এইবারের পুজোটাও চেন্নাইতেই কাটালাম। গত বছর এখানে দুর্গাপুজো কাটানোয় জানতাম যে বাড়ির থেকে দূরে থাকলেও, আনন্দ কম হবে না। আসলে এই গত পাঁচ বছরের ওপর এখানে রয়েছি, এত মানুষজনের সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে, চেন্নাই শহরটা এখন দিব্যি লাগে!
পুজো বলতে আমি পূজাবার্ষিকী বুঝি। সাম্পানের পূজাবার্ষিকী নিয়ে বেশ কিছুদিন টানা খাটাখাটুনির পর পুজো পুজো ভাব আনতে কিনে ফেললাম শারদীয়া দেশ আর বিচিত্রপত্র। এক দিদির থেকে আনন্দমেলাও পেয়ে গেলাম। আমার পুজো দিব্যি শুরু হয়ে গেল। ইতিমধ্যে অবশ্য ওয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছে। পুজোর সময় কে কবে কোন প্যান্ডেলে যাবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, সেই সব আলোচনা করতে। সেখান থেকেই একে একে ছবি পাচ্ছি, ঠাকুর আসছে বিভিন্ন প্যান্ডেলে। আলপনা দেওয়া চলছে। পুজো প্রাঙ্গণ সাজছে। তৈরি হচ্ছে আগামী কদিনের কর্মযজ্ঞের জন্য।
ষষ্ঠীর দিন থেকেই নতুন জামা পরতে লাগলাম। এমনই অভ্যেস, বরাবরের। বেশ সাজুগুজু করে ছবিটবি তুলব, ওয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে দেবো। এতেই আনন্দ। সারাদিন নতুন জামা পরে ল্যাবে কাজকর্ম করে সন্ধ্যেবেলা ঠাকুর দেখতে বেরোলাম। আমাদের চেন্নাইয়ে বেশ কয়েকটা পুজো হয়। প্রায় ১০-১২টা তো বটেই। তবে বড় ও জনপ্রিয় ওই হাতে গোনা কয়েকটিই। তার মধ্যে সবচেয়ে কাছে পড়ে ক্যাম্পাস থেকে, বেসন্ত নগরের সাউথ মাদ্রাস কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। ষষ্ঠীতে তাই ওখানেই গেলাম। ঠাকুর প্রতিমা একদম সাবেকি। রঙিন ঝলমলে শাড়ি গয়নায় মাকে সাজানো।
ঠাকুর নমস্কার করে এসে মূল কাজে মন দিলাম। পেট পুজো। পুজো মানেই চুটিয়ে খাওয়া দাওয়া করা আর আড্ডা মারা। সত্যি বলতে কী, প্যান্ডেলে গিয়ে কতবার ঠাকুর নমস্কার করি, মাঝে মাঝে খেয়ালই পড়ে না! বেসন্ত নগরের পুজো চত্বরে দারুণ দারুণ খাবারের স্টল থাকে। রোল বিরিয়ানি চপ ফ্রাই চাউমিন সিঙ্গারা লুচি পরোটা সব। এ ছাড়া মিষ্টি তো আছেই। ঘুরে ঘুরে সব দেখে শুনে প্রথম দিনের পেট পুজোটা সারলাম বিরিয়ানি আর এগ রোল সাঁটিয়ে। চেনা পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা হয়েই যায় এখানে, হলও তাই। ফিরলাম হোস্টেল।
ইচ্ছে ছিল পরেরদিন, অর্থাৎ সপ্তমী থেকে দশমী ল্যাবে যাবো না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কিছু পেন্ডিং কাজ পড়ে যায়, সপ্তমী দুপুরটায় ল্যাবে থাকতেই হল। অবশ্য তার আগে সকাল সকাল মাইলাপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে সপ্তমীর পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে নিয়েছি। দুপুরে ভোগ প্রসাদের ছবি আসছে ওয়াটসঅ্যাপে। এদিকে আমি কম্পিটারের সামনে বসে চরম মাথা ব্যাথা নিয়েও গ্রাফের পর গ্রাফ প্লট করে চলেছি। আজ কাজটা শেষ করতেই হবে। নইলে কাল আবার বসতে হবে এই নিয়ে। পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে। উহু। এরকম করে তো চলবে না। অনলাইন খাবার অর্ডার করে ফেললাম। সরু চালের ভাত, ডাল আর গারলিক ফিশ। এনার্জি পেয়ে কাজ শেষ করে হোস্টেলে এসে হাল্কা বিউটি ন্যাপ দিয়ে আবার সন্ধ্যেয় বেরোলাম বেসন্ত নগর। এবার সদলবলে। সঙ্গে ক্যামেরা। প্রচুর ছবি তুললাম। খেলামও অনেক। পুজোর ভোগের খিচুরি তরকারি তো ছিলই, এ ছাড়া মাছ ভাজা থেকে শুরু করে বিরিয়ানি, শেষ পাতে ইয়া বড় বড় কমলাভোগ। আড্ডা টাড্ডাও মারলাম। তারপর আর কী, ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। পরেরদিন অষ্টমী। অঞ্জলি দিতে হবে। রেস্ট দরকার।
