Monday, November 12, 2018

হঠাৎ দেখা

১।

দেরাদুনের জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্টে প্লেনটা যখন নামল, ঘড়িতে সকাল সাড়ে এগারোটা। হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া আর অন্য কোন কিছু নেওয়ার ছিল না, তাই প্লেন থেকে নেমেই একেবারে বাইরে চলে এলাম। আমি, সম্রাজ্ঞী দাশগুপ্ত, বর্তমানে দিল্লীতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। দেরাদুন এসেছি, বা বলা চলে, মুসোউরি যাচ্ছি আমার খুব কাছের এক বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে। মেঘা, আমার ক্লাসমেট কাম রুমমেট। একসাথে এম বি এ পড়েছি আমেদাবাদে। ওই দুই বছরের কঠিন দিনগুলো অনেকাংশেই কম কষ্টের কাটত শুধুমাত্র এই সদা হাসি খুশি পাহাড়ি মেয়েটির জন্য। মেঘা আমার কাছে বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। আর তাই ও যখন আমায় ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার কথা জানালো দশ মাস আগে, আমি তক্ষুনি ছুটির আবেদন করে ফেলেছিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের ব্যাচের অনেকেই আসবে। রুশা, সিম্মি, প্রিয়াঙ্কা, গৌরব, নেহাল, চঞ্চল, পারুল, বিবেক, আকাশ, সুমিত। সবার সাথে দেখা হবে, ভেবে এমনিতেই মন ভালো। তার ওপর এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়েই পাহাড় দেখে আর একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার আমেজ আমায় মুহূর্তেই খুশি করে দিল। দিল্লীতেও ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। তবে এই শুদ্ধ পরিবেশের বড্ড অভাব। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। মেঘার মেসেজ পেয়েছি, এয়ারপোর্টের সামনেই ওর পাঠানো গাড়ি আছে। গাড়ির নম্বর জানিয়ে রেখেছে। আমি ড্রাইভার সাহেবকে ফোন করে এগোতে লাগলাম।

একটা কালো রঙের ইনোভা গাড়ি। দরজার বাইরেই এক বছর পঁচিশ তিরিশের যুবক দাঁড়িয়ে। বুঝলাম ইনিই চালক। আমার হাত থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে বললেন, "মেমসাব, একটু অপেক্ষা করতে হবে। এর পরের ফ্লাইটে আর এক সাবজী আসছেন। মেঘা ম্যাডাম বলেছেন আপনাদের দুজনকে একসাথে নিয়ে আসতে। এই তো বারোটা পনেরোর দিকেই ল্যান্ড করবে। আপনি গাড়ির ভিতরে বসুন।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম একটু। কই, মেঘা তো আমায় কিছু বলেনি। কে আসছে? আমাদের ব্যাচের কেউ? ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কেউ কিছু তো লিখল না। আমার ধারণা ছিল বাকিরা বম্বে হয়ে আসছে। বিকেলে পৌঁছবে। কে জানে। থাক, একটু রোদ পোহাই, আর বাড়িতেও ফোন করে দিই। মা বাবা চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। হ্যান্ডব্যাগটা গাড়িতে রেখে আমি বাইরেই দাঁড়ালাম। বাড়িতে কথাবার্তা সারলাম। ঘড়িতে বাজে বারোটা পঁয়ত্রিশ। ইতিমধ্যেই ভৈঁরো সিং, মানে আমাদের ইনোভার চালকের ফোনে আমার সহযাত্রীর কল এসে গিয়েছে। উনি কনভেয়ার বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়েই আসছেন। আমি ভৈঁরোর সাথে খানিক খেজুরে গল্প করলাম। মুসৌরির আবহাওয়া, বিয়ের তোরজোড় ইত্যাদি নিয়ে।

"ওই তো, সাব এসে গিয়েছেন।"  ভৈঁরোর কোথায় সম্বিত ফিরল। ফোন থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম যাকে, মুহূর্তে আমার হৃৎপিণ্ড দু তিনটে বিট মিস করলোই করল। ঠিক আগের মতোই। নীল জিন্স, লাল কালো  চেক শার্ট আর চোখে কেতাদুরস্ত সানগ্লাস পরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সম্রাট। সম্রাট চট্টোপাধ্যায়। একদা আমাদের এম বি এ ক্লাসের ক্লাসমেট। তার চেয়েও বড় কথা, আমার প্রাক্তন প্রেমিক।


