে বিট্টু বলবে)।
"বিট্টু মাথা গরম করিস না মাম্মা, এত নিমন্ত্রিত লোকজন বাড়িতে, এখনই একটা সিন ক্রিয়েট না করলেই নয়? প্লিজ সোনা..." সুপর্ণা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে মেয়ের মেজাজ ঠাণ্ডা করতে চেয়ে বলে।
বিট্টু দরজার দিকে এগোয়। যাওয়ার পথে usual party scene cross করে। অনেক মহিলারা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলও (অবশ্যই ঈর্ষান্বিত হাসি)। এই এরাই আগামী কিছুদিনের মধ্যেই কিটি পার্টিতে বিট্টুর সাহসী পোশাকের ব্যাপারে মুখরোচক গল্প করবে।
বেল বাজল দ্বিতীয়বার।
খুব বিরক্ত মুখ করে বিট্টু এগিয়ে চলবে।
"আরে আসছি।" চিৎকার করে বলবে ও।
দরজা খুলেই আবার চিৎকার। "নিজেরা এত্ত লেট করে আসার বেলায় কিছু না, আর এখন এরকম অসভ্যদের মতো বারবার বেল বাজাচ্ছেন যে?"
দরজার ওপারে দেখা যাবে রণিতকে। বেশ একটা হকচকিয়ে গিয়েছে। ওর পিছনে ডেলিভারি বয় গোছের কেউ। রোগা পটকা, চুল উসকো খুস্কো, হাতে পায়ে কাদা মাখামাখি প্রায়। জামাতেও ওরকমই কিছু। দুজএন্র হাত ভর্তি বড় বড় প্যাকেট/বাসন...
রণিতঃ ম্যাডাম আপনি যা ভাবছেন তা না।
বিট্টুঃ চুপ করুন। একদম মুখে মুখে তর্ক করতে আসবেন না (আঙ্গুল তুলে, বেশ চোখ টোখ পাকিয়ে)। রাত্তির দশটা বেজে গিয়েছে। অর্ডার ডেলিভারির সময় কটা ছিল, খেয়াল আছে?
রণিতঃও ম্যাডাম, শুনুন না। বলছি যে...
বিট্টূঃ চুপ। একদম চুপ। (বেশ জমকালো কান ঝালাপালা করা মিউজিক চাই) আপনার সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে নেবো আমি। আপনার মতো দু পয়সার এমপ্লয়ীর সাথে কথা বলা না, আমার ইমেজের সাথে যায় না। বুঝেছেন? যতসব ইনএফিশিয়েন্ট ইউজলেস ডেলিভারি বয় পাঠায়।
ইতিমধ্যে "কে রে মা? কী হয়েছে?" বলতে বলতে আদিত্য বাবু চলে আসেন। বিট্টূ ন্যাকা/রাগী মুখ করে প্রচুর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "বাবা দেখো না, কেটারিং এর লোকগুলো দেরি করে এসেছে। এদিকে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কী না কী।"
আদিত্যঃ কই দেখি?
রণিতঃ আঙ্কল, অ্যাকচুয়ালি আমি কেটারিং এর স্টাফ নই। সেটা ও। (পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখায় আঙ্গুল দিয়ে)
আদিত্যঃ তুমি কেটারিং এর না?
রণিতঃ না।
আদিত্যঃ তাহলে তোমার হাতে এই এত্ত এত্ত প্যাকেট কীসের?
রণিতঃ সেটাই তো তখন তো বলতে চাইছই। ম্যাডাম কথাটা কমপ্লিট করতে দিলে তো?
বিট্টূঃ বাবা why are you wasting your time on him?
আদিত্যঃ আরে দাঁড়া না, বুঝতে ডে আমায় ব্যাপারটা। পুরোটা শুনতে ডে। হ্যাঁ তা বাবা, বলো তো কী বলছিলে? (রণিতের দিকে তাকিয়ে)
বিট্টূ বেশ বিরক্ত মুখ করে "যতসব ন্যাকামি" বলে চলে গেল একটু দূরে।
রণিতঃ আঙ্কল, আমার নাম রণিত। রণিত গাঙ্গুলি। আমি একজন অন্ত্রেপ্রেনিউর। কিছু মাস হল ইউ এস থেকে ইন্ডিয়া ফিরেছি (ইতিমধ্যে আশে পাশে শ্রীপর্ণা সুপর্ণা দুজনেই হাজির। ইউ ফেরত শুনে দুজনেরই চোখ চকচক করছে। দুজনেরই যে বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে) আমি এক জায়গায় যাচ্ছিলাম ড্রাইভ করে। তখন এই ছেলেটির সাথে দেখা হল। রাদার, ওর বাইক স্কিড করে এক্কেবারে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়ল। he was panicking, and yeah, so was I (বেশ নার্ভাস হাসি হেসে বলল)... ও বলল ওর কোথায় খাবার পৌঁছনর কথা। দেরি হয়ে যাওয়ায় স্পিডে বাইক চালাতে গিয়েই এই বিপত্তি। আমি ওকে আস্তে আস্তে টেনে তুললাম। বাইকটা চালানোর মতো কন্ডিশনে ছিল না। সাইড করে ওকে গাড়িতে নিয়ে আমি ফার্স্ট এড দিইয়ে তারপর এখানে এলাম।
আদিত্যঃ ওহো। এই রে। খুব খারাপ খুব খারাপ। (ছেলেটির দিকে তাকিয়ে) বাবা তোমার তো বেশ ইনজুরি দেখছি। শোনো, (ওয়ালেট বের করে, সেখান থেকে এক তাড়া নোট বের করে) এই টাকাটা ধরো। চিকিৎসা করিয়ো। ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি যেয়ো।
আদিত্য বাবু ভিতর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে বললঃ এই বুবাই? বিট্টূ? এদিকে এসে খাবার গুলও নিয়ে যা প্লিজ।
রণিতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এবার বললেন, "বাবা রণিত, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।তোমার সাথে আলাপ করতে হবে গুছিয়ে। এসো না। we are having a aprty tonight, to celebrate my anniversary. Why don't you join us for dinner?"
রণিতঃ It's okay uncle. Happy anniversary uncle aunty.. But some other time..আমি একটা অন্য পার্টিতে যাচ্ছিলাম। ওখানে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সো...
আদিত্যঃ তা হয় নাকি?
রণিতঃ না আঙ্কল, আমি সত্যিই পারবো না আজ।

বিট্টূ পাশ থেকে এসে বিরক্ত মুখ করে তাকাবে রণিতের দিকে। যদিও এমন সুপুরুষের প্রতি একটু কৌতূহলও হবে। কে এ?
আদিত্যঃ বেশ। কাল তাহলে আমাদের সাথে লাঞ্চ করো? ফ্রি আছো?
রণিতঃ সামনের সপ্তাহে কোন এক দিন হোক?
আদিত্যঃ শিয়োর।

রণিতের পিঠ চাপড়ে আদিত্য ওকে বিদায় জানালেন। রণিতের মুখে হাসি। বিট্টু অবাক।
শ্রীপর্ণা আর সুপর্ণা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
"কে রে দিদি? কী হ্যান্ডসাম... (মনে মনে ভাবছে, "আমার মুনিয়ার সাথে দারুণ মানাবে।")
সুপর্ণাঃ হুম। খোঁজ নিতে হবে (মনে মনে ভাববে, "দারুণ শাঁসালো মনে হচ্ছে। বিট্টুর সাথে তো এমন জন কেই মানায়।")

(অদ্ভুত ভ্যাম্প মিউকিজ বাজবে ব্যাকগ্রাউন্ডে। আস্তে আস্তে জুম আউট করবে ক্যামেরা। লাইটস বোকে এফেক্ট হবে। তারপর স্ক্রিন ফ্রিজ)   