অষ্টমীর অঞ্জলি দিলাম টি নগর বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের পুজোয়। এবারে বোধহয় ওদের ৮০ না ৮৫তম পুজো ছিল। এসোসিয়েশনের নিজস্ব বিল্ডিঙে হয়। পুজোর জায়গাটা একটু ছোট। আর খুব ভিড়। তার মধ্যেও জায়গা করে নিলাম। ঠাকুরের প্রতিমা সাবেকি। আসলে চেন্নাইয়ে এখনও থিম পুজোর উপদ্রব শুরু হয়নি তো, তাই সব জায়গায় ঠাকুরের রূপ অসামান্য লাগে। কেমন একটা মোহময়ী স্নিগ্ধ মাতৃরূপ। অঞ্জলি দিলাম। সন্ধিপুজো দেখলাম। তারপর পেট পুজো। অতি লোভনীয় লুচি ছোলার ডাল আর রসগোল্লা। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। কাছাকাছির মধ্যে কালীবাড়ি, সেখানে যাওয়া গেল না তাই। আবারও আড্ডা মেরে ভোগ খেতে বসলাম। সাবেকি ভোগ। খিচুরি লাবড়া বেগুনি চাটনি পায়েস। কী অপূর্ব স্বাদ। আহা। সন্ধ্যেয় আবার বেসন্ত নগর। আবারও প্রচুর চেনা লোক। আড্ডা। গল্প। আমার স্কুলের এক বান্ধবীর সাথে দীর্ঘ ষোল বছর পর দেখা হল। আরাত্রিকা। বেশ ভালোই লাগল। ছবি টবি তুললাম। খেলাম দেলাম। পুজোও মাঝামাঝি পর্যায়ে। ক্লান্তি আসছে অল্প করে। একেই পুজো কাটিয়েছি অসহ্য মাথা ব্যথায়। তবুও আনন্দ করব বলে দাঁতে দাঁত চিপে ওষুধ খেয়ে খেয়ে ঘুরেছি এই কটাদিন। বই পড়াও হচ্ছেনা। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত।
তাই নবমীর অঞ্জলি দেওয়া হল না। লাঞ্চের আগে আগে বেসন্ত নগর পৌঁছে গেলাম। আজও সদলবলে। তবে অন্য দল। বলে রাখা ভালো। আমার প্রচুর সার্কেল এখানে। সকলের সাথে মিলে মিশে প্ল্যান করে দেখা সাক্ষাত করতে হয়েছে পুজোয়। আজও ভালো মতনই খ্যাঁটন হল। পোলাও মাংস মাছ ভাজা মিষ্টি তো ছিলই, (ভোগ বাই ডিফল্ট ছিল) সাথে যোগ হল ফুচকা। হ্যাঁ জানি ভাবছেন বাবা, এ মেয়ে কত খায়। হ্যাঁ। ওজন বেড়ে যে কোথায় পৌঁছেছে, লজ্জার মাথা খেয়ে আর মাপিনি!
যাই হোক, নবমীর দুপুরে সব একে তাকে একসাথে নিয়ে আমাদের পরিক্রমায় বেরোনোর কথা ছিল। দেখা গেল লেট হচ্ছে। আমি ধ্রুব দা অপর্ণা দি আর ওদের ছেলে ময়ূখ বেরিয়ে পড়লাম ওলা নিয়ে। রামকৃষ্ণ মিশন পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি সুজয়দারা বিরাট টেম্পো ত্র্যাভেলার নিয়ে চলে এসেছে। আর সৈকতদারাও গাড়ি নিয়ে এসে গিয়েছে। ব্যস। আর কী, পুরো গ্রুপ রেডি। এরপর শুধুই ঘোরা। এ গাড়ি থেকে ওই গাড়িতে ফোন করে ডিরেকশন নেওয়া। ছবি তোলা। সিঙ্গল। কাপল। গ্রুপ। সেলফি। মানে যত রকমের কম্বিনেশন হয়। মাঝে চায়ের ব্রেক নেওয়া হল আন্না নগর দক্ষিনী সোসাইটির পুজোয়। বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় কাদা। ভিড়। সব মিলিয়ে কালীবাড়ি হয়ে টি নগরে এলাম যখন, ভেবেছিলাম ডিনার প্যাক করে হোস্টেলে ফিরব। ওরে বাবা, ওখানে এত ভিড়, তিলধারণের জায়গা নেই বলা যায়। শুনলাম এগারোটার আগে ডিনার পাওয়াই যাবে না। অগত্যা আবার বেসন্ত নগর। ওলা ছেড়ে দিয়েছি। গাড়ি আর পাওয়া যায় না। এত লোকের ঢল রাস্তায়। সত্যি বলছি, মনে হচ্ছিল, এ কলকাতা নাকি? শেষ মেশ অটো করে বেসন্ত নগর এলাম। মোগলাই পরোটা আর ফিস ফ্রাই প্যাক করে ফিরলাম হোস্টেল।
আর এনার্জি নেই। পরেরদিন তাই আর প্যান্ডেলে যাইনি। পি এইচ ডি স্কলার মানুষ। ফিরলাম ল্যাবে। কাগজে কলমে পুজো শেষ হল। তবে আমার পুজো এখনও চলছে। পরপর বন্ধুরা বাড়ি থেকে ফিরছে। মিষ্টির পর মিষ্টি খাচ্ছি। শারদীয়াগুলো পড়ছি। এছাড়াও আরো অনেক বই কেনা রয়েছে (দুটো তো সপ্তমীর দিন পেলাম)। সেগুলি পড়ছি এক এক করে। পুজোর এই রেশ থাকবে কিছুদিন! অন্তত কালীপূজো অবধি।
No comments:
Post a Comment