২।

সালটা ২০১১। তখন সবে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এম বি এ পড়তে ঢুকেছি। প্রথম বাড়ির বাইরে থাকা। হোস্টেল জীবন। পড়ার চাপ। র‍্যাগিং। সব মিলিয়ে মন খারাপ করেই অবসর কাটত। অবশ্য লেখাপড়ার এত চাপ থাকত, রোজ রোজ একেকটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করা, ক্লাসের পড়া রেডি করা, হঠাৎ হঠাৎ সারপ্রাইজ কুইজ, সব মিলিয়ে নাজেহাল। বরাবর স্কুল আর কলেজ টপার আমি। তাতেও হিমশিম খেতাম এম বি এর কারিকুলামে। ব্যাচের সকলের সাথেও আলাপ হয়নি সেরকমভাবে, কিছু বন্ধু বান্ধব হয়েছিল সেকশনে, ওইটুকুই। এরই মধ্যে একদিন আমাদের ব্যাচের থেকে কিছু লোকজন ঠিক করল, সব সেকশন মিলে মিড সেমেস্টারে একটা উইকেন্ডে বেড়াতে যাওয়া হবে। উদয়পুর। এই উপায়ে সকলের সাথে সকলের বেশ পরিচিতি হবে। বেড়াতে আমি ভালোইবাসি। আর রাজস্থান বেড়াতে যাওয়ার শখ অনেকদিন ধরেই। তাই না করিনি। কে জানত, এই ট্রিপই আমূল বদলে দেবে আমার জীবন। এনে দেবে এই নিস্তরঙ্গ জীবনে ঝঞ্ঝা।

বৃহস্পতিবার বিকেলে আমাদের ১০০ জনের দল চারটে বড় বাস নিয়ে রওনা দিলাম। যেহেতু এই ট্রিপের মূল কারণ বা লক্ষ্যই ছিল একে অপরের সাথে মেলামেশা হওয়া, পরিচিতি বাড়া, তাই সিটিং এরেঞ্জমেন্টও ছিল বেশ অভিনব। লটারিতে ঠিক হবে এই পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা কে কার সাথে বসবে। উদয়পুর পৌঁছনর আগে আবার বাসে লটারি হয়েছিল কে কার রুমমেট হবে। আমি যে চিরকুট দুটি তুলেছিলাম, তাতে আমার বাস সঙ্গী ছিল সম্রাট। আর রুমমেট পারুল। সম্রাটের পাশে বসবে সম্রাজ্ঞী, ব্যাচের যে কজন বাঙালি ছিল, তারা দায়িত্ব নিয়ে এই জোড়ির গল্প গোটা ব্যাচকে বুঝিয়ে দিল। আর কী, সারা রাস্তা আমাদের দুজনকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা হইহই হল। সুমন থেকে থেকেই রব নে বনা দি জোড়ির টাইটেল ট্র্যাক গাইতে লাগল। সম্রাটের সাথে আমার আলাপ ছিল না আগে। ও ছিল সেকশন এ তে। আর আমি, সেকশন বি। বরাবরের প্রগল্ভ আমি, লোকজনের উৎপাত থেকে কোনক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে নিজেই যেচে আলাপ করলাম। শুনলাম, ও প্রবাসী বাঙালি। জন্ম থেকেই নাগপুরে থাকে। ওর বাবা ওখানের এক কলেজের প্রফেসর। হিন্দি ফিল্ম আর কান্ট্রি ফোকের পোকা। আমারও মোটামুটি পছন্দের বিষয় এগুলিই। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা এই নিয়ে আলোচনা করতে করতে কখন যে কেটে গেল, খেয়ালই নেই। মনে আছে, ওর বাংলা ফোক সং নিয়ে তেমন ধারণা নেই শুনে আমি বেশ কয়েকটা গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম। আমার গানের গলার প্রশংসা পেলাম উপহারে। তবে সবচেয়ে বড় উপহার, বা বলা যায়, স্মরণীয় উপহার পেলাম, তা ছিল সম্রাটের বন্ধুত্ব। আগামী তিনদিন এত ভালো কেটেছিল, ঠিক যেন স্বপ্ন। উদয়পুর লেকে সূর্যাস্ত দেখা, নৌকাভ্রমণ, সিটি প্যালেসের ঐশ্বর্য্য জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া...প্রতি মুহূর্ত বন্ধুদের সাথে, বিশেষ করে সম্রাটের সাথে ঘুরে ভীষণ উপভোগ করেছিলাম। ফেরার পথে আর আমাদের সিটিং নিয়ে কিছু আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। যে যার পাশে বসা যাবে। অদ্ভুতভাবে আমার পাশের জায়গায় ঠিক সম্রাট এসে বসেছিল।