Thursday, November 22, 2018

সিরিয়ালঃ সিরিয়াসলি নেবেন না ২

২।

শহরের কোন ব্যস্ত রাস্তা। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বেশ দামী একটা গাড়ি চালাচ্ছে বছর সাতাশ আঠাশের এক সুপুরুষ যুবা। পরনে দামী সুট। টিপটাপ, ফিটফাট। বোঝাই যাচ্ছে এবশ ভালোই উপভোগ করছে ড্রাইভটা। মুখে চোখে এতটুকুও বিরক্তি নেই। বরং মাঝে মাঝেই মুখ হাসি হাসি হচ্ছে। গাড়িতে রেডিওতে চলছে কিছু পপুলার বাংলা রোমান্টিক গান। (মাঝে মাঝে এক মোহময়ী নারী কণ্ঠের আরজের গলা শোনা যাচ্ছে। keywords শোনা যাচ্ছে "প্রেম", "বৃষ্টি", "ট্রাফিক জ্যাম" ইত্যাদি।) গুনগুন করে গলা মেলাতেও দেখা যাচ্ছে ছেলেটিকে। পাশে বসে এক যুবতী। পরনে সাধারণ সিন্থেটিক শাড়ি। কোন গয়নার দোকান বা আধুনিক বেসরকারি হসপিটালের ইউনিফর্মের মতো। চেহারা (ওই মেক আপ আর কী) দেখেই বোঝা যায় মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। হাতে একটা ঢাউস খয়েরি ব্যাগ। অনেকক্ষণ ধরেই গাড়ির জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে। এমন সময়ে একটা সিগনালে গাড়িটা এসে থমকালো।
"কী ভালো weather, না?" সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে যুবকটি বলল।
যুবতী মুখ ফেরালো। স্মিত হাসি হাসল। আবার মুখ ঘুরিয়ে বলল, "আপনাদের যাদের লাক্সারি করার সুযোগ আছে, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কাদা জল জমার মধ্যে দিয়ে হেঁটে দিনের পর দিন চলাফেরা করে বা ভিড় বাসে চিঁরে চ্যাপ্টা হয়ে কাজে  যাওয়া আসা করতে হয় না, তাঁদের জন্য তো এমন ওয়েদার খুব ভালো। কী সুন্দর কাব্য করতে পারেন, গান গাইতে পারেন। কফি কাপ হাতে জানালর ধারে বসে ব্যাঙের ডাক শুনতে পারেন..."
যুবকটি কিছু একটা বলতে গিয়েও খানিক থেমে গেল। মাথাটা একটা "বড্ড স্টিরিওটাইপ করো" গোছের মুখ করে বলল, " আপনি এত সিনিকাল কেন বলুন তো?"
যুবতী এবার যুবকের চোখে চোখ রেখে বলল, "আপনি বুঝবেন না। অভিজ্ঞতা নেই তো, তাই। তবে আপনার দোষ নেই। যে যেমন কপাল নিয়ে জন্মায়।"
যুবকঃ তা যা বলেছেন। সবই ফেট, সবই ডেস্টিনি।
যুবতীঃ হ্যাঁ। একদিন এমন বর্ষার মধ্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে গোটা দিন যাতায়াত করুন, বুঝে যাবেন আমরা যারা মিডল ক্লাস, কীভাবে দিন যাপন করি। রোজদিন বা সকলের তো এমন সৌভাগ্য হয় না যে আপানর কাছ থেকে লিফট পাবে।"
যুবক বলতে লাগল, "মে বি... আসলে দশ বছর পর আমি ইন্ডিয়ায় ফিরেছি এই কিছু সপ্তাহ আগে। (ছেলেটির ইংরেজি, বিশেষ করে উচ্চারণ অত্যন্ত ঝরঝরে হওয়া উচিত। প্রয়োজনে অ্যাক্সেন্ট থাকা উচিত। অথচ অভিনেতার ইংরেজিতে পরিষ্কার বাংলার টান বোঝা যাবে আহা,কী মাটির মানুষ!!) তার আগেস্কুল ট্যুশন যাতায়াত গাড়িতেই করেছি। সো মে বি।। এনিওয়ে...
"ওই সামনের মোড়ে আমায় নামিয়ে দেবেন প্লিজ। পরের সিগনালটার আগে..." যুবতী কথা থামিয়ে দিয়ে বলল।
যুবকটি একটু অবাক মুখ করে বলল, "সে কী? রাগ করলেন নাকি?"
"আরে না না। ও মা, সে কী কথা। আমার বাড়ি ওইদিকে। একটু টুকটাক বাজার করে ঢুকব। বাবার জ্বর হয়েছে। ভাইয়ের ফিরতে দেরিয়া ছে। আমি এখন বাজার না করে এলে মা রাঁধতে পারবে না। তাই..." বলল যুবতী।
যুবকটি একটা অদ্ভুত ভ্যাবাচ্যাকা গোছের মুখ করে বলল, "বেশ"।
গাড়িটা চলছে। পাশ দিয়ে অন্য গাড়ি বাইক ইত্যাদি সব চলছে। রেডিওতে গান বেজেই চলেছে। আলাদা করে আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দরকার নেই। খানিক দূর যাওয়ার পর গাড়িটাকে রাস্তার বাঁ দিক করে থামাল যুবক।
যুবতী সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বলল, "আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো? আমার অনেক উপকার করলেন। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে বাস অটো কিচ্ছু পাচ্ছিলাম না। বড্ড মুস্কিলে পড়ে গিয়েছিলাম।"
যুবকঃ দ্যাটস ওকে।
যুবতী (হেসে): আসি।
যুবকঃ ভালো থাকবেন। নমস্কার।
যুবতী গাড়ি থেকে নেমে গেল। দরজা বন্ধ করছিল, যুবকটি একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, " ও বাই দি ওয়ে, আমার নাম রণিত। রণিত গাঙ্গুলি।"
যুবতী হাসল। হাসলে খুব সুন্দর টোল পড়ে বাঁ গালে। তারপর পিছন ফিরে চলে গেল। রণিত একটু বোকা বোকা হাসি হেসে মাথার চুল ঠিক করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে মোবাইল ফোন বেজে উঠল (খেয়াল রাখতে হবে, স্পেসিফিকালি, আইফোনের রিং টোন)।  স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, "Mom calling"। হাসি হাসি মুখেই মাথাটা একটু সবজান্তা বেড়ে পাকা অথচ ক্যাবলা মার্কা মাথা নেড়ে ফোন রিসিভ করেই বলল, "ইয়েস মম, অন মাই ওয়ে, আসছি। পার্টি জমে গিয়েছে তো?"
ওপর প্রান্ত থেকে একটা চাপা গলার স্বর শোনা যাবে। কোন তরুণীর। "হু মম? রণিত, দিস ইজ দিভ্যা (খেয়াল রাখবেন উচ্চারণে। দি-vi-য়া)। আমি নেহাত auntyর থেকে ফোনটা নিয়ে কল করলাম। আমার ফোনের চার্জ শেষ। তুই কতদূর রণিত? কাম সুন।"
রণিতঃ আসছি দিভ্যা, ভেরি সুন...অলমোস্ট দেয়ের।

ফোন ডিসকানেক্ট করে রণিত গাড়ি চালানোয় মন দেয়। ফাঁকা রাস্তা। হু হু করে স্পীড তোলে। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। রাস্তা পিছল। হঠাৎ ক্যাচ করে ব্রেক মারার শব্দ। তিন চারবার এই শব্দ শোনা যাবে। ততক্ষণে তিন চারটে অ্যাঙ্গেল দিয়ে রণিতের মুখে ফোকাস হবে ক্যামেরা। স্পষ্টতই ভীত মুখ। সামনে দেখা যাবে একটা বাইক উল্টে পড়ে আছে। পাশে উপুড় হয়ে পড়েছে হেলমেট পরা একটি ছেলে। বেশ আবার ধুম তানা নানা মিউজিক চলছে। ক্যামেরা আস্তে আস্তে বারবার ছেলেটি ও রণিতের মুখে ফোকাস করতে করতে রণিতের মুখে সেটল করে ফ্রিজ করে যাবে।

(আবার কাল)

Wednesday, November 21, 2018

#সিরিয়ালঃসিরিয়াসলি_নেবেন_না

#সিরিয়ালঃসিরিয়াসলি_নেবেন_না

পর্ব ১

স্থানঃ একটু রুচিশীল সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের বসবার ঘর। আবছা হলুদ আলো জ্বলছে টিউবলাইটের পরিবর্তে (প্রমাণ যে এটি এক ধনী পরিবারের বাড়ি)।

কোন এক কারণে জনসমাবেশ হয়েছে এই ঘরে (এই মুহূর্তে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা)। প্রত্যেকেই বেশ দামী পোশাকে। পুরুষদের পরনে হয় পাজামা পাঞ্জাবী নয় সুট (শুধু শার্ট প্যান্ট বা টিশার্ট না), মহিলারা দামী দামী সিল্কের শাড়ি পরে, গায়ে এত গয়না, মনে হবে যেন গয়নার দোকানের মডেল। চড়া মেক আপ। কারুর কারুর মাথায় দামী অর্কিড, রজনীগন্ধা খবরদার না। টু মিডল ক্লাস। টেবিলে রাশি রাশি খাবারের আয়োজন। পানীয়ও রয়েছে। হার্ড সফট দুইই। গল্প টল্প চলছে। হাসির রোল উঠছে মাঝে মাঝে। (স্ক্রিনে উঠবে লেখা "মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক"।)

বছর পঞ্চাশ পঞ্চান্নর এক প্রৌঢ়, পরনে সিল্কের সাদা পাঞ্জাবী (গলায় মোটা সোনার চেন এবং পোশাকে সোনার বোতাম লাগানো), কাঁধে কাশ্মীরী চাদর, হঠাৎ সোনালী পানীয়ের গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালেন আর বললেন, "বুঝলে গিন্নি, দেখতে দেখতে কেমন পঁচিশটা বছর কাটিয়ে ফেললাম বলো? কোন আফসোস নেই আমার। তোমার আছে?" (অতি নাটকীয় ভাবে, টেনে টেনে বলতে হবে কথা। ব্যাকগ্রাউন্ডে হাল্কা কোন মিউজিক বাজবে।)


আটচল্লিশ (দেখে মনে হবে আরো কম) বছরের এক "যুবতী", পরনে রানী কালারের সিল্কের শাড়ী (প্রচুর জরি দেওয়া। মনে হয় কাঞ্জিভরম।), মাথার চুল (আসলে উইগ) ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশ কায়দা করে খোঁপা করা, খোঁপায় ম্যাচিং রঙের অর্কিড লাগানো, ঠোঁটে উজ্জ্বল গোলাপি লিপস্টিক, মুখ ভর্তি মেক আপ, গা ভর্তি সোনার ভারী গয়না, একটু ন্যাকা ন্যাকা মুখ করে ভদ্রলোকের দিকে তাকাবে। সলজ্জ হাসি হাসবে। তারপর বলবে, "আমি তো সব সময় সকলকে বলি। গত জন্মে নিশ্চয়ই কোন পুণ্য করেছিলাম, নইলে তোমার মতো এমন এক জীবনসঙ্গী পাই?"

