১।
ক্লাস এইটের টিনার আজ বেশ মন খারাপ। আবার স্কুল খুলেছে পুজোর পর। এই এক মাস বাড়ি বসে দিব্যি শাহরুখ খানের সিনেমা দেখত। এখন আবার ওই টাইম অ্যান্ড ডিস্টেন্স আর কারেন্টস অফ দি প্যাসিফিক ওশেনের বোরিং ক্লাস। প্লেলিস্টে এস আর কের গান চালিয়ে ইয়ারফোন কানে ক্লাসরুমে নিজের পছন্দের ফ্রন্ট রো সিটে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখল একটি ছেলে বসে রয়েছে। নতুন স্টুডেন্ট নাকি? একে তো কখনও দেখে নি?
টিনা কিছু বলল না। ইয়ারফোনটা খুলে ব্যাগটা নিয়ে অন্য বেঞ্চের দিকে যাচ্ছিলই, ঠিক তখন ওর হাতটা ধরে আটকাল ছেলেটি। টিনা পিছন ফিরে তাকালো। হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এটা কে? সেই একইরকম টোল গালে, চুলটা হাল্কা উসকো খুস্কো।
বন্ধুত্বের হাতটা এগিয়ে বলল, "I'm Rahul...নাম তো সুনা হোগা!"
মুহূর্তেই টিনা শুনতে পেল সেই বিখ্যাত ম্যান্ডোলিনের টুং টাং।
২।
বছর তেইশের রাজীব থাপা আর পাঁচটা নেপালী ছেলের মতোই। স্কুলের গণ্ডী পেড়িয়ে এখন মা আর মাসীর সাথে ক্ষেতি করেই দিন চলে। গান পাগল ছেলেটি রাত্রে খাওয়ার পর খোলা আকাশের নিচে প্রিয় গিটার হাতে বলিউডের গান গায় গলা ছেড়ে। ওদের পাশের বাড়ির কাকীমারা নিজেদের বাড়িটাকে ইদানীং হোমস্টে হিসেবে ভাড়া দিচ্ছে। সেখানেরই কিছু বাবুরা রাজীবের গান শুনে এক্কেবারে মুগ্ধ। ওদের নাকি কলকাতায় হোটেল আছে। বলেছে ওকে হোটেলে গান গাইবার সুযোগ দেবে। নিয়মিত টাকা আসবে।
দার্জিলিং মেল থেকে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখল রাজীব। সাদা ফুল শার্ট, কালো কোট আর কালো প্যান্ট পরে। মধ্যে মধ্যে ওর মা ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। সাধের "রাজু বন গয়া gentleman!"
৩।
চায়ের দোকানের পল্টু ভারি হাসি খুশি ছেলে। বয়স ওই বারো তেরো। সকালবেলা মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে পড়াশোনা করে। দুপুর থেকে বাবার দোকানে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেয়। একটা আদ্যিকালের কালো রেডিয়োতে সারাক্ষণ বেজে চলেছে হিন্দি বাংলা গান। শুনে শুনে পল্টুর সব মুখস্থ। শারুখ খানের গানগুলো ওর হেব্বি লাগে। রেডিওর অফিসটা আবার ওদের দোকানের পিছনেই। কতবার ওই দাদা দিদিগুলোকে ও চা পৌঁছে দিয়ে এসেছে। কী রংচঙে আপিস। সবাই কী হাসিখুশি। পল্টু এক দুবার কাঁচের দরজার এপার থেকে দেখেছে কেমনভাবে মাইকের সামনে দাদা দিদিগুলো কথা বলে।ও যদি এমন সুযোগ পেতো...
শিশু দিবস উপলক্ষ্যে এই রেডিওর দিদি দাদাগুলো নাকি পল্টুর মতো ছেলে মেয়েদের সেই সুযোগ দেবে। ওরা মানে যারা লেখাপড়ার সাথে সাথে কাজকর্মওকরে, তাদের নিয়ে নাকি অনুষ্ঠান হবে। পল্টু বেজায় খুশি। ওকেও শোনা যাবে রেডিওতে।
বেশ ফিটফাট হয়ে পল্টু রেডিওর আপিসে গিয়েছে আজ। নিচে ওর বাবা রেডিওর একদম সামনে বসে আছে। অধীর অপেক্ষা। যে কোন মুহূর্তে ওর গলা শোনা যাবে। শুনতে পেল এক দিদির গলা, "তোমার নামটা বলো?"
আর তারপরেই বহু প্রতীক্ষিত সেই কণ্ঠ।
"আমায় সবাই পল্টু বলেই চেনে। কিন্তু আমার একটা ভালো নাম আছে। রাহুল। নাম তো সুনা হোগা?"
৪।
ইশ, কী কুক্ষণে যে ফোনটা চার্জ করতে ভুলে গিয়েছিল, চারজারটাও কাজ করছে না। ট্রেনের ভিতরে বসে টেনশন করতে লাগল সিমি। ইউরেল চেপে জুরিখ যাচ্ছে। অ্যানা থাকে। তবে হঠাৎ প্ল্যান বদল করে একদিন আগেই সিমি পৌঁছে যাচ্ছে। অ্যানাকে জানানো হয়নি। তাড়াহুড়োয় ভেবেছিল ট্রেনে উঠে জানিয়ে দেবে। এখন এই বিপত্তি। কী করে কী করবে ও জুরিখে? বড্ড চিন্তা হচ্ছে। ওর কামরাটাও একদম ফাঁকা। কারুর থেকে যে ফোন বা চারজার চাইবে, সেই উপায়ও নেই। এক্কেবারে কাঁদো কাঁদো অবস্থা ওর।
ট্রেন ছুটছে সুইজারল্যান্ডের ভিতর দিয়ে। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। এদিকে সিমির সেদিকে চোখ নেই। সানেন স্টেশনে এক যুবক উঠল ওর কামরায়। দেখে তো ভারতীয়ই মনে হল। চোখে কালো চশমা, সাদা শার্টের ওপর গাঢ় নীল জ্যাকেট, স্কাউ ব্লু জিন্স, পিঠে ব্যাকপ্যাক।
ওর উল্টোদিকের সিটে জানলার ধারে বসল। সিমির দিকে তাকিয়ে একবার হাসল।
"এক্সকিউজ মি, ডু ইউ হ্যাভ আ মোবাইল চারজার? মাইন ইস নট ওয়ার্কিং। অ্যান্ড আই নিড টু মেক আ ভেরি ইম্পরট্যান্ট কল টু মাই ফ্রেন্ড ইন জুরিখ। মাই ফোন ইস ডেড", বলল সিমি।
"koi baat nahin senorita.. bade bade desho mein aisi chhoto chhoti baatein hoti rehti hain..."
৫।
প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠ। টিফিন পিরিয়ডে ছেলেরা দৌড়ঝাঁপ করছে। আজও
গাবলু ছোঁওয়াছুঁই খেলায় অক্রমের নাগাল পেল না। উফ, কী জোরে ছুটতে পারে
ছেলেটা। কী দম।
"ঠিক আছে। থাম অক্রম। আমি আর ছুটতে পারবো না।"
"দেখলি তো, আজও ধরতে পারলি না আমায়?"
গাবলু একটু হেসে বলল, "জানি তো। ডন কো পকড়না মুশকিল হই নহি, না মুমকিন হ্যায়!"
No comments:
Post a Comment