দেখতে দেখতে দিন গেল। সম্রাটের সাথে আমার বন্ধুত্ব আরো নিবিড় হতে থাকল। সময় সুযোগ থাকলেই লাইব্রেরি গিয়ে পড়াশোনা করা, এক সাথে এসাইনমেন্ট সল্ভ করা, পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গেলে রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে গিয়ে একটু বিরাম নেওয়া... একদিন হঠাৎ বুঝলাম, কবে যেন আমরা শুধুই ভালো বন্ধুর গণ্ডি পেরিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি পরের ধাপে। হাসি মজার মধ্যে দিয়েই লেখাপড়া,  ঘুরে বেড়ানো, দেখতে দেখতে কোর্স শেষ হলো। প্লেসমেন্টে দুজনে দুই জায়গায় চাকরি পেলাম। আমি দিল্লি। সম্রাট চেন্নাই। অবশ্যই মাঝে মাঝেই একে অপরের কাছে চলে আসব, দেখা করব, এই সমস্ত কথা দেয়া নেওয়া চলল।

প্রথম এক বছর মোটামুটি তেমনভাবে চললও। লং উইকেন্ড পেলেই হয় আমি চেন্নাই নয় সম্রাট দিল্লি এসে যেত। ছুতোয় নাতায় কাজ নিয়ে চলে যেতাম চেন্নাই। বা ও আসত বোম্বে। আমি ছুটি ম্যানেজ করে সেখানে চলে যেতাম। দুই পক্ষের বাড়িতেই আমাদের কথা জানত। এক আধ বার আমরা কবে বিয়ে করেছি, এই মর্মে কথাবার্তা উঠেছে। দুজনেই কেরিয়ারে আরো উন্নতি করব, তারপর গাঁটছড়া বাঁধব, এই বলে সাময়িকভাবে কথা এড়াতাম। তবে মনে মনে বিয়ে নিয়ে যে অল্প বিস্তর স্বপ্ন দেখতাম, স্বীকার করতে লজ্জা নেই। সম্রাটকে বলেওছিলাম। তবে ও পাত্তা দিত না। ক্রমে কাজকর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের মধ্যে আসতে শুরু করল দূরত্ব। দিনে দুই তিনবার ফোন কলের বদলে সপ্তাহে দুদিন ভিডিও কল, তারপর তাও কমতে কমতে মাসে এক দুই দিন। এক সাথে কোথাও যাওয়া নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আমার ট্রান্সফার হয়ে গেল স্কটল্যান্ডের অপরূপ সুন্দর শহর, গ্লাসগো। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে চেষ্টা করেছিলাম দেখা করার সম্রাটের সাথে। কিন্তু ও সময় দিতে পারেনি। মন খারাপ নিয়েই গেলাম গ্লাসগো।

ওখান থেকে কয়েকবার কথা হয়েছে, অন্য টাইমজোন হয়ে দাঁড়িয়েছে পথের কাঁটা। তারপর আর তাও না। বুঝতাম সম্রাট আমায় এড়িয়ে যাচ্ছে। মেসেজের উত্তর নেই। আমার জন্মদিনে পর্যন্ত যোগাযোগ নেই। আমি বোকা মেয়ে। ভেবেছিলাম হয়তো আমায় সারপ্রাইজ দিতে গ্লাসগো আসবে। সারাদিন অফিস করতে করতে এই চিন্তাই মাথার মধ্যে খেলছিল আমার। দুদিন পরে ফেসবুকে দেখলাম আমার জন্মদিনের দিন সম্রাট ছিল অফিস পার্টিতে। ঝকঝকে পার্টি। হাসি খুশি মানুষজন। খাদ্য আর পানীয়ের অফুরান ব্যবস্থা। নতুন পরিবেশ। নতুন লোক। সম্রাটকে দেখে মনেই হলো না আমায় মিস করে বলে।