উপস্থিত সকলে আহা উহু বাহ বাহ ইত্যাদি করবে। ক্যামেরা জ্যুম করবে অনেকেরই মুখে। তাদের কারুর মুখে আলাদা করে কোন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাবেন না। মোটামুটি সব ক্লোন বলেই ধরতে পারেন।

"আরে আদিত্যদা, একটা গান ধরো দিদির জন্য?" প্রায় গায়ে ঢলে পড়ে এক ওই অতি সুসজ্জিতা ভদ্রমহিলা এই ভদ্রলোকটিকে বলবে।

(যাক, নাম জানা গেল। আদিত্য। পুরো নাম আদিত্য শঙ্কর মুখোপাধ্যায়। স্ত্রীর নামটা বলেই দিই। সুপর্ণা মুখোপাধ্যায়)

"বলছ?" আদিত্য একই রকম ন্যাকামি করে শালির দিকে তাকিয়ে বলবে।

শালিও ন্যাকামিতে কোনরকম কমতি না করেই বলবে "হ্যাঁ দাদা প্লিজ ধরো না।"

আদিত্য (এক্সট্রা ন্যাকামি ঢলানি ইত্যাদি সহকারে) : ধরতে বলছ যখন, ধরিই। জানি না আজ ভালো লাগবে কি না সুপর্ণার। তবে বিট্টু বুবাইয়ের ছোটবেলা অবধি কত গান শুনিয়েছি।

জনৈকা অতিথিঃ এই সুপর্ণা, আদিত্যদাকে গান গাইতে বল না। আমরাও শুনি। বেশ মেহফিল জমে যাবে।

সুপর্ণা (একটু মেকি বিরক্তি মুখ করে) বলবে, "আমি বারণ করেছি নাকি। গাক না। এই তো শ্রীপর্ণা বলল। গাইবে নিশ্চয়ই। (আচ্ছা বোঝা গেল শালি আপন শালি। নইলে এমন সুপর্ণা শ্রীপর্ণা ম্যাচ করে নাম হয়? কে জানে) "

আদিত্য (হাত থেকে উইস্কির গ্লাস নামিয়ে): বেশ, সকলের অনুরোধ যখন এত, নিশ্চয়ই গাইব। এই গানটা আজকের দিনে আমি ডেডিকেট করছি আমার সুপুকে। সুপু, দীঘায় যেবার প্রথম গিয়েছিলাম বিয়ের পরে পরে, মনে আছে, বীচের ধার দিয়ে এই গানটা গাইতে গাইতে আমরা হাঁটতাম (দীঘায় হানিমুন? হুম। তার মানে নিশ্চয়ই কোন স্ট্রাগল স্টোরি আছে।)। তুমিও গুনগুন করতে।

সুপর্ণাকে দেখা যাবে লাজে একেবারে নতুন বউয়ের মতো ব্লাশ করছে।

উপস্থিত অতিথিবৃন্দ একটু উসখুস করবে। বিট্টূ আর বুবাই (বিট্টু মেয়ে, বুবাই ছেলে) কে দেখা যাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা "উফ এরা পারেও বটে" গছের লুক দেবে। বিট্টু বুবাইকে বলবে, "শোন বুবাই, মা আর বাবার এই রোম্যান্স চলছে চলুক। আমি একবার কেটারিং এর লোকগুলোকে ফোন করি। শুধু স্টারটার পাঠালো। তাও রিফিল করার কথা। দেয়নি। মেন কোর্সই বা কোথায়? সাড়ে নটা বাজে। ডিনার করবে তো লোকে। ওদের ওপর না চেঁচালে হবে না। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে না, আঙ্গুল বেঁকাতে হয়। বুঝলি?" স্পষ্টতই বিট্টু বড়লোক বাপ মায়ের আদরে বাঁদর হওয়া মেয়ে। পরনে বেশ সাহসী ব্যাকলেস কেতাদুরস্ত মেরুন ব্লাউজের সাথে ম্যাচিং মেরুন সিল্কের শাড়ি, (আঁচল মাঝে মাঝেই সরে যাবে, আর ও ঠিক করবে)সরু জরি বর্ডার। গয়না হীরের। বুবাইয়ের পরনে সিল্কের পাঞ্জাবী। জিন্স। হাতে দামী ঘড়ি। মাথার চুল একটু বড়োর দিকে। নির্ঘাত ব্যান্ডে গান বাজনা কিছু করে। কানে হীরের স্টাড।


সুপর্ণার কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, "বুবাই, গিটারটা নিয়ে আয়। তোর বাবা গান গাইবে।"

বিরক্ত মুখ করে বুবাই ঘর থেকে গিটার নিয়ে আসবে। ভগবান জানে কী না কী কর্ড ধরে টুং টাং করবে। এদিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুল ক্যারিওকে বাজতে থাকবে। কোন সারেগামাপা বা ওই ধরণের কম্পিটিশনের প্রথম দশের শেষের দিকের বা তারপরের কোন শিল্পী গান শুরু করবে।

"এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো?"

আদিত্য আর সুপর্ণা লিপ দেবে। গোটা গান চলাকালীন র্যান্ডম লোকজনের ক্লোজ আপ শট নেবে। এমন অপূর্ব গান। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে শুনবে। কেউ কেউ নিজের বর/বউ/পরকীয়া পারটনার/প্রেমিক/প্রেমিকার দিকে সলজ্জভাবে তাকাবে। কেউ তাল দেবে হাতে।

গান প্রায় শেষের দিকে। কলিং বেল বাজবে। সব্বাই পিন ড্রপ সাইলেন্ট হয়ে যাবে।

অনেকজনের (র্যান্ডম) ক্লোজ আপ নেওয়া হবে। সবাই অবাক। কে এলো। এখন কে আসতে পারে। কী ঘটতে চলেছে? পার্টির ছন্দপতন ঘটবে? ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রচুর ধুম তানা নানা বাজনা। তারপর আদিত্যর মুখে ক্যামেরা জুম করে ফ্রিজ হয়ে যাবে।


serial

ইদানীং ধৈর্য ধরে দুটি বাংলা সিরিয়াল দেখতে দেখতে মনে হল যে আমিও মনে হয় স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলতে পারব। দুটো সম্ভাবনা মাথায় আছে।
১। কোন একজন ব্যক্তির দুইজন স্ত্রী। প্রথমজন হয় গরীব (যদি এই ব্যক্তি বড়লোক হন) নয় খুব বড়লোক (লোকটি এই ক্ষেত্রে গরীব। তবে এই সম্ভাবনা কম, স্ট্যাটিস্টিক্স তাই বলে।)। দুই পক্ষেই ছেলে মেয়ে আছে। বছর কুড়ি পঁচিশ পর এই দুই পক্ষের ছেলে মেয়ের দেখা সাক্ষাত হবে। সময়টা যদি বসন্তকাল হয়, তাহলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে এদের দুজনের মধ্যে ভাব ভালোবাসা হবে। আর যদি ওই পুজোর সময় হয়, তাহলে ভাইফোঁটায় একজন আরেকজনকে ফোঁটা দেবে। মোদ্দা কথা, পুনর্মিলন হবে। সেই করতে গিয়ে দেখা যাবে প্রথম বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য যে চক্রান্ত করেছিল, সে আবার ফিরে এসেছে। দু তিনটে এপিসোড অন্ধকার ঘরে শুধু তাকে সাইড ফেসে দেখানো হবে। হঠাৎ একদিন সামনে দেখাবে মুখ। তখন বোঝা যাবে আরে, এ তো অমুক মাসী, যাকে সবচেয়ে গোবেচারা লাগত, সে। এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে এগোবে, ডিপেন্ডিং অন কারেন্ট টপিকস।
২। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। বেশ ভালোই চলছে সব। দুই বাড়ি থেকেই খুব খুশি মনে মেনে নিয়েছে। বিয়ে টিয়েও বোধহয় ঠিক। হঠাৎ একদিন ছেলেটা রাস্তায় যেতে যেতে হিরোইনকে দেখবে। অসহায় অবলা নারী টাইপ। গুণ্ডা বদমাইশ এদের হাত থেকে বাঁচাবে। এদিকে নিজেও আহত হবে। মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে স্মৃতি চলে যাবে। হিরোইন সেবা যত্ন করে ভালো করবে। ইতিমধ্যে বাগদত্তার কথা ভুলে যাবে। এই মেয়েটির সাথেই প্রেম করবে। শুধু রাত্রে মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশের মতো স্বপ্নে বাগদত্তা আসবে। কিন্তু হিরো বুঝবে না। তারপর কোন একদিন হঠাৎ যখন বর্তমান মেয়েটির সাথে বিয়ে টিয়ে করে হানিমুনে যাবে (জিজ্ঞেস করবেন না পরিবার কোথায় ছিল ছেলেটির যখন বিয়ে হল), প্রথমজন ভ্যাম্পের মতো এন্ট্রি নেবে। উগ্র সাজে সেজে। একটা টিপিকাল থিম ম্যুজিক ট্যুজিক থাকবে। তারপর আবার যে কে সেই, ইনিয়ে বিনিয়ে চলবে।
দুর্গা পুজো, কালী পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, লক্ষ্মী পুজো, দোল, রথযাত্রা, ঝুলন, গুরু পূর্ণিমা, ইতু, মনসা পুজো, রান্না পুজো, পৌষ পার্বণ, সরস্বতী পুজো সব পালন করবে এরা। কিছু উৎসব মিস করে গেলে বলবেন। যোগ করে দেবো।
মাঝে সাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অরিজিত সিং ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে।
আমি জানি, অত্যন্ত জঘন্য হল ব্যাপারটা, তবে যা দেখি/বুঝি, এইগুলোই রমরম করে চলে। আমার আপানর বাড়িতে। প্রতিদিন সন্ধ্যে ৬টা সাড়ে ৬টা থেকে এক্কেবারে ১১টা অবধি। তবে কিছু ভালো সিরিয়াল যে হয়না বা হয়নি, তা বলবো না।

Monday, November 19, 2018

men's day

আজ পৃথিবীর বহু দেশে পালিত হচ্ছে "মেন'স ডে"। ৮ই মার্চ নারী দিবস নিয়ে যতটা উদযাপন হয় সর্বত্র, আজকের দিনটা যেন তুলনামূলকভাবে কম লোকে জানেন। তবুও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ক্রমশ আজকের দিনটি সম্পর্কেও সচেতনতা বাড়ছে। খুবই ভালো দিক এইটি। ইন্টারনেট ঘেঁটে যেটুকু জানলাম আজকের দিন সম্পর্কে, সেই তথ্য নিয়ে এলাম।
মূলত পুরুষমানুষদের মানসিক সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে আজকের দিনটি পালন করা হয়। ষাটের দশক থেকেই এমন একটি দিনের জন্য কথা উঠলেও, ১৯৯১ এ এই দিনটির কথা ভাবা হয়। তবে ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ তেই প্রথম পুরুষ দিবস পালন করা হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন টমাস ওয়েস্টার। সাময়িক বিরতির পর ১৯৯৯ সালে পুরুষ দিবসের পুনরুত্থান ঘটে। এইবার এটি হয় ট্রিনিডাড ও টোব্যাগো দ্বীপের এক ডাক্তার জেরোম টীলাক্সিং এর উদ্যোগে। উনি নিজের বাবার জন্মদিনের দিনে অর্থাৎ ১৯শে নভেম্বর এই দিনটিকে বেছে নেন উদযাপনের জন্য। ভারতে এই দিনটির উদযাপন শুরু হয় ২০০৭ সালে।
সাম্প্রতিক কালেই নয়, বহু বছর ধরেই সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে ব্যবধান একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। এ ছাড়া কিছু পুরুষের অত্যন্ত ঘৃণ্য আচার আচরণের জন্যও পুরুষ জাতের ওপর একটা বিতৃষ্ণা বা খারাপ লাগা অনেকের মধ্যেই ছিল। পুরুষ দিবস দিনটি উদযাপন করা হয় এই "স্টিগ্মা"কে দূর করতে। পরিসংখ্যান বলছে সারা বিশ্বে আত্মহত্যা, অসুস্থতা, হিংসা, একই অন্যায় করে কারাযাপন, এই সবে পুরুষদের সংখ্যা নারীর তুলনায় অনেকটাইবেশি। আজকের দিনের উদ্দেশ্যই হল সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে ব্যবধান কমানো, "জেন্ডার ইক্যুয়াল" সমাজ কাম্য। পুরুষেরাও যে বহু সময়েই নানান অন্যায় ও অবিচারের শিকার হন, সেই বিষয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে পুরুষের স্বাস্থ্য (বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য) ও সমাজে তাঁদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে করা হয়।
প্রতি বছর এই দিনটি পালনের জন্য একেকটি "থিম" বেছে নেওয়া হয়। যেমন ২০১১তে ছিল ""giving men the best possible start to their lives", ২০১২তে ছিল "Helping men and boys live longer happier and healthier lives" ইত্যাদি। এই বছরের "থিম" হল "Male role models"। IMD বা ইন্টারন্যাশনাল মেন'স ডের ওয়েবসাইট থেকে বলতে গেলে, " International Men's Day is a time to promote positive aspects of male identity based on the premise that 'males of all ages respond more energetically to positive role models than they do to negative gender stereotyping'."
আসুন আজকের দিনে আমাদের জীবনের সমস্ত প্রিয় পুরুষ মানুষদের শুভেচ্ছাবার্তা জানাই।

Monday, November 12, 2018

হঠাৎ দেখা

১।

দেরাদুনের জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্টে প্লেনটা যখন নামল, ঘড়িতে সকাল সাড়ে এগারোটা। হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া আর অন্য কোন কিছু নেওয়ার ছিল না, তাই প্লেন থেকে নেমেই একেবারে বাইরে চলে এলাম। আমি, সম্রাজ্ঞী দাশগুপ্ত, বর্তমানে দিল্লীতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। দেরাদুন এসেছি, বা বলা চলে, মুসোউরি যাচ্ছি আমার খুব কাছের এক বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে। মেঘা, আমার ক্লাসমেট কাম রুমমেট। একসাথে এম বি এ পড়েছি আমেদাবাদে। ওই দুই বছরের কঠিন দিনগুলো অনেকাংশেই কম কষ্টের কাটত শুধুমাত্র এই সদা হাসি খুশি পাহাড়ি মেয়েটির জন্য। মেঘা আমার কাছে বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। আর তাই ও যখন আমায় ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার কথা জানালো দশ মাস আগে, আমি তক্ষুনি ছুটির আবেদন করে ফেলেছিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের ব্যাচের অনেকেই আসবে। রুশা, সিম্মি, প্রিয়াঙ্কা, গৌরব, নেহাল, চঞ্চল, পারুল, বিবেক, আকাশ, সুমিত। সবার সাথে দেখা হবে, ভেবে এমনিতেই মন ভালো। তার ওপর এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়েই পাহাড় দেখে আর একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার আমেজ আমায় মুহূর্তেই খুশি করে দিল। দিল্লীতেও ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। তবে এই শুদ্ধ পরিবেশের বড্ড অভাব। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। মেঘার মেসেজ পেয়েছি, এয়ারপোর্টের সামনেই ওর পাঠানো গাড়ি আছে। গাড়ির নম্বর জানিয়ে রেখেছে। আমি ড্রাইভার সাহেবকে ফোন করে এগোতে লাগলাম।

একটা কালো রঙের ইনোভা গাড়ি। দরজার বাইরেই এক বছর পঁচিশ তিরিশের যুবক দাঁড়িয়ে। বুঝলাম ইনিই চালক। আমার হাত থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে বললেন, "মেমসাব, একটু অপেক্ষা করতে হবে। এর পরের ফ্লাইটে আর এক সাবজী আসছেন। মেঘা ম্যাডাম বলেছেন আপনাদের দুজনকে একসাথে নিয়ে আসতে। এই তো বারোটা পনেরোর দিকেই ল্যান্ড করবে। আপনি গাড়ির ভিতরে বসুন।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম একটু। কই, মেঘা তো আমায় কিছু বলেনি। কে আসছে? আমাদের ব্যাচের কেউ? ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কেউ কিছু তো লিখল না। আমার ধারণা ছিল বাকিরা বম্বে হয়ে আসছে। বিকেলে পৌঁছবে। কে জানে। থাক, একটু রোদ পোহাই, আর বাড়িতেও ফোন করে দিই। মা বাবা চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। হ্যান্ডব্যাগটা গাড়িতে রেখে আমি বাইরেই দাঁড়ালাম। বাড়িতে কথাবার্তা সারলাম। ঘড়িতে বাজে বারোটা পঁয়ত্রিশ। ইতিমধ্যেই ভৈঁরো সিং, মানে আমাদের ইনোভার চালকের ফোনে আমার সহযাত্রীর কল এসে গিয়েছে। উনি কনভেয়ার বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়েই আসছেন। আমি ভৈঁরোর সাথে খানিক খেজুরে গল্প করলাম। মুসৌরির আবহাওয়া, বিয়ের তোরজোড় ইত্যাদি নিয়ে।

"ওই তো, সাব এসে গিয়েছেন।"  ভৈঁরোর কোথায় সম্বিত ফিরল। ফোন থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম যাকে, মুহূর্তে আমার হৃৎপিণ্ড দু তিনটে বিট মিস করলোই করল। ঠিক আগের মতোই। নীল জিন্স, লাল কালো  চেক শার্ট আর চোখে কেতাদুরস্ত সানগ্লাস পরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সম্রাট। সম্রাট চট্টোপাধ্যায়। একদা আমাদের এম বি এ ক্লাসের ক্লাসমেট। তার চেয়েও বড় কথা, আমার প্রাক্তন প্রেমিক।


২।

সালটা ২০১১। তখন সবে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এম বি এ পড়তে ঢুকেছি। প্রথম বাড়ির বাইরে থাকা। হোস্টেল জীবন। পড়ার চাপ। র‍্যাগিং। সব মিলিয়ে মন খারাপ করেই অবসর কাটত। অবশ্য লেখাপড়ার এত চাপ থাকত, রোজ রোজ একেকটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করা, ক্লাসের পড়া রেডি করা, হঠাৎ হঠাৎ সারপ্রাইজ কুইজ, সব মিলিয়ে নাজেহাল। বরাবর স্কুল আর কলেজ টপার আমি। তাতেও হিমশিম খেতাম এম বি এর কারিকুলামে। ব্যাচের সকলের সাথেও আলাপ হয়নি সেরকমভাবে, কিছু বন্ধু বান্ধব হয়েছিল সেকশনে, ওইটুকুই। এরই মধ্যে একদিন আমাদের ব্যাচের থেকে কিছু লোকজন ঠিক করল, সব সেকশন মিলে মিড সেমেস্টারে একটা উইকেন্ডে বেড়াতে যাওয়া হবে। উদয়পুর। এই উপায়ে সকলের সাথে সকলের বেশ পরিচিতি হবে। বেড়াতে আমি ভালোইবাসি। আর রাজস্থান বেড়াতে যাওয়ার শখ অনেকদিন ধরেই। তাই না করিনি। কে জানত, এই ট্রিপই আমূল বদলে দেবে আমার জীবন। এনে দেবে এই নিস্তরঙ্গ জীবনে ঝঞ্ঝা।