ফেসবুকের থেকেই তারপর একদিন জানতে পারলাম সম্রাট সিডনি ট্রান্সফার হচ্ছে। একবার ভেবেওছিলাম শুভেচ্ছা জানাই। কে জানে কী হলো, জানালাম না। "গাট ফিলিং" হয়তো একেই বলে। ভাগ্যিস জানাইনি। কারণ তিন সপ্তাহ পর দেখলাম সম্রাটের নতুন আপডেট। "ইন এ রিলেশনশিপ উইথ স্বপ্না মেরহোত্রা"। স্টক করে দেখলাম স্বপ্না ওর কলিগ। ব্যাঙ্গালোর অফিস থেকে সিডনি গিয়েছে। কলেজের গ্রুপের বন্ধুদের সাথে তেমন আর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। শুধু মেঘার সাথে নিয়মিত কথা হতো। ও জানতো আমার আর সম্রাটের সম্পর্কের কথা। মেঘার তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড, বর্তমানে হবু বর স্বাধীনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সম্রাট। মেঘা আর স্বাধীন খুব আঘাত পেয়েছিল এই ঘটনাটির পর। একদিন স্কাইপ কলে আমি আর মেঘা দুইজনে অনেক অনেক কান্নাকাটি করলাম। তারপর "এগিয়ে চলতে হবে, যে আমার সাথে এমন করতে পারল, তার মতো খারাপ কেউ হতেই পারেনা। তার জন্য কান্নাকাটি করতে যাওয়া মানে নিজেকে অপমান করা।" এই সব ভেবে আমি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, চেষ্টা। আজও যখন তিন বছর কোনোরকম যোগাযোগ না রেখেও ওকে দেখে এরকম বুকের মধ্যে আনচান করে ওঠা... সত্যি কি আমি "মুভ অন" করতে পেরেছি? এতই কি সহজ?

৩।

প্রাথমিক ভ্যাবাচ্যাকা কাটিয়ে দুজনেই দুজনকে দেখে হাসলাম।
"কেমন আছিস, আই মিন, কেমন আছেন?" থমকে গিয়ে বললাম আমি।
"ভালো আছি। চলছে এক রকম। তুই? আর হ্যাঁ, প্লিজ আপনি আজ্ঞে করিস না। অদ্ভুত লাগে।" করমর্দন করতে করতে সম্রাট বললো। প্রয়োজনের চেয়ে কি একটু বেশিই সময় আমরা একে অপরের হাত ধরেছিলাম? কে জানে।
ভৈঁরো সিং এর ডাকে আমরা গাড়ির ভিতর ঢুকলাম। দুজনের লাগেজ পিছনে চালান হয়ে গিয়েছে। মাঝের সিটে দুই জানলার ধারে আমরা দুজন। আমার হ্যান্ডব্যাগটা দুজনের মধ্যের  যেন এক প্রাচীর সৃষ্টি করেছে। গাড়ি চলছে মুসৌরির দিকে। জানলার কাঁচ নামানো ছিল আমার দিকে অল্প। ঠান্ডা হাওয়া মুখের ওপর পড়ায় খুব আরাম লাগছিলো। একবার বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সম্রাট মাফলার বের করেছে নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে। আঁটোসাঁটো করে গলায় জড়িয়ে নিচ্ছে।
"জানলার কাঁচ তুলে দেব?" জিজ্ঞেস করলাম।
ও বললো, "না থাক।"
"খবর কী তোর, বল। অফিস কোথায় এখন?"
"এই তো। আপাতত কোম্পানি ইস্টার্ন জোনে এক্সপ্যান্ড করছে। তাই কলকাতায় হেডকোয়ার্টার সামলাচ্ছি।" হাসল সম্রাট।
"ফাইনালি তাহলে কলকাতা গেলি। কেমন লাগছে শহরটা?"
"উম, মন্দ না। এক সময় এত গল্প শুনেছি।"
সেই। কত গল্পই না করেছি আমি। শহরটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। আর তাই তার প্রতিটি আনাচে কানাচে ঘুরিয়েছিলাম সম্রাটকে আমার কথার মাধ্যমে। ভিক্টরিয়া হোক কি ময়দান, কলেজ স্ট্রিট বা গড়িয়াহাট, সল্ট লেক হোক কি বেহালা, পুরো কলকাতা আমার নখদর্পনে। কলকাতার গল্প করতে এত ভালোবাসতাম। কেন কে জানে?
বুঝলাম সম্রাটও সেই একই কথাই ভাবছে। আর তাই অপ্রস্তুতও বোধ করছে। কথায় কথা বাড়ে। আমি কিছু বললাম না। আবার জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। দুইবপাশে ঘন সবুজ রাশি। আকাশ পরিষ্কার। এমন নীল আকাশ কতদিন দেখিনা... নৈসর্গিক শোভা বড়ই অপূর্ব। মেঘার কাছে ছবি দেখেছি। আজ চাক্ষুস দেখে যেন আরো মোহাচ্ছন্ন লাগছিলো আমার।
মাঝে একটা জায়গায় আমরা গাড়ি থামালাম। দাঁড়িয়ে গরম গরম চা খেলাম। দেখলাম সম্রাট এখনও বেশি গরম কাপ ধরতে পারে না। কলেজ জীবনে আমার দুপাট্টা জড়িয়ে চায়ের গ্লাস ধরত। আজ দেখলাম স্বাবলম্বী হয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ধরল। পটাপট কিছু ছবি তুলে ওয়াটসঅ্যাপে দিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে বানানো গ্রুপে। কেউ কেউ রিপ্লাই দিল। ওরা আসছে সন্ধ্যেয়। সবার সাথে দেখা হবে পাঁচ বছর পর। কত গল্প বাকি।  আমরা গাড়িতে উঠলাম। ভৈঁরো নিজের পছন্দের নেপালি লোকসংগীত চালিয়ে রেখেছে। কথা যেটুকু বুঝলাম, মনে হলো ভালোবাসার গান। ও নিজেও বেশ ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করছিল। মুখে স্মিত হাসি। দেখে ভালো লাগছিলো আমার।
দু ঘন্টার একটু পর আমরা প্রায় যখন মুসৌরি শহরে ঢুকছি, মেঘার ফোন এলো আমার মোবাইলে। কতদূর এসেছি জানতে চাইলো। বললাম।
"শোন না, তুই কিন্তু প্লিজ আমার ওপর রাগ করিস না সম্রাজ্ঞী। সম্রাটকে কিন্তু আমি ইচ্ছে করে তোর গাড়িতে আনাইনি। ওকে আনতে যে গাড়ির যাওয়ার ছিল, আজ সকালে ওর ড্রাইভার ক্যানসেল করল। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। বিশ্বাস কর। সো সরি।" মেঘার কথা শুনে আমি অল্প হাসলাম। "আরে না না। কোনো ব্যাপার না। অসুবিধে হয়নি। তুই চিন্তা করিস না। এই এখনই পৌঁছবো। গিয়ে দেখা হচ্ছে। কান্ট ওয়েট টু সি ইউ উড বি ব্রাইড!"