বৃহস্পতিবার বিকেলে আমাদের ১০০ জনের দল চারটে বড় বাস নিয়ে রওনা দিলাম। যেহেতু এই ট্রিপের মূল কারণ বা লক্ষ্যই ছিল একে অপরের সাথে মেলামেশা হওয়া, পরিচিতি বাড়া, তাই সিটিং এরেঞ্জমেন্টও ছিল বেশ অভিনব। লটারিতে ঠিক হবে এই পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা কে কার সাথে বসবে। উদয়পুর পৌঁছনর আগে আবার বাসে লটারি হয়েছিল কে কার রুমমেট হবে। আমি যে চিরকুট দুটি তুলেছিলাম, তাতে আমার বাস সঙ্গী ছিল সম্রাট। আর রুমমেট পারুল। সম্রাটের পাশে বসবে সম্রাজ্ঞী, ব্যাচের যে কজন বাঙালি ছিল, তারা দায়িত্ব নিয়ে এই জোড়ির গল্প গোটা ব্যাচকে বুঝিয়ে দিল। আর কী, সারা রাস্তা আমাদের দুজনকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা হইহই হল। সুমন থেকে থেকেই রব নে বনা দি জোড়ির টাইটেল ট্র্যাক গাইতে লাগল। সম্রাটের সাথে আমার আলাপ ছিল না আগে। ও ছিল সেকশন এ তে। আর আমি, সেকশন বি। বরাবরের প্রগল্ভ আমি, লোকজনের উৎপাত থেকে কোনক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে নিজেই যেচে আলাপ করলাম। শুনলাম, ও প্রবাসী বাঙালি। জন্ম থেকেই নাগপুরে থাকে। ওর বাবা ওখানের এক কলেজের প্রফেসর। হিন্দি ফিল্ম আর কান্ট্রি ফোকের পোকা। আমারও মোটামুটি পছন্দের বিষয় এগুলিই। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা এই নিয়ে আলোচনা করতে করতে কখন যে কেটে গেল, খেয়ালই নেই। মনে আছে, ওর বাংলা ফোক সং নিয়ে তেমন ধারণা নেই শুনে আমি বেশ কয়েকটা গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম। আমার গানের গলার প্রশংসা পেলাম উপহারে। তবে সবচেয়ে বড় উপহার, বা বলা যায়, স্মরণীয় উপহার পেলাম, তা ছিল সম্রাটের বন্ধুত্ব। আগামী তিনদিন এত ভালো কেটেছিল, ঠিক যেন স্বপ্ন। উদয়পুর লেকে সূর্যাস্ত দেখা, নৌকাভ্রমণ, সিটি প্যালেসের ঐশ্বর্য্য জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া...প্রতি মুহূর্ত বন্ধুদের সাথে, বিশেষ করে সম্রাটের সাথে ঘুরে ভীষণ উপভোগ করেছিলাম। ফেরার পথে আর আমাদের সিটিং নিয়ে কিছু আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। যে যার পাশে বসা যাবে। অদ্ভুতভাবে আমার পাশের জায়গায় ঠিক সম্রাট এসে বসেছিল।

দেখতে দেখতে দিন গেল। সম্রাটের সাথে আমার বন্ধুত্ব আরো নিবিড় হতে থাকল। সময় সুযোগ থাকলেই লাইব্রেরি গিয়ে পড়াশোনা করা, এক সাথে এসাইনমেন্ট সল্ভ করা, পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গেলে রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে গিয়ে একটু বিরাম নেওয়া... একদিন হঠাৎ বুঝলাম, কবে যেন আমরা শুধুই ভালো বন্ধুর গণ্ডি পেরিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি পরের ধাপে। হাসি মজার মধ্যে দিয়েই লেখাপড়া,  ঘুরে বেড়ানো, দেখতে দেখতে কোর্স শেষ হলো। প্লেসমেন্টে দুজনে দুই জায়গায় চাকরি পেলাম। আমি দিল্লি। সম্রাট চেন্নাই। অবশ্যই মাঝে মাঝেই একে অপরের কাছে চলে আসব, দেখা করব, এই সমস্ত কথা দেয়া নেওয়া চলল।

প্রথম এক বছর মোটামুটি তেমনভাবে চললও। লং উইকেন্ড পেলেই হয় আমি চেন্নাই নয় সম্রাট দিল্লি এসে যেত। ছুতোয় নাতায় কাজ নিয়ে চলে যেতাম চেন্নাই। বা ও আসত বোম্বে। আমি ছুটি ম্যানেজ করে সেখানে চলে যেতাম। দুই পক্ষের বাড়িতেই আমাদের কথা জানত। এক আধ বার আমরা কবে বিয়ে করেছি, এই মর্মে কথাবার্তা উঠেছে। দুজনেই কেরিয়ারে আরো উন্নতি করব, তারপর গাঁটছড়া বাঁধব, এই বলে সাময়িকভাবে কথা এড়াতাম। তবে মনে মনে বিয়ে নিয়ে যে অল্প বিস্তর স্বপ্ন দেখতাম, স্বীকার করতে লজ্জা নেই। সম্রাটকে বলেওছিলাম। তবে ও পাত্তা দিত না। ক্রমে কাজকর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের মধ্যে আসতে শুরু করল দূরত্ব। দিনে দুই তিনবার ফোন কলের বদলে সপ্তাহে দুদিন ভিডিও কল, তারপর তাও কমতে কমতে মাসে এক দুই দিন। এক সাথে কোথাও যাওয়া নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আমার ট্রান্সফার হয়ে গেল স্কটল্যান্ডের অপরূপ সুন্দর শহর, গ্লাসগো। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে চেষ্টা করেছিলাম দেখা করার সম্রাটের সাথে। কিন্তু ও সময় দিতে পারেনি। মন খারাপ নিয়েই গেলাম গ্লাসগো।

ওখান থেকে কয়েকবার কথা হয়েছে, অন্য টাইমজোন হয়ে দাঁড়িয়েছে পথের কাঁটা। তারপর আর তাও না। বুঝতাম সম্রাট আমায় এড়িয়ে যাচ্ছে। মেসেজের উত্তর নেই। আমার জন্মদিনে পর্যন্ত যোগাযোগ নেই। আমি বোকা মেয়ে। ভেবেছিলাম হয়তো আমায় সারপ্রাইজ দিতে গ্লাসগো আসবে। সারাদিন অফিস করতে করতে এই চিন্তাই মাথার মধ্যে খেলছিল আমার। দুদিন পরে ফেসবুকে দেখলাম আমার জন্মদিনের দিন সম্রাট ছিল অফিস পার্টিতে। ঝকঝকে পার্টি। হাসি খুশি মানুষজন। খাদ্য আর পানীয়ের অফুরান ব্যবস্থা। নতুন পরিবেশ। নতুন লোক। সম্রাটকে দেখে মনেই হলো না আমায় মিস করে বলে।

ফেসবুকের থেকেই তারপর একদিন জানতে পারলাম সম্রাট সিডনি ট্রান্সফার হচ্ছে। একবার ভেবেওছিলাম শুভেচ্ছা জানাই। কে জানে কী হলো, জানালাম না। "গাট ফিলিং" হয়তো একেই বলে। ভাগ্যিস জানাইনি। কারণ তিন সপ্তাহ পর দেখলাম সম্রাটের নতুন আপডেট। "ইন এ রিলেশনশিপ উইথ স্বপ্না মেরহোত্রা"। স্টক করে দেখলাম স্বপ্না ওর কলিগ। ব্যাঙ্গালোর অফিস থেকে সিডনি গিয়েছে। কলেজের গ্রুপের বন্ধুদের সাথে তেমন আর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। শুধু মেঘার সাথে নিয়মিত কথা হতো। ও জানতো আমার আর সম্রাটের সম্পর্কের কথা। মেঘার তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড, বর্তমানে হবু বর স্বাধীনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সম্রাট। মেঘা আর স্বাধীন খুব আঘাত পেয়েছিল এই ঘটনাটির পর। একদিন স্কাইপ কলে আমি আর মেঘা দুইজনে অনেক অনেক কান্নাকাটি করলাম। তারপর "এগিয়ে চলতে হবে, যে আমার সাথে এমন করতে পারল, তার মতো খারাপ কেউ হতেই পারেনা। তার জন্য কান্নাকাটি করতে যাওয়া মানে নিজেকে অপমান করা।" এই সব ভেবে আমি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, চেষ্টা। আজও যখন তিন বছর কোনোরকম যোগাযোগ না রেখেও ওকে দেখে এরকম বুকের মধ্যে আনচান করে ওঠা... সত্যি কি আমি "মুভ অন" করতে পেরেছি? এতই কি সহজ?

৩।

প্রাথমিক ভ্যাবাচ্যাকা কাটিয়ে দুজনেই দুজনকে দেখে হাসলাম।
"কেমন আছিস, আই মিন, কেমন আছেন?" থমকে গিয়ে বললাম আমি।
"ভালো আছি। চলছে এক রকম। তুই? আর হ্যাঁ, প্লিজ আপনি আজ্ঞে করিস না। অদ্ভুত লাগে।" করমর্দন করতে করতে সম্রাট বললো। প্রয়োজনের চেয়ে কি একটু বেশিই সময় আমরা একে অপরের হাত ধরেছিলাম? কে জানে।
ভৈঁরো সিং এর ডাকে আমরা গাড়ির ভিতর ঢুকলাম। দুজনের লাগেজ পিছনে চালান হয়ে গিয়েছে। মাঝের সিটে দুই জানলার ধারে আমরা দুজন। আমার হ্যান্ডব্যাগটা দুজনের মধ্যের  যেন এক প্রাচীর সৃষ্টি করেছে। গাড়ি চলছে মুসৌরির দিকে। জানলার কাঁচ নামানো ছিল আমার দিকে অল্প। ঠান্ডা হাওয়া মুখের ওপর পড়ায় খুব আরাম লাগছিলো। একবার বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সম্রাট মাফলার বের করেছে নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে। আঁটোসাঁটো করে গলায় জড়িয়ে নিচ্ছে।
"জানলার কাঁচ তুলে দেব?" জিজ্ঞেস করলাম।
ও বললো, "না থাক।"
"খবর কী তোর, বল। অফিস কোথায় এখন?"
"এই তো। আপাতত কোম্পানি ইস্টার্ন জোনে এক্সপ্যান্ড করছে। তাই কলকাতায় হেডকোয়ার্টার সামলাচ্ছি।" হাসল সম্রাট।
"ফাইনালি তাহলে কলকাতা গেলি। কেমন লাগছে শহরটা?"
"উম, মন্দ না। এক সময় এত গল্প শুনেছি।"
সেই। কত গল্পই না করেছি আমি। শহরটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। আর তাই তার প্রতিটি আনাচে কানাচে ঘুরিয়েছিলাম সম্রাটকে আমার কথার মাধ্যমে। ভিক্টরিয়া হোক কি ময়দান, কলেজ স্ট্রিট বা গড়িয়াহাট, সল্ট লেক হোক কি বেহালা, পুরো কলকাতা আমার নখদর্পনে। কলকাতার গল্প করতে এত ভালোবাসতাম। কেন কে জানে?
বুঝলাম সম্রাটও সেই একই কথাই ভাবছে। আর তাই অপ্রস্তুতও বোধ করছে। কথায় কথা বাড়ে। আমি কিছু বললাম না। আবার জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। দুইবপাশে ঘন সবুজ রাশি। আকাশ পরিষ্কার। এমন নীল আকাশ কতদিন দেখিনা... নৈসর্গিক শোভা বড়ই অপূর্ব। মেঘার কাছে ছবি দেখেছি। আজ চাক্ষুস দেখে যেন আরো মোহাচ্ছন্ন লাগছিলো আমার।
মাঝে একটা জায়গায় আমরা গাড়ি থামালাম। দাঁড়িয়ে গরম গরম চা খেলাম। দেখলাম সম্রাট এখনও বেশি গরম কাপ ধরতে পারে না। কলেজ জীবনে আমার দুপাট্টা জড়িয়ে চায়ের গ্লাস ধরত। আজ দেখলাম স্বাবলম্বী হয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ধরল। পটাপট কিছু ছবি তুলে ওয়াটসঅ্যাপে দিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে বানানো গ্রুপে। কেউ কেউ রিপ্লাই দিল। ওরা আসছে সন্ধ্যেয়। সবার সাথে দেখা হবে পাঁচ বছর পর। কত গল্প বাকি।  আমরা গাড়িতে উঠলাম। ভৈঁরো নিজের পছন্দের নেপালি লোকসংগীত চালিয়ে রেখেছে। কথা যেটুকু বুঝলাম, মনে হলো ভালোবাসার গান। ও নিজেও বেশ ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করছিল। মুখে স্মিত হাসি। দেখে ভালো লাগছিলো আমার।
দু ঘন্টার একটু পর আমরা প্রায় যখন মুসৌরি শহরে ঢুকছি, মেঘার ফোন এলো আমার মোবাইলে। কতদূর এসেছি জানতে চাইলো। বললাম।
"শোন না, তুই কিন্তু প্লিজ আমার ওপর রাগ করিস না সম্রাজ্ঞী। সম্রাটকে কিন্তু আমি ইচ্ছে করে তোর গাড়িতে আনাইনি। ওকে আনতে যে গাড়ির যাওয়ার ছিল, আজ সকালে ওর ড্রাইভার ক্যানসেল করল। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। বিশ্বাস কর। সো সরি।" মেঘার কথা শুনে আমি অল্প হাসলাম। "আরে না না। কোনো ব্যাপার না। অসুবিধে হয়নি। তুই চিন্তা করিস না। এই এখনই পৌঁছবো। গিয়ে দেখা হচ্ছে। কান্ট ওয়েট টু সি ইউ উড বি ব্রাইড!"

"আর কতক্ষণ ভৈঁরো?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"মেমসব, আর পনেরো বিশ মিনিট। জ্যাম নেই ভাগ্যিস আজ।"
বাইরে হাওয়াটা ভালোই বইছে। সবে বেলা আড়াইটা পেরিয়েছে, এরই মধ্যে রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। একটু একটু কুয়াশার চাদর সবে জড়াতে শুরু করেছে পথঘাটকে। আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে স্টোলটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। দেখলাম সম্রাট আমার দিকে তাকিয়ে। কিছু কি বলবে? আমি কোনো কথা বললাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
আমাদের গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। বিরাট বাড়ি। গেটে ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। লম্বা করে টুনি বাল্ব লাগানো। বুঝলাম এটাই মেঘার বাড়ি। সাজগোজ দেখেই বোঝা যায় যে এটি একটি উৎসবের বাড়ি।
এইবার নামতে হবে। ভৈঁরো সিং নেমে লাগেজ নামাতে গেল। আমিও নামতে যাচ্ছিলামই, এমন সময় সম্রাট আমার হাতটা চেপে আটকালো। আমি অবাক হয়েই তাকালাম ওর দিকে।
"সম্রাজ্ঞী, আই এম ভেরি সরি ফর এভরিথিং। তুই প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিস পারলে। আই নো আই হ্যাভ রংড ইউ।"
আমি তাকিয়েই রইলাম ওর দিকে। তারপর কিচ্ছু না বলে হাতটা ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলাম। মুখে চওড়া হাসি। মেঘাও এর মধ্যে এসে গিয়েছে গেটে। এতদিন পর প্রাণের বন্ধুকে পেয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। পুরোনো কথা নিয়ে ভাবার এখন সময় নেই। আগামী কটাদিন হোক সুন্দর। সেই আশাতেই থাকবো আমি। আর সবচেয়ে বড় কথা। টের পেলাম, সম্রাটের কথায় বা আচরণে আমি আর একটুও বিচলিত হলাম না। হয়তো এই দু ঘন্টার যাত্রাপথটা খুব প্রয়োজন ছিল, আমাদের ক্লোজারের জন্য। কে জানে... ভালো থাকে ভালোবাসা।

Friday, November 9, 2018

ভাইফোঁটা

ছোটবেলা থেকে আজকের দিনটা নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহ থাকত। সপ্তাহখানেক আগে থেকে মা আর আমি বসতাম মেনু ঠিক করতে। ভাত হবে না পি-পোলাউ, নিরামিষে ভাজা মুগ ডাল নাকি মাছের মাথা দিয়ে হবে, এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা পর্ব চলত। তবে কিছু আইটেম একেবারে বাঁধাধরা ছিল। ভেটকি মাছের ফিলে দিয়ে ফিস ফ্রাই, মাটন আর জলপাইয়ের চাটনি। দাদাভাই আর মামার আবার মাছের পছন্দ আলাদা। তাই দুই তিন রকমের মাছের ব্যবস্থাও করতে হবে। প্রচুর আলাপ আলোচনার পর মা ফর্দ ধরিয়ে দিত বাবার হাতে। বাবা দুদিন আগে অফিস ফেরতা লেক মার্কেট থেকে মাছ কিনে আনত। আর মা যাদবপুরের একটা নির্দিষ্ট দোকান থেকে পাঁঠার মাংস কিনে আনত।
তখন কত ছোট। মাসে একশো টাকা করে পকেট মানি পাই। সারা বছর ওই জমানো টাকা দিয়ে একে তাকে গিফট কিনে দিই। সেই টাকা দিয়েই দাদাভাইয়ের জন্যও ভাইফোঁটার উপহার নিতে হবে। কী দেওয়া যায়, কী দেওয়া যায়। সেই আবার মা আর আমার ব্রেনস্টরমিং সেশন চলত। তারপর কোন বছর সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি তো কোন বছর অরিফ্লেমের পারফ্যুম। বা কখনও মানি ব্যাগ। যে বছর যেমন সাধয়ে কুলতো। আমার আবার প্রচণ্ড আত্মাভিমান এইসব বিষয়ে। এমনকি ভাইফোঁটার মিষ্টি যেটা দাদাভাইয়ের জন্য কিনব, সেটাও নিজের ট্যাঁক থেকে।
প্রতিপদের দিন বিকেল বিকেল মা আর আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম লর্ডসের মোড়ে কল্পনায়। কী উপচে পড়া ভিড়। তার মধ্যে থেকে বাছাই করে দাদাভাই আর আমআমর জন্য সাত রকমের মিষ্টি আর নোন্তা কিনতাম। তার মধ্যে ভাইফোঁটা লেখা সন্দেশ আর খাজা মাস্ট! এছাড়াও দুপুরের খাবারের পর লাল দই আর রসগোল্লা সকলের জন্য নেওয়া হত।
ভাইফোঁটার দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে নতুন জামা পরে ঠাকুরঘর থেকে চন্দন কাঠ এনে বেটে রেডি রাখতাম। আসন বের করে গুছিয়ে রাখা। বাগান থেকে দুব্বো তোলাটা মা করত, আমার দ্বারা ওইটি হয় না। না খেয়ে ফোঁটা দেবো। এদিকে দাদাভাই এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে সবার কাছ থেকে ফোঁটা নিয়ে শেষমেশ আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি বারবার ঘর বারান্দা করছি। মোবাইলের যুগে ফোন করে বারবার তাড়া দিচ্ছি। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। প্রতিজ্ঞা করছি, এত কষ্ট পোষায় না। সামনের বছর থেকে প্রতিপদে ফোঁটা দেবো (বরিশালের বাঙ্গাল, আমাদের আসলে প্রতিপদেই ফোঁটা)।
তারপর প্রায় বারোটা নাগাদ মামা মামী ঢুকল, মাসী এসে গিয়েছে আগেই। দাদাভাইও আসছে। শঙ্খধ্বনি, উলু দিয়ে গিফট এক্সচেঞ্জ করে  ঝটপট ফোঁটা পর্ব মিটত। ইতিমধ্যে জেঠু আর বাবা পিসির বাড়ি থেকে ফোঁটা নিয়ে গিফট নিয়ে ফিরে এসেছে। বসত একটা জমাটি আড্ডা। দেড়টা দুটোর মধ্যে খেতে বসা। ব্যাচ করে। হাতে হাতে মাকে সাহায্য করা। খাবার শেষে মামা ঠিক বেরিয়ে স্পেশাল মিঠে পান নিয়ে আসত। পান চিবোতে চিবোতে চলত আরেক প্রস্থ গল্প।  যাদের যাদের ঘুম পেতো, একেকটা ঘরে বিছানা দখল করে ঘুম। চারটের দিকে স্প্রাইট বা থাম্বস আপ। সাড়ে পাঁচটার দিকে চা আর রসগোল্লা।
শীত আসবো আসবো তখন। সাড়ে পাঁচটায়ই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসত। একে একে মামা মামী, মামণি (মাসী) আর দাদা সবার ফেরার পালা। কোন কোন বছর মামা বাজি নিয়ে আসত। সেই বছরগুলো দাদা আর আমি ওই ফুলঝুরি, তুবড়ি চর্কি জ্বালাতাম। বাড়তি আনন্দ। উপরি পাওনা।
পরেরদিন থেকে স্কুল অফিস সকলের। উৎসব শেষ। মন খারাপের রেশ।