"আর কতক্ষণ ভৈঁরো?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"মেমসব, আর পনেরো বিশ মিনিট। জ্যাম নেই ভাগ্যিস আজ।"
বাইরে হাওয়াটা ভালোই বইছে। সবে বেলা আড়াইটা পেরিয়েছে, এরই মধ্যে রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। একটু একটু কুয়াশার চাদর সবে জড়াতে শুরু করেছে পথঘাটকে। আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে স্টোলটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। দেখলাম সম্রাট আমার দিকে তাকিয়ে। কিছু কি বলবে? আমি কোনো কথা বললাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
আমাদের গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। বিরাট বাড়ি। গেটে ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। লম্বা করে টুনি বাল্ব লাগানো। বুঝলাম এটাই মেঘার বাড়ি। সাজগোজ দেখেই বোঝা যায় যে এটি একটি উৎসবের বাড়ি।
এইবার নামতে হবে। ভৈঁরো সিং নেমে লাগেজ নামাতে গেল। আমিও নামতে যাচ্ছিলামই, এমন সময় সম্রাট আমার হাতটা চেপে আটকালো। আমি অবাক হয়েই তাকালাম ওর দিকে।
"সম্রাজ্ঞী, আই এম ভেরি সরি ফর এভরিথিং। তুই প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিস পারলে। আই নো আই হ্যাভ রংড ইউ।"
আমি তাকিয়েই রইলাম ওর দিকে। তারপর কিচ্ছু না বলে হাতটা ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলাম। মুখে চওড়া হাসি। মেঘাও এর মধ্যে এসে গিয়েছে গেটে। এতদিন পর প্রাণের বন্ধুকে পেয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। পুরোনো কথা নিয়ে ভাবার এখন সময় নেই। আগামী কটাদিন হোক সুন্দর। সেই আশাতেই থাকবো আমি। আর সবচেয়ে বড় কথা। টের পেলাম, সম্রাটের কথায় বা আচরণে আমি আর একটুও বিচলিত হলাম না। হয়তো এই দু ঘন্টার যাত্রাপথটা খুব প্রয়োজন ছিল, আমাদের ক্লোজারের জন্য। কে জানে... ভালো থাকে ভালোবাসা।

No comments:

Post a Comment