এই বছরেরটা নিয়ে ছয় বছর হল এই ভাইফোঁটায় দাদাভাইকে ফোঁটা দিতে পারলাম না। ওই ওয়াটসআপে শুধু শুকনো মেসেজ করেছি বটে, কিন্তু এই অনুভূতিগুলো আসেই না। সকাল থেকেই তাই ভীষণ মন খারাপ।

Thursday, November 8, 2018

sad ভাইফোঁটা

ভাইফোঁটার দিনে ভাই বোনের ঝগড়া করাটা যেন একটা ট্র্যাডিশন হয়ে গিয়েছে। পাঁচ থ্বেকে পনেরো ছিল সকালে ভাইফোঁটা সন্দেশ আর খাজা নিয়ে কাড়াকাড়ি আর তারপর দুপুরে খেতে বসে মাটনের পিস আর ফিস ফ্রাই খাওয়া নিয়ে কম্পিটিশন।
দিন বদলায়। বছরের পর বছর কেটে যায়। ঝগড়া থামে না। শুধু পাল্টে যায় কারণ।
মধ্যবয়স্ক দুই ভাই বোন আজও ঝগড়া করে। মায়ের মান্তাসা চন্দ্রহার কে ভাগে পাবে, এই নিয়ে...

ভাই-জোনড

তন্ময়, শুভ্র, আকাশ, দেবারুণ এক্কেবারে যাকে বলে সেই হাফ প্যান্টের বয়স থেকে বন্ধু। এক স্কুল এক পাড়া। সৌভাগ্যবশত কাজের সূত্রেও চারজনই এখনও কলকাতায় আর তাই নিয়মিত আড্ডা বসে ওদের পাড়ার মোড়ের পান সিগারেটের দোকানে। সেরকমই এক আসর আজও বসেছে। কালীপূজো দেওয়ালি শেষ। পরশু থেকে আবার সব অফিস। সকলেই প্রায় মনমরা। ব্যতিক্রম দেবারুণ। বাকিরা দেখছে দেবা সেই আসা ইস্তক ফুরফুরে মেজাজে আছে। মন মেজাজ দিব্যি ভালো। এতটাই ভালো যে কিপ্টে বলে বদনাম যার, সেই দেবাই আজ বাকিদের লেমন সোডাও খাওয়াল। শুভ্র তন্ময় আর আকাশ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বলি হল টা কী ওদের বন্ধুর?
শেষমেশ শুভ্র আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, "দেবা ব্যাপার কী রে? আজ এত উড়ছিস? কী কেস? ঝুম্পা গ্রিন সিগনাল দিল নাকি?" ঝুম্পা দেবারুণের কলিগ। এই সুন্দরী মেয়েটিকে বেশ কিছু মাস ধরেই পটানোর চেষ্টা করছে দেবা। বন্ধুরা নিয়মিত আপডেট পায় অবশ্য। এখনও অবধি তেমন আশার কিছু দেখেনি।
দেবা একটু লাজুক মুখ করে হেসে বলল, " হ্যাঁ মানে মনে তো হচ্ছে তাই।"
"আরেএএএএ ভাই ভাই ভাই..." বাকি তিনজন পিঠ চাপড়ে "কী ব্যাপার, কী হল, কী করে হল"  ইত্যাদি প্রশ্নবাণ হানল দেবারুণের দিকে।
দেবা সেই একইরকম লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, "সেদিন আমি ওর টিফিনের মাংস টেস্ট করে এত প্রশংসা করেছিলাম, ও বলেছিল একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবে। তা একটু আগে মেসেজ করলো, বলল কাল ও নাকি অনেক রান্নাবান্না করবে। আমায় যেতে বলল ওর বাড়ি। খাওয়াবে।"
শুভ্র আকাশের দিকে, আকাশ তন্ময়ের দিকে আর তন্ময় শুভ্রর দিকে তাকাল। বেশ সিরিয়াস মুখ করেই। তারপর রীতিমত একই সাথে তিনজনে বলল, "ভাই তুই তো গেলি।"
দেবারুণ অবাক হয়ে বলল, "মানে? কী কেস?"
"ভাই, বুঝছিস না। কাল ভাইফোঁটা রে।"
"তো?"
"আরে এত রেঁধে বেড়ে তোকে ভাইফোঁটার দিনে বাড়িতে ডাকছে। বুঝছিস না? ভাই, তুই তো গেলি..."বলতে বলতে প্রবল অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল ওরা তিনজন। আর দেবারুণ? ওর মুখটা যেন ঠিক চুপসানো ফানুস একটা। 

Monday, November 5, 2018

দীপ্তি

রাত্তির প্রায় আটটা। প্লেনটা গত দশ মিনিট ধরে কলকাতা এয়ারপোর্টের ওপর চক্কর কাটছিল। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটের উইন্ডো সিট থেকে তিলোত্তমা শহরটিকে দেখে গুঞ্জার মনে হচ্ছিল যেন একটা দামী নেকলেস। ঠিক যেরকম দেখেছিল ও মা, আশাবরীর কর্মস্থলে। কালীপুজোর আগে কয়েকদিন দোকানে খুব ভিড় থাকত, মায়ের ফিরতে অনেক দেরি হত। দিদিমার কাছে বসে স্কুলের পড়া শেষ করে বারান্দায় বসে গল্প শুনত, যতক্ষণ না মা ফিরছে। রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ছোট্ট গুঞ্জা পৌঁছে যেত সব পেয়েছির দেশে। ওর বাস্তবের সাথে দেখানে অনেক অমিল।
আশাবরীর সাথে আবীরের প্রেমজ বিয়ে হয়। মধ্যবিত্ত ঘরের সুশ্রী তন্বী আশার সাথে আবীরের পরিচয় একটি জন্মদিনের পার্টিতে। আবীরের ভাগ্নির জন্মদিন। আশাবরী ছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির লোক। আবীরের পরিবার মধ্যবিত্ত ঘরের শ্যামলা মেয়েকে প্রথমে মানতে নারাজ হলেও পরে ছেলের জোরাজুরিতে বাধ্য হয় বিয়েতে মত দিতে। বছর খানেকের পর যখন আশার কোল জুড়ে গুঞ্জা আসে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন রীতিমতো ছি ছি করেছিল। একেই মেয়ে, তার ওপর মায়ের মতোই শ্যামলা। এক বস্ত্রে সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে আশা বেরিয়ে আসে সেদিন। আশ্রয় পায় নিজের মায়ের কাছে।
একা হাতে চাকরি করে সংসার চালাত আশাবরী। কোনদিনও মেয়ের লেখাপড়ায় কোন কমতি করেনি। যথাসাধ্য শখ আহ্লাদ পূর্ণ করেছে। তবে গুঞ্জা বুঝত মায়ের দুঃখ। মায়ের সংগ্রাম। আর তাই ছোট্টবেলা থেকেই গুঞ্জার তেমন আবদার ফরমায়েশ ছিল না।  বছরের পর বছর ধন্তেরসের দিন মা গল্প করত সেদিন দোকানের বিক্রির কথা। সামর্থ্যের মধ্যে হয়তো কোন বছর জুটত রূপোর দুল। কখনও হয়তো এক কুচি সোনার ফুল।
গুঞ্জা এখন সুপারমডেল। একের পর এক মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ায়। দেশে বিদেশে। বর্তমানে দেশের এক জনপ্রিয় গয়নার দোকানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। শহরের আনাচে কানাচে ওর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন গয়না পরে, বিভিন্ন পোশাকে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে।
আজ ধন্তেরস।  গুঞ্জা আজ মায়ের জন্য ওর বিজ্ঞাপনে পরা সবচেয়ে পছন্দের সেটটি কিনে এনেছে। মায়ের গলায় পরিয়ে তবে শুরু হবে ওর আলোর উৎসব। মায়ের চোখে মুখে যে দীপ্তি দেখবে ও, সেটাই ওর পরম প্রাপ্তি।

Friday, November 2, 2018

SRK and me


একদম ছোটবেলায় যখন প্রথম "জাদু তেরি নজর" শুনি/দেখি, তখন থেকেই লাভ (মানে ওইটুকু বয়সে আদৌ লাভ কী, বোঝা যায় না কি?) অ্যাট ফার্স্ট সাইট। নিজেকে তখন ওঁর হিরোয়িন ভাবতাম। সবাইকে বলতাম, আমার নাম জুহি চাওলা গুপ্ত!!

বাড়িতে কেবিল টিভি ছিল না। তাই রবিবারগুলো হাওড়ায় মাসির বাড়ি যাওয়ার হলেই মুখিয়ে থাকতাম। দুপুর দুটোয় লোকাল কেবিলে তখন সদ্য রিলিজ হওয়া সিনেমাগুলো দিত। মনে আছে একবার পরদেশ সিনেমাটি দেখি। যদিও ওই মারামারি রক্তারক্তি একদম দেখতে পারি না, তবুও ওই "দো দিল মিল রহে হ্যায়" শুনলে বা দেখলেই কেমন ভেবলে যেতাম।

স্কুলে বন্ধুদের দৌলতে তার পরে পরেই কুছ কুছ হোতা হ্যায়, কভি খুশি কভি ঘম এই সিনেমাগুলির কথা শুনলাম। তখন রেডিওতে ওই সিনেমার গান আর নিউজপেপার ম্যাগাজিনে হাঁ করে ছবি গিলে গিয়েছি। আনন্দলোকের পূজাবার্ষিকীগুলোতে গল্প উপন্যাসের চেয়ে গ্লসি কাগজে এস আর কের ছবিগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকতাম।

ক্লাস ইলেভেন পড়াকালীন স্কুল এক্সকারশানে ভাইজাগ গিয়েছিলাম। সেদিন রাত্রে আমাদের ক্যাম্প ফায়ার গোছের কিছু হওয়ার কথা ডিনারের পর। কেউ একজন হোটেলের ঘরে টিভি চালিয়ে দেখেছে ম্যায় হু না হচ্ছে। ব্যস। ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে গেল। আমি যত তাড়াতাড়ি পেরেছি ঘরে এসে সিনেমা দেখেছি। একেই শাহরুখ, বাড়তি পাওনা দার্জিলিং।

প্রথম ডেস্কটপ কম্পিউটার আসে হায়ার সেকন্ডারির পর। হ্যাপি কোইন্সিডেন্স, যিনি অ্যাসেম্বল করেছিলেন, মিউজিক ফোল্ডারে চলতে চলতে সিনেমার সব গান দিয়েছিলেন। তখন সদ্য ইন্টারনেটে অভ্যস্ত হচ্ছি। ওয়েবসাইট থেকে গান ডাউনলোড করছি আর ফোনে ট্রান্সফার করছি। তখনও স্মার্টফোন আসেনি, সিম্বিয়ানে চলে। বলা বাহুল্য, সবই ভদ্রলোকের সিনেমার।

কী বা করি আর? ওই যে স্বদেশের মোহন ভারগব হোক বা চক দে ইন্ডিয়ার কবীর খান, কুছ কুছ হোতা হ্যায় হোক বা চেন্নাই এক্সপ্রেস... হাল্কা হেসে গালে টোল পড়া আর ওই ultimate romantic চাউনি... loveriaর শিকার না হয়ে থাকা যায়?

অন্তত একবার আমার দিকে ওরকম ভাবে তাকাক... জিন্দেগি আপনে আপ হসীন হয়ে যাবে...

SRK

১।

ক্লাস এইটের টিনার আজ বেশ মন খারাপ। আবার স্কুল খুলেছে পুজোর পর। এই এক মাস বাড়ি বসে দিব্যি শাহরুখ খানের সিনেমা দেখত। এখন আবার ওই টাইম অ্যান্ড ডিস্টেন্স আর কারেন্টস অফ দি প্যাসিফিক ওশেনের বোরিং ক্লাস। প্লেলিস্টে এস আর কের গান চালিয়ে ইয়ারফোন কানে ক্লাসরুমে নিজের পছন্দের ফ্রন্ট রো সিটে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখল একটি ছেলে বসে রয়েছে। নতুন স্টুডেন্ট নাকি? একে তো কখনও দেখে নি?
টিনা কিছু বলল না। ইয়ারফোনটা খুলে ব্যাগটা নিয়ে অন্য বেঞ্চের দিকে যাচ্ছিলই, ঠিক তখন ওর হাতটা ধরে আটকাল ছেলেটি। টিনা পিছন ফিরে তাকালো। হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এটা কে? সেই একইরকম টোল গালে, চুলটা হাল্কা উসকো খুস্কো।
বন্ধুত্বের হাতটা এগিয়ে বলল, "I'm Rahul...নাম তো সুনা হোগা!"
মুহূর্তেই টিনা শুনতে পেল সেই বিখ্যাত ম্যান্ডোলিনের টুং টাং। 



২।

বছর তেইশের রাজীব থাপা আর পাঁচটা নেপালী ছেলের মতোই। স্কুলের গণ্ডী পেড়িয়ে এখন মা আর মাসীর সাথে ক্ষেতি করেই দিন চলে। গান পাগল ছেলেটি  রাত্রে খাওয়ার পর খোলা আকাশের নিচে প্রিয় গিটার হাতে বলিউডের গান গায় গলা ছেড়ে। ওদের পাশের বাড়ির কাকীমারা নিজেদের বাড়িটাকে ইদানীং হোমস্টে হিসেবে ভাড়া দিচ্ছে। সেখানেরই কিছু বাবুরা রাজীবের গান শুনে এক্কেবারে মুগ্ধ। ওদের নাকি কলকাতায় হোটেল আছে। বলেছে ওকে হোটেলে গান গাইবার সুযোগ দেবে। নিয়মিত টাকা আসবে।
দার্জিলিং মেল থেকে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখল রাজীব। সাদা ফুল শার্ট, কালো কোট আর কালো প্যান্ট পরে। মধ্যে মধ্যে ওর মা ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। সাধের "রাজু বন গয়া gentleman!"


৩।

চায়ের দোকানের পল্টু ভারি হাসি খুশি ছেলে। বয়স ওই বারো তেরো। সকালবেলা মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে পড়াশোনা করে। দুপুর থেকে বাবার দোকানে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেয়। একটা আদ্যিকালের কালো রেডিয়োতে সারাক্ষণ বেজে চলেছে হিন্দি বাংলা গান। শুনে শুনে পল্টুর সব মুখস্থ। শারুখ খানের গানগুলো ওর হেব্বি লাগে।  রেডিওর অফিসটা আবার ওদের দোকানের পিছনেই। কতবার ওই দাদা দিদিগুলোকে ও চা পৌঁছে দিয়ে এসেছে। কী রংচঙে আপিস। সবাই কী হাসিখুশি। পল্টু এক দুবার কাঁচের দরজার এপার থেকে দেখেছে কেমনভাবে মাইকের সামনে দাদা দিদিগুলো কথা বলে।ও যদি এমন সুযোগ পেতো...

শিশু দিবস উপলক্ষ্যে এই রেডিওর দিদি দাদাগুলো নাকি পল্টুর মতো ছেলে মেয়েদের সেই সুযোগ দেবে। ওরা মানে যারা লেখাপড়ার সাথে সাথে কাজকর্মওকরে, তাদের নিয়ে নাকি অনুষ্ঠান হবে। পল্টু বেজায় খুশি। ওকেও শোনা যাবে রেডিওতে।

বেশ ফিটফাট হয়ে পল্টু রেডিওর আপিসে গিয়েছে আজ। নিচে ওর বাবা রেডিওর একদম সামনে বসে আছে। অধীর অপেক্ষা। যে কোন মুহূর্তে ওর গলা শোনা যাবে। শুনতে পেল এক দিদির গলা, "তোমার নামটা বলো?"
আর তারপরেই বহু প্রতীক্ষিত সেই কণ্ঠ।
"আমায় সবাই পল্টু বলেই চেনে। কিন্তু আমার একটা ভালো নাম আছে। রাহুল। নাম তো সুনা হোগা?"


৪।

ইশ, কী কুক্ষণে যে ফোনটা চার্জ করতে ভুলে গিয়েছিল, চারজারটাও কাজ করছে না। ট্রেনের ভিতরে বসে টেনশন করতে লাগল সিমি।  ইউরেল চেপে জুরিখ যাচ্ছে। অ্যানা থাকে। তবে হঠাৎ প্ল্যান বদল করে একদিন আগেই সিমি পৌঁছে যাচ্ছে। অ্যানাকে জানানো হয়নি। তাড়াহুড়োয় ভেবেছিল ট্রেনে উঠে জানিয়ে দেবে। এখন এই বিপত্তি। কী করে কী করবে ও জুরিখে? বড্ড চিন্তা হচ্ছে। ওর কামরাটাও একদম ফাঁকা। কারুর থেকে যে ফোন বা চারজার চাইবে, সেই উপায়ও নেই। এক্কেবারে কাঁদো কাঁদো অবস্থা ওর।

ট্রেন ছুটছে সুইজারল্যান্ডের ভিতর দিয়ে। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। এদিকে সিমির সেদিকে চোখ নেই। সানেন স্টেশনে এক যুবক উঠল ওর কামরায়। দেখে তো ভারতীয়ই মনে হল। চোখে কালো চশমা, সাদা শার্টের ওপর গাঢ় নীল জ্যাকেট, স্কাউ ব্লু জিন্স, পিঠে ব্যাকপ্যাক।
ওর উল্টোদিকের সিটে জানলার ধারে বসল। সিমির দিকে তাকিয়ে একবার হাসল।
"এক্সকিউজ মি, ডু ইউ হ্যাভ আ মোবাইল চারজার? মাইন ইস নট ওয়ার্কিং। অ্যান্ড আই নিড টু মেক আ ভেরি ইম্পরট্যান্ট কল টু মাই ফ্রেন্ড ইন জুরিখ। মাই ফোন ইস ডেড", বলল সিমি।
"koi baat nahin senorita.. bade bade desho mein aisi chhoto chhoti baatein hoti rehti hain..."


৫।

প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠ। টিফিন পিরিয়ডে ছেলেরা দৌড়ঝাঁপ করছে। আজও গাবলু ছোঁওয়াছুঁই খেলায় অক্রমের নাগাল পেল না। উফ, কী জোরে ছুটতে পারে ছেলেটা। কী দম।
"ঠিক আছে। থাম অক্রম। আমি আর ছুটতে পারবো না।"
"দেখলি তো, আজও ধরতে পারলি না আমায়?"
গাবলু একটু হেসে বলল, "জানি তো। ডন কো পকড়না মুশকিল হই নহি, না মুমকিন হ্যায়!"